অনেকে বলেন পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ এলেই আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে আমরা শুধু ওই দুটো দিনে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি এটা সত্য নয়। আমার কাছে সমস্যাটা মনে হয় অন্য। এতগুলো বছর ধরে আমাদের জীবনের ওপর আলো ফেলছেন যে রবি, যিনি আবার প্রখরতাপে বটের ছায়াও দেন, তাঁর কাছে আমরা কী চাই তা কি আমরা জানি? কিংবা আমাদের তিনি যা দিয়েছেন এবং আমরা তাঁর কাছে যা চাই, তার মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে কি? পণ্ডিতেরা তাঁর রচনাবলীর সমস্ত প্রান্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাঁর সম্পর্কে আমাদের আলোকিত করেন। আমি সামান্য একজন গায়ক। গানের ভেতর দিয়েই তাঁর সাথে আমার প্রধানত সখ্য। শুধু তাঁর সাথে নয়, তাঁর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, নাটক, চিঠিপত্রের যে সামান্যটুকুতে আমার যাতায়াত হয়েছে, সেই যাতায়াতের পথেও তাঁর গানই আমাকে আলো জুগিয়েছে। এই ছোট্ট পরিসরে যা বলব, তা তাঁর গানের সুরের পথিক হিসেবেই বলব। পথিক শব্দটা বলতে গিয়েও একটু বাঁধল। একটা ন্যূনতম জীবন-পর্যটন না হলে বোধহয় কাউকে পথিক বলা সঙ্গত নয়। এটা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অনুভবেও আমরা জেনেছি, আবার একটি ইংরেজি গানের বাংলা ভাবান্তর করতে গিয়ে আমাদের সম্প্রতি সময়ের এক কবিয়াল বলেছেন, কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়! সম্প্রতি একটি কবিতায় পড়লাম একটি অবিস্মরণীয় পংক্তি, হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে পথ হয়ে গেছি। কবি কী অর্থে বলেছেন এই কথা জানি না। পথ হাঁটার ক্লান্তিতে, নাকি পথ হারানোর ভ্রান্তিতে, নাকি দীর্ঘ পথযাত্রার পরিশেষে পথের সমার্থক হয়ে উঠেছেন আমাদের আদর্শ পথিক, জানি না। সে অর্থে নিজেকে পথিক বলে অভিহিত করব না, করব পথচারী হিসেবে। পথচারীও হয়ত পথিকের মত পথের সাধনা না থাকলেও পথের নেশায় আকুল হয়ে ওঠেন কখনো কখনো। এই নেশার আলো থেকেই বলব কয়েকটি কথা।
রবীন্দ্রনাথকে আমরা তাঁর সমগ্রতায় বিচার করেছি কি? বোধহয় নয়। আমরা সবসময়ই
আমাদের খণ্ড সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের খণ্ডিত জীবনবোধের দ্বারা আমাদের তাৎক্ষণিক চাওয়া পাওয়ার
নিরিখে তাঁকে বিচার করতে চেয়েছি। স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলিতে, যখনও রবীন্দ্রনাথের
শিল্পকীর্তি জনসাধারণ্যে এতটা চর্চিত ছিল না, তখন আমাদের জাতীয় নেতারা চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে
তাঁদের সেই সময়ের চাওয়া পাওয়ার নিরিখে পেতে, তাঁর সৃষ্টিকে গ্রহণ করতে। তখন আমাদের
কাছে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল রবীন্দ্রনাথের পররাজ্যগ্রাস বিরোধী স্বাধীনতাস্পৃহা
উদ্রেককারী উচ্চারণগুলি এবং তাঁর সে ধরনের শিল্পসৃষ্টিগুলিকে বিবেচনার মধ্যে আনার।
সেই সময়ে তাঁর যে সৃষ্টিকেই মনে হয়েছে তাঁদের সেই চাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাকেই
তাঁরা এবং তাঁদের অনুবর্তী হয়ে আমরা বর্জন করেছি। আবার পরবর্তীতে যখন আমাদের খণ্ড সময়ের
প্রয়োজনে মনে হয়েছে নানা পরিচয়ে বিভক্ত সমাজের উর্ধে উঠে একটি বহুত্বের আদর্শকে তুলে
ধরার, তখন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীনতাকে, তাঁর ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ-এ উত্তরণের বার্তাগুলিকে
আমরা খুঁজে নিয়েছি। রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করার এমন প্রয়োজনভিত্তিক চর্চা থেকেই কখনো
‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ কথাটি মন্ত্র হয়েছে, কখনো ‘যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে
ভেসে/ ভাঙো ভাঙো আজ ভাঙো তারে নিঃশেষে’ আমাদের অস্ত্র হয়েছে। কিংবা ‘জনগণমনঅধিনায়ক’
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। কেউ বলবেন এই পাওয়াগুলিও পাওয়া এবং মহার্ঘ পাওয়া। সময়ের
প্রয়োজনে যিনি পাশে এসে দাঁড়ান তিনিই তো পান্থজনের সখা। এ ভাবেই তো তাঁকে আমরা সহ-পথিক
করে নিই। তবে আর অভিযোগ কীসের! প্রশ্ন জাগে মনে, তবে কী ‘দিনের প্রয়োজনের’ রসদের বাইরে
আর যা কিছু রবীন্দ্রনাথের, সবই আমাদের জন্যে বিবেচনায় অপাংক্তেয় হয়ে থাকবে?
