মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

সেই আদ্যিকালের পশুর ঠ্যাং ও আজকের রাজনীতি

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এই গল্প। ‘মন্দিরের সামনে গরুর ঠ্যাং রেখে দিয়ে গেছে ব্যাটারা`। কিম্বা ‘মসজিদের সামনে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা শুয়োরের ঠ্যাং রেখে গেছে`। সব গল্পের শেষ এক দৃশ্যে, দাঙ্গা। দাঙ্গা, রক্তপাত, পাথর ছোঁড়া, নিরীহ মানুষের মৃত্যু, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া, কারফিউ, নিরাপত্তা বাহিনীর টহল ইত্যাদি। এত গেল আইনশৃঙ্খলার দিক। তারচেয়েও মারাত্মক যে কাজটি এই গল্প করে যায়, যার রেশ থেকে যায় কারফিউ ওঠার, সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ারও অনেক অনেকদিন পর অবধি, তা হল- দীর্ঘদিন ধরে সুখে শান্তিতে পাশাপাশি বাস করা প্রতিবেশীর মধ্যে অবিশ্বাসের বিষ-হাওয়া ঢুকিয়ে দেওয়া। এই গল্পের শুরু ব্রিটিশ আমল থেকে। মায়ের মুখে ছোটবেলায় শুনেছি, মন্দির বা মসজিদের সামনে বিশেষ পশুর হাড় বা মাংসের টুকরো, তারপরই দু`দিক থেকে ‘বন্দে মাতরম` আর ‘আল্লাহো আকবর` রণধ্বনি। তারপর দেশ স্বাধীন হল। কত কত রঙের সরকার এল আর গেল। তবু এই গল্পের শেষ নেই।


মনে পড়ে ১৯৮০ সালের লোকসভার নির্বাচনের সময়ের কথা। মনে পড়ে ১৯৮৬-৮৭ থেকে শুরু করে ১৯৯২-৯৩ সাল অবধি সময়পর্বের কথা। তারপর বরাক কুশিয়ারা জিরি চিরি দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। পুরনো গল্প কার্যকারিতা হারানোয় নতুন গল্প এসেছে। সে জন্যেই হয়ত, কিছুদিন আগে শুনেছি অন্য গল্প। কে কাকে বিয়ে করল, সেই নিয়ে উপত্যকা জুড়ে চলল ফিসফিসানি আর চক্রান্তের জাল বোনা। অনেকদিন এই গল্প শুনিনি বরাক উপত্যকায়। আজ সকালে ইন্টারনেটের পাতায় শিলচরের খবরের কাগজের সংবাদ শিরোনাম ভেসে উঠতেই চমকে উঠলাম, শিউরে উঠলাম এবং সত্য কথা বললে, এক নিদারুণ যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝেই ভাবি, আমরা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা কি সত্যিই নিতান্ত ক্ষমতাহীন? আমাদের শুভবুদ্ধির কোনও শক্তি নেই, নেই এর কোনও দাম? যার যখন ইচ্ছে হল, তখনই মুহূর্তে এক সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভরিয়ে দিল গোটা সমাজের আকাশ। তবে আমরা যে প্রতিদিন একসাথে বাঁচি, একসাথে হাসি, একসাথে কাঁদি, শিলচর থেকে গুয়াহাটি বাসযাত্রা করতে গিয়ে ধর্মনির্বিশেষে এক সাথে নাজেহাল হই, তা কি আমাদের দু’টি হৃদয়ের মধ্যে কোনও শক্তিশালী সেতু গড়ে তুলতে পারে না? কেন কোনও সমাজবিরোধীদের ইচ্ছা হলেই এক মুহূর্তে, সেটা কারো বিয়ে হোক বা কোনও শিশুর মর্মান্তিক হত্যা হোক বা কোনও জনপ্রিয় চিকিৎসকের অপহরণের ঘটনা হোক, তাকে ব্যবহার করে এই শহরে এই উপত্যকাকে বিষের হাওয়ায় ভরিয়ে দিতে পারে? পারে জনজীবনকে তছনছ করে দিতে? এটা কী কারো বুঝতে বাকি থাকে, গতকাল যে ঘটনা দিয়ে শহরকে অস্থির করে উপত্যকায় আবার একটা সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ আনার চেষ্টা হল, সেটা সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত। নয়ত হঠাৎ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট শহর ও গঞ্জগুলিতে আবার নব্বইয়ের কায়দায় সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে কেন? কেনই বা হঠাৎ আবার অযোধ্যা নিয়ে সিংঘল, তোগাড়িয়ারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন? মাঝে দেশের মানুষ সিংঘল কোম্পানির নামই ভুলে গিয়েছিলেন হয়ত। তাদেরও রাম জনমভূমি বা অন্য ইস্যু নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না। প্রায় নির্বাসনই হয়ে গিয়েছিল সংবাদ পত্র থেকে। এখন সিংঘলও সক্রিয়, গ্রামে শহরে বানর বাহিনীও সাজসজ্জা শুরু করেছে।


