শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫

ওই বুঝি কেউ হাসে!

বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। হায়দরাবাদে একটি সংস্কৃতি কর্মীদের সম্মেলনে গিয়েছি। সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেল সমবেত কন্ঠের অট্টহাসিতে। খেয়াল করতেই বুঝলাম। এ তো যে যার মত কোনো একটি হাসির কথা শুনে হেসে ওঠা নয়। জানালা দিয়ে দেখি, সমবেত একদল লোক গায়ে টি শার্ট পায়ে কেডস পরনে ট্র্যাকসুট গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট ছন্দে সামনের দিকে মাথা ঝুঁকছে নিঃশব্দে, খানিকক্ষণ অবনতমস্তক থেকে তারপর ধীরে ধীরে ফুলের পাপড়ির ফোটার মত সোজা হচ্ছে এবং সঙ্গে সমবেত কন্ঠে গণসঙ্গীত গাওয়ার মত একটু একটু করে সশব্দে হাসিতে ফেটে পড়ছে। বুঝলাম, এটা প্রাণখোলা হাসি নয়। এটা কঠোর নিয়মানুবর্তিতার হাসি! মন নয়, শরীর চাঙ্গা করার হাসি! পাটনার নাট্যকর্মী বন্ধু হাসান ইমাম একটি উদ্ভট আইডিয়া দিলো। বলল, চলো, আমরা ওখানে যাই। একটু অদূরে দাঁড়িয়ে ওরা যখন চুপ করে সামনের দিকে মাথা ঝোঁকাবে তখন আমরা যে যার মত অট্ট হাসিতে ফেটে পড়বো। সেটা শুনে ওরা নিশ্চয়ই ভীষণ খেপে যাবে। বলবে, অ্যাই হতচ্ছাড়া, হাসছো কেন? আমরা উত্তরে গোবেচারা মুখ করে বলব, স্যার, আপনারাও তো হাসছেনই। শুধু আপনারা যখন চুপ করছেন তখন আমরা হাসছি। এ ছাড়া অন্য কিছু তো করি নি। উৎসাহী লোকের অভাবে শেষ পর্যন্ত এই হাসি অভিযান বা হাসি দিয়ে হাসি নিবারণ কর্মসূচিটা করা গেল না।

আমাদের রাষ্ট্র বা ধর্মের ব্যাপারটাও তেমনি। সবাইকে যখন হাসতে বলা হবে হাসতে হবে তখনই। অন্যথায় মুশকিল। একটা আইন কিংবা নিষেধের বেড়াজাল দিয়ে সবকিছুকে বাঁধতে চায় সবকিছুকে। একটি রাষ্ট্রে নিয়মকানুন যত সুক্ষ্ম নিষেধের বেড়াজালও তত সর্বগ্রাসী। এই নিয়মতান্ত্রিকতা ধর্মেও প্রবল। একটি ধর্ম যত বেশি সংগঠিত তার আচারের বেড়াজালও ততটাই তীব্র। যদিও ইতিহাসের একটা নির্দিষ্ট স্তরে এসেই রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছে, ধর্মেরও তেমনি সংগঠিত রূপ এসেছে ইতিহাসেরই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে। তবু মানুষের সমাজের সাধারণ চলাটা সবসময়ই মুক্তির দিকে। তবে এই মুক্তি মানে তো আর যথেচ্ছাচার নয়। মানুষই নিজে থেকে কতগুলি বাড়াবাড়ি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। সমাজ যেহেতু সকলের হাত ধরাধরি করে একসাথে চলার ফসল, ফলে সমাজ কখনোই চায় না, এমন কিছু হোক যার ফলে পরস্পর ধরে থাকা হাতটা আলগা হয়ে যায়। ব্যক্তির জীবনে বা পরিবারের আবহে বা সমাজের পরিসরে যদি এই ভালোবাসাবাসির সংস্কৃতিটি জেগে থাকে  তখন দেশে একটা সহনশীলতার আবহ জেগে থাকে। আইন করে সহনশীলতা জাগানো যায় না। খুব বেশি হলে কোথাও সহনশীলতার ব্যত্যয় ঘটলে তার প্রতিকার করা যায়। এখন মুশকিলটা হচ্ছে ধর্মই হোক বা রাষ্ট্রই হোক, সে নিয়মের শাসনকে প্রগাঢ় করতে গিয়ে ভুলে যায় নিয়মের প্রবর্তনটি ঠিক কী কারণে করা হয়েছিল। এটা অনেকটা ছোটোবেলায় শোনা শ্রীরামকৃষ্ণের কথা ও গল্পের ‘কৌপীনকা ওয়াস্তে‘ গল্পের মত। গৃহী মানুষ সংসার চেড়ে বনে গেলেন সন্ন্যাসী হওয়ার জন্যে। ইঁদুর কৌপীন কেটে কেটে কুটি কুটি করে দেয় বলে প্রথমে বিড়াল আনা, তারপর বিড়ালের জন্যে গরু, গরুর জন্যে রাখাল, রাখালের জন্যে তার সংসার, সংসারের জন্যে সমাজ, সবশেষে বনে এসেও সংসারীই হয়ে যেতে হল। 

আমাদের আচারসর্বস্ব ধার্মিক বা আইনসর্বস্ব রাষ্ট্ররক্ষকদের অবস্থাও তাই। মানুষের সমাজকে সুন্দরতর হবে ভেবে যে সমস্ত আচার বা আইনের প্রবর্তন হয়েছিল একদিন, এখন সেই আচার বা আইনের ঠেলাতেই সমাজের প্রায় দফরফা অবস্থা। মরমীয়া সাধকরা যেমন বলেন সেই কথাটাই সত্য হওয়া উচিত। তাঁরা বলেন, আচারের চেয়ে বিচার অনেক বড়ো বিষয়। প্রথমেই বিচার করে দেখা উচিত একটি বিশেষ আচার বা আইন মানুষের সমাজে ভালোবাসাবাসির সংস্কৃতি বা পারস্পরিক বিশ্বাসবোধের সংস্কৃতিকে পোক্ত করছে না দুর্বল করছে। যদি দেখা যায় যে একটি আইন বা আচার পালন করতে গিয়ে মানুষের সমাজটাতেই আগুন লেগে গেল, একজন আরেকজনের বুকে ছুরি মারতে উদ্যত হচ্ছে তখন সেই আচার বা আইন যত প্রাচীন বা যত যুক্তিনিষ্ঠই হোক, তাকে মাথায় করে রাখলে সভ্যতার মৃত্যু অনিবার্য।

এখন এমন একটা সময়, যখন ‘এখানে মন্দির ছিল না মসজিদ ছিল‘ থেকে শুরু করে সমাজের সামান্যতম মনান্তরের বিষয়কেও আইনের বারান্দায় গিয়ে সমাধান খুঁজতে হয়, যখন সকলের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হাজার হাজার মানুষের হত্যালীলার রূপকার শুধুমাত্র আইনের চোখে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ার জন্যে পুরুষোত্তমের স্বীকৃতি পেয়ে যান, তখন অসহিষ্ণুতার কালোছায়া যে আমাদের ঘর গেরস্থালির ভেতরমহল অবধি ব্যাপ্ত হবে এ আর আশ্চর্যের কী! আমাদের প্রতিটি রাষ্ট্র যেমন গড়ে উঠেছে প্রাথমিকভাবে মানুষের সমাজের চারা পানিতে, তেমনি প্রতিটি সংগঠিত ধর্মেরও জন্ম একটি লোকায়ত গৌণ মরমিয়া ধর্মের গভীর থেকে। প্রতিটি রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছিল সেসময়ে চলতে থাকা রাষ্ট্রনৈতিক অবক্ষয়ের সামাজিক প্রতিবাদের গর্ভ থেকে। এভাবে প্রতিটি সংগঠিত ধর্মেরও প্রাথমিক অঙ্কুরোদ্গম প্রচলিত ধর্মব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগঠিত সামাজিক বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই। পরে প্রতিটি রাষ্ট্রই হয়ে উঠেছিল যারে পরাভূত করেছিল তাদেরই প্রতিভূ। একইভাবে সামূহিক সামাজিক বিচারবোধ থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিটি সংগঠিত ধর্মই পরে হয়ে ওঠে আচারের কারাগার। রাষ্ট্রের মত এখানেও স্পষ্ট হয় শ্রেণি আধিপত্যের কালো ছায়া।


এমনিতে একটি সমাজ এমনটা কখনো হয় না যেখানে কিছু ব্যাপারে কট্টরপন্থা থাকলেও বাকি বিষয়গুলিতে সাধারণভাবে এক উদার ও সহিষ্ণুতার আবহ থাকবে। ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে তৈরি হওয়া অসহিষ্ণুতা শেষ পর্যন্ত এক চূড়ান্ত অ-গণতন্ত্রের সমাজ তৈরি করে। তখন শুধু কে সংখ্যায় কম তাকেই যাবতীয় অসহিষ্ণুতার বিষ গ্রহণ করতে হয় না। মুক্তচিন্তক থেকে শুরু করে নাট্যকর্মী, গায়ক থেকে চলচ্চিত্রশিল্পী, লেখক থেকে বিজ্ঞানী সকলেই হয়ে ওঠেন অসহিষ্ণু হিংস্রতার শিকার। সাধারণতন্ত্র বা গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে রাজত্ব বিস্তার করে তখন এক ধরনের ইতরতন্ত্র বা দঙ্গলতন্ত্র (mobocracy)। আর এই সার্বিক মাৎস্যন্যায়ের থেকে মানুষকে মুক্তির অপার দরিয়ায় নিয়ে যাবে এমন কোনো ধর্ম বা রাষ্ট্র তখন চোখে পড়ে না। তো, কথা হল মুক্তি কোথায়! হয়ত এক বিকল্প গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা ‘ধর্ম‘কে গড়ে তুলতে হবে এই প্রচলিত রাষ্ট্র বা ধর্মকে অন্তর্ঘাত করেই। সেই কাজটি করতে পারে কোনো বীর নয়, সামাজিক মানুষ। এক অপার ভালোবাসা এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাই পারে এমন অসাধ্য সাধন করতে। আমাদের জীবদ্দশায় তা যদি না-ও হয় ক্ষতি কি? রবীন্দ্রনাথ তো বলেইছেন, তোমার কাছে পৌঁছনোটাই বড়ো কথা নয়। ‘পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া‘। এভাবেই মানুষের সভ্যতা যুগে যুগে হাজারো মন্দের মধ্যে এক সামূহিক ভালোর স্বপ্নে বাঁচে। আমাদের শিল্পকলা সেই অধরা মাধুরীকেই ধরে ছন্দের বন্ধনে। বিধিনিষেধের আচারসর্বস্বতা বা আইনসর্বস্বতার কালো ছায়া আমাদের মনের গভীর থেকে যত সরবে ততই সূর্যের আলো পেয়ে জীবন পাবে মানুষের সমাজ এবং তার নন্দন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন