মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

সেই আদ্যিকালের পশুর ঠ্যাং ও আজকের রাজনীতি

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এই গল্প। ‘মন্দিরের সামনে গরুর ঠ্যাং রেখে দিয়ে গেছে ব্যাটারা`। কিম্বা ‘মসজিদের সামনে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা শুয়োরের ঠ্যাং রেখে গেছে`। সব গল্পের শেষ এক দৃশ্যে, দাঙ্গা। দাঙ্গা, রক্তপাত, পাথর ছোঁড়া, নিরীহ মানুষের মৃত্যু, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া, কারফিউ, নিরাপত্তা বাহিনীর টহল ইত্যাদি। এত গেল আইনশৃঙ্খলার দিক। তারচেয়েও মারাত্মক যে কাজটি এই গল্প করে যায়, যার রেশ থেকে যায় কারফিউ ওঠার, সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ারও অনেক অনেকদিন পর অবধি, তা হল- দীর্ঘদিন ধরে সুখে শান্তিতে পাশাপাশি বাস করা প্রতিবেশীর মধ্যে অবিশ্বাসের বিষ-হাওয়া ঢুকিয়ে দেওয়া। এই গল্পের শুরু ব্রিটিশ আমল থেকে। মায়ের মুখে ছোটবেলায় শুনেছি, মন্দির বা মসজিদের সামনে বিশেষ পশুর হাড় বা মাংসের টুকরো, তারপরই দু`দিক থেকে ‘বন্দে মাতরম` আর ‘আল্লাহো আকবর` রণধ্বনি। তারপর দেশ স্বাধীন হল। কত কত রঙের সরকার এল আর গেল। তবু এই গল্পের শেষ নেই।


মনে পড়ে ১৯৮০ সালের লোকসভার নির্বাচনের সময়ের কথা। মনে পড়ে ১৯৮৬-৮৭ থেকে শুরু করে ১৯৯২-৯৩ সাল অবধি সময়পর্বের কথা। তারপর বরাক কুশিয়ারা জিরি চিরি দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। পুরনো গল্প কার্যকারিতা হারানোয় নতুন গল্প এসেছে। সে জন্যেই হয়ত, কিছুদিন আগে শুনেছি অন্য গল্প। কে কাকে বিয়ে করল, সেই নিয়ে উপত্যকা জুড়ে চলল ফিসফিসানি আর চক্রান্তের জাল বোনা। অনেকদিন এই গল্প শুনিনি বরাক উপত্যকায়। আজ সকালে ইন্টারনেটের পাতায় শিলচরের খবরের কাগজের সংবাদ শিরোনাম ভেসে উঠতেই চমকে উঠলাম, শিউরে উঠলাম এবং সত্য কথা বললে, এক নিদারুণ যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝেই ভাবি, আমরা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা কি সত্যিই নিতান্ত ক্ষমতাহীন? আমাদের শুভবুদ্ধির কোনও শক্তি নেই, নেই এর কোনও দাম? যার যখন ইচ্ছে হল, তখনই মুহূর্তে এক সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভরিয়ে দিল গোটা সমাজের আকাশ। তবে আমরা যে প্রতিদিন একসাথে বাঁচি, একসাথে হাসি, একসাথে কাঁদি, শিলচর থেকে গুয়াহাটি বাসযাত্রা করতে গিয়ে ধর্মনির্বিশেষে এক সাথে নাজেহাল হই, তা কি আমাদের দু’টি হৃদয়ের মধ্যে কোনও শক্তিশালী সেতু গড়ে তুলতে পারে না? কেন কোনও সমাজবিরোধীদের ইচ্ছা হলেই এক মুহূর্তে, সেটা কারো বিয়ে হোক বা কোনও শিশুর মর্মান্তিক হত্যা হোক বা কোনও জনপ্রিয় চিকিৎসকের অপহরণের ঘটনা হোক, তাকে ব্যবহার করে এই শহরে এই উপত্যকাকে বিষের হাওয়ায় ভরিয়ে দিতে পারে? পারে জনজীবনকে তছনছ করে দিতে? এটা কী কারো বুঝতে বাকি থাকে, গতকাল যে ঘটনা দিয়ে শহরকে অস্থির করে উপত্যকায় আবার একটা সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ আনার চেষ্টা হল, সেটা সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত। নয়ত হঠাৎ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট শহর ও গঞ্জগুলিতে আবার নব্বইয়ের কায়দায় সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে কেন? কেনই বা হঠাৎ আবার অযোধ্যা নিয়ে সিংঘল, তোগাড়িয়ারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন? মাঝে দেশের মানুষ সিংঘল কোম্পানির নামই ভুলে গিয়েছিলেন হয়ত। তাদেরও রাম জনমভূমি বা অন্য ইস্যু নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না। প্রায় নির্বাসনই হয়ে গিয়েছিল সংবাদ পত্র থেকে। এখন সিংঘলও সক্রিয়, গ্রামে শহরে বানর বাহিনীও সাজসজ্জা শুরু করেছে।


ক‘দিন ধরেই মনে মনে আতঙ্কে রয়েছি বরাক উপত্যকা নিয়ে। যে দিন থেকে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করার স্বপ্ন ফেরি শুরু হয়েছে আমাদের দেশের কর্পোরেট মিডিয়া ও কর্তাদের তরফে, তখন থেকেই এই আতঙ্ক। গুজরাট গণহত্যার নায়ক নরেন্দ্র মোদী যতই উন্নয়নের মুখোস পড়ুন এবং ঈদের দিন মুসলিমদের টুপি নিজের মাথায় দিন, তার যে কোনও রাজনৈতিক প্রচারাভিযান উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ব্যতিরেকে কখনো হয় নি আর হবেও না। মজার কথা, একসময়ে মুলায়ম সিং যাদব ঈদের সময় মুসলিমদের মত টুপি পড়ায় নরেন্দ্র মোদী ও সারা দেশজুড়েই সঙ্ঘপরিবারের লোকেরা মুলায়মকে মৌলানা মুলায়ম বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই সঙ্ঘ পরিবারওয়ালাদের এইটেই মজার ব্যাপার, নিজেরা বাঁশকান্দির মৌলানার কাছেই যান আর জামা মসজিদের ঈমামর কাছে যান, ওরা গেলে সেটা ধর্মনিরপেক্ষতা। যদি অ-বিজেপি কেউ এই একই কাজ করেন, তবে সেটা মুসলিম তোষণ। যাইহোক, এবার ঈদের সময় নরেন্দ্র মোদী তাঁর নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষতায় মুসলিমদের টুপি মাথায় পড়লেও, তাকে নিয়ে বিজেপি ও কর্পোরেট মিডিয়ার উৎসাহী প্রচার শুরু হতেই দেশের নানা জায়গায় নব্বইয়ের কায়দায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর কাজও শুরু হয়ে গেছে। বিহারে অশান্তি, কর্ণাটকে অশান্তি, উত্তরপ্রদেশে তো বাঁদর-নৃত্য শুরু হয়েছে। আমার ভয় ছিল, কবে এই বাঁদর-বাহিনী বরাকের মাটিতে থাবা বসায়। গতকালের ঘটনা আমার কাছে সেই দেশব্যাপী অশুভ পরিকল্পনারই অংশ বলে মনে হয়েছে।


খবরের কাগজে এই যন্ত্রণাদায়ক সংবাদ প্রতিবেদনটি পড়েই ফোন করেছিলাম কয়েকজন বন্ধুকে। সবাই বললেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত। চিন্তার কোনও কারণ নেই। তাঁদের কথায় আমি আশ্বস্ত হয়েছি ঠিকই, তবু কয়েকটি কথা বলব। আমার মনে হয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে পথে নামতে হবে। আমরা যাঁরা বরাক উপত্যকার মানুষ, কিন্তু এই মুহূর্তে বাইরে থাকি, তাঁরা এ ধরনের খবর শুনলে অস্থির হয়ে ওঠেন। নাট্যকর্মী সুব্রত রায় ফেসবুকে বলেছেন, এই মুহূর্তে পথে না নামাই উচিত। তাঁর মতে, এতে উত্তেজনা বাড়তে পারে। তাঁর স্পষ্ট বিশ্বাস, বরাক উপত্যকার নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনটি অনেক বেশি শক্তিশালী। গুটিকয়েক সমাজবিরোধীরা একে বিনষ্ট করতে পারবে না। ওর এই কথা সাথে অনেকাংশে একমত হয়েও আমার ধারণা, পথে নামা উচিত। এই মুহূর্তে সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন যারা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের তীব্র বিরোধী, তাঁদের পথে নামতে হবে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্যেই। যাঁরা ভাবছেন গরু ছাগল শুয়োরের ঠ্যাং দেখিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন, তাদের দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে যে, বেশির ভাগ মানুষ এসব গরু ছাগল শুয়োরের সুড়সুড়িতে বশ হন না। অবিশ্বাস আর বিষের অপশক্তির চেয়ে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের মিছিল অনেক বেশি শক্তি ধরে।


শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৩

তেলেঙ্গানা-গোর্খাল্যান্ড-বোড়োল্যান্ড ও সতেরো আগস্ট

বাহাত্তরের পর থেকে সতেরো আগস্ট প্রতি বছর আসছে। আসছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে। শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তী যে মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন, সেখানে শহীদ দিবস পালন মানে ইতিহাসের চর্বিত চর্বন নয়। প্রতি বছর বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেখতে হবে শহীদের আত্মদানের ইতিহাসকে। দু‘টোকে যুক্ত করেই পালিত হবে শহীদ দিবস। এবার যখন সতেরো আগস্ট পালিত হবে তখন গোটা দেশের রাজনীতি মুখর হয়ে আছে ছোট রাজ্যের দাবিতে। আসামও আবার উত্তাল হয়ে উঠেছে বোড়োল্যান্ড ও কামতাপুরের দাবিতে। বরাক উপত্যকায় কেউ কেউ পৃথক বরাকের আওয়াজ নিয়ে আবার সক্রিয় হতে চাইছেন। অন্য কেউ কেউ বলছেন পৃথক অর্থনৈতিক পরিষদের কথা। দেশের নানা প্রান্তেই এখন নতুন নতুন রাজ্যের আওয়াজ। এমন একটি পরিস্থিতিতে যখন সতেরো আগস্ট পালিত হবে, তখন আমরা কী এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারব? বাচ্চু চক্রবর্তীর মতাদর্শই বলে, এই পরিস্থিতিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনার মধ্যে না রাখলে শহীদ দিবস পালন অর্থহীন হয়ে যাবে।
           

ছোট রাজ্যের দাবিদার সমস্ত আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, তাঁদের সংগ্রাম ভাষা-সংস্কৃতি-আত্মপরিচয় রক্ষার সংগ্রাম। শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীদের সংগ্রামও ছিল ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সংগ্রামই। বাচ্চু চক্রবর্তীর স্মরণ দিবস পালন করতে গিয়ে এই বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হবে। যদিও নীতি হিসাবে এই দাবিকে গ্রহণ করা একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল বিজেপি সবসময় ছোট রাজ্য গঠনের স্বপক্ষে থাকার যুক্তি হিসাবে প্রশাসনিক সুবিধার কথাই তুলে ধরেছে। কিন্তু এই দাবি নিয়ে যারা আন্দোলন সংগ্রাম করছেন, তাদের কারো কাছেই প্রশাসনিক সুবিধাটি কোনো বিষয়ই নয়। প্রত্যেকটি পক্ষই ছোট রাজ্য গঠনের সাথে ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের প্রশ্নকে যুক্ত করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই একটা প্রশ্ন করা যায়, সত্যিই কি ছোট রাজ্য গঠনের সাথে ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সম্পর্ক রয়েছে? ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সংগ্রাম এবং ছোট রাজ্যের দাবিতে লড়াই কি সত্যিই সমার্থক? তা ছাড়া, ভাষা-সংস্কৃতি-আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আন্দোলন লড়াইয়ে কি মিশে নেই আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার প্রশ্ন? আমরা দেখব, আত্মপরিচয়ের দাবির মধ্য দিয়ে মূলত আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার সমস্যাগুলিই প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভাষা সংস্কৃতি আত্মপরিচয়ের দোহাই দিয়ে বড় রাজ্য ভেঙে ছোট রাজ্য গড়ার ঘটনা কম ঘটেনি। প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে স্বাধীনতার পর থেকে যতগুলি ছোট রাজ্য গঠনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলি কি তার প্রার্থিত লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে? আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্ন কিংবা আত্মপরিচয়ের প্রশ্নই হোক, ছোট রাজ্যগুলির অবস্থা বড়ো রাজ্যগুলির চাইতে এখনও খুব একটা উন্নত নয়।  বেশিলভাগ ছোট রাজ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বপ্ন কিংবা ভাষা সংস্কৃতির উন্নতির স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। আজকের ঝাড়খন্ড বা ছত্তিশগড়ের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।


অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার সমস্যাগুলি মূলত রাজনৈতিক সমস্যা, যদিও তার মধ্যে গভীরতর অর্থে কতগুলি সাংস্কৃতিক প্রশ্নও যুক্ত হয়ে আছে। এই বিষয়ে লড়াই সংগ্রাম করার সময় শুধু রাজনৈতিক দিকটিকে গুরুত্ব প্রদান করলে যেমন লড়াইটি খঞ্জ হয়ে যায়, তেমনি রাজনীতি অর্থনীতির বৃহত্তর প্রশ্নটিকে খাটো করে গোটা সংগ্রামটিকে আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে পর্যবসিত করলেও লড়াইটি শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিকতার গহ্বরে হারিয়ে যায়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের দীর্ঘদিনের রোগটি হল এই যে সেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রশ্নগুলি যথাযথ গুরুত্ব পায় নি। রাজনীতি শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবাজীতে আটকে পড়ে। আবার গত কয়েক দশকে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের এই দুর্বলতাগুলির প্রত্যাখান হিসাবে যে লড়াই সংগ্রামগুলি আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে এই মুহূর্তে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রান্তে সেখানে রাজনীতি অর্থনীতির বৃহত্তর প্রশ্নগুলি প্রায় ব্রাত্যই। এমন কি সমস্যাগুলির বৈশ্বিক তাৎপর্যের দিকে নজর না দিয়ে সমস্ত কিছুকে এক ধরনের আঞ্চলিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতাই বেশি। এই আঞ্চলিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ফলাফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, এক জায়গার সংগ্রামরত জনগোষ্ঠী প্রায়শই অন্য আরেকটি স্থানের সংগ্রামরত মানুষের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন। এ ভাবেই কাবেরীর জলবন্টনের মত একটি সমস্যাও প্রতিবেশী দু’টি রাজ্যের মানুষকে সংঘাতের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। এভাবেই কখনো দার্জিলিং-এর গোর্খা হয়ে যায় কলকাতার বাঙালির প্রতিপক্ষ। কখনো গুয়াহাটির সাধারণ অসমীয়া হয়ে যান বরাকের সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ। কখনো আবার একই ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে বসবাস করা দুটি জনগোষ্ঠীর মানুষ পরস্পর পরস্পরের শত্রু হয়ে যান এবং গোষ্ঠীগত হিংসার জন্ম হয়। অনেকেই মনে করেন, সারা পৃথিবী জুড়ে ছোট ছোট পরিচয়ের দ্বীপে মানুষকে বন্দী করে ছোট ছোট সত্তার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেই বিপ্লবী সংগ্রামের একমাত্র রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার মধ্যে একটি নয়া উপনিবেশবাদী ছক রয়েছে। শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্যকে এ ভাবেই দুর্বল করতে চেয়েছে দেশে দেশে কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূরা। আমাদের দেশেও দেখব, কখনো মারাঠী সত্তা, কখনো গোর্খা আত্মপরিচয়, কখনো অসমীয়া জাতিসত্তা, কখনো তেলেঙ্গানার বঞ্চনা দূরীকরণ- এই সমস্ত প্রশ্নকে সামনে এনে শোষিত নিপীড়িত মানুষের ঐক্যে বিশ্বাসী বামপন্থীদের ওপরই প্রথম আঘাতটি সংঘটিত হয়েছে। এ কাজে রাষ্ট্রশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলি এক অদ্ভুত সখ্যে আবদ্ধ হয়েছে।


এরই মধ্যে আরেকটি মুশকিলের ব্যাপার হচ্ছে, বামপন্থীদের একটি অংশের ধারণা, ছোট ছোট রাজ্য গঠন ঐ সব অঞ্চলের সামগ্রিক পশ্চাদপদতা এবং বঞ্চনার দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে। এঁদের অনেকেই ছোট রাজ্যের দাবির বিরোধিতাকে শাসকশ্রেণির লেজুড়বৃত্তি বলেও অভিহিত করেন। এই আদর্শগত বিবেচনা থেকেই বামপন্থীদের ওই অংশগুলি একসময় পৃথক ছত্তিশগড় ও ঝাড়খ-ের প্রবল প্রবক্তা ছিলেন। এখনও তাঁদের ওই অংশ একইভাবে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের সোচ্চার সমর্থক। কিন্তু তাঁদের তরফে পৃথক ছত্তিশগড় এবং পৃথক ঝাড়খ- গঠন পরবর্তী অভিজ্ঞতার কোনো মূল্যায়ন চোখে পড়ে নি।
ছোট রাজ্য গঠনের যাঁরা বিরোধিতা করেন, তাঁদের অবস্থানটিও কখনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসাবে এই মুহূর্তে গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতায় সমগ্র পশ্চিমবাংলা জুড়ে যে বক্তব্যগুলি উপস্থিত করা হচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতা করতে গিয়ে দু’ধরনের বক্তব্য এই মুহূর্তে শোনা যাচ্ছে। প্রথম বক্তব্য, বাংলার অখ-তা বারবার বিপন্ন হয়েছে। আর কোনো অবস্থাতেই এই অখ-তাকে ধ্বংস করতে দেওয়া যায় না। দ্বিতীয় বক্তব্য, মাত্র সাড়ে তিনটি মহকুমা নিয়ে কোনো রাজ্য গঠিত হতে পারে না। তাই গোর্খাল্যান্ড এর দাবিকে মান্যতা উচিত নয়। আমার মতে, দুটি বক্তব্যই বিভ্রান্তিকর।