ক‘দিন ধরেই মনে মনে আতঙ্কে রয়েছি বরাক উপত্যকা নিয়ে। যে দিন থেকে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করার স্বপ্ন ফেরি শুরু হয়েছে আমাদের দেশের কর্পোরেট মিডিয়া ও কর্তাদের তরফে, তখন থেকেই এই আতঙ্ক। গুজরাট গণহত্যার নায়ক নরেন্দ্র মোদী যতই উন্নয়নের মুখোস পড়ুন এবং ঈদের দিন মুসলিমদের টুপি নিজের মাথায় দিন, তার যে কোনও রাজনৈতিক প্রচারাভিযান উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ব্যতিরেকে কখনো হয় নি আর হবেও না। মজার কথা, একসময়ে মুলায়ম সিং যাদব ঈদের সময় মুসলিমদের মত টুপি পড়ায় নরেন্দ্র মোদী ও সারা দেশজুড়েই সঙ্ঘপরিবারের লোকেরা মুলায়মকে মৌলানা মুলায়ম বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই সঙ্ঘ পরিবারওয়ালাদের এইটেই মজার ব্যাপার, নিজেরা বাঁশকান্দির মৌলানার কাছেই যান আর জামা মসজিদের ঈমামর কাছে যান, ওরা গেলে সেটা ধর্মনিরপেক্ষতা। যদি অ-বিজেপি কেউ এই একই কাজ করেন, তবে সেটা মুসলিম তোষণ। যাইহোক, এবার ঈদের সময় নরেন্দ্র মোদী তাঁর নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষতায় মুসলিমদের টুপি মাথায় পড়লেও, তাকে নিয়ে বিজেপি ও কর্পোরেট মিডিয়ার উৎসাহী প্রচার শুরু হতেই দেশের নানা জায়গায় নব্বইয়ের কায়দায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর কাজও শুরু হয়ে গেছে। বিহারে অশান্তি, কর্ণাটকে অশান্তি, উত্তরপ্রদেশে তো বাঁদর-নৃত্য শুরু হয়েছে। আমার ভয় ছিল, কবে এই বাঁদর-বাহিনী বরাকের মাটিতে থাবা বসায়। গতকালের ঘটনা আমার কাছে সেই দেশব্যাপী অশুভ পরিকল্পনারই অংশ বলে মনে হয়েছে।


খবরের কাগজে এই যন্ত্রণাদায়ক সংবাদ প্রতিবেদনটি পড়েই ফোন করেছিলাম কয়েকজন বন্ধুকে। সবাই বললেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত। চিন্তার কোনও কারণ নেই। তাঁদের কথায় আমি আশ্বস্ত হয়েছি ঠিকই, তবু কয়েকটি কথা বলব। আমার মনে হয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে পথে নামতে হবে। আমরা যাঁরা বরাক উপত্যকার মানুষ, কিন্তু এই মুহূর্তে বাইরে থাকি, তাঁরা এ ধরনের খবর শুনলে অস্থির হয়ে ওঠেন। নাট্যকর্মী সুব্রত রায় ফেসবুকে বলেছেন, এই মুহূর্তে পথে না নামাই উচিত। তাঁর মতে, এতে উত্তেজনা বাড়তে পারে। তাঁর স্পষ্ট বিশ্বাস, বরাক উপত্যকার নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনটি অনেক বেশি শক্তিশালী। গুটিকয়েক সমাজবিরোধীরা একে বিনষ্ট করতে পারবে না। ওর এই কথা সাথে অনেকাংশে একমত হয়েও আমার ধারণা, পথে নামা উচিত। এই মুহূর্তে সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন যারা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের তীব্র বিরোধী, তাঁদের পথে নামতে হবে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্যেই। যাঁরা ভাবছেন গরু ছাগল শুয়োরের ঠ্যাং দেখিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন, তাদের দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে যে, বেশির ভাগ মানুষ এসব গরু ছাগল শুয়োরের সুড়সুড়িতে বশ হন না। অবিশ্বাস আর বিষের অপশক্তির চেয়ে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের মিছিল অনেক বেশি শক্তি ধরে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন