রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

‘মসীহা’র প্রবেশ ও আমার প্রস্থান

শিলচর ছাড়ার পর এত ঘনঘন আর কখনো আসি নি শিলচরে পুজোয় প্রায় প্রতিবার আসি, যেমনটা আসি উনিশে মেতে এবার পুজোর পর থেকে পাঁচ নম্বর বার এলাম গত উনিশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্য একুশের সকালে বারৈগ্রামের শহীদ স্মারক উন্মোচন অনুষ্ঠান এসেই দেখি বরাক জমজমাট একুশের আগের দিন আসছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, পরের দিন আসছেন প্রধানমন্ত্রী-পদাভিলাষি আরেক মুখ্যমন্ত্রী বিমানবন্দর থেকে শহর অবধি রাস্তার দুধার ব্যানারে ব্যানারে সয়লাব মুখ্যমন্ত্রী গগৈর ছবি চেনা, প্রধানমন্ত্রীর পদাভিলাষী মোদীর ছবিও সম্যক চেনা এই দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর আগমনকে বজ্রনির্ঘোষে জনসমাজে বিজ্ঞাপিত করার জন্যে আরো অনেক ছবি প্রতিটি ব্যানারে

ছবি দেখতে দেখতে মালুম হয়, আমার জেনারেল নলেজটা অনেকদিন ঝালানো হয় নি ব্যানারের বড়ো ছবির নীচে ততটা-ছোটো-না- করেও-ছোটো অন্য ছবিগুলির অনেকগুলিই আমার অপরিচিত গগৈ এর আগমনী ব্যানারের একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র রয়েছে মানে নীচের ছোটো ছবিগুলির মানুষেরা সংখ্যায় সবাই সবাইকে টেক্কা দিচ্ছেন কারোরই একাধিপত্য নেই তুলনায় মোদীর আগমনী ব্যানারে আমার অপরিচিত একটি ছবির দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দৃশ্যমান দুটো সম্ভাবনা রয়েছে ক্ষেত্রে হয়ত দল থেকে তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছেমোদীজী‘-কে স্বাগত জানাতে অথবা এলেমের দিক থেকে হয়ত তিনি অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়ে গেছেন পরে শুনলাম ভোট এলেই বাইরে থেকে এসে শিলচরের পাড়ায় পাড়ায় পথের মোড়ে যিনি চোস্ত হিন্দিতে বিজেপি- হয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন, ছবিটি তাঁরইতাঁর কন্ঠটি আমার চেনা অনেক দিনের, যদিও ছবিটি নয় আসলে আমাদের বরাকের বঙ্গভাষী মানুষের বেশিরভাগের হিন্দিজ্ঞানখায়গা যায়গাপেরোয় না সেখানে কাউকে স্থানীয় পথসভায় নিখুঁত উত্তর ভারতী ঢঙে হিন্দি বলতে শুনলে মনে দাগ কেটে তো যাবেই এই অভ্যর্থনাকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব সেদিনই ছবিতে চোখে দেখলাম, যদিওবাঁশি শুনেছিঅনেকদিনই শহরে বাড়ি ওবাড়ি চায়ের দোকান চায়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখলাম শহর সরগরম মোদীকে ঠেকাতে গগৈ নাকি এক হাজার কোটি টাকারএক অব্যর্থ টোটকা‘ নিয়ে আসছেন মোদীপ্রেমীদের মুখে শুনলাম উদ্বেগ, ডি-ভোটার নিয়ে বলবেন তোমোদীজী’? নয়ত কেলেঙ্কারি! বাঙালি হিন্দু যে আশায় বুক বাঁধছে তাঁকে ঘিরে সেখানে এই প্রশ্নে নীরবতা একটু বেশি রিস্কি হয়ে যেতে পারে গুয়াহাটির সভায় সব বলেছেন, কিন্তু এই মুহূর্তে রাজ্য তোলপাড় করা ডি-ভোটার ইস্যু নিয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেন নি পরের দিনই রাজ্য জুড়ে তুমুল হৈচৈহিন্দু-হৃদয়-সম্রাট মোদীজীরাজ্যের বাঙালি হিন্দুদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এই সমস্যা নিয়ে কিস্যুটি বললেন না কেন? মামার বাড়ি গিয়ে শুনলাম, জনৈক বিজেপি নেতা নাকি পরে সাংবাদিকদের বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘মোদীজীকে বক্তৃতার জন্যে যে পয়েনন্ট্স্ লিখে দেওয়া হয়েছিল তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ডি-ভোটারের সমস্যার কথা সময়ের অভাবে তিনি সেখানে ওই বিষয়ে কিচ্ছু বলতে পারেন নি শিলচরের জনসভায় আশা করা যাচ্ছে তিনি ডি-ভোটার নিয়ে কিছু বলবেন

পাশেই বসেছিলেন এক মোদী-বিরূপ এক বন্ধু তিনি বললেন, আর নতুন কথা কি কংগ্রেস বিজেপি সব্বাই- তো ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় এক কথা আর বরাকে এলে অন্য কথা বলেন এখানে এলে যাঁদের বাঙালিদের দুঃখে নয়ন ভেসে যায়, তাঁরাই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় গিয়ে নানা প্রশ্নে বাঙালি-বিরোধী অবস্থান নেন আসাম আন্দোলনের সময় যখন গুয়াহাটিতে অঞ্জন চক্রবর্তী, দুলিয়াজানে রবি মিত্র, নানা প্রান্তে প্রতিদিন গরিব নিরীহ বাঙালি হিন্দু মুসলমানের বাড়ি ঘর পুড়ছে, লাঞ্ছনা হচ্ছে, নেলি, গহপুর, কামপুরের গণহত্যা হচ্ছে, তখন বিজেপির আদবানি, বাজপেয়িরা আসাম আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করছেন শিলচরে তাঁদের দোসররা শরণার্থীদের দুঃখে চোখ ভাসিয়েছেন আর শরণার্থীদের চিরদিনের জন্যে সর্বনাশ করার জন্যে যখন প্রফুল্ল মোহন্ত- ভৃগু ফুকনরা দিল্লিতে কেন্দ্রের সরকারের সাথে আলোচনা করতে গিয়ে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের তাঁরাই ছিলেন দিল্লিতে তাঁদে লোক্যাল গার্জিয়ান একই কথা সত্য, কংগ্রেসের জন্যেও শিলচরে এলে তাঁদের বড়ো মেজো ছোটে নেতারা সবাই উনিশ-প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যান অথচ বিধানসভায় তাঁরা স্পিকটি নট আসাম সরকারের ভাষিক আগ্রাসনের বেশিরভাগ সনদ এঁদের সময়কালেই তৈরি কুড়ি তারিখ শহরে গগৈ আসবেন

শিলচর এলেই পুরনো কর্মস্থল কাছাড় কলেজে যাই এবারও গেলাম ট্রাঙ্ক রোডের কলেজের গেট থেকেই কানে এলো মুখ্যমন্ত্রীর জনসভার বক্তাদের বজ্রহুঙ্কার গমগম করে মাইক বাজছে সব কথা সব গান স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কলেজে ঢুকেই দেখি আমার প্রাক্তন সহকর্মীরা শশব্যস্ত পরীক্ষার খাতা নিয়ে বিভিন্ন রুমের দিকে এগোচ্ছেন তাঁর মানে আজ পরীক্ষা? বন্ধুরা বললেন, পরীক্ষা মানে হায়ার সেকেন্ডারি ফাইনাল পরীক্ষা এবং সেদিন পরীক্ষা গণিতপত্রের আমি অবাক! ফাইন্যাল পরীক্ষা চলছে আর পাশের মাঠ থেকে গাঁক গাঁক করে মাইক বাজছে! তো জীবনে শুনিনি হচ্ছে তো হচ্ছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জনসভা! যিনি রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার কাণ্ডারী, তিনিই আইন ভেঙে সভা করছেন! আমি জনে জনে জিজ্ঞেস করি, প্রতিবাদ হওয়া উচিত নয় কি? আমরা তো এই শহরেই আগে দেখেছি, ফাইনাল পরীক্ষার মরশুমে নাজিরপট্টি প্রেমতলা অঞ্চলে হ্যান্ডমাইক নিয়েও পথসভা করার অনুমতি দেওয়া হত না একজন প্রাক্তন সহকর্মী বললেন, এই মুহূর্তে শুধু হায়ার সেকেন্ডারি নয়, স্কুল ফাইনালও চলছে সকালবেলা যখন স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে পরীক্ষার্থীরা হল থেকে রাস্তায় নেমেছে এবং হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে বাড়ি থেকে রাস্তায় বেড়িয়েছে, তখনই শহর জুড়ে বাস ট্রাক টেম্পো মিনিবাস করে মুখ্যমন্ত্রীর সভার লোক ঢুকছে শহরে ফলে যানব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন এই কথা বলার সময়ে ডিএসএ থেকে যখন বক্তৃতা ভেসে আসছে, তখন ট্রাঙ্করোড থেকে আরেকটি মাইকে ভেসে এলো চিলচিৎকার করা গান আমি বললাম, আবার কী? শুনলাম, মোদীর জনসভার প্রচার করার জন্যে বিভিন্ন বাজারহিট হিন্দি গানের সুরে মোদী নিয়ে বাঁধা গান মাইকে বাজিয়ে বাইশ তারিখের সভার প্রচার চলছে বেশ কিছুদিন ধরে তার মানে পরীক্ষা দিতে এসে গগৈর মাইক, বাড়িতে পড়তে বসলে মোদীর মাইক! আমি অবাক এমন অসভ্য সংস্কৃতিতে ভর করে রাজনীতির প্রচার তো শহরে আগে কখনো শুনি নি মোদী বা গগৈ নাহয় বাইরের লোক, কিন্তু যাঁরা এই শহরে এই উপত্যকায় এই মাইকবাজি করছেন, তাঁদের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই তো স্কুল ফাইনাল বা হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরীক্ষার্থী! সবাই বুঝি কালিদাস হয়ে গেলেন! যে ডালে বসেছেন, সেই ডালেই দায়ের কোপ চালাচ্ছেন


মোদী আসবেন, আবার আমাকে আজই ফিরতে হবে কলকাতায়। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি বিমানবন্দরের দিকে। গাড়ির চালক বলল, মোদী আসবেন সাড়ে এগারোটায়। আমি বললাম, তবে প্লেন লেট হবে না তো? চালক ভরসা দিয়ে বললেন, না না, উনি হেলিকপ্টারে আসবেন আগরতলা থেকে। পথে পথে উৎসাহী জনতারা ছুটছে রামনগরের দিকে। বাচ্চা বুড়ো নওজোয়ান মহিলা সবাই। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। মনে হচ্ছে, রামরাজত্বের ঠিকানা বোধহয় রামনগরের আইএসবিটি-লাগোয়া মাঠেই। শুনলাম গুজরাট থেকে এসেছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অফিসাররা। বাংলাদেশ থেকে বলা যায় না কখন কোনোউগ্রবাদীঢুকে পড়ে। পাটনায় যা হল! শিলচরে নাকি একজন ধরাও পড়েছে। জানা যায় নি অবশ্য সে সত্যিই উগ্রবাদী কিনা। সব কথা শুনতে শুনতে মন চলে যায় উনিশো নিরানব্বুইয়ে। সামনে লোকসভা নির্বাচন। দেশের দিকে দিকে প্রতিদিন ধরা পড়ছে আইএসআই এজেন্ট। সাঙ্ঘাতিক সব ঘাতকবাহিনী নাকি এদেশের কোণে কোণে ঢুকে পড়েছে। সে সময়ই হঠাৎ স্থানীয় খবরের কাগজে একটি সংবাদ বেরোলো।শিলচর সুভাষনগরে ভর সন্ধ্যায় ধৃত এক আইএসআই-এজেন্ট বিস্তারিত খবরে জানা গেল কোনো এক বাড়িতে ঢুকে নাকি উঁকি ঝুঁকি মারছিল সেইআইএসআই এজেন্ট উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা যায় নি। পোষাক ছিল ঠিক তেমনই, যেমনটা হওয়া উচিত আইএসআই এজেন্টের। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। চেহারাও যেমনটা হওয়া উচিত তেমনই। মাথায় তকি গালে দাড়ি। পাড়ার জাগ্রত কিছু ছেলেছোকরার তৎপরতায় অন্তর্ঘাত ঘটে নি! ছেলেরাআইএসআই এজেন্টকে উত্তম মধ্যম দিয়ে রক্তাক্ত করে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছে।