দার্জিলিং কখনোই অখ- বাংলার অংশ ছিল না। ব্রিটিশ শাসকদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্যেই একে বাংলার সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। যে সময়পর্বে এই সংযুক্তির ঘটনা ঘটে তখন থেকেই ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পৃথকত্বের দাবি উঠে আসছে। এই দাবি উত্থাপনের পেছনে ভাষা সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যই মুখ্য কারণ ছিল। দার্জিলিংকে ঘিরে বাংলা ভাগ হতে দেবো না গোছের সোচ্চার ধ্বনি যত উঠছে, ততই দার্জিলিং-এর মানুষ বিপন্নতা বোধ করেন নিজেদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে। এখানে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতা করতে হবে অনেক বেশি সংবেদনশীলতার সঙ্গে। ওই অঞ্চলের মানুষের সমব্যথী হয়ে তাঁদের সামনে তুলে ধরতে হবে পৃথকত্বের নিস্ফলতার কথা। আচার আচরণে বোঝাতে হবে যে ওই অঞ্চলের পশ্চাদপদতায় বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গের মানুষও একই ভাবে ক্ষুব্ধ। দ্বিতীয়ত, মাত্র সাড়ে তিন মহকুমা নিয়ে রাজ্য হয় না, যুক্তি হিসেবেও এটা অত্যন্ত দুর্বল যুক্তি। যে দেশে গোয়ার মত রাজ্য রয়েছে, সিকিমের মত রাজ্য রয়েছে, দিল্লির মত রাজ্য রয়েছে, সেখানে আয়তনের প্রশ্নে দার্জিলিং-এর দাবিকে প্রত্যাখান করা যায় না। বিরোধিতার স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে মানুষকে বলা উচিত যে, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে এই পথ সমস্যার কানাকড়ি সমাধান করতেও সক্ষম নয়। যে সমস্যায় দশকের পর দশক ধরে তাড়িত হয়ে মানুষ আলাদা রাজ্য চাইছেন, সেই সমস্যার যদি কিছুই না হয়, তবে শুধু শুধু একটি রাজ্য গঠনের কী সার্থকতা রয়েছে। আমার ধারণা বিরোধিতা করতে হলে, এমন একটি অবস্থান থেকেই করতে হবে। কোথাও একটি পৃথক রাজ্যের আওয়াজ উঠলেই তাকে সংবিধান বিরোধী, বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে নিন্দা করলে অনেক সময়েই সেখানকার মানুষকেই দূরে ঠেলা হবে।


সারা পৃথিবী জুড়েই এক ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং বিদ্বৎজনেরভ দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের তাত্ত্বিক চর্চা করে আসছেন, যেখানে অর্থনীতির প্রশ্ন, শ্রেণির প্রশ্নকে লঘু করে এবং সর্বোপরি শ্রমজীবী মানুষের বিশ্ববীক্ষাকে প্রত্যাখান করে আত্মপরিচয়ের সংগ্রামকেই সর্বরোগহর বিপ্লবী পন্থা হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বিশ্বায়নের হাত ধরে এই আন্তর্জাতিক রোগ আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চায় এবং প্রতিটি অঞ্চলের তথাকথিত বিকল্পের রাজনীতির কর্মসূচিতে স্থান করে নিয়েছে। ছোট ছোট জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে থাকা মানুষের মধ্যে পৃথকত্ব সম্পর্কিত মোহ সৃষ্টিতে এ ধরনের জ্ঞানচর্চার এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।


এবার দেখা যাক, বরাক উপত্যকার পৃথকত্বের দাবির দিকে। আমার মতে, বরাক উপত্যকায় পৃথকত্বের দাবি এখানকার মানুষকে নিশ্চিতভাবেই এক অভূতপূর্ব গৃহবিবাদের দিকে ঠেলে দেবে। বরাক উপত্যকার আধুনিক ইতিহাসটি অন্য অঞ্চলের মত নয়, একটু ব্যতিক্রমীই। অন্যত্র অঞ্চলগুলি পৃথকত্ব চায়, আর রাজ্য বা কেন্দ্র তা মানতে চায় না। বরাকে বিষয়টি উল্টো। বরাকে পৃথক হতে চাওয়াটা কখনোই গণদাবী ছিল না। যাঁরা পৃথকত্ব চান তাঁরা সবসময়েই এখানকার রাজনীতিতে ব্রাত্য। মজার কথা, বরাকের চেয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নানা মহল বিভিন্ন সময়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন বরাক উপত্যকাকে আসাম থেকে কেটে ফেলতে। ফলে আমরা দেখব বরাকের পৃথকত্বের বিষয়টি বরাক উপত্যকায় যতটা আলোচিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়, সেখানকার নানা  সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন সংগঠনের সভাসমিতির বক্তৃতায় ও প্রস্তাবাবলীতে। যখনই বরাক উপত্যকার মানুষ তাদের অধিকারের প্রশ্নে সংগ্রামমুখর হয়েছেন, তখনই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কোনো না কোনো সংবাদপত্রে নিবন্ধ বা চিঠিপত্র লিখে কেউ না কেউ বলেছেন, বরাককে আসাম থেকে আলাদা করে দেওয়া হোক। অন্যদিকে, বরাকে দীর্ঘদিন ধরে কিছু সংগঠন পৃথকত্বের দাবি জানালেও বরাকের মানুষ এই দাবিকে বলা যায় পাত্তাই দেন নি। এই দাবি নিয়ে অনেকে নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, কিন্তু কোনো নির্বাচনেই তাঁরা জামানত রাখাই দায় হয়েছে। বরাকের সাধারণ দাবি হচ্ছে, আসামের মধ্যে থেকে আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের ন্যায্য দাবির পূরণ। এ ছাড়াও মনে রাখা উচিত, হাজার বিবাদ বিসম্বাদ সত্ত্বেও বরাকে এখন পর্যন্ত কোনও তীব্র গৃহবিবাদ হয় নি। নানা অভাব অভিযোগ বঞ্চনা সত্ত্বেও এখানকার ভাষা ও সম্প্রদায়ের মানুষ সদ্ভাবে সম্প্রীতিতেই বসবাস করছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে পৃথকত্বের পথে হাঁটবে এ অঞ্চল নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ বিবাদ বিসম্বাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বরাককে পৃথক রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করলেই এখানেও নানা ভাষাগোষ্ঠী ও জনসম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হবে ক্ষমতা দখলের লড়াই। ক্ষমতার কেকটি কে খাবেন, উদ্বাস্তু বাঙালি না স্থানীয় বাঙালি, মনিপুরি না চা শ্রমিক সম্প্রদায় না অন্য কেউ- এ নিয়েও তখন শুরু হবে বিচ্ছিরি ধরনের বিভেদপন্থী রাজনীতি। বরাক উপত্যকায় সামাজিক শান্তি ও সৌহার্দ্যরে স্বার্থেই এখানে পৃথকত্বের দাবি দাওয়া নিয়ে রাজনীতি না করাই বাঞ্ছনীয়। আমাদের দাবি করা উচিত বৃহত্তর বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের। এই দাবি শুধুমাত্র বরাক উপত্যকার জন্যে নয়, সারা দেশেই যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রচলনের জন্যে কেন্দ্র থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে জেলা, জেলা থেকে গ্রামস্তর পর্যন্ত যথার্থ অর্থে বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।এরই সঙ্গে আমাদের অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের বিভিন্ন দাবিদাওয়াগুলি পূরণের দাবিতেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত অংশগ্রহণে জোরদার গণআন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।


বামপন্থীদের এই মুহূর্তে একটি বড় ভূমিকা পালনের প্রয়োজন রয়েছে। এই ভূমিকা পালন করতে হলে, বামপন্থীদেরও চিরাচরিত রণনীতি ও কৌশলের আবর্ত থেকে বেরিয়ে নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। আমরা দেশের নানা প্রান্তে দেখেছি, বিকাশমান বামপন্থী আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে কায়েমী স্বার্থান্বেষীরা বারবার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার ও ভাষা সংস্কৃতির প্রশ্নে জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তুলে শ্রেণি আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই দুর্বলতার পটভূমিতেই বামপন্থীরা নিজেদের শক্তি ধরে রাখতে না পেরে ওই অঞ্চলগুলির রাজনীতিতে প্রান্তিকায়িত হয়ে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে শুরু করে দার্জিলিং, মুম্বইয়ের শ্রমিক মহল্লা থেকে কৃষক আন্দোলনের দুর্জয় ঘাঁটি তেলেঙ্গানা, সর্বত্র আমরা একই ঘটনার সাক্ষী থেকেছি। এতদিন অবধি বামপন্থীদের নীতিগত অবস্থান ছিল যে, ভাষা সংস্কৃতি জাতিসত্তা ইত্যাদির প্রশ্নগুলি জীবনজীবিকার স্বার্থে গড়ে তোলা দুর্বার শ্রেণি আন্দোলন ও গণআন্দোলনের আঘাতে দুর্বল হয়ে পড়বে। বাস্তবে ঘটেছে ঠিক উল্টো। জাতিসত্তা ও ভাষাসংস্কৃতির প্রশ্নই শ্রেণি আন্দোলনকে দুর্বল ও কোণঠাসা করে দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হলে, বামপন্থীদের শুধু নীতিগতভাবে নয়, কর্মক্ষেত্রেও শ্রেণি আন্দোলনের সাথে ভাষা সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রশ্নগুলিকে যুক্ত করতে হবে। এই সমস্ত বিষয়কে একসাথে নিয়েই গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এভাবে সংগ্রাম গড়ে তুললেই সংঘাতের পরিবর্তে এক অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ অন্য অঞ্চলের সংগ্রামরত মানুষের সাথে এক লড়াকু মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হবে। শুধু শ্রেণি আন্দোলন দিয়ে এই কাজটি সমাধা করা অসম্ভব। আমরা অনেকেই এই মুহূর্তে লাতিন আমেরিকার বামপন্থার পুনর্জাগরন নিয়ে খুবই আলোড়িত। লাতিন আমেরিকার দিকে তাকালে দেখব, সেখানে যে নতুন বামপন্থা আত্মপ্রকাশ করছে, তার মূল বৈশিষ্ট্য শ্রেণি আন্দোলনের সাথে সামাজিক আন্দোলনের মৈত্রীবন্ধন। ভেনিজুয়েলা থেকে পেরু, ব্রাজিল থেকে ইকুয়েডর, সর্বত্রই যে বামপন্থী মুখচ্ছবিগুলি আমাদের এই অনুপ্রাণিত করছে, তাঁদের বেশিরভাগই সামাজিক আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসা ব্যক্তিত্ত্ব। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রামের যে বামধারা, তার সাথে রাজনৈতিক বামপন্থার ঐক্যই সেখানে পুনর্জাগরিত বামপন্থাকে এক নতুন ভাষা জুগিয়েছে। এই নতুন বামপন্থার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে সংস্কৃতির সংগ্রাম। এই নতুন বামপন্থা একই সঙ্গে স্থানীয় বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, আবার একই সঙ্গে মার্কিনী পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিকল্পে এক নতুন বিশ্ববীক্ষারও জন্ম দিচ্ছে। আমাদের দেশে জাতিসত্তার আন্দোলনগুলি যখন এক অঞ্চলকে অন্য অঞ্চলের প্রতিপক্ষ হিসাবে উপস্থিত করছে, লাতিন আমেরিকায় বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সংগ্রামগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক বৃহত্তর লাতিন আমেরিকীয় সত্তার নির্মানও করছে। আমাদেরকেও হাঁটতে হবে সেই পথে।



২০১৩ সালের শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তী স্মরণ অনুষ্ঠান সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়ের স্বপ্ন দেখতে যদি আমাদের প্রাণিত করতে পারে, তবেও বলতে পারব, আমরা সঠিক দিশায় আমাদের যাত্রারম্ভ করতে পেরেছি। নচেৎ এক প্রতিযোগিতামূলক আঞ্চলিকতাবাদের নীরব দর্শক হয়ে আমরা আমাদের স্বপ্নগুলির সমাধি রচিত হতে দেখব চোখের সামনে।

শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই



অনেকে বলেন পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ এলেই আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে আমরা শুধু ওই দুটো দিনে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি এটা সত্য নয়। আমার কাছে সমস্যাটা মনে হয় অন্য। এতগুলো বছর ধরে আমাদের জীবনের ওপর আলো ফেলছেন যে রবি, যিনি আবার প্রখরতাপে বটের ছায়াও দেন, তাঁর কাছে আমরা কী চাই তা কি আমরা জানি? কিংবা আমাদের তিনি যা দিয়েছেন এবং আমরা তাঁর কাছে যা চাই, তার মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে কি? পণ্ডিতেরা তাঁর রচনাবলীর সমস্ত প্রান্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাঁর সম্পর্কে আমাদের আলোকিত করেন। আমি সামান্য একজন গায়ক। গানের ভেতর দিয়েই তাঁর সাথে আমার প্রধানত সখ্য। শুধু তাঁর সাথে নয়, তাঁর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, নাটক, চিঠিপত্রের যে সামান্যটুকুতে আমার যাতায়াত হয়েছে, সেই যাতায়াতের পথেও তাঁর গানই আমাকে আলো জুগিয়েছে। এই ছোট্ট পরিসরে যা বলব, তা তাঁর গানের সুরের পথিক হিসেবেই বলব। পথিক শব্দটা বলতে গিয়েও একটু বাঁধল। একটা ন্যূনতম জীবন-পর্যটন না হলে বোধহয় কাউকে পথিক বলা সঙ্গত নয়। এটা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অনুভবেও আমরা জেনেছি, আবার একটি ইংরেজি গানের বাংলা ভাবান্তর করতে গিয়ে আমাদের সম্প্রতি সময়ের এক কবিয়াল বলেছেন, কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়! সম্প্রতি একটি কবিতায় পড়লাম একটি অবিস্মরণীয় পংক্তি, হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে পথ হয়ে গেছি। কবি কী অর্থে বলেছেন এই কথা জানি না। পথ হাঁটার ক্লান্তিতে, নাকি পথ হারানোর ভ্রান্তিতে, নাকি দীর্ঘ পথযাত্রার পরিশেষে পথের সমার্থক হয়ে উঠেছেন আমাদের আদর্শ পথিক, জানি না। সে অর্থে নিজেকে পথিক বলে অভিহিত করব না, করব পথচারী হিসেবে। পথচারীও হয়ত পথিকের মত পথের সাধনা না থাকলেও পথের নেশায় আকুল হয়ে ওঠেন কখনো কখনো। এই নেশার আলো থেকেই বলব কয়েকটি কথা।


রবীন্দ্রনাথকে আমরা তাঁর সমগ্রতায় বিচার করেছি কি? বোধহয় নয়। আমরা সবসময়ই আমাদের খণ্ড সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের খণ্ডিত জীবনবোধের দ্বারা আমাদের তাৎক্ষণিক চাওয়া পাওয়ার নিরিখে তাঁকে বিচার করতে চেয়েছি। স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলিতে, যখনও রবীন্দ্রনাথের শিল্পকীর্তি জনসাধারণ্যে এতটা চর্চিত ছিল না, তখন আমাদের জাতীয় নেতারা চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের সেই সময়ের চাওয়া পাওয়ার নিরিখে পেতে, তাঁর সৃষ্টিকে গ্রহণ করতে। তখন আমাদের কাছে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল রবীন্দ্রনাথের পররাজ্যগ্রাস বিরোধী স্বাধীনতাস্পৃহা উদ্রেককারী উচ্চারণগুলি এবং তাঁর সে ধরনের শিল্পসৃষ্টিগুলিকে বিবেচনার মধ্যে আনার। সেই সময়ে তাঁর যে সৃষ্টিকেই মনে হয়েছে তাঁদের সেই চাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাকেই তাঁরা এবং তাঁদের অনুবর্তী হয়ে আমরা বর্জন করেছি। আবার পরবর্তীতে যখন আমাদের খণ্ড সময়ের প্রয়োজনে মনে হয়েছে নানা পরিচয়ে বিভক্ত সমাজের উর্ধে উঠে একটি বহুত্বের আদর্শকে তুলে ধরার, তখন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীনতাকে, তাঁর ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ-এ উত্তরণের বার্তাগুলিকে আমরা খুঁজে নিয়েছি। রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করার এমন প্রয়োজনভিত্তিক চর্চা থেকেই কখনো ‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ কথাটি মন্ত্র হয়েছে, কখনো ‘যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে/ ভাঙো ভাঙো আজ ভাঙো তারে নিঃশেষে’ আমাদের অস্ত্র হয়েছে। কিংবা ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। কেউ বলবেন এই পাওয়াগুলিও পাওয়া এবং মহার্ঘ পাওয়া। সময়ের প্রয়োজনে যিনি পাশে এসে দাঁড়ান তিনিই তো পান্থজনের সখা। এ ভাবেই তো তাঁকে আমরা সহ-পথিক করে নিই। তবে আর অভিযোগ কীসের! প্রশ্ন জাগে মনে, তবে কী ‘দিনের প্রয়োজনের’ রসদের বাইরে আর যা কিছু রবীন্দ্রনাথের, সবই আমাদের জন্যে বিবেচনায় অপাংক্তেয় হয়ে থাকবে?


