শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫

‘প্রাণবন্ধু আসিলা ঘরে`

সিলেটে আরকুম শাহ-র মাজারে যখন প্রথম যাই উনিশ শ নিরানব্বুই সালে। তখনই প্রথম শুনি এই গান। মাজারে অতিথি এলে মাজারের শিল্পীরা ঢোল করতাল বাজিয়ে নেচে নেচে গান করেন, ‘আমার আনন্দের আর সীমা নাই গো, প্রাণবন্ধু আসিল ঘরে`। এই মুহূর্তে বরাক কতটা আনন্দমুখর আমি জানি না। কারণ আমি বসে আছি চৌদ্দশ কিলোমিটার দূরে। মনে পড়ছে শুধু সেই দিনগুলি কথা। বর্ধমানে পড়তাম। কলকাতা থেকে কামরূপ এক্সপ্রেস গুয়াহাটি স্টেশনে পৌঁছলেই ছুটতাম জানতে রাতের ট্রেন পাবো কিনা। তখন ইন্টারনেটের যুগ নয়। অনওয়ার্ড রিজার্ভেশন করার একটা নিয়ম ছিল, টেলিগ্রাম পাঠিয়ে পরের ট্রেনের বার্থ রিজার্ভ করা যেতো। আমরা নিষ্ঠার সাথে প্রতিবারই সেটা করতাম। প্রতিবারই গুয়াহাটি স্টেশনে নেমে জানতাম সেই ট্রেলিগ্রাম পৌঁছোয় নি। তখনই খোঁজ শুরু হত টিটি-র। কারণ কাউন্টার থেকে বার্থ বুক করার সময় ততক্ষনে পেরিয়ে যেতো। সারা রাত্রি ও সারা দিনের ট্রেন সফরের ধকলকে অগ্রাহ্য করে টিটিকে খোঁজা। 

‘দাদা, একটা বার্থ হলেও চলবে। আমরা ভাগাভাগি করে নেবো।` টিটি-র কোন্ উত্তরের অর্থ সবুজ সংকেত আর কোন্টি নয়, আমরা ততদিনে জেনে গিয়েছি। যদিও মুখে সবসময়ই বলত, কোনো সিট নেই। এই ‘নেই` কথার কোনটা সত্যি সত্যি ‘নেই` আর কোনটা দর হাঁকানো, আমরা জানতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কত টাকাই বা পকেটে থাকত। ঝুলোঝুলি চালিয়ে যেতাম। ক্কচিৎ দুটো বার্থ পেয়েছি আমি আর বিশ্বতোষদা। কখনো একই বার্থে দুজনে দুদিকে মাথা দিয়ে ওর মাথাকে আমি বালিশ করে, আর আমার মাথাকে ও বালিশ করে পাহাড় লাইনে বাড়ি ফিরেছি, তার ইয়ত্তা নেই। কখনো কপাল খারাপ হলে সারা রাত, দুটো সিটের নীচে মাটিতে খবরের কাগজ পেতে অথবা বাথরুমের সামনের খোলা জায়গায় বসে রাত কাটিয়েছি। 

তবু এই লাইন নিয়ে আমাদের অহংকারের শেষ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখনই কেউ জিজ্ঞেস করত, বাড়ি কোথায়। আমি আর বিশ্বতোষদা শিলচর বলেই বলতাম, চৌদ্দশ কিলোমিটার দূরে। সাঁইত্রিশটা টানেল পেরিয়ে যেতে হয়। ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেই পাহাড়ের ঘাস, গাছের ডাল ছোঁওয়া যায়। বন্ধুরা অবাক হয়ে যেতো। আমরাও অবাক হতাম যখন প্রতি শনিবার অর্ঘ্য সেনের কাছে গান শিখতে কলকাতা আসতাম, তখন ইলেকট্রিক ট্রেনের বিদ্যুৎ গতি দেখে। নিজেরা ফিসফিস করতাম, কবে আমাদের বরাকেও এমন ট্রেন চলবে। আমাদের অনেক বন্ধু আশি নব্বুই কিলোমিটার দূর থেকে যাতায়াত করে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত। 

কলকাতা থেকে একশ পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব ট্রেনে বর্ধমানে এসে অনুষ্ঠান করে আবার রাতেই কলকাতায় ফিরে যেতেন সুচিত্রা মিত্র, অর্ঘ্য সেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ইন্দ্রানী সেনরা। আমাদের কাছে তা ছিল অভাবনীয়। আমাদের শিলচর থেকে হাফলং যেতেই দিন কাবার। কপাল খারাপ হলে রাতও মাটি। ধর্মনগর করিমগঞ্জও ছিল ট্রেনে দূর অস্ত্। আমার ছাত্রজীবন শুরু হয়েছিল নিউ বঙ্গাগাঁও থেকে ব্রডগেজের ট্রেন ধরা দিয়ে। এমএসসি পড়া শেষ হতে হতেই ব্রডগেজ চলে এল গুয়াহাটি অবধি। খুব তাড়াতাড়ি ব্রডগেজের লাইন চলে গেল লামডিং, এমনকী ডিব্রুগড় অবধি। শিলচর অধরাই রয়ে গেলে। লামডিং গুয়াহাটি মিটারগেজ তুলে দেওয়ার পর আমাদের স্বপ্নের কু ঝিকঝিক মিটারগেজ ক্রমেই হতশ্রী হতে থাকল। তবু সব মেনে নিয়েছিলাম আমরা, অচিরেই ব্রডগেজ আসছে। ছ’জন প্রধানমন্ত্রী এলেন গেলেন, আমরা পড়ে রইলাম সেই অন্ধকারেই। 

ভোট এলো ভোট গেলো। লোকসভায় যিনিই ভোট চাইতে আসেন, তিনিই বলেন, আমাকে ভোট দিন। ব্রডগেজ এনে দেবো। বিধানসভায় যিনি ভোট চান, তিনিও বলেন, আমাকে ভোট দিন, আমি এনে দেবো ব্রডগেজ। কখনো শুনি ট্রান্সপোর্ট লবির চক্রান্ত। কখনো শুনি দিল্লি উদাসীন। কখনো শুনি দিসপুর কাঠি নাড়ছে। আশ্চর্য কথা। যারা ভোট চাইতে আসতেন ব্রডগেজের নামে তাদের প্রত্যেকেরই টিঁকি বাঁধা ছিল দিল্লি কিংবা দিসপুরে। এমন কী ট্রান্সপোর্ট লবির মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তাঁদের অনেকেই। অনেক নেতারই বাস চলত নাইটসুপার ডেসুপার হয়ে। এখানে রঙের কোনো তারতম্য নেই। বরাকের মানুষ জানতেন সবই। আমাদের বঞ্চনার অপমান ক্রমে অন্তর্মুখী হল। 

বর্ণবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট একজন অন্ত্যজ যেমন নিজের জন্মের প্রতি ধিক্কারে একান্তে বলে, ‘জন্ম নিয়েছি ধূলিতে/ দয়া করে দাও ভুলিতে/ নাই ধূলি মোর অন্তরে`। তেমনি দুর্ভাগা বরাকের আমরাও আমাদের সব দুর্গতির কথা বলতে গেলেই বলতাম, আমাদের জন্মটাই অভিশপ্ত। আমরা কেঁদেছি কবিতায় গল্পে ছবিতে সিনেমায় ব্যর্থ শ্লোগানে। আমাদের নিয়ে খেলেছে কেউ কেউ। আমরা বুঝেও বুঝি নি। যখন আমাদের ক্রোধ তীব্র হয়েছে। কেউ কেউ ভয় পেয়েছেন, এই বুঝি সমস্ত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফেটে পড়বে প্রবল বিক্ষোভে। তখনই গোপনে কেউ কেউ ছড়িয়ে দিয়েছেন বিষের হাওয়া। হিন্দু মুসলমান, গরু শুয়োরে মত্ত হয়ে ভুলে গিয়েছি, আমাদের সব না-পাওয়াগুলোর কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই। এখন গোটা বরাক জুড়ে আনন্দের হাওয়া বইছে। আমরা বাকি পৃথিবীর সাথে যুক্ত হচ্ছি। আমরা আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে থাকব না। জানি, এই মুহূর্তে এই দেশ ভাবছে এমন ট্রেনের কথা যা ছুটবে ঘন্টায় তিনশ কিলোমিটার বেগে। 

এখন স্মার্ট ট্রেন, স্মার্ট স্টেশন, স্মার্ট সিটির হাওয়া বইছে দেশজুড়ে। এই হাওয়ায় যে ট্রেন আমাদের আসছে, তার গতি হবে কোথাও ঘন্টায় তিরিশ কিলোমিটার, কোথাও পঞ্চাশ কিলোমিটার। গোটা যাত্রাপথে সর্বোচ্চ গতিতে যাবে বরাকের ভেতরে শুধু। ঘন্টায় সত্তর কিলোমিটার। চারধারে আশঙ্কা। ক’দিন চলবে এই ট্রেন? বর্ষায় চালু থাকবে তো লাইন? নাকি আবার সেই দিনের পর দিন লাইন বন্ধ। জরুরি সামগ্রীর আকাল। কালোবাজারী। তবু আমাদের আজ আনন্দের সীমা নেই। জানি, উনবিংশ শতকে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছিল অনেক পশ্চাৎপদ, যখন এখানকার পাহাড় জঙ্গল ছিল দুর্গম, তখন সাঁইত্রিশটি টানেল ও একটি দীর্ঘ রেলপথ গড়ে উঠতে সময় লেগেছিল আট বছর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের চোখ ধাঁধানো এই সুসময়ে আমাদের সুড়ঙ্গগুলি ও লাইনকে বড়ো করতে আর কিছুটা নতুন লাইন পাততে সময় রেগেছে দীর্ঘ উনিশ বছর।

