বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

অন্য চলা


পঁচিশে বৈশাখের সকালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজবাটির মাঠের প্রভাতী অনুষ্ঠানে মঞ্চের পাশে হাঁটাহাঁটি করছি প্রতিবারের মত। প্রতিবারের মতই ওদিকে টাউন হলের মাঠের অনুষ্ঠান থেকে ঘনঘন ফোনে তাগাদা, কখন আসছ? প্রতিবারই বর্ধমানের সকালের অনুষ্ঠান সেরে কলকাতায় যাই, বিকেলের দিকে কিছু না কিছু থাকে।


হঠাৎ-ই মোবাইলে ম্যাসেজ শিলচর থেকে, ‘জোড়াসাঁকো থেকে সরাসরি সম্প্রচারে দেখছি তোমার এক বন্ধু গাইছে। তুমিও কি ওখানেই?` আমি উত্তর দিই, ‘ওই অনুষ্ঠানগুলোতে তারকা-শিল্পীরা গান করেন। আমার ওই বন্ধু তারকা, তাই বলে আমি তো আর তারকা নই। পঁচিশে বৈশাখে আমি আমার মাপের অনুষ্ঠানেই ব্যস্ত আছি। যেমনটা প্রতি বছর ঘটে।` শিলচরের বন্ধু তারপরও একটা উত্তর দিয়েছিল, সেটা মনে খুব একটা প্রবেশ করল না। আমি ডুবে গেলাম অন্য ভাবনায়, ওর ম্যাসেজের উত্তরে পাঠানো আমার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গী হয়ে।


তারকা হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই, এটা আমার জানা। থাকলেও কি আমি ওই পথ নিতাম? আমি তো নিজেই বেছে নিয়েছি আমার পথ। যে পথ বিনোদন-শিল্পীর নয়, তারকার নয়, সে পথ কর্মীর পথ। আমার কাজ বিনোদন নয়, বার্তাবহনের। গান আমার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বড়ো হওয়া আমার পথ নয়। আমার স্বপ্ন, ব্যাপ্ত হওয়া, গভীরে নিহিত হওয়া। সমস্ত অন্ধকার রাতের পর একটি শুভ্রসকাল নিশ্চিত রয়েছে আগামীতে, এই প্রত্যয়ের কথাটি বলতে চাই গানে গানে। বলতে চাই ভালোবাসার কথা, ভালোবাসাবাসির কথা। বাজারকে আমি এড়াতে চাই না, চাই পেরিয়ে যেতে। ঠিক যেমন একজন বিপ্লববিশ্বাসী রাজনৈতিককর্মী মোহমুগ্ধ না হয়ে পার্লামেন্টে যায়, সেভাবেই বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে আমি চাই আমার প্রবেশ ও প্রস্থান। পেজ থ্রি, ছোট পর্দা, জনচিত্তজয়- আমার অভীষ্ট হতে পারে না। আমার দেবতা হতে পারে না। আমার গন্তব্য হতে পারে না। হতে পারে খুব বেশি হলে আমার দীর্ঘচলার এক যাত্রাবিরতি বিন্দু। আমার পথ আলাদা। ‘আমার পথ আলাদা‘ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে উঠে আসে অন্য আশঙ্কা মনে। আমি কী অজান্তে এক হীনমন্যতার শিকার? হঠাৎ কানের কাছে প্রথমে বেজে অসংখ্য মানুষের করতালি, আর তারপরই খানিক নিস্তব্ধতার পর চোখের সামনে ভাসে কোনও মুগ্ধ চোখের কোণ থেকে ঝরা দু‘ফোটা অশ্রু। না, করতালি না। ওই দু‘ফোটা অশ্রুই আমার দেবতা।