অন্যভাবে দেখলে, হয়ত দেখব, আমরা আসলে আমাদের নানা প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের প্রয়োজনের আসরে আমন্ত্রণ জানিয়েছি মাত্র, তাঁর কাছে আমরা এগিয়ে যাই নি। তিনি যেমন তাঁর ঈশ্বরকে বলেন, ‘আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায় তুমি ছিলে আমার কাছে/ আমি তোমার কাছে যাই নি’। হয়ত এটাই সত্যি, আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে যাই নি। তাঁকে আমরা ডেকে এনেছি আমাদের সমস্ত দৈনন্দিন বাঁচামরায়। এ ভাবে তাঁকে পেয়েই ভেবেছি আমাদের পাওয়া যথেষ্ট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জীবনকে বা দেবতার রূপকল্পে জীবনদেবতাকে এই দৈনন্দিন চাওয়া পাওয়ার গণ্ডীর ভেতরে সীমিত করে রাখতে চান নি। তাঁর জীবনদেবতাকে তিনি বলেছেন, ‘সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে/ এসেছি সকল চাওয়ার বাহির দেশে/ নেব আজ অসীমধারার তীরে এসে/ প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে’। আসলে আমাদের জীবনসাধনা, প্রকৃতিসাধনা, এমন কি রবীন্দ্রসাধনা-সবই প্রয়োজনের গণ্ডীতে বাঁধা। সে জন্যেই সেই তাৎক্ষণিক চাওয়ার দাবি পূরণ করতে গিয়ে আমরা হিরোসিমা তৈরি করি, উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় তৈরি করি, তৈরি করি উগ্র জাতিভাবনা বা সম্প্রদায়ভাবনাকেও। এমন কী ঈশ্বরবিশ্বাসীর ধর্মসাধনাও কখনো তাৎক্ষণিক জাগতিক চাওয়া পাওয়াকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। জীবনের প্রতি এমন একটি দৃষ্টিকোণ আমাদেরকে সমগ্রের সমীপবর্তী হতে দেয় না। আমাদের ভালো-মন্দ বিবেচনা আমাদের হিত-অহিত বোধ সবই স্থান এবং কালের নিরিখে ক্ষুদ্রতার ঘেরাটোপে বন্দী। সাধারণভাবে একটি মানুষের জীবন স্থান এবং কালের নিরিখে সংকীর্ণ পরিসীমাতেই বাঁধা থাকে। বাঁধা থাকে ব্যক্তির জন্ম এবং মৃত্যু দিয়ে ঘেরা পরিসরে। কিন্তু ব্যক্তিকে যখন মানবপ্রবাহ বা জীবনপ্রবাহের অঙ্গ হিসেবে দেখব, তখন সে অসীমের সন্তান। তখন এই গ্রহ-তারা-মহাকাশের, এই পৃথিবীর, এই সভ্যতার ভালো-মন্দ হিত-অহিত একজন ব্যক্তির বোধির অবিভাজ্য অংশ হয়ে ওঠে।


একজন প্রকৃত দার্শনিক, কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাধক, বিপ্লবী- এই বোধিতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। দূর এবং নিকট, ক্ষণকাল এবং চিরকালের মধ্যে সেতুরচনার আর্তিতেই বেজে ওঠে তাঁদের জীবনবীণা। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা কখনোই সমকাল কিংবা প্রতিবেশ সম্পর্কে উদাসীন থাকেন না। আবার দৈনন্দিনের নেশায়ও অন্ধ হন না। দৈনন্দিনের চাওয়া-পাওয়াকে বৃহত্তর অর্জনের বা মহত্তর প্রত্যাশার সাথে একাত্ম করে নেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধও তাই। সে জন্যেই তিনি যখন ‘ঘরে-বাইরে’ রচনা করেন, তখন তাঁর সামনে দেশের স্বাধীনতা-স্পৃহাটিই একমাত্র সত্য নয়, তার চেয়েও বড়ো কিছু সভ্যতার সত্যের দায় পূরণ করেই তিনি দেশের দায় মেটানোর কথা ভাবেন। যাদের চেতনার তার ‘কাছের সুরে বাঁধা’, তারা তাঁর ওই সৃষ্টির গভীরে যে ‘দূরের বাঁশি’ বাজে তা শুনতে পান না। এমনকি দেশপ্রেমও তাঁর কাছে নিছক স্বদেশবাজী নয়। প্রথমত, দেশ তাঁর কাছে কোনো রাষ্ট্র বা কাঠামোর চেহারায় আসে না, আসে দেশের অঙ্গাঙ্গী অংশ সাধারণ মানুষ ও প্রকৃতির সহজাত প্রকাশের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ কখনোই দেশপ্রেমকে বিদেশ-বিদ্বেষের চেহারায় হাজির করেন নি। তিনি দেশের মাটির ’পরে মাথা ঠেকাতে চান এ জন্যেই কারণ তাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা আছে। তাঁর সমসময়ের একজন কবি যখন স্বদেশকে সকল দেশের রাণী হিসেবে তুলে ধরে তার বন্দনা করতে চান, তখন রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ আটপৌরে ঘরের জননী। সে জন্যেই সমকালীন কবির সেই রাণীতত্ত্বকে প্রত্যাখান করে ঘরের মা’কে বরণ করতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, জানি নে তোর ধনরতন আছে কী না রাণীর মতন/শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে। ভিখারিণী মায়ের শতচ্ছিন্ন নোংরা আঁচলেও তার নিজের শিশু যে পরম আশ্রয় খুঁজে পায়, সেখানেই, সেই সাধারণ্যেই রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছেন দেশকে। তাঁর স্বদেশকে তাই রাণীর অবয়বে পাই না, পাই আমাদের প্রতিদিনের ঘরের মায়ের ¯স্নেহদৃষ্টিতে। উগ্র জাতীয়তাবাদী উল্লাস ব্যক্ত করার প্রহরে স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের এমন উচ্চারণ অ-প্রাসঙ্গিকই মনে হয়েছে আমাদের। আবার অন্যদিকে এটাও সত্য, দেশ থেকে ব্রিটিশ চলে গেলেও রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার গান বা স্বদেশভাবনা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না। আমাদের অন্যান্য স্বদেশচেতনার গানের বর্তমান পরিণতির নিরিখে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের গান ওই গানগুলির মত শুধুমাত্র পনেরো আগস্ট আর ছাব্বিশে জানুয়ারিতে বন্দী হয় নি।


রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরবিষয়ক গানগুলি যত শুনি, যত পড়ি, যত গাই, নতুন নতুন উপলব্ধি জন্মায়। মাঝে মাঝেই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরবিষয়ক গানের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এই গানগুলিকে কোনোভাবেই ধর্মচর্চার অঙ্গ বলেও মনে হয় না। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ধর্ম কথাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক বা সংগঠিত ধর্ম হিসেবে দেখেই বলছি। রবীন্দ্রনাথের গানগুলি একান্তভাবেই একটি ব্যক্তিগত সংলাপ, কোনো সঙ্ঘসঙ্গীত নয়। আমি জানি না, লোকায়ত ধর্মের গভীর থেকে যে গানগুলি সৃষ্ট হয়েছে, সেগুলিকে আপাতত আলোচনার বাইরে রেখে, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া নাগরিক বা আধা-নাগরিক আর কোনো ঈশ্বরবিষয়ক সঙ্গীত বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সকলের এত প্রাণের গান হয়ে ওঠে কি না। এটা কেন? রবীন্দ্রনাথের গানের এই প্রাণময়তা কি শুধুই এর কাব্যগুণের জন্যে বা সঙ্গীতগুণের জন্যে? নাকি অন্য কোনও সত্যও নিহিত আছে এতে? একটি অন্য কথা মাঝে মাঝেই মনে হয়। মানুষের সমাজে বা মনোজগতে ঈশ্বরের উদভাস এসেছে ধর্মের জন্মের অনেক আগেই। জগৎ-জীবন সম্পর্কিত তার বিস্ময়বোধ, তার অন্তহীন জিজ্ঞাসাকে ঘিরে জন্ম নেওয়া তার নিজের সাথে সংলাপকে যে প্রতিকল্পে সে ব্যক্ত করেছে, সেই তার ঈশ্বর। সেই ঈশ্বর তার দূরের স্বপ্ন, কাছের বন্ধু। ধর্ম এসে তার এই কাছের ঈশ্বরকে ছিনিয়ে নিয়ে স্থাপন করেছে দুর্লঙ্ঘ উচ্চতায়। তাকে ঘিরে তৈরি করেছে অসংখ্য আচার আর সংহিতা। তৈরি হয়েছে নিষেধের প্রাচীর। আমার কখনো মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গানের ঈশ্বর ধর্মকারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে যান তাঁর সেই আদিকল্পে, যার সাথে মানুষের হয়েছিল সভ্যতার প্রথম সংলাপ। সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরকে ঘিরে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলের এমন প্রাণবন্ত সংলাপ জমে ওঠে। আচারসর্বস্বতার বাইরে আমাদের লোকায়ত ধর্মের যে ঈশ্বর তার বাসও প্রায় সেখানেই। প্রায় বললাম এ জন্যেই লোকায়ত গানের যেখানে আচারধর্ম আর বিচারধর্মের সংঘর্ষের চিহ্ন রয়েছে, সেখানে আচারসর্বস্ব ধর্মের গভীরে অন্তর্ঘাত করতে গিয়ে বিচারধর্ম কখনো কখনো কতগুলি ছদ্মবেশ ধারণ করে, যাকে প্রকৃত চেহারায় না চিনলে ভ্রম হতে পারে। এই ভ্রম শুধু বাইরের শ্রোতার কাছে নয়, যাঁরা এই অন্দরের সাধক তাঁদেরও বিভ্রান্ত করে।


কবির কবিতায় যেমন শব্দ শব্দার্থের শেকল ছিঁড়ে ভাবার্থের দিকে পা বাড়িয়ে এক মায়ালোক তৈরি করে, রবীন্দ্রনাথের গান, নাটক, নিবন্ধেও তেমনি ঘটে। শব্দার্থে তার সবটা ধরা পড়ে না। শব্দার্থের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যদি আমরা তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকাই, তবে দেখব তাঁর গান নাটক চিঠিপত্র গদ্য ছবি সবকিছুর মধ্যে একটি অচ্ছেদ্য সূত্র রয়েছে। প্রেমের গান, পুজার গান, দেশের গান, প্রকৃতির গান এ ধরনের জলবিভাজন রেখা দিয়ে যেমন তাঁর গানকে বিভাজিত করা যায় না। সবগুলো একে অপরের সাথে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। তেমনি সব মিলিয়ে তাঁর সৃষ্টি যেন এক জীবন-বেদ। এর কেন্দ্রে তাঁর সামগ্রিক জীবনবোধ। এই জীবনবোধের প্রকাশকে খণ্ড খণ্ড করে তুলে এনে নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার করাটাই আমার বিবেচনায় আমাদের এতদিনকার সাধারণ রবীন্দ্রচর্চার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে। জগৎ-সংসারের যে কোনো বিষয় নিয়ে বক্তৃতা দিতে উঠে একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা প্রবন্ধের উদ্ধৃতি না থাকলে বাঙালি বুদ্ধিজীবী থেকে রাজনৈতিক নেতা নেত্রী কারোরই যেন ঠিক জাতে ওঠা হয় না। বিবাহ-বার্ষিকী থেকে ছেলের জন্মদিন, প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন- এখানেও চাই রবীন্দ্রনাথের এক আধটা পংক্তি। আর আমাদের শ্লাঘা ঝরে পড়ে এমনতর সংলাপে, জীবনের একটিও ক্ষেত্র নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছু বলে যান নি। আমাদের এমনতর রবীন্দ্রচর্চাতেই চারপাশ সদাসর্বদা সরগরম। এই খণ্ডিত চর্চা শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে আটকে নেই। মে দিবস থেকে শ্রীশ্রী ঠাকুরের জন্মদিন অবধি এমন কোনোদিন নেই যেদিন আমরা রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করি নি। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে মনে পড়ে তাঁর গানেরই লাইন, তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল/সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল।



এই হলাহল আর কোলাহল ছেড়ে কবে এক ভিন্নতর রবীন্দ্রচর্চায় আমরা রত হব তারই পথ চেয়ে আপাতত থাকতে হবে।

বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

অন্য চলা


পঁচিশে বৈশাখের সকালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজবাটির মাঠের প্রভাতী অনুষ্ঠানে মঞ্চের পাশে হাঁটাহাঁটি করছি প্রতিবারের মত। প্রতিবারের মতই ওদিকে টাউন হলের মাঠের অনুষ্ঠান থেকে ঘনঘন ফোনে তাগাদা, কখন আসছ? প্রতিবারই বর্ধমানের সকালের অনুষ্ঠান সেরে কলকাতায় যাই, বিকেলের দিকে কিছু না কিছু থাকে।


হঠাৎ-ই মোবাইলে ম্যাসেজ শিলচর থেকে, ‘জোড়াসাঁকো থেকে সরাসরি সম্প্রচারে দেখছি তোমার এক বন্ধু গাইছে। তুমিও কি ওখানেই?` আমি উত্তর দিই, ‘ওই অনুষ্ঠানগুলোতে তারকা-শিল্পীরা গান করেন। আমার ওই বন্ধু তারকা, তাই বলে আমি তো আর তারকা নই। পঁচিশে বৈশাখে আমি আমার মাপের অনুষ্ঠানেই ব্যস্ত আছি। যেমনটা প্রতি বছর ঘটে।` শিলচরের বন্ধু তারপরও একটা উত্তর দিয়েছিল, সেটা মনে খুব একটা প্রবেশ করল না। আমি ডুবে গেলাম অন্য ভাবনায়, ওর ম্যাসেজের উত্তরে পাঠানো আমার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গী হয়ে।


তারকা হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই, এটা আমার জানা। থাকলেও কি আমি ওই পথ নিতাম? আমি তো নিজেই বেছে নিয়েছি আমার পথ। যে পথ বিনোদন-শিল্পীর নয়, তারকার নয়, সে পথ কর্মীর পথ। আমার কাজ বিনোদন নয়, বার্তাবহনের। গান আমার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বড়ো হওয়া আমার পথ নয়। আমার স্বপ্ন, ব্যাপ্ত হওয়া, গভীরে নিহিত হওয়া। সমস্ত অন্ধকার রাতের পর একটি শুভ্রসকাল নিশ্চিত রয়েছে আগামীতে, এই প্রত্যয়ের কথাটি বলতে চাই গানে গানে। বলতে চাই ভালোবাসার কথা, ভালোবাসাবাসির কথা। বাজারকে আমি এড়াতে চাই না, চাই পেরিয়ে যেতে। ঠিক যেমন একজন বিপ্লববিশ্বাসী রাজনৈতিককর্মী মোহমুগ্ধ না হয়ে পার্লামেন্টে যায়, সেভাবেই বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে আমি চাই আমার প্রবেশ ও প্রস্থান। পেজ থ্রি, ছোট পর্দা, জনচিত্তজয়- আমার অভীষ্ট হতে পারে না। আমার দেবতা হতে পারে না। আমার গন্তব্য হতে পারে না। হতে পারে খুব বেশি হলে আমার দীর্ঘচলার এক যাত্রাবিরতি বিন্দু। আমার পথ আলাদা। ‘আমার পথ আলাদা‘ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে উঠে আসে অন্য আশঙ্কা মনে। আমি কী অজান্তে এক হীনমন্যতার শিকার? হঠাৎ কানের কাছে প্রথমে বেজে অসংখ্য মানুষের করতালি, আর তারপরই খানিক নিস্তব্ধতার পর চোখের সামনে ভাসে কোনও মুগ্ধ চোখের কোণ থেকে ঝরা দু‘ফোটা অশ্রু। না, করতালি না। ওই দু‘ফোটা অশ্রুই আমার দেবতা।


অ্যাক্টিভিস্ট। কথাটার তেমন বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তার মানে, বাংলায় কি অ্যাক্টিভিজম বিষয়টি এতটা চর্চিত নয়? কিন্তু বাংলাই তো শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে জনকল্লোলের স্পন্দন এনেছিল। আমি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী। কথাটায় সবটা বলা হয় না। বললেই ধারণা হবে, আমার কাজ শুধু পথসভায় ও জনসভায় গেয়ে বেড়ানো। দলীয় কর্মসূচির বৃত্তে ঘুরে বেড়ানোই বুঝি শুধু রাজনীতি! যখন ছোট পর্দায় বা সাধারণ অনুষ্ঠানমঞ্চে রবীন্দ্রনাথের একটি গান ধরি, তখনও তো আমি অ্যাক্টিভিস্ট। আমার দায়বদ্ধতা শুধু সমকালে নয়, চিরকালের কাছেও। সমকাল মানে আমার কাছে ২০১০, ১১, ১২, ১৩ এমনটা নয়। আমার জন্ম থেকে আমার মৃত্যু অবধি ব্যাপ্ত সময় আমার সমকাল। ১০, ১১, ১২-কে বলব ক্ষণকাল, যদিও সে আমার সমকালেরই অঙ্গ। ঠিক যেমন আমার সমকাল চিরকালের সন্তান। সে জন্যেই আমার দায়বদ্ধতা যেমনি ক্ষণকালে, তেমনি সেখান থেকে সমকালে এবং সবশেষে চিরকালে। আমার গানেও চাই ক্ষণকালের সাথে বেজে উঠুক সমকালের উদ্ভাস। সমকালে প্রতিধ্বণিত হোক চিরকালের মর্মবাণী।


এমন করে কোনও ভাবনা স্রোতে যখনই ভেসে যেতে থাকি, ডুবে যেতে থাকি, তখনই ভেতরে রিনরিনিয়ে ওঠে কোনও না কোন গান। ভাবতে থাকি, বহিরঙ্গ নয়, অন্তরঙ্গেই চাই আশ্রয়। কে যেন গায়, কার ‘বারতা‘ যেন আমার ভাষায় কথা বলতে চায়। গানের তানে লুকিয়ে তারে, কে যেন বার্তা পাঠায়! ‘আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু/ গন্ধভরে তন্দ্রাহারা‘। একজন অ্যাক্টিভিস্টের চলা কখনোই নদীর মত উদ্দাম নয়। পাগলপারা নয়। মৃগনাভীর গন্ধে আপনহারা নার্সিসিস্ট নয় সে। একজন প্রকৃত অ্যাক্টিভিস্ট বলতে পারে, ‘আমি সদা অচল থাকি/গভীর চলা গোপন রাখি/ আমার চলা নবীন পাতায়/ আমার চলা ফুলের ধারা‘। ওরা ভিন্ন গোত্র, যারা নদীর মত। যারা চলার বেগে পাগলপারা। পথে বেরিয়ে আপনহারা। আর যিনি অ্যাক্টিভিস্ট, তাঁর তৃপ্তি ভিন্ন, আনন্দ আলাদা। বহিরঙ্গের আলোর ভাষায় তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত বলা যায় না। সে বলে, ‘আমার চলা যায় না বলা/ আলোর পানে প্রাণের চলা/ আকাশ বোঝে আনন্দ তার/ বোঝে নিশার নীরব তারা‘।


আশৈশব শোনা গান। ছোটবেলায় যে কোনো প্রতিযোগিতায় অসম্পূর্ণ কন্ঠপ্রস্তুতি ও তার সাথে তরলতম তবলাসঙ্গতে অসংখ্যবার শুনেছি এই গান। খেমটা তালে কেমন নেচে নেচে দুলে দুলে গাইত এ গান কত শিশু। গোটা গানজুড়ে থাকত আপনহারা পাগলপারা লয় ও দুলুনি। হঠাৎই পঁচিশে বৈশাখের সকালে এই গান থেকে সমস্ত পূর্ব অভিজ্ঞতা উবে গেল কর্পূরের মত। সমস্ত চপলতা, সমস্ত অস্থিরতা, আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার অশ্লীল কাঙালপনার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে কে যেন নিভৃতে আত্মঘোষণা করে, ‘আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু..../‘, ‘আমি সদা অচল থাকি/ গভীর চলা গোপন রাখি...‘, ‘আমার চলা যায় না বলা...‘।


চোখের কোণে জমে ওঠে একটুখানি জলের রেখা, ঠোঁটের কোণে জেগে ওঠে গভীর আনন্দানুভূতির এক চিলতে হাসি, একান্তেই।
সারাটা দিন আজ শুধু এই গানেরই...।

সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৩

সুদীপ্ত নিমিত্ত মাত্র!


সারদা নামক বেলুনটি চুপসে গেছে। তারই হাত ধরে কারো কারো রাজনীতির নটেগাছটিও মুড়োতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। অন্তত, সততা ত্যাগ গরিবের প্রতি দরদের যে মুখোসটা ছিল তা ভেঙে পড়ছে, দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের মত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা, যারা পূর্বাভাস করেছিলেন, মোহভঙ্গটা শুধু সময়ের অপেক্ষা, ষোলো অব্দি গড়াবে না, তারা উৎফুল্ল। রাজ্যের রাহুমুক্তির দিন বুঝি ঘনিয়ে এলো। যারা রাহুমুক্তি ঘটাবেন, তারা নিজেরা কতটা অগ্নিশুদ্ধি সমাপন করেছেন, সেটা এখন আলোচনার কেন্দ্রে নেই। যারা তখ্ত আলো করে আছেন এই মুহূর্তে, তাদের অনেকের মনেই দিনান্তের আকাশ উঁকি মারছে। যারা মার খেয়ে তাড়া খেয়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা একটা সকালকে যেন খুব কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছেন। হয়ত কথাগুলি অসত্য নয়, বাস্তব হয়ত এমনই দিকে মোড় নিচ্ছে। একের পর এক নেতা কর্মী জড়াচ্ছেন জালে। নিঃস্ব মানুষের কান্নায় ভরে উঠছে আকাশ বাতাস। মিছিলে মিটিং-এ আবার স্বতস্ফূর্ত মানুষের সমাগম দেখা যাচ্ছে। সবই সত্যি! কিন্তু একজন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে আমার মনের ভেতর আরো কতগুলো কথা জাগে, এখনকার ঘটনাবলীকে আরো এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখি। ট্রেনে বাসে মানুষের কথাবার্তায় দূরস্থান কিংবা বাণিজ্যিক মিডিয়ার টান টান উত্তেজনার সংবাদ ও গরমাগরম আলোচনা বিতর্কের আসরে হয়ত এটার প্রতিফলন আশা করে লাভ নেই, কিন্তু বামপন্থীদের বক্তৃতা, আলোচনা, শ্লোগানে, মিছিলেও সেই কথাগুলি এখনও জোরালোভাবে ভাষা পেল না, সেটাই একটুখানি অবাক করা।


আমার অনেক দিন থেকেই মনে হচ্ছে, পশ্চিমবাংলায় রাজনীতি থেকে রাজনীতিকে বর্জন করে শুধুমাত্র কতগুলো গা-গরম করা সংবাদ, কেউ-কারো-কথা-না-শোনা তর্ক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা কুতর্ক - এগুলো দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে রাজনীতিটা যেন মমতা আর সিপিএম-এর দ্বৈরথ। কবে কোন আলোচনায় মমতা একটু কোণঠাসা হলেন, কবে আবার সিপিএম নেতারা হঠাৎ কোনও ঘটনার সূত্রে একটু বেকায়দায়, বা কিঞ্চিৎ আমতা আমতা করছেন, সেটাই এখন সংবাদ, সেটাই এখন সব আলোচনার কেন্দ্রে। অর্থনীতি, রাজনীতির যে বৃহত্তর বিষয় এবং তার নিরিখে বিভিন্ন দল ও নেত্রানেত্রীর অবস্থান, এই আলোচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। যে সমস্ত নেতা বা আলোচকরা একটু ধীর-স্থির বা উচ্চকন্ঠে কথা বলতে পছন্দ করেন না, তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই এই ছোট পর্দার আলোচনা নামক চেঁচামেচির আসরগুলিতে পার্সনা ননগ্রাটা। এখানে তারাই আসেন, যারা প্রতিদিন আসেন। শিল্পী আক্রান্ত হলে যে প্যানেল, চিটফা- কেলেঙ্কারিতেও একই প্যানেল। সন্ধে হলেই তারা গলা সেধে হাজির হন। সবার একেকটা পক্ষ নির্দিষ্ট রয়েছে। যাই ঘটুক না কেন, সকলে যার যার নির্দিষ্ট পক্ষের হয়ে গলা ছেড়ে সাফাই গাইবেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা কোনও আলোচনার অনুষ্ঠান নয়, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলার সরাসরি সম্প্রচার। যাঁরা একটু অন্যরকম, ধীরে কথা বলেন, চাতুরি নয়, হৃদয় থেকে বলতে পছন্দ করেন, কখনো হয়ত একটি পক্ষের প্রতি দায়বদ্ধতা সত্ত্বেও একটু অন্যভাবে কথা বলতে চান, তারা এখানে ব্রাত্য। সবসময়ই একটা ডু অর ডাই ব্যাটল। ফলেই সন্ধে হলেই টান টান উত্তেজনা, একেক দিন একেকটি পর্দাফাঁস এবং তৎসঙ্গে গলাবাজী!


এখন মিডিয়া গরম সুদীপ্ত-দেবযানী নিয়ে। কোন্ চিঠিতে কার দিকে অঙ্গুলি নির্দিষ্ট হচ্ছে, ফলে কারা ল্যাজে-গোবরে হচ্ছে থেকে শুরু করে আজ দেবযানী চা খেলেন, না পিৎজা খেলেন, এই সমস্তই আলোচনার বিষয়। একটি সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে, দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে দেবযানীর দাঁত ঠিকঠাক করা হলেও এখনও হাতে মুখ দিয়ে কথা বলার আশৈশব মুদ্রাদোষ দেবযানীর যায় নি। যেন একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য একটু একটু করে বলা হচ্ছে। ছবির হিরো সুদীপ্ত, প্রধান নায়িকা দেবযানী। জেমস বন্ডের মত নায়িকা আরো অনেক। ললিতা পাওয়ার, জীবন, প্রেম চোপড়া, প্রেমনাথের ভূমিকায় রাজ্যের শাসক দলের কেষ্টবিষ্টুরা। কেলেঙ্কারি ফাঁস হচ্ছে!


সুদিন এল বলে! বামপন্থীদের জন্যে বিষয়টা কী এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে? কিংবা সাধারণ মানুষ কি শুধু একটি চলচ্চিত্রের দর্শক হয়েই থাকবেন? নাকি আরো বৃহত্তর ও গভীরতর সমাজসত্য সম্পর্কে তাঁদের ওয়াকিবহাল হওয়াটা তাদের জন্যে এখন জরুরি। মিডিয়ার পর্দায় আর পাতায় যে ভাষায় কিংবা বাস্তবতার যে উপরিতলের চর্চার মধ্যে দিয়ে আজকের সর্বনাশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বামপন্থীদের মিটিং মিছিল কি সেই সুরেই বাঁধা থাকবে শুধু? যে বৃহত্তর ও গভীরতর সমাজসত্যটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, সে সম্পর্কে বামপন্থীরা ছাড়া আর কে মানুষকে সচেতন করবে!


এটা সত্য ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আসার পর পশ্চিমবাংলায় সরকারি ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং সরকারি প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সজ্ঞানে বেসরকারি চিটিংবাজ অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলিকে গরিবের টাকা লুঠ করতে দেওয়া হয়েছে। দল হিসেবে তৃণমূল এবং নেত্রী হিসেবে মমতা এই সর্বনাশের জন্যে সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু যে সর্বনাশা অর্থনৈতিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে এ ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি গরিবের ধন হরণ করার সুযোগ পায় তাকে ভুলে গেলে চলবে না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৯১ সাল থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে আর্থিক উদারীকরণের নীতি ভারতে চালু করেছে, সেই নীতির প্রতি আস্থাপ্রকাশে কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে চরিত্রগত দিক থেকে বিশেষ ফারাক নেই। কেউ একটু ধীরে চান, কেউ চান দ্রুত, এই যা তফাৎ। দেশের আর্থিক কাঠামোর বড়লোকমুখী এই উদারীকরণের নীতি নিয়ে তারা দু‘দলই গদগদ। আমরা এটা জানি, নয়া উদারনীতির লক্ষ্যই হচ্ছে, বুনিয়াদি শিল্পে বিনিয়োগের চাইতে শেয়ার বাজারে তরল বিনিয়োগে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোমড় ভেঙে দিয়ে বেসরকারি ফাটকাবাজদের উৎসাহিত করা। নয়া উদারবাদ চায়, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের টাকা যাক শেয়ার বাজারে এবং গরিবের টাকা ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প ছেড়ে চিট ফান্ড বা অন্য চটজলদি লাভের মরীচিকা দেখানো প্রতিষ্ঠানের দিকে ছুটুক। এই লক্ষ্য নিয়েই দিনের পর দিন, কি কংগ্রেস কি বিজেপি, সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিরাষ্ট্রীয়করণ করতে চেয়েছে। অলাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেচে দেওয়ার আওয়াজ দিয়ে শুরু করে শেষ পর্যন্ত জোর দিয়েছে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে জলের দরে বেচে দিতে। ব্যাঙ্ক বীমা থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের স্পর্শকাতর পরিসরগুলিতে দেশি বিদেশি বেসরকারি পুঁজিকে ঢালাও আমন্ত্রণ জানিয়েছে। গ্রামে শহরে ফাটকাবাজদের রমরমার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে।

এই নীতির নিষ্ঠাবান প্রয়োগের জন্যেই আজ সারদাদের উত্থান ও গরিবের এই দুরবস্থা। এখন পর্যন্ত যে দুরবস্থাকে ঠেকিয়ে যাওয়া গিয়েছিল, তা প্রধানত বামপন্থীদের জন্যেই। কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছিলাম মার্কিন মুলুক সহ বেশিরভাগ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শেয়ার বাজারের ধ্বসের সাথে ওই দেশগুলিতে অর্থব্যবস্থার ওপর প্রগাঢ় ধাক্কা লেগেছিল। ভারত সে যাত্রায় বেঁচে যায়। এ নিয়ে মনমোহন প্রণববাবুরা যথেষ্ট ‘হেঁ হেঁ‘ দেখিয়েছেন সাধারন্যে, কিন্তু প্রকৃত সত্যটি বলেন নি। প্রথম ইউপিএ সরকার যদি বামপন্থীদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল না হত, তবে আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি অনেক আগেই বেচে দেওয়া হত। ব্যাঙ্ক বীমা শিল্পে দেশি বিদেশি পুঁজিপতিদের রররমার সাথে দেশের শেয়ার বাজারে সারা পৃথিবীর তরল অর্থের আগম হত এবং শেয়ার বাজারের ওই ধ্বস এলে ভারতও ভেসে যেত। ওই বিপর্যয় যে হয় নি, তার জন্যে কৃতিত্ব মনমোহন চিদাম্বরম প্রণববাবুদের নয়। কৃতিত্ব প্রাপ্য বামপন্থীদের। প্রথম ইউপিএ-তে বামপন্থীদের কার্যকরী বাধাদানের কর্মকাণ্ড না থাকলে কবেই দেশি-বিদেশি ফাটকবাজদের মৃগয়াভূমিতে পরিণত হত ভারত।


সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে যে বিপর্যয়টি এসেছে, সেটাও বামপন্থীদের জমানায় হয় নি। নীতিগতভাবেই বামফ্রন্ট সরকারের সময় ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলির স্বপক্ষে দাঁড়িয়েছিল সরকার। নব্বইয়ের দশকে এই নীতিগত অবস্থান থেকেই বহুবিধ ফাটকাবাজ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দিয়েছিল সরকার। কার্যকরী এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থেই প্রণয়ন করার চেষ্টা হয়েছে আইন প্রণয়নের। মূলত এই কারণেই ২০০৮ সালের পর থেকে যে সমস্ত শক্তি বুঝতে পেরেছিল সবাই মিলে লাগলে বামফ্রন্টকে হঠানো সম্ভব, তারা সকলে জোট বাঁধছিল। এই জোটে সারা দেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমাজকর্মী থেকে ছোট বামপন্থী, শিল্পী বুদ্ধিজীবী থেকে শিল্পবাণিজ্য মহল একত্রিত হয়েছে। বামেরা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে নিশ্চিতই নিজেদের সুদিন আসবে এটা জেনে এই জোটে যোগ দিয়েছে সুদীপ্ত সেনদের দল। এখন বর্তমানে সরকারের হালহকিকতে বিরূপ হওয়া এক শ্রেণির শিল্পী বুদ্ধিজীবী নানা কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু যখন ২০১১-এর নির্বাচনের আগে তৎকালীন মন্ত্রী গৌতম দেব এই চিট ফা- কোম্পানিগুলি ও তৃণমূলের অশুভ আঁতাতের কথা বলেছিলেন তখন তাঁকে ব্যঙ্গ করেছিলেন এঁরা প্রত্যেকে। পয়লা বৈশাখের আগে মমতা জানতেন না কথাটা যত বড় মিথ্যে, তার চেয়ে কম মিথ্যে নয় একদা পরিবর্তনপন্থী, বর্তমানে মমতা-বিরূপদের ‘তখন বুঝতে পারি নি‘ বলা।
           

ক‘দিন থেকেই ভাবছিলাম, এই বিপর্যয় নিয়ে এত কথা হচ্ছে চারদিকে, কিন্তু কেউ এটা বলছে না কেন, এটা নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। আজ মমতা ক্ষমতায় না থেকে অন্য কোনও নয়া উদারনীতির সমর্থক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলেও তো একই হত। হয়ত মমতা থাকায় সর্বস্তরের চটজলদি লুটপাটের সংস্কৃতিটা একটু বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে। গতকালই কোনো একটি কাগজে দেখলাম বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ সিপি চন্দ্রশেখর বলেছেন, চিট ফাণ্ডের রমরমার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিও দায়ী। ডাক বিভাগের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের সুদের হার কমিয়ে দেওয়ার জন্যেই প্রাথমিকভাবে চিট ফাণ্ডগুলির কর্মতৎপরতা বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আজকের গণশক্তিতে আরেকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক একটি নিবন্ধে বলেছেন আরো কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, ফ্যাসীবাদীরা প্রথম অবস্থায় একটি বাম মুখোস পড়ে হাজির হয়। তাদের কথাবার্তায় থাকে নানা ধরনের পুঁজিপতিবিরোধী গরিবদরদী বক্তব্য। ইতিহাস দেখিয়েছে, এতে ওই সময়েও অনেক প্রগতিপন্থী শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা প্রলুব্ধ হন। তাঁদের মনে হয় এই ফ্যাসীবাদীরা বামপন্থীদের চেয়েও বেশি বামপন্থী। আন্দোলন সংগ্রামের নতুন নতুন আগ্রাসী কর্মসূচিতে মনে হয় জনসাধারণের দুঃখদুর্দশা নিয়েও বুঝি এরা অন্য সবার চাইতে বেশি মুখর। তারপর এরা একবার ক্ষমতায় এলে পুঁজির সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীতদাসে পরিণত হয়। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে এদের কর্মতৎপরতা, শক্তিসঞ্চয় এবং সবশেষে ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতায় এসে তারা প্রথমেই আঘাত হানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলে। হরণ করতে থাকে একের পর এক গণতান্ত্রিক অধিকার। ক্ষমতায় আরোহণের পথে এদের বামমুখোসকে বিশ্বাসযোগ্য করতে যাদেরকে সাথি হিসেবে বেছে নিতে হয়, ক্ষমতায় এসে এদেরকেই টুঁটি টিপে হত্যা করে ফ্যাসীবাদীরা। বিগত শতকের চল্লিশের দশকের জার্মানি ইতালি ও অন্য দেশের ফ্যাসীবাদী শক্তির পর্যালোচনা করে যে কথাগুলি লিখেছিলেন বুলগেরিয়ার প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা জর্জি ডিমিট্রভ, সে কথাগুলি কী আশ্চর্যভাবে সত্য হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ইতিহাসে! আমাদের নিশ্চয়ই ভুলে যাই নি, ২০০৮ থেকে ২০১১ কীভাবে পশ্চিমবাংলায় কৃষক দরদি, গরিব দরদি পুঁজিপতিদের লুন্ঠন বিরোধী এক গণতান্ত্রিক ঝড়ের পাখি হিসাবে নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিভাত হয়েছিলেন বাণিজ্যিক মিডিয়া ও শিল্পী-বুদ্ধিজীবী মহলে। তাঁর মুখের অসংযত ভাষা, এককেন্দ্রিক কর্মপদ্ধতি, কথায় কথায় হিংসাত্মক ধর্মঘট, এ সমস্ত কিছুই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল এক শ্রেণির বামপন্থীদের কাছেও। ক্ষমতায় আসতে না আসতেই ধর্মতলার তথাকথিত অনশনের মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ছোট বামপন্থী নেতা নেত্রীরা একে একে ঘাড়ধাক্কা খেলেন। জঙ্গলমহলে বন্দুক নাচানো কিষেণজী লাশ হয়ে গেলেন। ছত্রধর যেমন জেলে ছিলেন তেমনই রইলেন জেলে, জঙ্গলমহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীও রইল। একদিন যিনি টাটার কারখানার জন্যে সরকারি জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন, ক্ষমতায় এসে তিনিই পশ্চিম বাংলার গ্রাম শহরে লেলিয়ে দিলেন জমি হাঙরদের। চিট ফা- কোম্পানিদের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা সরকারি আশীর্বাদপ্রাপ্ত হল। একদিন যিনি গোবিন্দপুর গিয়ে উচ্ছেদ হতে যাওয়া মানুষের দুঃখে কেঁদে চেঁচিয়ে ভাসিয়েছেন, ক্ষমতায় এসেই তিনি নোনাডাঙা লোবা ঘটালেন। এই সত্য জানে কিষেণজীর লাশ, জানে হাজতবাসী-মাওবাদী দেবলীনা, জানেন একদা পরিবর্তনপন্থী চিত্রশিল্পী সঙ্গীতশিল্পীরা, আর মর্মান্তিভাবে জানে লক্ষ লক্ষ প্রতারিত নিঃস্ব গরিবমানুষেরা।


এই সমস্ত ঘটনার মধ্যেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে। খবরের কাগজে টেলিভিশন চ্যানেলে শিল্পবাণিজ্য মহলের আলোচনা সভাগুলিতে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভারতবর্ষের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গুজরাট নাকি উন্নতির অগ্রগতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষ নাকি বাঁচবে যদি নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী হন। যেন তিনি আরএসএস নন। যেন তার রাজ্যে সরকারি ষড়যন্ত্রে সংঘটিত গণহত্যায় দশ হাজার মানুষ প্রাণ দেয় নি। যেন তার রাজ্য মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বহু পেছনে নয় অর্থাৎ শিক্ষা স্বাস্থ্য গ্রামোন্নয়ন অনুসূচিত জাতি সংখ্যালঘু উন্নয়নের নানা কর্মসূচির রূপায়ণে যেন বহু রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে নেই গুজরাট। সব ভুলিয়ে দিতে একটি কৃত্রিম আধুনিক মুখচ্ছবি তৈরির উদ্দেশ্যে জিনস ও টি-শার্ট পরে সমুদ্রতীরে পায়চারিরত নরেন্দ্র মোদির ছবি প্রচারিত হচ্ছে মিডিয়ায় মিডিয়ায়। স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী নিয়ে এমন ধরনের প্রচার আর কখনো হয়েছে বলে জানি না। ভারতবর্ষের সংসদীয় ব্যবস্থায় মার্কিনি রাষ্ট্রপতিধাঁচের সরকারি সংস্কৃতি আমদানি হচ্ছে। আমাদের রাজ্যেরও বাণিজ্যিক সংবাদ মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে যে আদিখ্যেতা হচ্ছে তা দেখে ২০১১-পূর্ব তাঁদের মমতা-বন্দনা ও মমতা-ভাবমূর্তি নির্মান কর্মসূচির কথা মনে পড়ছে। কেন নরেন্দ্র মোদি? কারণ তিনি এই মুহূর্তে নয়া উদারবাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেবক, আর্থিক সংস্কারের সোচ্চার সমর্থক। তিনি ক্ষমতায় এলে খোলাখুলিভাবে নয়া উদারনীতির নীতি প্রয়োগ করা হবে। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সবই বাধাহীনভাবে চলে যাবে বেসরকারি হাতে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতে ধনীদের স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিটি দলকেই নির্বাচনের আগে গরিবের কথা বলতে হয়, নানা ধরনের দারিদ্র দূরীকরণের আওয়াজ দিয়ে ভোটের আসরে নামতে হয়েছে। এই প্রথম কোনও একজন প্রার্থীকে সামনে রেখে একটি দল সরাসরি শিল্পবাণিজ্য মহলের প্রবক্তা হিসেবে ভোট চাইতে নেমেছে। ষাটের শেষে পিলু মোদি, বিজু পট্টনায়েকদের স্বতন্ত্র পার্টি এবং জনসঙ্ঘ জোটও বোধহয় এমন আগ্রাসী দক্ষিণপন্থা নিয়ে ভোটের আসরে সেদিন নামে নি।


মোদি এবং মমতা, দুই-ই নয়া উদারবাদের মুখ। ফ্যাসীবাদের ভিন্ন ভিন্ন চেহারা। একজন প্রথমে জনদরদের মুখোস পরে পরবর্তীতে লুম্পেন-নির্ভর অগণতান্ত্রিকতার একনিষ্ঠ সেবক। রাজনীতি থেকে শিষ্টাচার সৌজন্য শিক্ষাদীক্ষাকে নির্বাসন দিয়ে গা-জোয়ারি মস্তানিকে প্রতিষ্ঠিত করাই তার পথ। আরেকজন তীব্র সংখ্যালঘু বিদ্বেষ, পাশ্চাত্য বিদ্বেষ, সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধে আপাদমস্তক ডুবে থাকা নেতা পরিকল্পিত অপপ্রচারের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চরম দক্ষিণপন্থা প্রতিষ্ঠায় তৎপর। মমতা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এক অভূতপূর্ব কেলেঙ্কারি দেখল পশ্চিমবাংলা, নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলে নয়া উদারনীতির জোয়ারে ভাসবে দেশ। শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিষেবা সমাজ উন্নয়ন- সমস্ত ক্ষেত্রের দখল নেবে দেশি বিদেশি পুঁজিবাদী রাঘব বোয়ালরা। জনকল্যাণের সমস্ত পরিসর থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেবে রাষ্ট্র। অতীতে আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারের পতনেও যে সার্বিক আর্থিক বিপর্যয় গ্রাস করতে পারেনি ভারতকে, তাও বাস্তব হয়ে উঠবে।


ফলে সুদীপ্ত নিয়ে আলোচনায় টেলিভিশনের পর্দায় যখন কংগ্রেস বিজেপির নেতারাও নানা কথা বলেন, তখন প্রশ্ন ওঠা উচিত, যারা নয়া উদারনীতির প্রবক্তা তাদের কতটা অধিকার আছে সবহারা নিঃস্ব মানুষগুলির হয়ে কথা বলার। এ ক্ষেত্রে তৃনমূল, কংগ্রেস এবং বিজেপি একই জায়গাতেই অবস্থান করছে।
           

গরিব মানুষদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্দোলন হতেই হবে। দোষী চিট ফাণ্ড ও তাদের রাজনৈতিক মদতদাতাদের শাস্তির দাবিতেও আন্দোলন হতে হবে। কিন্তু এই আন্দোলনেই আওয়াজ তুলতে হবে সর্বনাশা আর্থিক উদারীকরণের নীতি অবিলম্বে প্রত্যাহারের। নয়া উদারনীতিবাদের কুফলকে গ্রাম শহরের সাধারণ গরিব খেটে খাওয়া মানুষকে বুঝিয়ে বলার মত এতটা অনুকূল পরিস্থিতি বোধহয় এর আগে কখনো আসে নি। সেজন্যেই একটি যথার্থ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব এখন বামপন্থীদেরই।

শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩

বরাকের ভাষা সংগ্রাম - একটি বামপন্থী মূল্যায়নের প্রতীক্ষায়


বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রাম নিয়ে যতটা আবেগের প্রকাশ, তার তুলনায় বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা বা রাজনৈতিক মূল্যায়ন খুবই কম। ভাষা সংগ্রামের প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়ে ষাটের শুরুতে, কিন্তু এ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ লেখালেখি হতে হতে প্রায় দু’টি দশক কেটে গেছে। তাও সেই অর্থে গবেষণাধর্মী পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনও হয় নি। প্রথম পর্বে যে সমস্ত লেখালেখি হয়েছে, তার বেশিরভাগটাই স্মৃতিকথা। এই স্মৃতিকথা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, এতে বিভিন্ন ব্যক্তির তরফে অতিকথন রয়েছে, কেউ বলেন এতে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। কেউ বলেন, এই স্মৃতিকথাগুলিতে অনেক সত্য অনুল্লেখিত রয়ে গেছে। পরবর্তীতে অবশ্য কিছু কিছু গবেষণাধর্মী লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন অনেকে। সম্প্রতি দুয়েকজন বিচ্ছিন্নভাবে বিধিসম্মত গবেষণাও করেছেন বা করছেন এই ঐতিহাসিক সংগ্রাম নিয়ে। কিন্তু এই সংগ্রামের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যের নিরিখে এই উদ্যোগগুলিকে খুবই প্রাথমিক স্তরের, যদিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মনে হবে।

যে সামান্য লেখালেখিকে নির্ভর করে বরাকের ভাষা সংগ্রাম নিয়ে চর্চা হয়, সেই লেখালেখিগুলিও ভীষণ রকমের আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণের দ্বারা আক্রান্ত। আসাম রাজ্যের রাজনীতি বা সামাজিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতার নিরিখে বরাকের ভাষা সংগ্রামের মূল্যায়ন করার কোনও উদ্যোগ এখনও পরিলক্ষিত হয় নি। এই কথাটি দু’দিক থেকেই সত্য। বরাক উপত্যকায় যেমন এই সংগ্রামের ইতিহাসকে রাজ্যগত দৃষ্টি থেকে পর্যালোচনা করা হয় নি, ঠিক তেমনি অবশিষ্ট আসামেও বুদ্ধিজীবী মহলে বা রাজনৈতিক স্তরে বরাকের ভাষা সংগ্রাম নিয়ে কোনও গভীর অনুসন্ধান করেন নি কেউ। অন্তত তেমন কোনও আলোচনা এখনও সাধারণ্যে প্রকাশিত হয় নি। অবশিষ্ট আসামের উদার মনোভাবাপন্ন ভিন্নভাষাগোষ্ঠীর বিদ্বৎসমাজের কাছে বরাকের ভাষা সংগ্রাম একটি পৃথকত্বমুখী রাজনৈতিক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের কাছে এটি একটি বাঙালি উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ। এই সমস্যা অবশ্য শুধু বরাকের ভাষা সংগ্রাম নিয়েই নয়। বরাক ও অবশিষ্ট আসামের মধ্যে অন্যান্য বিষয় নিয়েও তেমন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক সংলাপ আমরা খুব একটা দেখি নি। এক অলিখিত বিভাজন যেন কাজ করে মানসিকতার স্তরে। লেবাননের ক্ষেত্রে আমরা যেমন জেনেছি যে সেখানে সরকারি বৈধতা নিয়েই দেশের ভেতর খ্রিস্টান ও মুসলিমদের আলাদা অঞ্চল। দুই অঞ্চলের মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই কাঁটাতারও রয়েছে। বরাক ও বহির্বরাক নিয়ে সরকারিভাবে কোনো সীমান্ত বিভাজন না থাকলেও দু‘টি অঞ্চলেই মানসিকতার স্তরে এক জল বিভাজন রেখা রয়েছে। অথচ বহুভাষিক বহুসাংস্কৃতিক বহুজাতিক আসাম রাজ্যে এক মৈত্রী ও পারস্পরিক সহযোগিতার সমাজ গড়ে তুলতে এই রাজ্যের বহুমুখী বৈচিত্রের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক চর্চা অত্যন্ত জরুরি। বামপন্থী আন্দোলনের জন্যে বলা বাহুল্য, এই চর্চা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিভিন্ন অংশের শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক ঐক্য। সামাজিকস্তরে যে সংলাপ বিভিন্ন অংশের মধ্যে চলতে থাকলে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্যের পাশাপাশি সামাজিক মিলন ঘটে, সেই সংলাপের স্বার্থেই  বামপন্থীদের তরফে বরাকের ভাষা সংগ্রাম ও রাজ্যের বিভিন্ন অংশের নানা ভাষা জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের গভীর পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ ক্ষেত্রে এখনও কোনও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় নি কোত্থাও।

বরাকের ভাষা সংগ্রাম যদিও ১৯৬০ সালের রাজ্যভাষা আইনের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছিল, তবু এর প্রেক্ষাপটটি যুক্ত হয়ে আছে এই অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে। আরো স্পষ্ট করে বললে, ইতিহাসের নানা পর্যায়ে এই অঞ্চলের ভূগোলের ভাঙা-গড়ার সাথে সম্পৃত্ত হয়ে আছে বরাকের ভাষা সংগ্রামের প্রশ্নটি। আবার, পণ্ডিতদের কাছে সমস্যাটা আসামের পরিচয় নিয়েও। আসাম কি বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি বহুভাষিক রাজ্য, নাকি আসাম মূলত একটি একভাষী রাজ্য? অসমীয়াভাষী ছাড়া অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ বা আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে বাঙালিরা কি এখানে নিতান্তই বহিরাগত এবং ফলে উটকো, নাকি শতাধিক বছর পাশাপাশি বাস করার ফলে এখানকার স্থানীয় মানুষদেরই একজন হয়ে গেছেন? আসামের ভাষা ও জাতি সমস্যা নিয়ে পণ্ডিত গবেষকরা এ পর্যন্ত যে প্রতিবেদনগুলি তৈরি করেছেন, তার বেশিরভাগই রাজ্যের মূল সমস্যার খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরেছে। আগেই বলেছি. বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রাম নিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার তাত্ত্বিকেরা প্রায় নীরব। দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী পণ্ডিতেরা বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনকে পৃথকত্ববাদী প্রবণতা হিসাবেই দেখেছেন। তাদের কাছে, একষট্টি, বাহাত্তর, ছিয়াশির ভাষা আন্দোলন আসামের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার প্রবণতার প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা, যারা সংকটের দিনে ভাষিক সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়ে নিগৃহীত হয়েছেন নানা সময়ে, তারাও বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রাম বা আসামের রাজনীতিতে এই সংগ্রামের তাৎপর্য তাৎপর্য সম্পর্কে খুব একটা অবহিত নন। বরাক উপত্যকায় সাধারণভাবে ভাষা সংগ্রামকে দেখা হয়ে থাকে শুধুমাত্র বাঙালিত্বের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে, এই আন্দোলন বঙ্গভাষী মানুষের প্রধান অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে গড়ে উঠলেও এর তাৎপর্য ছিল অনেক গভীর ও বিস্তৃত। শুধুমাত্র বাঙালিত্বের গণ্ডিতে একে  দেখলে ঐতিহাসিক ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে, বহুভাষিক আসামের স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্বটিই এখানে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। একদিকে আসামের শাসকশ্রেণি চেয়েছে রাজ্যের বহুভাষিক চরিত্রকে অস্বীকার করতে, আর অন্যদিকে বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীগুলির সংগ্রামগুলি মূলগতভাবে চেয়েছে আসামের বহুভাষিক, অসংখ্য ছোট বড় জাতিগোষ্ঠীগত পরিচয়কে (multilingual and multi-ethnic) প্রতিষ্ঠিত করতে। গত পঞ্চাশ বছরের আসামের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে এই কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বের আবর্তে। ১৯৬০ সালে সরকারি ভাষা আইনের মাধ্যমে আসামের সরকারি ভাষা হিসাবে যখন একমাত্র অসমীয়া ভাষাকেই চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা হচ্ছিল, তখন প্রতিবাদ ধ্বণিত হয়েছিল শুধু বাঙালি নয়, সমস্ত অনসমীয়া ভাষাগোষ্ঠীগুলির তরফ থেকে। এই প্রতিবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রে অবশ্যই ছিলেন বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষী সমাজ, তবে বিভাজন ছিল অসমীয়া ও অনসমীয়ার, শুধু বাঙালি অসমীয়ার নয়। ১৯ শে মে শিলচর রেল স্টেশনে গুলিতে এগারো জন বাঙালি যুবক যুবতী প্রাণ দিলে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শিলং শহরে হাজার হাজার খাসি সম্প্রদায়ের মানুষ মৌন মিছিলে শামিল হয়েছিলেন। এর আগে পরে বিভিন্ন অনসমীয়া গোষ্ঠীর মানুষ আসামের সরকারি ভাষা আইন সম্পর্কে রাজ্য সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলেও ঐতিহাসিক নানা কারণে এই আন্দোলন পরবর্তীতে বরাক উপত্যকার সংগ্রাম হিসাবেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকল। আসামের শাসক শ্রেণিও চেয়েছিল গোটা বিষয়টিকে অসমীয়া বাঙালি বা আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে অসমীয়া ও বরাক উপত্যকার বাঙালির বিরোধ হিসাবে উপস্থিত করে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে কিংবা অসমীয়া সমাজের গণতান্ত্রিক অংশকে এই সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে দিতে। অন্যদিকে দূরদর্শিতার অভাবে বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনও আসামের বহুত্বের সংগ্রাম না হয়ে বরাকের বাঙালির লড়াই হিসাবে প্রতিপন্ন হল।

বরাকের ভাষা সংগ্রামকে আরো গভীরভাবে বুঝতে হলে একটুখানি পেছনের দিকে তাকাতে হবে। উনবিংশ শতকে প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্রিটিশ শাসনাধীন আসামকে যুক্ত করা হয়েছিল বঙ্গদেশের সাথে। ১৮৩৪ সাল থেকে বাংলা ভাষাকে আসামে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করা হয়। সারা রাজ্য জুড়ে গড়ে উঠল অসংখ্য বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়। ঔপনিবেশিক প্রশাসনে করণিক ইত্যাদি  চাকরিতে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে ইংরাজি শিক্ষিত বাঙালিরা এসে হাজির হলেন আসামের নানাপ্রান্তে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সদ্যজাত অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনে। একদিকে সরকারি কাজ ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা, অন্যদিকে করণিকের চাকরিতে হাজার হাজার বঙ্গভাষী মানুষের নিয়োগ, তারা ভাবলেন এই বঙ্গীকরণের মধ্যদিয়ে হারিয়ে যাবে তাদের মাতৃভাষা অসমীয়া ও তাদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি। তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৮৭৪ সালে বাংলা ভাষা প্রত্যাহৃত হল। কিন্তু আতঙ্ক রয়েই গেল। নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি গ্রাস হয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই জন্ম নিল মধ্যবিত্ত সমাজে বাঙালি-বিদ্বেষ। 

পরবর্তীতে বাংলা থেকে আলাদা করে আসামকে পৃথক রাজ্য হিসাবে গঠন করা হলে আসামের রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করা জন্যে ব্রিটিশ প্রশাসন যে দু’টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাও রাজ্যে বাঙালি-বিদ্বেষের আবহে আরো নেতিবাচক ভূমিকা পাল করে। প্রথমত, রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে বঙ্গদেশের দু’টি রাজস্ব উদ্বৃত্ত অঞ্চল, সিলেট জেলা ও রংপুর জেলার গোয়ালপাড়া মহকুমাকে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, যেহেতু আসামের স্থানীয় মানুষ জলাজমিতে চাষ করতে জানতেন না, আর অন্যদিকে পূর্ব বাংলায় জমির ক্ষুধায় দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক সমাজ অস্থির হয়ে ছিল, তাই রাজ্যের খাদ্য উৎপাদনে নতুন জোয়ার আনার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন পূর্ব বাংলা থেকে ভূমিহীন কৃষকদের এনে বসতি দিল আসামে। আসামের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পালে নতুন বাতাস লাগার আশায় প্রথম অবস্থায় অসমীয়া মধ্যবিত্ত সমাজের পুরোধারা ব্রিটিশ প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানিয়েছিলেন। আসামের খাদ্য উৎপাদন বেড়ে গেল দ্রুত গতিতে। শূন্য থেকে শুরু করে ১৯১৯-২০ সালের মধ্যে আসামের ১,০৬,০০০ একর জমি পাটচাষের আওতায় চলে এল। কিন্তু এর অনুষঙ্গে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা ভূমিহীন কৃষকের জনসংখ্যাও বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে। ১৯০৪-১১ সময়সীমায় পূর্ববঙ্গীয় কৃষকের সংখ্যা ছিল ৫৪,০০০। ১৯২১-৩১ সময়সীমায় তা দাঁড়াল ৫,৭৫,০০০ এ। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার আনন্দ মুছে গেলে অসমীয়া মধ্যশ্রেণির মন থেকে। গ্রাস করল নিজদেশে পরবাসী হবার আতঙ্ক। প্রশাসনে বাঙালিদের আধিপত্য খর্ব করা, পূর্ববঙ্গ থেকে কৃষকদের জনস্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করার জোরালো দাবি উঠল। অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানা সংগঠন দাবি তুলল নানা ধরনের - সবগুলিরই সাধারণ উদ্দেশ্য বাঙালিদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে অসমীয়া ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা করা। ১৯২০ সালে চালু হল কুখ্যাত ‘লাইন প্রথা‘। আসামের মূলভূমিতে বহিরাগত বাঙালি কৃষকদের বাধ্য করা হল চর এলাকার বসতি স্থাপন করতে। চর এলাকার বাইরে তাদের বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ হল। যাদের হাড়ভাঙা শ্রমে আসামের বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে সোনার ফসল ফলল, তাদের ঠেলে দেওয়া হল নদীর চরে। নদীচরের ভাঙা-গড়ার মতই অনিশ্চিত হয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। পৃথিবীর ইতিহাসে বর্ণবিদ্বেষী শাসনে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্ল্যাক টাউনশিপের ঘেটো ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত আর কোথাও নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে আসামের পার্থক্য এটাই - দক্ষিণ আফ্রিকার ঘেটো আন্তর্জাতিক ভাবেই বর্ণবিদ্বেষ নামে নিন্দিত ও ঘৃণিত। আসামের লাইন প্রথাকে এখনও বহু প্রগতিশীলেরা অভিহিত করেন অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসাবে। আসামের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব অম্বিকাগিরি রায় চৌধুরীও ছিলেন এই কুখ্যাত লাইন প্রথার উগ্র সমর্থক। স্বাধীনতার সময় গণভোটের মধ্যদিয়ে আসামের রাজস্ব সমৃদ্ধ জেলা সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন অসমীয়া জাতীয়তাবাদী নেতারা। এই ঘটনায় তারা বিজয়ের অনুভূতি পেলেন।

১৯৪৭ এর স্বাধীনতা সারা দেশে সাধারণ মানুষের মনে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্তির স্বাদ এনে দিলেও আসামের অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে তা এনে দিয়েছিল বাড়তি আরেকটি মুক্তির স্বাদ। সেটা ছিল রাজ্যের রাজনীতিতে বঙ্গভাষীদের প্রভাব থেকে মুক্তির আনন্দ। পত্র পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধ, জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভাষণ, এমন কি আসাম বিধানসভায় রাজ্যপালের ভাষণ - সবকিছুতেই ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্তির পাশাপাশি বাঙালিদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দ।

১৯৪৭ এর ২০ জুলাই আসামের প্রধান সংবাদপত্র ‘দ্য আসাম ট্রিবিউন‘ লিখল -
“ চিরজাগ্রত থাকার মূল্যেই মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক এবং ভাষিক - সমস্ত বিচারে আসামের প্রত্যেক অনসমীয়া মানুষ বিদেশি। ...... ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ অধিগ্রহণের পর যারা ব্যবসায়িক বা অন্যকাজে আসামে এসেছে, তারা সকলেই বহিরাগত। এই বহিরাগতরা আগামী দিনের স্বাধীন আসামে কোনও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে এমন আশা করার কোনও কারণ নেই।“
প্রায় একই সময়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ এক জনসমাবেশে বলেন - নিঃসন্দেহে আসাম অসমীয়াভাষীদের রাজ্য। ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর আসাম বিধানসভার অধিবেশনে রাজ্যপাল স্যার আকবর হায়দরী বলেন-
“ আসামের স্থানীয় মানুষরাই এখন নিজেদের রাজ্যের প্রভু।.... এখন তারা অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসার সহ তাদের সতীর্থ ট্রাইবেল জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। বাঙালিরা চাইলেও এখন আর আসামের পাহাড় ও সমতলের মানুষের ওপর কিছু চাপাতে পারবে না, কারণ এখন তারা ক্ষমতাহীন। বাঙালিদের সম্পর্কে এমন ধারণার ভিত্তি যে ভয়, সেই ভয়ের এখন আর কোনও কারণ নেই। যতক্ষণ না এই বহিরাগতরা আমাদের প্রতি বশ্যতা প্রকাশ করছে ততক্ষণ এঁদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে, আমি আপনাদের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।“ বিরিঞ্চি কুমার বরুয়ার মত ব্যক্তিত্বও মত দিলেন, “আসামের সমস্ত অনসমীয়া মানুষকে বিদেশি বিবেচনা করা হোক। তাঁর মতে, নিজেদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে অনসমীয়ারা যদি একমাত্র অসমীয়া ভাষা, সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেন, তবেই তারা আসামে বসবাস করার অধিকার পেতে পারেন।“ এই তথাকথিত বিদেশিদের অসমীয়াকরণই হয়ে দাঁড়াল এর পরবর্তী দশকগুলির আসামের শাসকশ্রেণির সাংস্কৃতিক-রাজনীতির প্রধান নীতি। এর সূত্র ধরেই আসামের জনবিন্যাস নিজেদের স্বার্থে পরিবর্তিত করার জন্য আদম শুমারিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়ে দাঁড়াল আসামের শাসকশ্রেণির প্রধান রণকৌশল। আসামের জনসংখ্যার ভাষিক বিন্যাসে রাতারাতি ঘটে গেল প্রায় ‘অলৌকিক‘ পরিবর্তন। ‘অলৌকিক‘ শব্দটি ব্যবহৃত হল, কারণ সমাজ বিজ্ঞানীরা একে ‘ডেমোগ্রাফিক মিরাকল‘-ই বলেছেন। ১৯৩১ এর আদম শুমারিতে আসামে অসমীয়াভাষীর অনুপাত যেখানে ছিল ৩১.৪%, মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে ১৯৫১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল ৫৬.৭% এ। পূর্ববঙ্গাগত বাঙালি মুসলমান কৃষকরা যারা আসামকে শস্যশ্যামলা করেছে, তারা রাতারাতি নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা ত্যাগ করে নিজেদের অসমীয়াভাষী হিসাবে পরিচয় দিতে বাধ্য হল। বলা বাহুল্য, এটি কোনও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ঘটা সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের স্বাভাবিক দৃষ্টান্ত নয়। বিশুদ্ধ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাষা, সংস্কৃতির অধিকার হরণ করে নেওয়ার জঘন্যতম উদাহরণ। এই দরিদ্র বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যালঘুত্ব নিয়ে এমনভাবে ষড়যন্ত্র সাজানো হয়েছিল যে, তখন এর কাছে আত্মসমর্পন করা ছাড়া কোনও গত্যন্তর ছিল না। ভাষিক আগ্রাসনের এই অভূতপূর্ব নজিরকেই আসামের শাসকশ্রেণি অভিহিত করেছে ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়‘ হিসাবে। আসামবাসী অন্যান্য অনসমীয়া সমাজকেও তারা আহ্বান জানিয়েছে এই পথে হাঁটতে। আশ্চর্যের বিষয়, সারা পৃথিবীতে ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়‘ বললে দ্বিমুখী সাংস্কৃতিক প্রবাহ বোঝালেও আসামের শাসকশ্রেণির ক্ষেত্রে এই শব্দের অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকেই ব্যাখ্যা করা হয়ে আসছে ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়‘ হিসাবে। এখানে ‘সমন্বয়‘ একটি একমুখী আগ্রাসী প্রবাহ।

আমরা আলোচনা করছিলাম আসামের রাজনীতির প্রেক্ষিতে একটি বামপন্থী অবস্থান থেকে বরাকের ভাষা সংগ্রামের একটি বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের। এই কাজটি করতে যাওয়ার পথে আসামের সমাজ ও রাজনীতির কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার হয়ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর সময়ের নানা ঘটনাবলীর উগ্র জাতীয়তাবাদী নানা ভাষ্য আসামের রাজনীতির মূলস্রোতে এক ধরনের বৈধতা পেয়ে গেছে। এ নিয়ে এই রাজ্যেরই অন্য অংশের বা অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষের ভিন্ন ভাষ্য থাকতে পারে বা রয়েছে। কিন্তু রাজ্যের মুল স্রোতের¯ গণমাধ্যম বা সরকারি বেসরকারি পরিসরে সেগুলির জন্যে খুব একটা ঠাঁই নেই। স্বাধীনতার পর থেকেই আসামের রাজনীতি দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এক, অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতি অন্য ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসনের মুখে বিপন্ন, একে বাঁচাতে হবে। দুই, বিপুল সংখ্যায় বহিরাগত মানুষ এসে আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্য বদলে দিয়ে এই রাজ্যের নিরাপত্তা বিপন্ন করছে। এই ‘বহিরাগত‘ বলতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বোঝাতো পূর্ববঙ্গাগত বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের। পরে এই অর্থের আওতায় যুক্ত হল নেপালিরা। এখন ‘বহিরাগত‘ বলতে প্রধানত বোঝানো হয় পূর্ববঙ্গমূলের মুসলিমদের। আসামের মূল স্রোতে¯এই দু’টি অসত্য অভিমত প্রায় ধ্রুবসত্য হিসেবে গৃহীত হয়ে গেছে।

বাস্তব বিচারে দেখা যাবে, স্বাধীনতার পর আসামে যদি কোনো একটি ভাষা-সংস্কৃতিকে যদি চিহ্নিত করা যায়, যা স্পষ্টত ক্রমসমৃদ্ধ হয়েছে, তবে তা অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতি। অসমীয়া সাহিত্য সঙ্গীত নাটক চলচ্চিত্র সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে এই সময়পর্বে। অসমীয়া নৃত্য সঙ্গীতের সমৃদ্ধি এতটাই যে তা আসামের ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অন্য সঙ্গীত নৃত্যের সাথে নিজেকে সংলাপে রত করতে সমর্থ হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অসমীয়া ভাষা এতটাই সমৃদ্ধ হয়েছে যে সরকারি কাজকর্মে, নতুন পরিভাষা সৃজনে পূর্বাঞ্চলে আর কোনও ভাষা এতটা সাফল্যের মুখ দেখতে পেয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির এই সমৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় আসামের অন্যান্য ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কখনোই নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেন নি। গভীর অনুসন্ধানে দেখা যাবে, অসমীয়াভাষী মানুষের এই সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে আসামের অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ সক্রিয় সহযাত্রাই প্রদান করেছেন তাঁর অসমীয়া প্রতিবেশীকে। বরং এই সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের ফলে বিপন্নতার মুখে পড়েছে, আসামের অন্য ভাষা ও সংস্কৃতি। অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধির এই কাজকে আসামের শাসকশ্রেণি ও উগ্র জাতীয়তাবাদী বিদ্বৎসমাজ আসাম রাজ্যে অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির একাধিপত্য স্থাপনের সাথে একাকার করে দিয়েছেন। এই একাকার করার প্রক্রিয়াতেই তাঁরা অস্বীকার করতে চেয়েছেন অন্য ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতির অধিকারকে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত জনজাতিগোষ্ঠীগুলি অসমীয়া জাতিসত্তার মধ্যে নিজেদের বিকশিত করতে চেয়েছিল একটা সময়ে, তাঁরা এই আগ্রাসী সাংস্কৃতিক-রাজনীতির মুখে নিজেদের আত্মপরিচয়ের দাবি উত্থাপন করতে উদ্যত হলেন। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি প্রথম থেকেই মুখোমুখি হতে হয়েছে হিংসাত্মক আক্রমনেরও। অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির একাধিপত্য স্থাপন করার অভিপ্রায়ে আসামের বঙ্গভাষী জনপদগুলিকে অসমীয়াকরণের সরকারি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৫১ সালের আদম শুমারির যে সরকারি কর্মসূচির কথা আগেই বলা হয়েছে, সেই কর্মসূচির ফলাফলে ধুবড়ি- গোয়ালপাড়া অঞ্চলের ভাষিক পরিবর্তন ঘটে যায়। দুঃখের বিষয়, ভাষিক আগ্রাসনের এই সরকারি কূটকৌশলকে কোনও কোনও বামপন্থী লেখক একটি ইতিবাচক উদ্যোগ বলে উল্লেখ করেছেন সম্প্রতি কোন কোনও লেখায়। একটি কথা স্পষ্ট, যখন ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে দীর্ঘদিন বসবাস করার পর একটি ভাষাগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের ভাষিক পরিচয় বদলে যায়, সেটা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা নিয়ে আপত্তি তোলার অবকাশ থাকে না। মানব সভ্যতা বলা বাহুল্য এই পথেই এগোয়। কিন্তু যখন কোনও শাসকগোষ্ঠী সরকারি কর্মসূচি হিসেবে ছলে-বলে-কৌশলে একটি জনগোষ্ঠীকে তাঁর মাতৃভাষা ত্যাগ করতে বাধ্য করে, তা কখনোই ইতিহাসের বিচারে শুভ হতে পারে না।

১৯৫১ সালের আদম শুমারির সময়ে সংগঠিত যে অপকর্মটিকে এতকাল আসামে ‘সমন্বয়‘ বলে মহিমান্বিত করা হয়েছে, সেই অপচেষ্টার ভূতই এখনও আসামের রাজনীতিকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এই তথাকথিত ‘সমন্বয়‘-এর ভূত নানা ধরনের। সাম্প্রতিক সময়ে বড়োল্যাণ্ড অঞ্চলে যে হিংসাত্মক ঘটনাবলীর ঘটনা ঘটেছে, তাকে সংবাদ মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে বড়ো-মুসলিম সংঘাত হিসেবে। অর্থাৎ এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাষিক পরিচয়ের উল্লেখকে এড়িয়ে গিয়ে। এমন কি বামপন্থী দলের বিবৃতি বা দলিলেও বারবার উল্লেখ করা হয়েছে বড়ো-মুসলিম বিবাদ হিসেবে। কোথাও কোথাও তাঁদের উল্লেখ করা হয়েছে পূর্ববঙ্গমূলের মুসলিম হিসেবে। এই নিবন্ধেও সেভাবেই পরিচিত করা হয়েছে এই জনগোষ্ঠীর মানুষকে। তার মানে এটা স্পষ্ট যে গত ষাট বছরেও এই জনগোষ্ঠীর মানুষের ভাষিক পরিচয়ের ব্যাপারটি এখনও নিষ্পত্তির প্রতীক্ষায়, আদম শুমারি যাই বলুক না কেন। একদা যাঁদের উল্লেখ করা হয়েছিল ন-অসমীয়া বা নব-অসমীয়া বলে, কয়েক যুগ কেটে যাওয়ার পর এখনও তাঁরা ভিতর ঘরে স্থান পেলেন না। এখনও তাঁরা ন-অসমীয়া কিংবা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘বাংলাদেশী‘। বড়োল্যান্ড অঞ্চলের সাম্প্রতিক দাঙ্গার সময়ে টেলিভিশনের পর্দায় ঘরপোড়া সর্বস্ব হারানো তথাকথিত বাংলাদেশী মানুষের সাক্ষাৎকার আমরা শুনেছি। তাঁদের বলা ভাষা বাংলা ও অসমীয়ার মাঝামাঝি একটা রূপ নিয়েছে, তবু তাঁরা এখনও সাধারণ জনমানসে বাংলাদেশী। ভাষাসংস্কৃতি ত্যাগ করার পরও এ মাটি তাঁদের নিজের হল না। বামপন্থীরা কী ভাবে দেখবেন এই প্রশ্নটিকে? সম্ভবত কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই। সাম্প্রতিককালে শুনেছিলাম একটি ঘটনা। একটি বামপন্থী দলের রাজ্যস্তরের শিক্ষাক্লাসে একজন ‘পূর্ববঙ্গমূলের‘ মুসলিম রাজনৈতিক কর্মী তাঁর দলের রাজ্য নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কমরেড, আমাদের দল আমাদের কী মনে করে? অসমীয়া, না বাঙালি? আমরা বাড়িতে বাংলা বলি, সরকারিভাবে আমাদের পরিচয় অসমীয়া। আমরা কে?‘ শুনেছিলাম এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে সেই নেতাকে। কারণ সত্যিই এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট সর্ববাদীসম্মত অবস্থান নেই দলের। বিগত ষাট বছরে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বহু ভাষাগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মেরই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভাষিক পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে আছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি হিন্দু, নেপালি, মারওয়ারি, সাঁওতাল সহ নানা আদিবাসী ও আরো নানা ভাষা গোষ্ঠীর একটি অংশ। এই স্বাভাবিক ঘটনা রাজ্যে কোনও অশান্তি সৃষ্টি করে নি।

সরকারি উদ্যোগ বা স্বাভাবিক পরিবর্তন, এই দুয়ের একটিও অবিভক্ত কাছাড়ে সম্ভব ছিল না। ফলে রাজ্যভাষা আইনের মাধ্যমে কাছাড়ের ভাষিক পরিবর্তনের অপচেষ্টা হয় বিগত শতকের ছয়ের দশকের শুরুতে। এই ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই আজকের বরাক কিংবা তৎকালীন কাছাড়ে ভাষা সংগ্রাম গড়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নীতির প্রতিক্রিয়াতে একইভাবে বড়ো অঞ্চলে পিটিসিএ-র আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে আসামের নানা অঞ্চলে আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যে ভাবে সংগ্রামমুখর হয়েছে, তার মধ্যে উগ্রবাদী, অ-গণতান্ত্রিক ঝোঁক কখনো কখনো থাকলেও মূলগতভাবে যে প্রশ্নগুলিকে সামনে এনেছে, তার গণতান্ত্রিক সারবত্তা রয়েছে।

১৯৫১ সালের আদম শুমারির কথা আগে বলেছি। ১৯৭১ সালের আদম শুমারিতেও কতগুলো অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা শ্রমিকদের লেখানো হল অসমীয়ভাষী হিসেবে, আর বরাক উপত্যকার চা শ্রমিকদের বলা হল হিন্দিভাষী। বলা বাহুল্য, দু‘টোই চরমতম অসত্য। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা শ্রমিকদের সাথে অসমীয়া জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের কোনও পর্বেই কোনও আত্মীয়তা নেই। অন্যদিকে, বরাক উপত্যকায় চা শ্রমিকদের মধ্যে হিন্দিভাষীরা সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হচ্ছেন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান, ছোট নাগপুর অঞ্চল থেকে আসা মানুষ। বরাকের চা বাগান অঞ্চলে যে উপভাষাটি বহুল প্রচলিত, তাকে চা বাগানে বলা হয় ‘বর্ধমানী‘। এ থেকেই স্পষ্ট এরা কাঁরা। 

এমন আরো নানা প্রশ্ন রয়েছে আসামের ভাষা-সংস্কৃতি-জাতিগত সমস্যা নিয়ে। এই সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র শ্রমজীবী মানুষের রুটিরুজির লড়াইতে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে বামপন্থী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা যাবে না। আজকের পৃথিবীতে যে তিনটি ধরনের লড়াইকে বামপন্থীরা বিশ্বজুড়েই গুরুত্ব আরোপ করছেন এবং ভারতবর্ষেও শ্রেণিসংগ্রামের সাথে এই লড়াইকে যুক্ত করতে চাইছেন, তা হল নারী, আদিবাসী এবং সংস্কৃতির লড়াই। উত্তর পূর্বাঞ্চলে একমাত্র ত্রিপুরাতেই আদিবাসী মানুষের মধ্যে বামপন্থীরা শক্তিশালী। বামপন্থীরা প্রথম যুগ থেকেই আদিবাসী সমাজের ভাষা-সংস্কৃতির লড়াইকে গুরুত্ব দিয়ে সংগঠিত করেছেন। লক্ষ্যণীয়, ভারতবর্ষের অন্যান্য আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে মাওবাদীদের কর্মপরতা থাকলেও ত্রিপুরায় এরা অনুপস্থিত।

এবার ফিরে আসা যাক গোড়ার কথায়। ভাষা রাজনীতির এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনকে মূল্যায়ণ করা হবে কোন্ নিরিখে? বাংলাদেশে যে ভাবে ‘একুশের চেতনা‘ কথাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত, একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে বরাক উপত্যকায় ভাষা সংগ্রাম থেকে জন্ম নেওয়া চেতনাকে বলা হচ্ছে ‘উনিশের চেতনা‘। তবে ‘উনিশের চেতনা‘কে এখনও আসামের ভাষা রাজনীতির ইতিহাসের আলোয় সংজ্ঞায়িত করার কাজটি এখনও অপূর্ণ। দায়সারাভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শব্দটিই যে ভাষার রাজনীতির আবর্তে জর্জরিত আসামে ভাষিক ঐক্যের নতুন পথ দেখাতে পারে সে সম্পর্কে ভাবার সময় এসেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বহুভাষিক আসামে শাসক শ্রেণি ছলে বলে প্রচেষ্টা চালিয়েছে আসামকে একভাষী হিসেবে একীকরণ করার। এর উত্তরে ষাট, সত্তর বা আশির দশকের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের মূল অভিমুখই ছিল আসামের বহুভাষিক সত্তাকে তুলে ধরার। ফলেই ‘উনিশের চেতনা‘ প্রকৃতপক্ষে বহুত্বের চেতনাই। উনিশের চেতনা একটি বহুভাষিক সামাজিক পরিসরের শরিক সমস্ত ভাষাগোষ্ঠীর নিজের ভাষা চর্চার চেতনা।

১৯৬১ সালের ১৯ মে, ১৯৭২ সালের ১৬ আগস্ট, ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই, ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ সেই সংগ্রামের নানা রক্তাক্ত দিনের নাম। বহমান সেই ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস ১৯ মে। একুশ যদি ধর্মভিত্তিক জাতিতত্ত্বের প্রত্যাখান হয়, তবে উনিশ আসামের বহুভাষিক বহুসাংস্কৃতিক পরিসরে শাসকশ্রেণির উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাষানীতির বিরুদ্ধে বহুভাষিকতার নীতির, প্রত্যেকটি ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্য নাম।


বরাকের ভাষাসংগ্রাম সহ রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে বামপন্থী মহলে এখনও কোনও পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা হয়ে ওঠে নি। কোনও কোনও বামপন্থী দল কখনো রাজ্যের স্বার্থ রক্ষার নামে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। কোনও কোনও বামপন্থী দলের মূল্যায়নে আমরা দেখেছি, এক ধরনের সংখ্যালঘুবাদের ঝোঁক। তা ছাড়া, আসামের দু’টি প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক নানা প্রশ্ন নিয়ে দু’টি অংশের সমাজ-সংস্কৃতিকর্মীদের স্তরেও এখনও মতবিনিময়ের অভিপ্রায় নিয়ে কোনও আলোচনা চক্র বা সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণও হয় নি। দু’টি অঞ্চলের ইতিহাস সংস্কৃতি নিয়েও রয়েছে এক সীমাহীন পারস্পরিক অজ্ঞতা। ফলেই বিভ্রান্তি সৃষ্টির সব উপাদানই বিরাজমান।  ১৯৫১ সালের আদমশুমারিকে কেন্দ্র করে যে ভাষিক আগ্রাসনের ঘটনা ঘটে, সেই অধ্যায় নিয়েও দুঃখের বিষয় বরাক উপত্যকা এবং অবশিষ্ট আসামের বামপন্থী মহলে কোনও সর্বসম্মত দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠে নি। কোনও কোনও বামপন্থী লেখকের কলমেও অভিবাসী বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা হরণের সরকারি কর্মসূচিটিকে প্রশংসিত করার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে সম্প্রতি কালে। কেউ কেউ আসামের সমাজ ও রাজনীতিতে একটি বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাকে একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে চান।

বর্তমান নিবন্ধেও নানা অপূর্ণতা থাকতেই পারে। কিন্তু আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বরাকের ভাষা সংগ্রাম সহ আসামের ভাষা সংস্কৃতিগত সমস্যার নানা প্রশ্ন নিয়ে এক বামপন্থী পর্যালোচনার। একটি সর্ববাদী সম্মত বামপন্থী ভাষ্যই আগামী দিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারে। অন্যথায়, আমাদের সমস্ত অগ্রগতি থমকে যাবে বারবার ভাষাসংস্কৃতির নানা চোরাবালিতে।



বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩

অথ অসম্ভব কথা



সকাল মানেই ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘। যখন এই অনুষ্ঠান থেকে অনেক দূরে ছিলাম শিলচরে তখনও, এখনও। পরিচিত অপরিচিত নামী অনামী গলায় গান শুনে দিনের কাজের শুরু। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে একটা ভালোবাসা তখনও ছিল। যদিও তখন সেটা ছিল দূরের ভালোবাসা। ওখানে অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সুবাদে সেই দূরের ভালোবাসা আত্মীয়তার বন্ধনে পরিণত হয়েছে। উপস্থাপক, প্রযোজক সকলেই যেন বন্ধুজন। এখন আমার মেয়েও নিয়মিত যায়। ফলে সম্পর্কটা পারিবারিকই হয়ে উঠেছে। সেদিন সকালে ট্রেন ধরার তাড়া, তৈরি হওয়ার অস্থিরতার মাঝেই হঠাৎ চোখে পড়ল স্ক্রিনে লাইভ কথাটা লেখা নেই। কী ব্যাপার! ভাবলাম নির্ধারিত শিল্পী হয়ত একেবারে শেষ মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই পুরোনো অনুষ্ঠান দিয়েই শূন্যস্থান পূরণ হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানের মাথার ওপর কখনো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোপ নেমে আসবে, কখনো এই চ্যানেল উঠে যাওয়ার অবস্থায় এসে দাঁড়াবে, এ তো কল্পনা করাই যায় না। যদিও ব্যবসার জগতের ওঠা নামায় সবই সম্ভব। এটা আমাদের জীবনের মত। জানি, আমরা কেউই অমর নই, যে কোনও মুহূর্তেই মৃত্যু এসে সব কান্না হাসি লীলা খেলা সাঙ্গ করে দিতে পারে, তাই বলে সর্বক্ষণ কি মৃত্যুর কথা ভেবে ভেবে বাঁচতে পারি আমরা? পারি না। অবচেতনে নিজেদের মধ্যে অমরত্বের এক অলীক ধারণা বাসা বাঁধে।


পরদিনই সন্ধ্যায়, সঙ্গীতমেলায় এক তরুণশিল্পী বললেন, শুনেছেন? তারার লাইভ অনুষ্ঠান তো বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে রাতে ফোন করি তারা মিউজিকের এক বন্ধুকে। সেখান থেকেই জানতে পারি মালিক নিখোঁজ, ফোন বন্ধ। এর আগে উনি জানিয়েছিলেন, চ্যানেল আর চালাতে পারবেন না। কর্মীরা তখন বলেছেন, চ্যানেলটি নতুন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দিতে। ক্রেতা তারাই জোগাড় করবেন। মালিক প্রথমে রাজি হলেও তারপর থেকে বেপাত্তা। কয়েকদিন ধরেই তারার কর্মীবন্ধুরা বাড়ি ফিরছেন না। অফিসে থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চ্যানেলটাকে চালু রাখতে। দুয়েক দিনের মধ্যেই তাঁরা সাংবাদিক সম্মেলন করে শ্রোতার দরবারে, শিল্পীদের দরবারে তাঁদের কথা জানাবেন। আমি বলি, সারা পৃথিবী জুড়ে এই চ্যানেলের প্রতি মানুষের এত ভালোবাসা! এই চ্যানেল কখনো বন্ধ হতে পারে না! বলি ঠিকই, কিন্তু বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কা ক্রমেই জমাট বাঁধতে থাকে। শুধু ভালোবাসার শক্তি দিয়ে এত বড় বাণিজ্যিক সংস্থাকে কীভাবে বাঁচানো সম্ভব! এটা সত্যিই ‘তারা‘-র শুভানুধ্যায়ী সারা পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে শুভানুধ্যায়ীদের এক জায়গায় জড়ো করা যাবে কী করে! সাংবাদিক বৈঠক করে বড়োজোর কয়েকটি সংবাদপত্র আর চ্যানেলের হাজার খবরের কোণে একটু ঠাঁই পাওয়া যাবে, সেও তো স্থানীয় স্তরে। কিন্তু ‘তারা‘-র সংসার যে আবিশ্ব। তার হৃদয়ের কান্না, চোখের জলকে সমস্ত আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারে এমন সংবাদ মাধ্যম কোথায়!



আমরা কী তবে ‘তারা‘-হারা হয়ে যাবো! এ কথা মনে হতেই চলচ্চিত্রের মত অনেকগুলি মানুষের মুখ সামনে ভেসে ওঠে। প্রথমে ভেসে ওঠে ‘তারা‘-র উপস্থাপকদের মুখ, প্রযোজকদের মুখ, কর্মীদের মুখ। আর দেখবো না ওই লোগো, ওই সিগনেচার টিউন, দেখবো ওই প্রারম্ভিক কথা, শুনবো না এক গভীর রুচিবোধের গান! তারপরই যেন ক্যামেরার চোখ কোণবদল করে। ভেসে ওঠে অসংখ্য মানুষের মুখচ্ছবি। বাংলাদেশের শাহজাদপুরের ওই বোরখাপরা গ্রামীণ রমণী, রবীন্দ্র জন্মোৎসবের হাজার হাজার মানুষের ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা করে এনে যে হাজির হয় মঞ্চের পেছনে। মুখের সামনে থেকে বোরখার আবরণ তুলে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনেরে দেখছি তো আমি টিবির মধ্যে, তারার প্রোগ্রামে। আমি অবাক! বাংলাদেশের শাহজাদপুরের এক গ্রামীণ রমণী, যার পৃথিবীর বেশিরভাগটাই হচ্ছে তার গৃহকোণ, সেও আমাকে চেনে! সেও শোনে আমার গান! মনে পড়ে বর্ধমান-কলকাতা এক্সপ্রেসওয়ের ধাবাতে দেখা হওয়া পুলিস অফিসারের কথা! ধাবা থেকে বেরোবার পথে আমাকে দেখেই, যেন কতদিনের পরিচিত, বলে উঠলেন, আরে শুভ বাবু যে! সঙ্গী পুলিস অফিসারকে বললেন, চিনেছ? সঙ্গীতশিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। খাকি পোষাক পরিহিত পুলিস অফিসার কবে আমার এতটা পরিচিত হলেন? কোনও অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন কি তিনি? হয়ত তখন সাধারণ পোষাকে ছিলেন। সাধারণ পোষাকের লোক উর্দি পরিহিত হয়ে এলে চেহারা পাল্টে যায়, এটা জানি। হঠাৎ-ই চোখে পড়ল, বুকের নেমপ্লেটে লেখা নামটা! আরে, এই ভদ্রলোক কি তিনি যিনি নিয়মিত ফোন করেন ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘? ভদ্রলোকই বাকিটা খোলসা করলেন, সেদিনের অনুষ্ঠানে আপনাকে যে গানের অনুরোধ করেছিলাম, সেটা আমার বড়ো প্রিয়! ভদ্রলোক আর বেরিয়ে গেলেন না। ফিরে এলেন, বসলেন আমাদের টেবিলেই। ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে সামনে পেয়ে গিয়েছি। আপনাদের একটু সেবা করার সুযোগ দিতেই হবে‘। অনেক কথা। প্রতিদিন দেখেন ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘। সারারাত চোর ডাকাতের পেছনে ছুটোছুটি করে এলেও সকালে কোয়ার্টার্সে ফিরে আগে দেখবেন ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘। তারপর ¯স্নান করে বিশ্রাম। একদিকে তিনি পুলিস অফিসার, অন্য দিকে বাংলা গানের এক ব্যতিক্রমী শ্রোতা। যে কোনও যুগের যে কোনও বাংলা গানের উল্লেখ করলেই মুহূর্তের মধ্যে বলে দেবেন কে গীতিকার, কে সুরকার, কে শিল্পী, কোন কোম্পানি, কবে বের করেছিল সেই রেকর্ড। এই মানুষকে আমার চেনার কী কথা ছিল? জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। গান বাজনা যা করেছি, মূলত ওখানেই। আমার যা পরিচিতি, যা ‘খ্যাতি‘, সবই ওই ভূগোলে! এই পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলের এক পুলিস অফিসার তিনি গরগর করে বলে যাচ্ছেন আমার পরিচিতি তাঁর সঙ্গী পুলিস অফিসারকে। আমি অবাক, এতটাই পরিচিত আমি তাঁর কাছে!

মনে পড়ে, পুরুলিয়ার মানবাজারের সেই স্কুল শিক্ষককে, মনে পড়ে উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের ঘরের বউকে, মনে পড়ে বাঁকুড়ার সেই তরুণবন্ধুকে, মনে পড়ে মার্কিনমুলুকের হিউজটনের বাংলাদেশী তরুণ জাকিরকে। জাকির ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘ অনুষ্ঠানে শুনেছিল আমার বাড়ি বরাক উপত্যকা। বরাক উপত্যকা আর জাকিরের বাড়ি বাংলাদেশের সিলেটের বিয়ানি বাজারের দূরত্ব খুব কম, মাঝে শুধু কাঁটাতারের বেড়া। আমার ফোন নম্বর কী করে জোগাড় করল জাকির, সেও এক অসম্ভবের উপাখ্যান। তারপর থেকে ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘-র প্রতিটি পর্বের আগের রাতে জাকিরের ফোন। ‘দাদা, কাল লাইন পাবো কী না জানি না, অমুক অমুক গান গাওয়া চাই-ই‘। কোথায় হিউজটনের জাকির আর কোথাকার আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরের মালুগ্রাম পাড়ার, শুভ! এই যোগাযোগ কী কখনো সম্ভব হত, যদি না তারা মিউজিক মধ্যে থাকত! বন্ধ হয়ে যাবে সেই চ্যানেল! এ সব ভাবতে ভাবতেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছলাম বর্ধমানে। নাটক দেখতে গিয়ে দেখা কবি অংশুমান করের সাথে। বলল, মন খুবই খারাপ। শ্রীজাতদের চাকরি শেষ হয়ে যাচ্ছে। ‘পরমা‘ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিন দিন ধরে মালিক ফোন সুইচঅফ করে উধাও। আমি বললাম, একই অবস্থা তো তারা মিউজিকেরও। ও বলল, একই তো মালিক। সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন করি তারা মিউজিকের বন্ধুকে। ‘কিছু হল কি তোমাদের?‘ ও বলল, ‘না, শুভদা, এখনও কিছুই হয় নি। আমরা সাংবাদিক বৈঠক করি নি। তবে কাল নববর্ষের সকালে আমরা একটা অনুষ্ঠান করছি। সব শিল্পীদের ডেকেছি। দেখো অবশ্যই।‘


পরদিন সকাল থেকেই ঘটে গেল অভূতপূর্ব অসম্ভব ঘটনাটি। নববর্ষের অনুষ্ঠানে অশ্রুসজল চোখে উপস্থাপক জানালেন গভীর সংকটের মুখে তাঁদের চ্যানেল। তারা জানেন না কী ভবিতব্য তাঁদের প্রতীক্ষায়। তবে প্রত্যয় যদি শিল্পীরা পাশে দাঁড়ান, শ্রোতা দর্শকরা পাশে দাঁড়ান তবে তাঁরা নিজেদের প্রাণাধিক প্রিয় চ্যানেলকে বন্ধ হতে দেবেন না। বললেন, তাঁরা সকলে কয়েকদিন ধরেই তাঁদের অফিস ছেড়ে যাচ্ছেন না। না, কাউকে কোনো দোষারোপ নয়, কারো বিরুদ্ধে আঙুল তোলা নয়, শুধু বললেন এক বুকভরা বিষাদের কথা। চোখের জলে ভেসে যেতে যেতে বললেন, এক আলো ঝলমল ভবিষ্যতে পৌঁছনোর প্রত্যয়ের কথা। শিল্পীরা, বাংলা গানের প্রথিতযশা শিল্পীরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেন বাংলা গানের এক উন্নত রুচিকে তুলে ধরতে এই চ্যানেলের অবদানের কথা। তাঁরা বললেন, তাঁরা আছেন সর্বান্তকরণে পাশে। বিশ্বাস করেন, এই চ্যানেল কিছুতেই বন্ধ হবে না। অনুষ্ঠানের দৃশ্যপটও ছিল অভূতপূর্ব। সাধারণত অনুষ্ঠানচলাকালীন অনুষ্ঠান প্রয়োজক ও কর্মীরা দৃশ্যপটে থাকেন না। সেদিন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। কোনও আনুষ্ঠানিকতা নেই। পরতে পরতে যা আছে, তা এক অন্য  আন্তরিকতা। অনুষ্ঠান চলছে, অপলক দেখছেন কর্মী প্রযোজকরা। তাঁদের চোখেও জল। সারা পৃথিবী থেকে মানুষের সহমর্মিতার কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। বিষাদ ধীরে ধীরে যেন কাটছে। কোথাও একটা সোনালী রেখা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কী সেই সোনালী রেখা কেউ জানেন না। শুধু জানেন, মানুষ পাশে আছে।


এ সবই আমার শোনা। অনুষ্ঠানচলাকালীন আমি গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলাম বর্ধমান থেকে কলকাতা। মুহূর্তে মুহূর্তে ফোন, ম্যাসেজ। কলকাতা থেকে শিলচর, গুয়াহাটি থেকে দিল্লি, মুম্বই থেকে বাংলাদেশের ঢাকা, ঢাকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সকলের প্রশ্ন, কী সংকটে পড়েছে তারা মিউজিক? তাঁরাই জানাচ্ছেন আমাকে অনুষ্ঠানের ধারাবিবরণী। শিলচর থেকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস ফোনে বলছেন, আমরা শিলচর থেকে মাসে এক লক্ষ টাকা তুলে পাঠাবো। কয়েক জন কর্মীর দায়িত্ব নেবো আমরা। চ্যানেলটা যেন বন্ধ না হয়। শিলিগুড়ি থেকে একজন ফোন করে বললেন প্রায় কাঁদতে কাঁদতে, এতগুলো বছর ধরে আমার সকাল আর তারা মিউজিক একাকার হয়ে গেছে। যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে আমার সকালের কী হবে! চলন্ত গাড়ি থেকে আমিও ম্যাসেজ পাঠাই তারা মিউজিকের বন্ধুদের, এত এত মানুষের ভালোবাসা কখনো বৃথা যেতে পারে না। আবার আশঙ্কায় ভুগি, পৃথিবীর দেশে দেশে যখনই কোনও মালিকের মর্জি হয়েছে তার শিল্পসংস্থা বন্ধ করে দেবে, বন্ধ করে দিয়েছে। শ্রমিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মূল্য নেই এখানে। কয়েক শ বছরের আধুনিক সভ্যতায় গণতন্ত্র যতই বিকশিত হোক, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে তার কোনও প্রভাব নেই বললেই চলে। আবার এও ভাবছিলাম, এটা তো সাধারণ শিল্প কারখানা নয়। এখান থেকে মানুষ যা পায় তা খাবার জিনিস নয়, গায়ে পড়ারও নয়। এই শিল্পের যা সৃষ্ট বস্তু, মানুষ তা গ্রহণ করে হৃদয়ে। সকালে যা সে হৃদয়ে ধরে, সারাদিন তাই বহন করে সে গড়ে তোলে তাঁর দৈনন্দিন। এ ভাবে ভোক্তাও শিল্পী হয়ে ওঠে। আশ্চর্য বাংলাভাষার অন্য সংবাদমাধ্যমগুলো এই নিয়ে নীরব। তবে পরের দিন জাতীয় স্তরের সংবাদপত্রে এই অভূতপূর্ব ঘটনার প্রতিবেদন বেরোল। সন্ধ্যে থেকে ‘তারা‘-র চ্যানেলের তলায় সংবাদ-শিরোনামে জানানো হযল, চ্যানেল বন্ধ হচ্ছে না, মুখ্যমন্ত্রী পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। অসংখ্য মানুষ দেশ বিদেশ থেকে সম্ভাব্য ক্রেতার সন্ধান দিয়েছেন। এ ভাবেই চালু থেকে যায় তারা মিউজিক। এ এক ইতিহাস। অন্যদিকে, মালিকপক্ষ চ্যানেলের সাথে ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তাঁরা যেন হাত গুটিয়ে নেন। যাঁরা উপগ্রহ মারফৎ চ্যানেলের অনুষ্ঠানকে মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন, জানানো হল তাঁদের, আপনারা সম্প্রচার বন্ধ করে দিন। না, তাঁরা বন্ধ করলেন না। তারার কর্মীরা নিজেদের কর্মী সংস্থা গড়ে চ্যানেল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুনে তারাও আপাতত টাকার কথা মূলতুবী রেখে চ্যানেল আপলিঙ্ক অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। একই সিদ্ধান্ত নিলেন বিজ্ঞাপনদাতারাও। শ্রোতা, শিল্পী, কর্মী- এই ত্রয়ীর শক্তি যে ঘটনা ঘটালেন তা এক ইতিহাস। আগামীতে যাঁরা বিনোদনবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করবেন, ‘তারা‘ তাঁদের পাঠক্রমে এক ঝড়ের হাওয়ার পাঠ সংযোজন করল। কর্পোরেট বাণিজ্যের সাম্রাজ্যে সাধারণ মানুষের সমবেত রুচিবোধ যেন গেরিলা আক্রমন চালিয়ে বাঙালির সঙ্গীতরুচির এক মুক্তাঞ্চলকে রক্ষা করল। কেউ কি কখনো ভাবতে পারেন সিরিয়ালসর্বস্ব যে সব চ্যানেলে সন্ধের পর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রামশহরের ঘরের মা বউরা, সেগুলোর কোনোটা বন্ধ হলে এ ভাবে সোচ্চার হবেন সাধারণ দর্শক? মালিকের অন্যায় আক্রমনের মুখে গড়ে তুলবেন এমন দুর্বার মানব-ঢাল? বাংলা সঙ্গীত চ্যানেল নাকি আরো আছে, যদিও সেগুলো দেখিই না প্রায়। এ গুলো বন্ধ হলে সামান্যতম ঢেউ কি উঠবে চরাচরে? শ্রোতা শিল্পী ও কর্মীর এমন আত্মীয়তা গড়ে তুলেছে কি কোনো দেশবিদেশের চ্যানেল এর আগে?


ছোটবেলায় শিশুতোষ সব পাঠের শেষেই নীতিবাক্য থাকত। যে ভাবে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সাধারণ মানুষের সমবেত রুচিবোধের সম্মিলিত প্রতিরোধের সামনে জয়ী হল ‘তারা মিউজিক‘, এই উপাখ্যানের নীতিবাক্যটি কী? একজন গাইয়ের পরিচয়ের বাইরে বিগত কয়েক দশক ধরেই আমার পরিচয় একজন সাংস্কৃতিক কর্মীর। শিলচর, বর্ধমান, কলকাতা- সর্বত্রই নানা ধরনের অনুষ্ঠান উৎসব আয়োজনের সাথে জড়িত হয়ে আছি বেশ কয়েকটি দশক ধরেই। অনুষ্ঠান সাজানোর কাজ করতে বসলেই এক শ্রেণীর লোক সব সময় মনে করিয়ে দেন, আপনাদের রবীন্দ্র, নজরুল, শাস্ত্রীয় আর গভীর বোধের আধুনিক গান ওগুলো সাধারণ মানুষ শোনে না। নতুন প্রজন্মকে ধরতে হলে, বেশিরভাগ মানুষকে অনুষ্ঠানে টানতে হলে, একটু চটুল গান নাচ রাখতেই হবে। হাজার হোক গণতান্ত্রিক দেশে বেশিরভাগ মানুষের রুচিকে সম্মান জানাতে তো হবেই!!


‘তারা মিউজিক‘-এর ঘুরে দাঁড়ানোর এই উপাখ্যান এমন মনোভাবের মুখে এক জোরালো চপেটাঘাত! বেশিরভাগ মানুষ কোন গান কোন কবিতা কোন অনুষ্ঠানকে পছন্দ করে, কোন সংস্কৃতির জন্যে রাষ্ট্র, রাজ্য, অঞ্চল নির্বিশেষে এমন উদ্বেল হয়ে ওঠে মানুষ, আমরা চোখের সামনেই দেখলাম। ‘তারা‘-র জয় মুষ্টিমেয় রুচিহীনের বিরুদ্ধে সামাজিক মানুষের রুচিবোধের জয়। তারার জয় কর্পোরেট দেউলিয়াপনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জয়। ‘সাধারণ‘-তন্ত্র রুখে দাঁড়ালে চুরমার হয়ে যায় কর্পোরেটতন্ত্রের সব ছলাকলা। ‘তারা‘-র জয় তাই ফিরিয়ে আনে নি শুধু ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘-কে। এই জয়কে অনুভব করতে গিয়ে দেখি আগের চেয়ে অনেকবেশি প্রিয় মনে হচ্ছে ভোরের আলোকে, পাখির গানকে, সন্ধের আকাশকে, মানুষের মুখের হাসিকে। নববর্ষের সকালের চোখের জল এক শুভ্র পৃথিবীর দুয়ার খুলে দিয়েছে। জয় অজানার জয়! জয় অসম্ভবের জয়!