তবু আমাদের খুশির সীমা নেই আজ! আবার ট্রেন ছুটবে গুয়াহাটি থেকে শিলচর। হোক না ন্যূনতম চৌদ্দ ঘন্টার সফর। তবু হারেঙ্গাজাওয়ের সিঙারা। বদরপুরের পুরি তরকারি। মাহুরের প্যারা। জাটিঙ্গার কমলা। সব ফিরে আসছে আমাদের কাছে। হাফলং এ টিলার ওপরের হোটেলের ডিম ভাত নিউ হাফলঙে থাকবে কি? খুব বেশি চাওয়া নেই আমাদের। বুলেট ট্রেন চাই না। উলেকট্রিক ট্রেনের দরকার নেই। একটু ভালোবেসে, আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক না ভেবে একটি নিরবচ্ছিন্ন ট্রেন পরিষেবা হলেই হোলো। শিলচরে চাপবো নামবো কলকাতা বা চেন্নাই বা নতুন দিল্লিতে মোটামুটি স্বাভাবিক সময়ে, তাতেই হবে। আমি জানি না, এই মুহূর্তে যারা কৃতিত্বের প্রতিযোগিতায় মত্ত, তারা এই প্রতিশ্রুতিটুকু দিতে পারবেন কি না। মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি আগামী ভোটের বড় বড় হোর্ডিং, দলের প্রতীক আলাদা হলেও কৃতিত্বের ব্রডগেজ ট্রেনের ছবি অভ্রান্তভাবেই ঠাঁই পাবে সেখানে। এই প্রবল প্রতিযোগিতার মধ্যে প্রতিযোগীরা নিশ্চয়ই ভুলে যাবেন, কিন্তু আমরা বরাকের মানুষরা যেন না ভুলি, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের নাম যদি ত্রিপুরা না হতো, সেখানকার মানুষ যদি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হতেন, তবে উনিশ বছরেও এই লাইন জুড়তো কিনা আমার সন্দেহ আছে।

এটুকুমাত্র রাজনৈতিক উচ্চারণের জন্যে ক্ষমা চাইছি।

শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫

ওই বুঝি কেউ হাসে!

বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। হায়দরাবাদে একটি সংস্কৃতি কর্মীদের সম্মেলনে গিয়েছি। সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেল সমবেত কন্ঠের অট্টহাসিতে। খেয়াল করতেই বুঝলাম। এ তো যে যার মত কোনো একটি হাসির কথা শুনে হেসে ওঠা নয়। জানালা দিয়ে দেখি, সমবেত একদল লোক গায়ে টি শার্ট পায়ে কেডস পরনে ট্র্যাকসুট গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট ছন্দে সামনের দিকে মাথা ঝুঁকছে নিঃশব্দে, খানিকক্ষণ অবনতমস্তক থেকে তারপর ধীরে ধীরে ফুলের পাপড়ির ফোটার মত সোজা হচ্ছে এবং সঙ্গে সমবেত কন্ঠে গণসঙ্গীত গাওয়ার মত একটু একটু করে সশব্দে হাসিতে ফেটে পড়ছে। বুঝলাম, এটা প্রাণখোলা হাসি নয়। এটা কঠোর নিয়মানুবর্তিতার হাসি! মন নয়, শরীর চাঙ্গা করার হাসি! পাটনার নাট্যকর্মী বন্ধু হাসান ইমাম একটি উদ্ভট আইডিয়া দিলো। বলল, চলো, আমরা ওখানে যাই। একটু অদূরে দাঁড়িয়ে ওরা যখন চুপ করে সামনের দিকে মাথা ঝোঁকাবে তখন আমরা যে যার মত অট্ট হাসিতে ফেটে পড়বো। সেটা শুনে ওরা নিশ্চয়ই ভীষণ খেপে যাবে। বলবে, অ্যাই হতচ্ছাড়া, হাসছো কেন? আমরা উত্তরে গোবেচারা মুখ করে বলব, স্যার, আপনারাও তো হাসছেনই। শুধু আপনারা যখন চুপ করছেন তখন আমরা হাসছি। এ ছাড়া অন্য কিছু তো করি নি। উৎসাহী লোকের অভাবে শেষ পর্যন্ত এই হাসি অভিযান বা হাসি দিয়ে হাসি নিবারণ কর্মসূচিটা করা গেল না।

আমাদের রাষ্ট্র বা ধর্মের ব্যাপারটাও তেমনি। সবাইকে যখন হাসতে বলা হবে হাসতে হবে তখনই। অন্যথায় মুশকিল। একটা আইন কিংবা নিষেধের বেড়াজাল দিয়ে সবকিছুকে বাঁধতে চায় সবকিছুকে। একটি রাষ্ট্রে নিয়মকানুন যত সুক্ষ্ম নিষেধের বেড়াজালও তত সর্বগ্রাসী। এই নিয়মতান্ত্রিকতা ধর্মেও প্রবল। একটি ধর্ম যত বেশি সংগঠিত তার আচারের বেড়াজালও ততটাই তীব্র। যদিও ইতিহাসের একটা নির্দিষ্ট স্তরে এসেই রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছে, ধর্মেরও তেমনি সংগঠিত রূপ এসেছে ইতিহাসেরই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে। তবু মানুষের সমাজের সাধারণ চলাটা সবসময়ই মুক্তির দিকে। তবে এই মুক্তি মানে তো আর যথেচ্ছাচার নয়। মানুষই নিজে থেকে কতগুলি বাড়াবাড়ি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। সমাজ যেহেতু সকলের হাত ধরাধরি করে একসাথে চলার ফসল, ফলে সমাজ কখনোই চায় না, এমন কিছু হোক যার ফলে পরস্পর ধরে থাকা হাতটা আলগা হয়ে যায়। ব্যক্তির জীবনে বা পরিবারের আবহে বা সমাজের পরিসরে যদি এই ভালোবাসাবাসির সংস্কৃতিটি জেগে থাকে  তখন দেশে একটা সহনশীলতার আবহ জেগে থাকে। আইন করে সহনশীলতা জাগানো যায় না। খুব বেশি হলে কোথাও সহনশীলতার ব্যত্যয় ঘটলে তার প্রতিকার করা যায়। এখন মুশকিলটা হচ্ছে ধর্মই হোক বা রাষ্ট্রই হোক, সে নিয়মের শাসনকে প্রগাঢ় করতে গিয়ে ভুলে যায় নিয়মের প্রবর্তনটি ঠিক কী কারণে করা হয়েছিল। এটা অনেকটা ছোটোবেলায় শোনা শ্রীরামকৃষ্ণের কথা ও গল্পের ‘কৌপীনকা ওয়াস্তে‘ গল্পের মত। গৃহী মানুষ সংসার চেড়ে বনে গেলেন সন্ন্যাসী হওয়ার জন্যে। ইঁদুর কৌপীন কেটে কেটে কুটি কুটি করে দেয় বলে প্রথমে বিড়াল আনা, তারপর বিড়ালের জন্যে গরু, গরুর জন্যে রাখাল, রাখালের জন্যে তার সংসার, সংসারের জন্যে সমাজ, সবশেষে বনে এসেও সংসারীই হয়ে যেতে হল। 

আমাদের আচারসর্বস্ব ধার্মিক বা আইনসর্বস্ব রাষ্ট্ররক্ষকদের অবস্থাও তাই। মানুষের সমাজকে সুন্দরতর হবে ভেবে যে সমস্ত আচার বা আইনের প্রবর্তন হয়েছিল একদিন, এখন সেই আচার বা আইনের ঠেলাতেই সমাজের প্রায় দফরফা অবস্থা। মরমীয়া সাধকরা যেমন বলেন সেই কথাটাই সত্য হওয়া উচিত। তাঁরা বলেন, আচারের চেয়ে বিচার অনেক বড়ো বিষয়। প্রথমেই বিচার করে দেখা উচিত একটি বিশেষ আচার বা আইন মানুষের সমাজে ভালোবাসাবাসির সংস্কৃতি বা পারস্পরিক বিশ্বাসবোধের সংস্কৃতিকে পোক্ত করছে না দুর্বল করছে। যদি দেখা যায় যে একটি আইন বা আচার পালন করতে গিয়ে মানুষের সমাজটাতেই আগুন লেগে গেল, একজন আরেকজনের বুকে ছুরি মারতে উদ্যত হচ্ছে তখন সেই আচার বা আইন যত প্রাচীন বা যত যুক্তিনিষ্ঠই হোক, তাকে মাথায় করে রাখলে সভ্যতার মৃত্যু অনিবার্য।

এখন এমন একটা সময়, যখন ‘এখানে মন্দির ছিল না মসজিদ ছিল‘ থেকে শুরু করে সমাজের সামান্যতম মনান্তরের বিষয়কেও আইনের বারান্দায় গিয়ে সমাধান খুঁজতে হয়, যখন সকলের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হাজার হাজার মানুষের হত্যালীলার রূপকার শুধুমাত্র আইনের চোখে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ার জন্যে পুরুষোত্তমের স্বীকৃতি পেয়ে যান, তখন অসহিষ্ণুতার কালোছায়া যে আমাদের ঘর গেরস্থালির ভেতরমহল অবধি ব্যাপ্ত হবে এ আর আশ্চর্যের কী! আমাদের প্রতিটি রাষ্ট্র যেমন গড়ে উঠেছে প্রাথমিকভাবে মানুষের সমাজের চারা পানিতে, তেমনি প্রতিটি সংগঠিত ধর্মেরও জন্ম একটি লোকায়ত গৌণ মরমিয়া ধর্মের গভীর থেকে। প্রতিটি রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছিল সেসময়ে চলতে থাকা রাষ্ট্রনৈতিক অবক্ষয়ের সামাজিক প্রতিবাদের গর্ভ থেকে। এভাবে প্রতিটি সংগঠিত ধর্মেরও প্রাথমিক অঙ্কুরোদ্গম প্রচলিত ধর্মব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগঠিত সামাজিক বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই। পরে প্রতিটি রাষ্ট্রই হয়ে উঠেছিল যারে পরাভূত করেছিল তাদেরই প্রতিভূ। একইভাবে সামূহিক সামাজিক বিচারবোধ থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিটি সংগঠিত ধর্মই পরে হয়ে ওঠে আচারের কারাগার। রাষ্ট্রের মত এখানেও স্পষ্ট হয় শ্রেণি আধিপত্যের কালো ছায়া।


এমনিতে একটি সমাজ এমনটা কখনো হয় না যেখানে কিছু ব্যাপারে কট্টরপন্থা থাকলেও বাকি বিষয়গুলিতে সাধারণভাবে এক উদার ও সহিষ্ণুতার আবহ থাকবে। ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে তৈরি হওয়া অসহিষ্ণুতা শেষ পর্যন্ত এক চূড়ান্ত অ-গণতন্ত্রের সমাজ তৈরি করে। তখন শুধু কে সংখ্যায় কম তাকেই যাবতীয় অসহিষ্ণুতার বিষ গ্রহণ করতে হয় না। মুক্তচিন্তক থেকে শুরু করে নাট্যকর্মী, গায়ক থেকে চলচ্চিত্রশিল্পী, লেখক থেকে বিজ্ঞানী সকলেই হয়ে ওঠেন অসহিষ্ণু হিংস্রতার শিকার। সাধারণতন্ত্র বা গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে রাজত্ব বিস্তার করে তখন এক ধরনের ইতরতন্ত্র বা দঙ্গলতন্ত্র (mobocracy)। আর এই সার্বিক মাৎস্যন্যায়ের থেকে মানুষকে মুক্তির অপার দরিয়ায় নিয়ে যাবে এমন কোনো ধর্ম বা রাষ্ট্র তখন চোখে পড়ে না। তো, কথা হল মুক্তি কোথায়! হয়ত এক বিকল্প গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা ‘ধর্ম‘কে গড়ে তুলতে হবে এই প্রচলিত রাষ্ট্র বা ধর্মকে অন্তর্ঘাত করেই। সেই কাজটি করতে পারে কোনো বীর নয়, সামাজিক মানুষ। এক অপার ভালোবাসা এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাই পারে এমন অসাধ্য সাধন করতে। আমাদের জীবদ্দশায় তা যদি না-ও হয় ক্ষতি কি? রবীন্দ্রনাথ তো বলেইছেন, তোমার কাছে পৌঁছনোটাই বড়ো কথা নয়। ‘পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া‘। এভাবেই মানুষের সভ্যতা যুগে যুগে হাজারো মন্দের মধ্যে এক সামূহিক ভালোর স্বপ্নে বাঁচে। আমাদের শিল্পকলা সেই অধরা মাধুরীকেই ধরে ছন্দের বন্ধনে। বিধিনিষেধের আচারসর্বস্বতা বা আইনসর্বস্বতার কালো ছায়া আমাদের মনের গভীর থেকে যত সরবে ততই সূর্যের আলো পেয়ে জীবন পাবে মানুষের সমাজ এবং তার নন্দন।