অ্যাক্টিভিস্ট। কথাটার তেমন বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তার মানে, বাংলায় কি অ্যাক্টিভিজম বিষয়টি এতটা চর্চিত নয়? কিন্তু বাংলাই তো শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে জনকল্লোলের স্পন্দন এনেছিল। আমি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী। কথাটায় সবটা বলা হয় না। বললেই ধারণা হবে, আমার কাজ শুধু পথসভায় ও জনসভায় গেয়ে বেড়ানো। দলীয় কর্মসূচির বৃত্তে ঘুরে বেড়ানোই বুঝি শুধু রাজনীতি! যখন ছোট পর্দায় বা সাধারণ অনুষ্ঠানমঞ্চে রবীন্দ্রনাথের একটি গান ধরি, তখনও তো আমি অ্যাক্টিভিস্ট। আমার দায়বদ্ধতা শুধু সমকালে নয়, চিরকালের কাছেও। সমকাল মানে আমার কাছে ২০১০, ১১, ১২, ১৩ এমনটা নয়। আমার জন্ম থেকে আমার মৃত্যু অবধি ব্যাপ্ত সময় আমার সমকাল। ১০, ১১, ১২-কে বলব ক্ষণকাল, যদিও সে আমার সমকালেরই অঙ্গ। ঠিক যেমন আমার সমকাল চিরকালের সন্তান। সে জন্যেই আমার দায়বদ্ধতা যেমনি ক্ষণকালে, তেমনি সেখান থেকে সমকালে এবং সবশেষে চিরকালে। আমার গানেও চাই ক্ষণকালের সাথে বেজে উঠুক সমকালের উদ্ভাস। সমকালে প্রতিধ্বণিত হোক চিরকালের মর্মবাণী।


এমন করে কোনও ভাবনা স্রোতে যখনই ভেসে যেতে থাকি, ডুবে যেতে থাকি, তখনই ভেতরে রিনরিনিয়ে ওঠে কোনও না কোন গান। ভাবতে থাকি, বহিরঙ্গ নয়, অন্তরঙ্গেই চাই আশ্রয়। কে যেন গায়, কার ‘বারতা‘ যেন আমার ভাষায় কথা বলতে চায়। গানের তানে লুকিয়ে তারে, কে যেন বার্তা পাঠায়! ‘আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু/ গন্ধভরে তন্দ্রাহারা‘। একজন অ্যাক্টিভিস্টের চলা কখনোই নদীর মত উদ্দাম নয়। পাগলপারা নয়। মৃগনাভীর গন্ধে আপনহারা নার্সিসিস্ট নয় সে। একজন প্রকৃত অ্যাক্টিভিস্ট বলতে পারে, ‘আমি সদা অচল থাকি/গভীর চলা গোপন রাখি/ আমার চলা নবীন পাতায়/ আমার চলা ফুলের ধারা‘। ওরা ভিন্ন গোত্র, যারা নদীর মত। যারা চলার বেগে পাগলপারা। পথে বেরিয়ে আপনহারা। আর যিনি অ্যাক্টিভিস্ট, তাঁর তৃপ্তি ভিন্ন, আনন্দ আলাদা। বহিরঙ্গের আলোর ভাষায় তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত বলা যায় না। সে বলে, ‘আমার চলা যায় না বলা/ আলোর পানে প্রাণের চলা/ আকাশ বোঝে আনন্দ তার/ বোঝে নিশার নীরব তারা‘।


আশৈশব শোনা গান। ছোটবেলায় যে কোনো প্রতিযোগিতায় অসম্পূর্ণ কন্ঠপ্রস্তুতি ও তার সাথে তরলতম তবলাসঙ্গতে অসংখ্যবার শুনেছি এই গান। খেমটা তালে কেমন নেচে নেচে দুলে দুলে গাইত এ গান কত শিশু। গোটা গানজুড়ে থাকত আপনহারা পাগলপারা লয় ও দুলুনি। হঠাৎই পঁচিশে বৈশাখের সকালে এই গান থেকে সমস্ত পূর্ব অভিজ্ঞতা উবে গেল কর্পূরের মত। সমস্ত চপলতা, সমস্ত অস্থিরতা, আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার অশ্লীল কাঙালপনার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে কে যেন নিভৃতে আত্মঘোষণা করে, ‘আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু..../‘, ‘আমি সদা অচল থাকি/ গভীর চলা গোপন রাখি...‘, ‘আমার চলা যায় না বলা...‘।


চোখের কোণে জমে ওঠে একটুখানি জলের রেখা, ঠোঁটের কোণে জেগে ওঠে গভীর আনন্দানুভূতির এক চিলতে হাসি, একান্তেই।
সারাটা দিন আজ শুধু এই গানেরই...।