অন্যভাবে দেখলে, হয়ত দেখব, আমরা আসলে আমাদের নানা প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে
আমাদের প্রয়োজনের আসরে আমন্ত্রণ জানিয়েছি মাত্র, তাঁর কাছে আমরা এগিয়ে যাই নি। তিনি
যেমন তাঁর ঈশ্বরকে বলেন, ‘আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায় তুমি ছিলে আমার কাছে/
আমি তোমার কাছে যাই নি’। হয়ত এটাই সত্যি, আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে যাই নি। তাঁকে আমরা
ডেকে এনেছি আমাদের সমস্ত দৈনন্দিন বাঁচামরায়। এ ভাবে তাঁকে পেয়েই ভেবেছি আমাদের পাওয়া
যথেষ্ট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জীবনকে বা দেবতার রূপকল্পে জীবনদেবতাকে এই দৈনন্দিন
চাওয়া পাওয়ার গণ্ডীর ভেতরে সীমিত করে রাখতে চান নি। তাঁর জীবনদেবতাকে তিনি বলেছেন,
‘সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে/ এসেছি সকল চাওয়ার বাহির দেশে/ নেব আজ অসীমধারার তীরে
এসে/ প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে’। আসলে আমাদের জীবনসাধনা, প্রকৃতিসাধনা, এমন কি
রবীন্দ্রসাধনা-সবই প্রয়োজনের গণ্ডীতে বাঁধা। সে জন্যেই সেই তাৎক্ষণিক চাওয়ার দাবি পূরণ
করতে গিয়ে আমরা হিরোসিমা তৈরি করি, উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় তৈরি করি, তৈরি করি উগ্র জাতিভাবনা
বা সম্প্রদায়ভাবনাকেও। এমন কী ঈশ্বরবিশ্বাসীর ধর্মসাধনাও কখনো তাৎক্ষণিক জাগতিক চাওয়া
পাওয়াকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। জীবনের প্রতি এমন একটি দৃষ্টিকোণ আমাদেরকে সমগ্রের
সমীপবর্তী হতে দেয় না। আমাদের ভালো-মন্দ বিবেচনা আমাদের হিত-অহিত বোধ সবই স্থান এবং
কালের নিরিখে ক্ষুদ্রতার ঘেরাটোপে বন্দী। সাধারণভাবে একটি মানুষের জীবন স্থান এবং কালের
নিরিখে সংকীর্ণ পরিসীমাতেই বাঁধা থাকে। বাঁধা থাকে ব্যক্তির জন্ম এবং মৃত্যু দিয়ে ঘেরা
পরিসরে। কিন্তু ব্যক্তিকে যখন মানবপ্রবাহ বা জীবনপ্রবাহের অঙ্গ হিসেবে দেখব, তখন সে
অসীমের সন্তান। তখন এই গ্রহ-তারা-মহাকাশের, এই পৃথিবীর, এই সভ্যতার ভালো-মন্দ হিত-অহিত
একজন ব্যক্তির বোধির অবিভাজ্য অংশ হয়ে ওঠে।
একজন প্রকৃত দার্শনিক, কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাধক, বিপ্লবী- এই বোধিতেই
উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। দূর এবং নিকট, ক্ষণকাল এবং চিরকালের মধ্যে সেতুরচনার আর্তিতেই বেজে
ওঠে তাঁদের জীবনবীণা। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা কখনোই সমকাল কিংবা প্রতিবেশ সম্পর্কে উদাসীন
থাকেন না। আবার দৈনন্দিনের নেশায়ও অন্ধ হন না। দৈনন্দিনের চাওয়া-পাওয়াকে বৃহত্তর অর্জনের
বা মহত্তর প্রত্যাশার সাথে একাত্ম করে নেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধও তাই। সে জন্যেই
তিনি যখন ‘ঘরে-বাইরে’ রচনা করেন, তখন তাঁর সামনে দেশের স্বাধীনতা-স্পৃহাটিই একমাত্র
সত্য নয়, তার চেয়েও বড়ো কিছু সভ্যতার সত্যের দায় পূরণ করেই তিনি দেশের দায় মেটানোর
কথা ভাবেন। যাদের চেতনার তার ‘কাছের সুরে বাঁধা’, তারা তাঁর ওই সৃষ্টির গভীরে যে ‘দূরের
বাঁশি’ বাজে তা শুনতে পান না। এমনকি দেশপ্রেমও তাঁর কাছে নিছক স্বদেশবাজী নয়। প্রথমত,
দেশ তাঁর কাছে কোনো রাষ্ট্র বা কাঠামোর চেহারায় আসে না, আসে দেশের অঙ্গাঙ্গী অংশ সাধারণ
মানুষ ও প্রকৃতির সহজাত প্রকাশের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ কখনোই দেশপ্রেমকে বিদেশ-বিদ্বেষের
চেহারায় হাজির করেন নি। তিনি দেশের মাটির ’পরে মাথা ঠেকাতে চান এ জন্যেই কারণ তাতে
বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা আছে। তাঁর সমসময়ের একজন কবি যখন স্বদেশকে সকল দেশের রাণী হিসেবে
তুলে ধরে তার বন্দনা করতে চান, তখন রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ আটপৌরে ঘরের জননী। সে জন্যেই
সমকালীন কবির সেই রাণীতত্ত্বকে প্রত্যাখান করে ঘরের মা’কে বরণ করতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ
বলেন, জানি নে তোর ধনরতন আছে কী না রাণীর মতন/শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায়
এসে। ভিখারিণী মায়ের শতচ্ছিন্ন নোংরা আঁচলেও তার নিজের শিশু যে পরম আশ্রয় খুঁজে পায়,
সেখানেই, সেই সাধারণ্যেই রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছেন দেশকে। তাঁর স্বদেশকে তাই রাণীর অবয়বে
পাই না, পাই আমাদের প্রতিদিনের ঘরের মায়ের ¯স্নেহদৃষ্টিতে। উগ্র জাতীয়তাবাদী উল্লাস
ব্যক্ত করার প্রহরে স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের এমন উচ্চারণ অ-প্রাসঙ্গিকই মনে হয়েছে
আমাদের। আবার অন্যদিকে এটাও সত্য, দেশ থেকে ব্রিটিশ চলে গেলেও রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার
গান বা স্বদেশভাবনা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না। আমাদের অন্যান্য স্বদেশচেতনার গানের বর্তমান
পরিণতির নিরিখে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের গান ওই গানগুলির মত শুধুমাত্র পনেরো আগস্ট আর
ছাব্বিশে জানুয়ারিতে বন্দী হয় নি।
রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরবিষয়ক গানগুলি যত শুনি, যত পড়ি, যত গাই, নতুন নতুন
উপলব্ধি জন্মায়। মাঝে মাঝেই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরবিষয়ক গানের সাথে ধর্মের কোনো
সম্পর্ক নেই। এই গানগুলিকে কোনোভাবেই ধর্মচর্চার অঙ্গ বলেও মনে হয় না। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে
ধর্ম কথাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক বা সংগঠিত ধর্ম হিসেবে দেখেই বলছি। রবীন্দ্রনাথের গানগুলি
একান্তভাবেই একটি ব্যক্তিগত সংলাপ, কোনো সঙ্ঘসঙ্গীত নয়। আমি জানি না, লোকায়ত ধর্মের
গভীর থেকে যে গানগুলি সৃষ্ট হয়েছে, সেগুলিকে আপাতত আলোচনার বাইরে রেখে, রবীন্দ্রসঙ্গীত
ছাড়া নাগরিক বা আধা-নাগরিক আর কোনো ঈশ্বরবিষয়ক সঙ্গীত বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নির্বিশেষে
সকলের এত প্রাণের গান হয়ে ওঠে কি না। এটা কেন? রবীন্দ্রনাথের গানের এই প্রাণময়তা কি
শুধুই এর কাব্যগুণের জন্যে বা সঙ্গীতগুণের জন্যে? নাকি অন্য কোনও সত্যও নিহিত আছে এতে?
একটি অন্য কথা মাঝে মাঝেই মনে হয়। মানুষের সমাজে বা মনোজগতে ঈশ্বরের উদভাস এসেছে ধর্মের
জন্মের অনেক আগেই। জগৎ-জীবন সম্পর্কিত তার বিস্ময়বোধ, তার অন্তহীন জিজ্ঞাসাকে ঘিরে
জন্ম নেওয়া তার নিজের সাথে সংলাপকে যে প্রতিকল্পে সে ব্যক্ত করেছে, সেই তার ঈশ্বর।
সেই ঈশ্বর তার দূরের স্বপ্ন, কাছের বন্ধু। ধর্ম এসে তার এই কাছের ঈশ্বরকে ছিনিয়ে নিয়ে
স্থাপন করেছে দুর্লঙ্ঘ উচ্চতায়। তাকে ঘিরে তৈরি করেছে অসংখ্য আচার আর সংহিতা। তৈরি
হয়েছে নিষেধের প্রাচীর। আমার কখনো মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গানের ঈশ্বর ধর্মকারাগার থেকে
মুক্ত হয়ে ফিরে যান তাঁর সেই আদিকল্পে, যার সাথে মানুষের হয়েছিল সভ্যতার প্রথম সংলাপ।
সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরকে ঘিরে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলের এমন প্রাণবন্ত সংলাপ
জমে ওঠে। আচারসর্বস্বতার বাইরে আমাদের লোকায়ত ধর্মের যে ঈশ্বর তার বাসও প্রায় সেখানেই।
প্রায় বললাম এ জন্যেই লোকায়ত গানের যেখানে আচারধর্ম আর বিচারধর্মের সংঘর্ষের চিহ্ন
রয়েছে, সেখানে আচারসর্বস্ব ধর্মের গভীরে অন্তর্ঘাত করতে গিয়ে বিচারধর্ম কখনো কখনো কতগুলি
ছদ্মবেশ ধারণ করে, যাকে প্রকৃত চেহারায় না চিনলে ভ্রম হতে পারে। এই ভ্রম শুধু বাইরের
শ্রোতার কাছে নয়, যাঁরা এই অন্দরের সাধক তাঁদেরও বিভ্রান্ত করে।
কবির কবিতায় যেমন শব্দ শব্দার্থের শেকল ছিঁড়ে ভাবার্থের দিকে পা বাড়িয়ে
এক মায়ালোক তৈরি করে, রবীন্দ্রনাথের গান, নাটক, নিবন্ধেও তেমনি ঘটে। শব্দার্থে তার
সবটা ধরা পড়ে না। শব্দার্থের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যদি আমরা তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকাই,
তবে দেখব তাঁর গান নাটক চিঠিপত্র গদ্য ছবি সবকিছুর মধ্যে একটি অচ্ছেদ্য সূত্র রয়েছে।
প্রেমের গান, পুজার গান, দেশের গান, প্রকৃতির গান এ ধরনের জলবিভাজন রেখা দিয়ে যেমন
তাঁর গানকে বিভাজিত করা যায় না। সবগুলো একে অপরের সাথে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। তেমনি
সব মিলিয়ে তাঁর সৃষ্টি যেন এক জীবন-বেদ। এর কেন্দ্রে তাঁর সামগ্রিক জীবনবোধ। এই জীবনবোধের
প্রকাশকে খণ্ড খণ্ড করে তুলে এনে নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার করাটাই আমার বিবেচনায়
আমাদের এতদিনকার সাধারণ রবীন্দ্রচর্চার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে। জগৎ-সংসারের যে কোনো
বিষয় নিয়ে বক্তৃতা দিতে উঠে একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা প্রবন্ধের উদ্ধৃতি না থাকলে
বাঙালি বুদ্ধিজীবী থেকে রাজনৈতিক নেতা নেত্রী কারোরই যেন ঠিক জাতে ওঠা হয় না। বিবাহ-বার্ষিকী
থেকে ছেলের জন্মদিন, প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন- এখানেও চাই রবীন্দ্রনাথের এক আধটা পংক্তি।
আর আমাদের শ্লাঘা ঝরে পড়ে এমনতর সংলাপে, জীবনের একটিও ক্ষেত্র নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ
কিছু বলে যান নি। আমাদের এমনতর রবীন্দ্রচর্চাতেই চারপাশ সদাসর্বদা সরগরম। এই খণ্ডিত
চর্চা শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে আটকে নেই। মে দিবস থেকে শ্রীশ্রী ঠাকুরের
জন্মদিন অবধি এমন কোনোদিন নেই যেদিন আমরা রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করি নি। দেখতে দেখতে
শুনতে শুনতে মনে পড়ে তাঁর গানেরই লাইন, তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে
কোলাহল/সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল।
এই হলাহল আর কোলাহল ছেড়ে কবে এক ভিন্নতর রবীন্দ্রচর্চায় আমরা রত হব তারই
পথ চেয়ে আপাতত থাকতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন