শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৩

তেলেঙ্গানা-গোর্খাল্যান্ড-বোড়োল্যান্ড ও সতেরো আগস্ট

বাহাত্তরের পর থেকে সতেরো আগস্ট প্রতি বছর আসছে। আসছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে। শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তী যে মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন, সেখানে শহীদ দিবস পালন মানে ইতিহাসের চর্বিত চর্বন নয়। প্রতি বছর বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেখতে হবে শহীদের আত্মদানের ইতিহাসকে। দু‘টোকে যুক্ত করেই পালিত হবে শহীদ দিবস। এবার যখন সতেরো আগস্ট পালিত হবে তখন গোটা দেশের রাজনীতি মুখর হয়ে আছে ছোট রাজ্যের দাবিতে। আসামও আবার উত্তাল হয়ে উঠেছে বোড়োল্যান্ড ও কামতাপুরের দাবিতে। বরাক উপত্যকায় কেউ কেউ পৃথক বরাকের আওয়াজ নিয়ে আবার সক্রিয় হতে চাইছেন। অন্য কেউ কেউ বলছেন পৃথক অর্থনৈতিক পরিষদের কথা। দেশের নানা প্রান্তেই এখন নতুন নতুন রাজ্যের আওয়াজ। এমন একটি পরিস্থিতিতে যখন সতেরো আগস্ট পালিত হবে, তখন আমরা কী এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারব? বাচ্চু চক্রবর্তীর মতাদর্শই বলে, এই পরিস্থিতিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনার মধ্যে না রাখলে শহীদ দিবস পালন অর্থহীন হয়ে যাবে।
           

ছোট রাজ্যের দাবিদার সমস্ত আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, তাঁদের সংগ্রাম ভাষা-সংস্কৃতি-আত্মপরিচয় রক্ষার সংগ্রাম। শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীদের সংগ্রামও ছিল ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সংগ্রামই। বাচ্চু চক্রবর্তীর স্মরণ দিবস পালন করতে গিয়ে এই বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হবে। যদিও নীতি হিসাবে এই দাবিকে গ্রহণ করা একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল বিজেপি সবসময় ছোট রাজ্য গঠনের স্বপক্ষে থাকার যুক্তি হিসাবে প্রশাসনিক সুবিধার কথাই তুলে ধরেছে। কিন্তু এই দাবি নিয়ে যারা আন্দোলন সংগ্রাম করছেন, তাদের কারো কাছেই প্রশাসনিক সুবিধাটি কোনো বিষয়ই নয়। প্রত্যেকটি পক্ষই ছোট রাজ্য গঠনের সাথে ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের প্রশ্নকে যুক্ত করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই একটা প্রশ্ন করা যায়, সত্যিই কি ছোট রাজ্য গঠনের সাথে ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সম্পর্ক রয়েছে? ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সংগ্রাম এবং ছোট রাজ্যের দাবিতে লড়াই কি সত্যিই সমার্থক? তা ছাড়া, ভাষা-সংস্কৃতি-আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আন্দোলন লড়াইয়ে কি মিশে নেই আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার প্রশ্ন? আমরা দেখব, আত্মপরিচয়ের দাবির মধ্য দিয়ে মূলত আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার সমস্যাগুলিই প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভাষা সংস্কৃতি আত্মপরিচয়ের দোহাই দিয়ে বড় রাজ্য ভেঙে ছোট রাজ্য গড়ার ঘটনা কম ঘটেনি। প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে স্বাধীনতার পর থেকে যতগুলি ছোট রাজ্য গঠনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলি কি তার প্রার্থিত লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে? আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্ন কিংবা আত্মপরিচয়ের প্রশ্নই হোক, ছোট রাজ্যগুলির অবস্থা বড়ো রাজ্যগুলির চাইতে এখনও খুব একটা উন্নত নয়।  বেশিলভাগ ছোট রাজ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বপ্ন কিংবা ভাষা সংস্কৃতির উন্নতির স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। আজকের ঝাড়খন্ড বা ছত্তিশগড়ের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।


অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার সমস্যাগুলি মূলত রাজনৈতিক সমস্যা, যদিও তার মধ্যে গভীরতর অর্থে কতগুলি সাংস্কৃতিক প্রশ্নও যুক্ত হয়ে আছে। এই বিষয়ে লড়াই সংগ্রাম করার সময় শুধু রাজনৈতিক দিকটিকে গুরুত্ব প্রদান করলে যেমন লড়াইটি খঞ্জ হয়ে যায়, তেমনি রাজনীতি অর্থনীতির বৃহত্তর প্রশ্নটিকে খাটো করে গোটা সংগ্রামটিকে আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে পর্যবসিত করলেও লড়াইটি শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিকতার গহ্বরে হারিয়ে যায়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের দীর্ঘদিনের রোগটি হল এই যে সেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রশ্নগুলি যথাযথ গুরুত্ব পায় নি। রাজনীতি শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবাজীতে আটকে পড়ে। আবার গত কয়েক দশকে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের এই দুর্বলতাগুলির প্রত্যাখান হিসাবে যে লড়াই সংগ্রামগুলি আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে এই মুহূর্তে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রান্তে সেখানে রাজনীতি অর্থনীতির বৃহত্তর প্রশ্নগুলি প্রায় ব্রাত্যই। এমন কি সমস্যাগুলির বৈশ্বিক তাৎপর্যের দিকে নজর না দিয়ে সমস্ত কিছুকে এক ধরনের আঞ্চলিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতাই বেশি। এই আঞ্চলিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ফলাফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, এক জায়গার সংগ্রামরত জনগোষ্ঠী প্রায়শই অন্য আরেকটি স্থানের সংগ্রামরত মানুষের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন। এ ভাবেই কাবেরীর জলবন্টনের মত একটি সমস্যাও প্রতিবেশী দু’টি রাজ্যের মানুষকে সংঘাতের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। এভাবেই কখনো দার্জিলিং-এর গোর্খা হয়ে যায় কলকাতার বাঙালির প্রতিপক্ষ। কখনো গুয়াহাটির সাধারণ অসমীয়া হয়ে যান বরাকের সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ। কখনো আবার একই ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে বসবাস করা দুটি জনগোষ্ঠীর মানুষ পরস্পর পরস্পরের শত্রু হয়ে যান এবং গোষ্ঠীগত হিংসার জন্ম হয়। অনেকেই মনে করেন, সারা পৃথিবী জুড়ে ছোট ছোট পরিচয়ের দ্বীপে মানুষকে বন্দী করে ছোট ছোট সত্তার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেই বিপ্লবী সংগ্রামের একমাত্র রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার মধ্যে একটি নয়া উপনিবেশবাদী ছক রয়েছে। শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্যকে এ ভাবেই দুর্বল করতে চেয়েছে দেশে দেশে কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূরা। আমাদের দেশেও দেখব, কখনো মারাঠী সত্তা, কখনো গোর্খা আত্মপরিচয়, কখনো অসমীয়া জাতিসত্তা, কখনো তেলেঙ্গানার বঞ্চনা দূরীকরণ- এই সমস্ত প্রশ্নকে সামনে এনে শোষিত নিপীড়িত মানুষের ঐক্যে বিশ্বাসী বামপন্থীদের ওপরই প্রথম আঘাতটি সংঘটিত হয়েছে। এ কাজে রাষ্ট্রশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলি এক অদ্ভুত সখ্যে আবদ্ধ হয়েছে।


এরই মধ্যে আরেকটি মুশকিলের ব্যাপার হচ্ছে, বামপন্থীদের একটি অংশের ধারণা, ছোট ছোট রাজ্য গঠন ঐ সব অঞ্চলের সামগ্রিক পশ্চাদপদতা এবং বঞ্চনার দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে। এঁদের অনেকেই ছোট রাজ্যের দাবির বিরোধিতাকে শাসকশ্রেণির লেজুড়বৃত্তি বলেও অভিহিত করেন। এই আদর্শগত বিবেচনা থেকেই বামপন্থীদের ওই অংশগুলি একসময় পৃথক ছত্তিশগড় ও ঝাড়খ-ের প্রবল প্রবক্তা ছিলেন। এখনও তাঁদের ওই অংশ একইভাবে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের সোচ্চার সমর্থক। কিন্তু তাঁদের তরফে পৃথক ছত্তিশগড় এবং পৃথক ঝাড়খ- গঠন পরবর্তী অভিজ্ঞতার কোনো মূল্যায়ন চোখে পড়ে নি।
ছোট রাজ্য গঠনের যাঁরা বিরোধিতা করেন, তাঁদের অবস্থানটিও কখনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসাবে এই মুহূর্তে গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতায় সমগ্র পশ্চিমবাংলা জুড়ে যে বক্তব্যগুলি উপস্থিত করা হচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতা করতে গিয়ে দু’ধরনের বক্তব্য এই মুহূর্তে শোনা যাচ্ছে। প্রথম বক্তব্য, বাংলার অখ-তা বারবার বিপন্ন হয়েছে। আর কোনো অবস্থাতেই এই অখ-তাকে ধ্বংস করতে দেওয়া যায় না। দ্বিতীয় বক্তব্য, মাত্র সাড়ে তিনটি মহকুমা নিয়ে কোনো রাজ্য গঠিত হতে পারে না। তাই গোর্খাল্যান্ড এর দাবিকে মান্যতা উচিত নয়। আমার মতে, দুটি বক্তব্যই বিভ্রান্তিকর।


দার্জিলিং কখনোই অখ- বাংলার অংশ ছিল না। ব্রিটিশ শাসকদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্যেই একে বাংলার সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। যে সময়পর্বে এই সংযুক্তির ঘটনা ঘটে তখন থেকেই ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পৃথকত্বের দাবি উঠে আসছে। এই দাবি উত্থাপনের পেছনে ভাষা সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যই মুখ্য কারণ ছিল। দার্জিলিংকে ঘিরে বাংলা ভাগ হতে দেবো না গোছের সোচ্চার ধ্বনি যত উঠছে, ততই দার্জিলিং-এর মানুষ বিপন্নতা বোধ করেন নিজেদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে। এখানে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতা করতে হবে অনেক বেশি সংবেদনশীলতার সঙ্গে। ওই অঞ্চলের মানুষের সমব্যথী হয়ে তাঁদের সামনে তুলে ধরতে হবে পৃথকত্বের নিস্ফলতার কথা। আচার আচরণে বোঝাতে হবে যে ওই অঞ্চলের পশ্চাদপদতায় বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গের মানুষও একই ভাবে ক্ষুব্ধ। দ্বিতীয়ত, মাত্র সাড়ে তিন মহকুমা নিয়ে রাজ্য হয় না, যুক্তি হিসেবেও এটা অত্যন্ত দুর্বল যুক্তি। যে দেশে গোয়ার মত রাজ্য রয়েছে, সিকিমের মত রাজ্য রয়েছে, দিল্লির মত রাজ্য রয়েছে, সেখানে আয়তনের প্রশ্নে দার্জিলিং-এর দাবিকে প্রত্যাখান করা যায় না। বিরোধিতার স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে মানুষকে বলা উচিত যে, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে এই পথ সমস্যার কানাকড়ি সমাধান করতেও সক্ষম নয়। যে সমস্যায় দশকের পর দশক ধরে তাড়িত হয়ে মানুষ আলাদা রাজ্য চাইছেন, সেই সমস্যার যদি কিছুই না হয়, তবে শুধু শুধু একটি রাজ্য গঠনের কী সার্থকতা রয়েছে। আমার ধারণা বিরোধিতা করতে হলে, এমন একটি অবস্থান থেকেই করতে হবে। কোথাও একটি পৃথক রাজ্যের আওয়াজ উঠলেই তাকে সংবিধান বিরোধী, বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে নিন্দা করলে অনেক সময়েই সেখানকার মানুষকেই দূরে ঠেলা হবে।


সারা পৃথিবী জুড়েই এক ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং বিদ্বৎজনেরভ দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের তাত্ত্বিক চর্চা করে আসছেন, যেখানে অর্থনীতির প্রশ্ন, শ্রেণির প্রশ্নকে লঘু করে এবং সর্বোপরি শ্রমজীবী মানুষের বিশ্ববীক্ষাকে প্রত্যাখান করে আত্মপরিচয়ের সংগ্রামকেই সর্বরোগহর বিপ্লবী পন্থা হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বিশ্বায়নের হাত ধরে এই আন্তর্জাতিক রোগ আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চায় এবং প্রতিটি অঞ্চলের তথাকথিত বিকল্পের রাজনীতির কর্মসূচিতে স্থান করে নিয়েছে। ছোট ছোট জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে থাকা মানুষের মধ্যে পৃথকত্ব সম্পর্কিত মোহ সৃষ্টিতে এ ধরনের জ্ঞানচর্চার এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।


এবার দেখা যাক, বরাক উপত্যকার পৃথকত্বের দাবির দিকে। আমার মতে, বরাক উপত্যকায় পৃথকত্বের দাবি এখানকার মানুষকে নিশ্চিতভাবেই এক অভূতপূর্ব গৃহবিবাদের দিকে ঠেলে দেবে। বরাক উপত্যকার আধুনিক ইতিহাসটি অন্য অঞ্চলের মত নয়, একটু ব্যতিক্রমীই। অন্যত্র অঞ্চলগুলি পৃথকত্ব চায়, আর রাজ্য বা কেন্দ্র তা মানতে চায় না। বরাকে বিষয়টি উল্টো। বরাকে পৃথক হতে চাওয়াটা কখনোই গণদাবী ছিল না। যাঁরা পৃথকত্ব চান তাঁরা সবসময়েই এখানকার রাজনীতিতে ব্রাত্য। মজার কথা, বরাকের চেয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নানা মহল বিভিন্ন সময়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন বরাক উপত্যকাকে আসাম থেকে কেটে ফেলতে। ফলে আমরা দেখব বরাকের পৃথকত্বের বিষয়টি বরাক উপত্যকায় যতটা আলোচিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়, সেখানকার নানা  সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন সংগঠনের সভাসমিতির বক্তৃতায় ও প্রস্তাবাবলীতে। যখনই বরাক উপত্যকার মানুষ তাদের অধিকারের প্রশ্নে সংগ্রামমুখর হয়েছেন, তখনই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কোনো না কোনো সংবাদপত্রে নিবন্ধ বা চিঠিপত্র লিখে কেউ না কেউ বলেছেন, বরাককে আসাম থেকে আলাদা করে দেওয়া হোক। অন্যদিকে, বরাকে দীর্ঘদিন ধরে কিছু সংগঠন পৃথকত্বের দাবি জানালেও বরাকের মানুষ এই দাবিকে বলা যায় পাত্তাই দেন নি। এই দাবি নিয়ে অনেকে নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, কিন্তু কোনো নির্বাচনেই তাঁরা জামানত রাখাই দায় হয়েছে। বরাকের সাধারণ দাবি হচ্ছে, আসামের মধ্যে থেকে আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের ন্যায্য দাবির পূরণ। এ ছাড়াও মনে রাখা উচিত, হাজার বিবাদ বিসম্বাদ সত্ত্বেও বরাকে এখন পর্যন্ত কোনও তীব্র গৃহবিবাদ হয় নি। নানা অভাব অভিযোগ বঞ্চনা সত্ত্বেও এখানকার ভাষা ও সম্প্রদায়ের মানুষ সদ্ভাবে সম্প্রীতিতেই বসবাস করছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে পৃথকত্বের পথে হাঁটবে এ অঞ্চল নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ বিবাদ বিসম্বাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বরাককে পৃথক রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করলেই এখানেও নানা ভাষাগোষ্ঠী ও জনসম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হবে ক্ষমতা দখলের লড়াই। ক্ষমতার কেকটি কে খাবেন, উদ্বাস্তু বাঙালি না স্থানীয় বাঙালি, মনিপুরি না চা শ্রমিক সম্প্রদায় না অন্য কেউ- এ নিয়েও তখন শুরু হবে বিচ্ছিরি ধরনের বিভেদপন্থী রাজনীতি। বরাক উপত্যকায় সামাজিক শান্তি ও সৌহার্দ্যরে স্বার্থেই এখানে পৃথকত্বের দাবি দাওয়া নিয়ে রাজনীতি না করাই বাঞ্ছনীয়। আমাদের দাবি করা উচিত বৃহত্তর বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের। এই দাবি শুধুমাত্র বরাক উপত্যকার জন্যে নয়, সারা দেশেই যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রচলনের জন্যে কেন্দ্র থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে জেলা, জেলা থেকে গ্রামস্তর পর্যন্ত যথার্থ অর্থে বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।এরই সঙ্গে আমাদের অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের বিভিন্ন দাবিদাওয়াগুলি পূরণের দাবিতেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত অংশগ্রহণে জোরদার গণআন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।


বামপন্থীদের এই মুহূর্তে একটি বড় ভূমিকা পালনের প্রয়োজন রয়েছে। এই ভূমিকা পালন করতে হলে, বামপন্থীদেরও চিরাচরিত রণনীতি ও কৌশলের আবর্ত থেকে বেরিয়ে নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। আমরা দেশের নানা প্রান্তে দেখেছি, বিকাশমান বামপন্থী আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে কায়েমী স্বার্থান্বেষীরা বারবার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার ও ভাষা সংস্কৃতির প্রশ্নে জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তুলে শ্রেণি আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই দুর্বলতার পটভূমিতেই বামপন্থীরা নিজেদের শক্তি ধরে রাখতে না পেরে ওই অঞ্চলগুলির রাজনীতিতে প্রান্তিকায়িত হয়ে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে শুরু করে দার্জিলিং, মুম্বইয়ের শ্রমিক মহল্লা থেকে কৃষক আন্দোলনের দুর্জয় ঘাঁটি তেলেঙ্গানা, সর্বত্র আমরা একই ঘটনার সাক্ষী থেকেছি। এতদিন অবধি বামপন্থীদের নীতিগত অবস্থান ছিল যে, ভাষা সংস্কৃতি জাতিসত্তা ইত্যাদির প্রশ্নগুলি জীবনজীবিকার স্বার্থে গড়ে তোলা দুর্বার শ্রেণি আন্দোলন ও গণআন্দোলনের আঘাতে দুর্বল হয়ে পড়বে। বাস্তবে ঘটেছে ঠিক উল্টো। জাতিসত্তা ও ভাষাসংস্কৃতির প্রশ্নই শ্রেণি আন্দোলনকে দুর্বল ও কোণঠাসা করে দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হলে, বামপন্থীদের শুধু নীতিগতভাবে নয়, কর্মক্ষেত্রেও শ্রেণি আন্দোলনের সাথে ভাষা সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রশ্নগুলিকে যুক্ত করতে হবে। এই সমস্ত বিষয়কে একসাথে নিয়েই গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এভাবে সংগ্রাম গড়ে তুললেই সংঘাতের পরিবর্তে এক অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ অন্য অঞ্চলের সংগ্রামরত মানুষের সাথে এক লড়াকু মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হবে। শুধু শ্রেণি আন্দোলন দিয়ে এই কাজটি সমাধা করা অসম্ভব। আমরা অনেকেই এই মুহূর্তে লাতিন আমেরিকার বামপন্থার পুনর্জাগরন নিয়ে খুবই আলোড়িত। লাতিন আমেরিকার দিকে তাকালে দেখব, সেখানে যে নতুন বামপন্থা আত্মপ্রকাশ করছে, তার মূল বৈশিষ্ট্য শ্রেণি আন্দোলনের সাথে সামাজিক আন্দোলনের মৈত্রীবন্ধন। ভেনিজুয়েলা থেকে পেরু, ব্রাজিল থেকে ইকুয়েডর, সর্বত্রই যে বামপন্থী মুখচ্ছবিগুলি আমাদের এই অনুপ্রাণিত করছে, তাঁদের বেশিরভাগই সামাজিক আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসা ব্যক্তিত্ত্ব। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রামের যে বামধারা, তার সাথে রাজনৈতিক বামপন্থার ঐক্যই সেখানে পুনর্জাগরিত বামপন্থাকে এক নতুন ভাষা জুগিয়েছে। এই নতুন বামপন্থার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে সংস্কৃতির সংগ্রাম। এই নতুন বামপন্থা একই সঙ্গে স্থানীয় বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, আবার একই সঙ্গে মার্কিনী পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিকল্পে এক নতুন বিশ্ববীক্ষারও জন্ম দিচ্ছে। আমাদের দেশে জাতিসত্তার আন্দোলনগুলি যখন এক অঞ্চলকে অন্য অঞ্চলের প্রতিপক্ষ হিসাবে উপস্থিত করছে, লাতিন আমেরিকায় বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সংগ্রামগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক বৃহত্তর লাতিন আমেরিকীয় সত্তার নির্মানও করছে। আমাদেরকেও হাঁটতে হবে সেই পথে।



২০১৩ সালের শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তী স্মরণ অনুষ্ঠান সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়ের স্বপ্ন দেখতে যদি আমাদের প্রাণিত করতে পারে, তবেও বলতে পারব, আমরা সঠিক দিশায় আমাদের যাত্রারম্ভ করতে পেরেছি। নচেৎ এক প্রতিযোগিতামূলক আঞ্চলিকতাবাদের নীরব দর্শক হয়ে আমরা আমাদের স্বপ্নগুলির সমাধি রচিত হতে দেখব চোখের সামনে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন