রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

কথার কথা

আগুণঝরা দিনের শেষে দগ্ধ-আমি বাড়ি ফিরি। একটু শীতল হাওয়ার জন্যে ভেতর ও বাহির অস্থির হয়ে ওঠে। ঘরে ঢুকে ফ্যানের সুইচ অন করতেও সেই গরম হাওয়ারই ঝাপট লাগে সারা অঙ্গে। না হাওয়ায় কোনো শুশ্রুষা নেই। অগত্যা মন ঘোরাতে টিভির নব ঘোরাই।যদি একটি গানের কলি বা নিদেন পক্ষে একটি সুর কিংবা কিছু ভালো লাগায় ভাসিয়ে দেওয়া দু’চারটি কথা শুনি। আলো গিয়ে পড়ে সরাসরি এক সংবাদ ও ভাষ্যের চ্যানেলে। সেখানে তখন ভেসে ভেসে উঠছে একটি ব্রেকিং নিউজের চাঞ্চল্যকর উপস্থাপনা। পেছনে মানানসই আবহসঙ্গীত। একটি শিশুর শরীরে ভেসে ওঠা আঘাতের চিহ্নের ছবি ভেসে ভেসে ওঠে পর্দায়। বড়দের রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কোপ থেকে বাঁচে নি এই শিশুটিও। একটু পরেই শুরু হয় আলোচনার প্রহর। আলোচনা বা বিতর্কের কি কোনো সুযোগ আছে এখানে? এমন একটি জঘন্য পাশবিকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে সবাই! 

হঠাৎই যেন অনুভব করি দুপুরের খররোদের দহন। আমার শ্রবণজুড়ে ঝাপটাতে থাকে তপ্তহাওয়ার ঝড়। এই পাশবিকতারও তবে রঙ আছে? এই হিংস্রতারও তবে একটি এ-পক্ষ ওপক্ষ রয়েছে? তার মানে আমাদের সমস্ত কথাই কি পূর্ব নির্ধারিত। শুধু মাত্র উপলক্ষ্য বদলে বদলে যায়! বিশ্বব্রহ্মা- এদিক ওদিক হলেও এই সান্ধ্য আলোচনায় কোলাহলটিই শুধু একমাত্র সত্য? কার কন্ঠস্বর কীভাবে চাপা দেওয়া যাবে তারই বুঝি শিল্পিত উপস্থাপনা পর্দা জুড়ে? এই চীৎকৃত উল্লাস ও ক্রোধ- এর বাইরে বুঝি এই পৃথিবীতে কোনো কান্না নেই, মৃদু হাসি নেই, ¯িস্নগ্ধতায় ¯স্নাত করে দেওয়ার মত সুবাতাস নেই। এই দানবীয় হুঙ্কার থেকে রেহাই পেতে হঠাৎ আঙুলের চাপ পড়ে মিউট বোতামে। শব্দহীন দৃশ্যপট যেন আরো বীভৎস করে দেয় সবকিছুকে। না, সব বন্ধই করে দিতে হবে! 

বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দূরে আকাশে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে একটি দু’টি তারা। বুকের ভেতর থেকে হঠাৎই জেগে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। কে যেন গেয়ে ওঠে, ‘যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে/ তারা কথার বেড়া গাঁথে/ কেবল দলের পরে দলে‘। তার মানে সেই কবেই বুঝি ‘কথা দিয়ে‘ কথা বলায় বিতৃষ্ণ হয়েছিলেন কবিগুরু! শব্দহীন টিভির পর্দাটা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, আর গান জেগে ওঠে, ‘একের কথা আরে/ বুঝতে নাহি পারে/ বোঝায় যত কথার বোঝা তত বেড়েই চলে‘। এ যেন এ রাজ্যেরই ধারাবিবরণী! রাজ্য কেন, এই সমসময়ের পৃথিবী নয় কি? যেখানে সর্বক্ষণ চলে শুধু কথার চাতুরি কিংবা চীৎকৃত উল্লাস! কিন্তু কথারও একটা সাহিত্য রয়েছে, কথা ছাড়া কবিতারই বা জন্ম হবে কী করে! কথাকে বর্জন করতে বলছেন কবিগুরু? তবে মুক্তি কোথায়? গানের সঞ্চারী যেন উত্তর নিয়ে বসেই ছিল।

‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর/ তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর‘! সুরে? সঙ্গীতে? গীতে? তবে যে প-িতেরা বলেন কবিতার সমাজে গীতি কবিতারা তুলনায় তরলতর সৃষ্টি। উচ্চ সাহিত্যের পদবাচ্য নয় তারা। সত্যিই কি তাই? রবীন্দ্রনাথ বলছেন একটি প্রসঙ্গে, সাহিত্যে সঙ্গীতের প্রয়োজন কতটা? তাঁর মতে যে সাহিত্যে সঙ্গীত নেই তা সাহিত্যই নয়। সাহিত্যে সঙ্গীত থাকা বাঞ্ছনীয়। সঙ্গীতই সাহিত্যকে সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। তার মানে যে কথায় সুর নেই তা কথাই নয়? ওই যে উচ্চকিত কথার ¯্রােত চার পাশকে তপ্ত করে, দগ্ধ করে, তাতে আর যাই থাক সুর নেই। বুকের ভেতর বেজে যায়, ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর/ তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর/ বোঝে কি নাই বোঝে থাকে না তার খোঁজে/ বেদন তাদের মেলে গিয়ে তোমার চরণতলে‘। বারবার বেজেই যায়, ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর...‘।

চেন্নাইয়ের হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে মা। দূর থেকে দেখি তামিল আয়া মেয়েটি মায়ের সাথে হাত নেড়ে কথা বলে চলেছে। কখনো হেসে, কখনো একটু গম্ভীর, কখনো করুণ চোখে। মা-ও উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করছে। কখনো দুজনের হাসি মিলছে কথোপকথনে, কখনো দুজনের করুণ আঁখিতে জেগে উঠছে একই অশ্রুবিন্দু। দূর থেকে দেখি, শুনি না কিছুই। বিস্ময় জাগে, এখানে আয়ারাও ভালো হিন্দি বা ইংরেজি বলে তবে। সে জন্যেই মা পেয়ে গেছে ভিজিটিং আওয়ার পেরিয়ে যাওয়ার পরও কথার সাথি। সামনে এসে ঘোর ভাঙে। মেয়েটি কথা বলে চলে বিশুদ্ধ তামিলে। মা নিজের বহুভাষিকতার সর্বস্ব দিয়ে কখনো বাংলা কখনো মায়ের পরীক্ষা পাশ করা অথচ দুর্বল কথ্যের হিন্দি, কখনো ইংরেজিতে। আমি অবাক, মা পরিচয় করিয়ে দিল, আমার ছেলে। উত্তরে এক গাল হেসে কুশল জিজ্ঞেস করল মাতৃভাষাতেই সেই আয়া। মা’কে বললাম, এভাবেই বুঝি তোমাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে? কেউ কারো কোনো কথা না বুঝে? মা বলে, অত বোঝার কী আছে? খুব ভালো মেয়েটি। বুঝি, ওর স্বাভাবিক ভালোত্বটাই হচ্ছে মায়ের সাথে তার সংযোগ ভাষা। এটাই কি কথার গভীরে থাকা সুর যা সর্বত্রগামী। এটাকেই কি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সাহিত্যের সার্থকতার জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় সঙ্গীত?

তোমার চরণতলে! যারা বিশ্বাসী তাদের জন্যে তোমার মানে তো ঈশ্বরই। যে নিরীশ্বর, আমার মতো? এই তুমি হচ্ছে জীবন, আবহমান জীবন, আমার ঘিরে থাকা বিশ্ব, তার প্রাণ, যার সুরে সুর মেলাতে আমার বেলা যায় সাঁঝ বেলাতে। কাছের সুরের একতারার একটি তারের ধ্বনিতে সেই বেজে ওঠে না। বিশ্বসঙ্গীতের ‘সহস্র দোতারা’ বেজে ওই সঙ্গীতে যেখানে দূর হয় নিকট, নিকট হয় চিরকালের। ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর..‘। না, এটা সুরকে ধরতে চেয়ে কথাকে বর্জন করার কথা নয়। আমরা নিশ্চয়ই চাই না, কথা আর সুর চিরবিরহে থেকে যাক সমান্তরালে। চাই এমন কথা যা বেজে ওঠে সুরে, চাই এমন সুর যে এক গভীর গভীরতর কথা বহন করে।
পাশের বাড়ির টিভি থেকে অন্ধকার বারান্দায় ভেসে আসে হট্টগোল, সিরিয়ালের। হয়ত সংবাদ কিংবা ভাষ্যের অনুষ্ঠানেরই। একই রকম শোনায় যে দুটো, ধন্দ লেগে যায়!
‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে হলাহল
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল‘।