ভোট টোট চুকে যাওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই সারা দেশেআইএসআই এজেন্টধরা পড়ার ঘটনা কমে এলো। শিলচরের একটি ছোট কাগজ সংবাদ শিরোনাম করেছিল, ‘ভোট শেষ, আইএসআই শেষ‘ অনেকদিন পর ওই পাড়ার আমার পরিচিত এক হিন্দুবাদী ছেলে সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, তোদের পাড়ায় যে আইএসআই এজেন্ট ধরা পড়েছিল তার কী হল রে? প্রায় বুক অবধি জিভ বের করে সে বলল, আর বোলো নো, ব্যাটা বাংলাদেশের বাঙ্গাল, এসেছিল সিলেট থেকে ওর এক বন্ধু চিঠি পাঠিয়েছে শিলচরে আত্মীয়কে। সেটা পৌঁছে দিতে এসেছিল। ত্রিসন্ধ্যা সময় জানালা দিয়ে হিন্দু পাড়ায় এক দাড়ি লুঙ্গি উঁকি মারছে দেখে বাড়ির লোকেরা আর্ত চিৎকার দিয়েছিল। কী করবে, সারা দেশে তখন আইএসআই এজেন্ট ধরা পড়ছে। আমরা তো ব্যাটাকে ধরে উত্তম মধ্যম দিয়ে পুলিসের হাতে তুলে দিলাম। পরে শুনলাম, ওই বাড়ির সিলেটের আত্মীয়েরই বন্ধু তিনি। বন্ধুর পত্রবাহক হয়ে এসেছিলেন তিনি! আমি সব শুনে তাঁকে বললাম, ওই ভদ্রলোক -সাম্প্রদায়িক হতেই পারেন। কিন্তু এই ঘটনার পর বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে তিনি জামাতপন্থী হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে যান, তখন তাঁর এই চরিত্র পরিবর্তনের দায় তুই বা ওই বাড়ির লোকেরা নেবেন কি? সেই ভদ্রলোক যদি পরের বার আমি সিলেট গেলে আমাকে এমন ধোলাই দিয়ের‘-এর এজেন্ট বানিয়ে পুলিসের হাতে তুলে দেন, তার জন্যে দায়ি কে থাকবে? উত্তরে সে বলল, কী করবে! পলিটিক্সে এরকম হয়-ই। কথাটা এতদিন পর লিখতে গিয়ে আমার ইশরাত জাহান নামের তরুণীটির কথা মনে পড়ছে, যাকে গুজরাটের পুলিস উগ্রপন্থী আখ্যা দিয়ে কোনো বিচার প্রক্রিয়ায় না গিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। জানি না, ‘মোদীজী‘র সভার আগে ওরকম কোনোআইএসআই এজেন্টশিলচরে ধরা পড়ল কি না। কারণ, দোরগোড়ায় যে ভোট আবার!


বিমানবন্দরে বসে আছি চেক ইন করে। হঠাৎ দেখলাম হন্তদন্ত ঢুকছেন কবীন্দ্র বাবু। শুনলাম মোদীর চার্টার্ড প্লেন একটু পরেই নামবে কুম্ভীরগ্রামে। আকাশ থেকে নামল ছোট্টো সুদৃশ্য একটি প্লেন। জানালার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি থেকে সাধারণ স্টাফ সবাই। লাউঞ্জের টিভিটায় কেউ এসে ধরলেন এনইটিভির চলতি সম্প্রচার। রামনগর থেকে রিপোর্ট করছেন সংবাদদাতা। বলছেনমানুষের ঢল নেমেছে। যে মাঠে সভা হচ্ছে, সেই মাঠটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের। তাঁরা অনুমতি দিয়েছে সভা করার। তার মানে মোদীর মুসলিম-বিরোধী ভাবমূর্তি এখন অতীত হয়ে গেছে।সহজ সমীকরণ? বিমানবন্দরের ক্লিনার থেকে সাধারণ গরিব কর্মী ঝুটে এলেন এবার টিভির কাছে। পরক্ষণেই ছুটে গেলেন জানালার দিকে। মুখে হাসির ঝিলিক। চড়াই পাখির মত একটি হেলিকপ্টার এগিয়ে গেল ঝাঁ চকচকে চার্টার্ড প্লেনের দিকে। মোদীকে দেখতে পেলাম না। দেখার খুব একটা ইচ্ছেও ছিল না। আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল হেলিকপ্টার। উড়ল আকাশে। আমরাও সিকিউরিটি চেক শেষ করে আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছি আমাদের প্লেনের দিকে। ডানদিকের কোণে পার্ক করা মোদীর চার্টার্ড ফ্লাইট। ঝাঁ চকচকে। আয়তনে আমাদের বিমানের মতই। এই বিমানেই এখন চষে বেড়াচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। প্রতিদিন সভা। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করে আসে জনসভায়। একই আগ্রহ নিয়েই একবার টিভির পর্দায়, একবার বিমানবন্দরের জানালায় ছুটে গেলেন বিমানবন্দরের কর্মীরা তাঁকে একবার দেখতে। তেমন উন্মাদনা নাকি সর্বত্র।

প্লেনটার দিকে তাকালাম শেষবার। দূরে দেখা যাচ্ছে আকাশে হেলিকপ্টার। এখন বুঝি তিনি আর ট্রেন চড়েন না? চড়েন না কোনও ভূতল পরিবহনেও? শুধুই আকাশে সওয়ার? প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি শুধু আকাশে? কখনো আধঘন্টা, কখনো চল্লিশ মিনিট কখনো একঘন্টা মাটিতে, কিন্তু সু-উচ্চ সভামঞ্চে। বক্তৃতা, তারপরই আবার আকাশে। ট্যুইটার খুলে দেখলাম কে যেন বলছে, তাঁর এই আকাশ-সওয়ারি প্রাক-নির্বাচনী প্রচারের বাজেট পাঁচশো কোটি টাকা। তারপর আসবে নির্বাচন। তখন নির্বাচনী প্রচারে আবার কয়েকশো কোটি! কেউ বললেন, এবারের নির্বাচন টাকার অঙ্কে রেকর্ড গড়বে! কে দেয় এই টাকা? কখনো তো দেখি না, চাঁদার কুপন হাতে রসিদ বই নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরছে ওই দলের স্বেচ্ছাসেবকরা। কে দেয়? তবে কি সত্য যে তাঁর এই বিপুল ভাবমূর্তি নির্মানের প্রচারাভিযানের টাকার জোগান দিচ্ছে ভারতের বড়ো বড়ো বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি? এটাও কি সত্যি, এই জন্যে সব বিষয়ে মুখর মোদী এক ডলারের তেল আট ডলারে কেন কিনতে হয় এই প্রশ্নে একটি কথাও বলছেন না পাছে ফান্ড ম্যানেজাররা অসস্তুষ্ট হয়? প্লেনের জানালা দিয়ে শেষ বার দেখি মোদীর উড়ালপাখিকে। এবার মনে ভেসে এল, বিমানবন্দরের সাফাইমহিলাদের মুখ। ভেসে এল রামনগরের মাঠে হাজির হওয়া লক্ষ লক্ষ সাধারণ দরিদ্র মানুষের মুখের হাসির ঝিলিক। যদি প্রধানমন্ত্রী শেষপর্যন্ত হনও, কার স্বার্থ রক্ষা করবেন মোদী? ওই হতদরিদ্র মানুষগুলির? নাকি যাঁরা তাঁর আকাশ-অভিযানের, তাঁকে ঘিরে আকাশছোঁয়া স্বপ্নের নির্মানের, সন্ধ্যার আকাশে ঝলমল করে ফুটে থাকা তারকার মত ভাবমূর্তি নির্মানের জন্যে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করছেন, তাঁদের? গরিব আর ধনীর স্বার্থরক্ষা যে একসাথে হয় না। একটা দলকে প্রতারিত করে অন্য দলের বিশ্বাসভাজন যে হতেই হবে। কার স্বার্থ? কার স্বার্থে?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা!!!!  

২টি মন্তব্য: