সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০০৯

অসম না আসাম ? : নামে কিবা আসে যায়?


একমাত্র গণশক্তি এবং আজকাল-ই এখনও আসামকে অসম নয়, আসাম-ই লিখছে। কলকাতার বাকি সমস্ত সংবাদপত্র, এমনকি লিটল ম্যাগাজিনও আজকাল আসাম লিখছে অসম হিসাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সারা ভারত জুড়েই তো চলছে নাম বদলের ব্যাপার। বোম্বে মুম্বই হল, মাদ্রাজ চেন্নাই হল, ক্যালকাটা হল কলকাতা, কিংবা হালে ব্যাঙ্গালোরও হয়েছে বেঙ্গালুরু, এই ধারাবাহিকতায় আসাম অসম হলে আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই। সকলেই ফিরে যাচ্ছে স্থানগুলির মূল নামে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিহ্ন মুছে ফেলার এই উদ্যোগ আর যাই হোক নিন্দনীয় নয়। সব পরিবর্তন সকলের মত মেনে নিলেও আসামের ক্ষেত্রেই গণশক্তি বা আজকাল পরিবর্তনটি করছে না কেন? এটা কি টেলিগ্রাফ কাগজের মত একগুঁয়ে মনোভাব? ইংরেজি বাংলা হিন্দি ওড়িয়া নির্বিশেষে সকলে কলকাতা লিখলেও তারা যেমন এখনও ক্যালকাটাই লিখে চলেছে কলকাতা না লিখে। বিষয়টি কি এমন? বলা বাহুল্য, এমনটা নয়। আজকাল-এর ক্ষেত্রেও বিষয়টি যেমন একগুঁয়ে মনোভাবের ব্যাপার হতে পারে না, গণশক্তির মত মতাদর্শগত চালিকাশক্তি দ্বারা নির্ধারিত সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে তো নয়ই। সেখানে নীতি ছাড়া, অভ্যেস বা একগুঁয়ে মনোভাব কোনও ভূমিকা নেয় না। ফলে বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
নানা ভাষা ও নানা জাতিগোষ্ঠীর বাসভূমি আসাম নিয়ে যত রাজ্যের যত বিভ্রান্তি। শুধু বাইরে নয়, বিভ্রান্তি আসাম রাজ্যের ভেতরেও। ছোট্ট একটা রাজ্যের মধ্যে এত ভাষা ও জাতিগত বৈচিত্র্য যে এখানকার এক অংশের মানুষ অন্য অংশের গত দু’শো বছরের ইতিহাস নিয়েও নানা বিভ্রান্তিতে ভোগেন। এখন বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে খোদ রাজ্যের নাম নিয়েও। সমস্যা, আসামকে বাংলা বা ইংরাজিতে কী বলা হবে? অসম, অহম না আসাম। ইংরাজিতে নতুন বানানে Assam এর বদলে কেউ লিখছেন Asom, আবার কেউ Axom। এমনিতে ভাবতে গেলে এ নিয়ে জটিলতার কোন অবকাশ নেই। ক্যালকাটা যদি কলকাতা হয় বা বোম্বে, মুম্বই - তবে আসাম অসম হতে আপত্তি কোথায়? আসামের ভাষা রাজনীতির গভীরে গিয়ে বিষয়টি না দেখলে এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বস্তুত, আজকাল কেউ জেনে বুঝে, কেউ বা অজ্ঞানতাবশত তড়িঘড়ি বাংলায় ‘অসম’ লিখতে শুরু করে দিয়েছেন। সমস্যা দু’টি। প্রথমত, সংবিধানগত ভাবে এখনও আসামের নাম আসাম-ই। মহীশূর বা মাদ্রাজের মত সংবিধান সংশোধন করে কর্ণাটক বা তামিলনাড়– হয় নি। রাজ্যের প্রধান শহর গৌহাটি সরকারিভাবেই এখন গুয়াহাটিতে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের নামের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। অন্যদিকে, অসমীয়াতে আসামকে অসম লেখা হলেও উচ্চারণে তা অহম, অসম নয়। বাংলায় অসমীয়া অনুসারী বানান লিখতে হলে অহম লেখা বাঞ্ছনীয়, অসম কখনোই নয়। বাংলায় ‘অসম’ যে ভাবে উচ্চারিত হয়, সে নামে কোনও রাজ্য ভূ-ভারতে নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, যখন গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত ইংরাজি সংবাদপত্র বা সরকারি কাগজপত্রে ‘আসাম’ শব্দ ব্যবহার এখনও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, এমন কি তরুণ গগৈ-র নেতৃত্বাধীন সরকার যারা মন্ত্রিসভার আচমকা এক সিদ্ধান্তে রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে সরকারিভাবে ‘অসম’ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আসামের জনসাধারণের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় পিছু হটে তারা এখনও সরকারিভাবে রাজ্যের নাম ‘আসাম’-ই বহাল রেখেছেন, তখন কলকাতার আনন্দবাজার তড়িঘড়ি ‘আসাম’ বিদায় দিয়ে ‘অসম’ লিখতে শুরু করল কেন? এ প্রশ্নেরও উত্তর সম্পৃত্ত হয়ে আছে আসামের ভাষা রাজনীতির গভীরে। তবে প্রথমে আসা যাক, রাজ্যের প্রাচীনতম নামের প্রশ্নে। কোনটি আদি নাম? আসাম না অসম? আসামের নামকরণ হয়েছে প্রকৃতপক্ষে শ্যাম জাতির অধ্যুষিত দেশ, আ-শ্যম থেকে। শ্যাম বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে আগত আহোম নামের মঙ্গোলীয় বংশদ্ভূত মানুষদের কথা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরাও আ-শ্যম থেকেই রাজ্যের নামকরণ করেছিল, আসাম। আ-শ্যম কথা থেকেই আসলে আহোম শব্দটি এসেছে। আহোম থেকেই এসেছে অহম। ‘অসম’ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ‘অহম’ নামের সংস্কৃতকরণের বা আর্যীকরণের ফল। এই সংস্কৃতকরণ বা আর্যীকরণের ব্যাপারটিও একটি বিচিত্র ব্যাপার। এই মুহূর্তে সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতের সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সব ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভারতীয়ত্ব বর্জন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী পথে হাঁটানোর চেষ্টা চলছে। এখন মনিপুরের জাতীয়তাবাদীরাও বৈষ্ণবীয় পরম্পরাকে ভারতীয় আগ্রাসনের পূর্বসূরী আখ্যা দিয়ে প্রাক-বৈষ্ণব ধর্মে ফিরে যাওয়ার উন্মাদনায় রাজ্যের নাম বদল করে ‘কাইলেংপাক’ করতে চান। সেই ধারাতেই নিজেদের পদবীর শেষে সিংহ ব্যবহার বাদ দিয়ে নামের শুরুতে গোত্র নাম ব্যবহার শুরু করার চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে ইদানিং। বাংলা লিপি ও বৈষ্ণব ইতিহাসের সমস্ত স্মারক মুছে দেওয়ার জন্য শতাব্দী প্রাচীন গ্রন্থাগারের কয়েক লক্ষ বইয়ের বহ্ন্যুৎসব হয়েছে। উনবিংশ শতকে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী। আসামের কথাই ধরা যাক। আজ যে আসামের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ কথায় কথায় ভারতীয়ত্ব বর্জনের কথা বলেন, সেই সংগঠন, সেই জাতীয়তাবাদীরা উনবিংশ শতকে অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষপর্বে নিজেদেরকে আর্য সভ্যতার উত্তরসূরী প্রমাণ করার জন্যে তৎপর ছিলেন। উত্তর ভারতীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করতে চেয়ে তাঁরা এমনও অভিমত সেদিন প্রকাশ করেছিলেন যে অসমীয়া ভাষায় আধুনিক সঙ্গীত বা সাহিত্য রচিত হতে পারে না। এই ভাষা কেবল লোকসঙ্গীত বা লোকসাহিত্যেরই পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে। আধুনিক অসমীয়া সঙ্গীতকে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সুর শুধু নয়, বাণীর জন্যেও আশ্রয় নিতে হবে বাংলা বা হিন্দি ভাষার কাছে। এই প্রবণতার বিরুদ্ধেই লড়াই করে পরবর্তীতে অসমীয়া আধুনিক সঙ্গীতের রূপকার, আসাম গণনাট্যের প্রথম সভাপতি জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়াল অসমীয়া লোক সুরের পরম্পরা ও অসমীয়া ভাষার বিচিত্র সৌন্দর্যকে নির্ভর করে তৈরি করেন অসমীয়া আধুনিক গানের প্রাথমিক ভিত্তি। আবার ফিরে আসি, রাজ্যের নামকরণের প্রশ্নে। অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষ পর্বে সংস্কৃতকরণের পর্যায়ে, আসামকে পাহাড় সমতলের সমন্বয়ে গড়া অ-সম মাটির দেশ থেকে রাজ্যের নাম হয়েছে ‘অসম’, এমনটাই বলার চেষ্টা হয়েছে। এই কথা বলে ‘অহম’ শব্দের বানান পাল্টে করা হয় ‘অসম’। যদিও উচ্চারণ একই থাকে। এই দাবি সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক। আসামে ব্যবহৃত কোন ভাষারই পূর্বরূপে সংস্কৃত-অনুরূপ এ ধরনের কোনও শব্দ নেই। সময়ের দীর্ঘ পরিবর্তনের পর আর্য সভ্যতার সাথে নিজেদের একাত্ম করে তোলার বিপরীত পথেই অবশ্য যাত্রা করছে অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বা সাংস্কৃতিক রাজনীতি। এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে, সাংস্কৃতিক-রাজনীতির ভিন্নতর কৌশল হিসাবে ‘অসম’ নাম নিয়ে চলছে কূট রাজনীতি। এক উগ্র জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রকল্প নির্মাণের অঙ্গ হিসাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে রাজ্যের নাম বিষয়ক রাজনীতির বিষয়টি। বাস্তবে আসাম রাজ্যটি বহুভাষিক বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাজ্য। প্রধান জনগোষ্ঠী অসমীয়া ভাষীরা মোট জনসংখ্যার মাত্র অর্ধেকের একটু বেশি। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আদম সুমারিতে বঙ্গভাষী মুসলিমদের রাজনৈতিক চাপ ও ভীতি প্রদর্শন করে অসমীয়াভাষী বলে ঘোষণা করতে বাধ্য করে। এর পর আবার ১৯৭১ সালের আদম সুমারিতে শাসকশ্রেণির পরিকল্পনায় ও আইএনটিউসি’র প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা শ্রমিকদেরদেখানো হয়েছে অসমীয়াভাষী হিসাবে। আসামে অসমীয়া জাতির জাতি গঠন প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক রাস্তা ছেড়ে ইতিহাসে বারবারই রাজনৈতিক কূট কৌশলের পথে হেঁটেছে। আসামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, যেমন কার্বি, লালুং, আহোম, মটক, কোচ, রাভা, এমন কি বড়োরাও, জাতি গঠন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ঐতিহাসিক পথ ধরে অসমীয়া জাতিসত্তার সাথে যখন সম্পৃত্ত হচ্ছিল, তখন বর্ণহিন্দু অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি উগ্র জাতীয়তাবাদের পথ ধরে আগ্রাসনের পথে হাঁটতে শুরু করে। যার ফলশ্র“তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী পরিচিতিকে সামনে রেখে এই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসে আসামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা জনগোষ্ঠীর মানুষও ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছিলেন অসমীয়া জাতিসত্তাতেই। উগ্রতার রাজনীতির উত্তরে এখন তারাও উগ্রতার পথ ধরেছেন। একই বিষয় বঙ্গভাষী মুসলিমদের ক্ষেত্রেও। রাজনৈতিক চক্রান্তে তারা ভাষিক পরিচয় হারালেও উগ্র জাতীয়তাবাদী অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি এঁদেরকে কখনো অসমীয়া মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করে নি। তাদের ন-অসমীয়া নাম দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে অসমীয়া জাতিসত্তার ভেতর আঙ্গিনার একটু বাইরে। তাদের অসমীয়া পরিচিতি ব্যবহার করা হয়েছে শুধু মাত্র আদম সুমারির প্রয়োজনে। এর ফলে, বাঙালি জাতিসত্তার বাইরে বেরিয়ে যাওয়া এবং অসমীয়া জাতিসত্তায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়া এই মাতৃভাষা-হারা জনগোষ্ঠীর জন্য একমাত্র পরিচিতি থেকে যায় তার ধর্মীয় পরিচয়। ফলেই ধর্মীয় পরিচিতিকে কেন্দ্র করেই এই মুহূর্তে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ চান। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে আসামের রাজনীতিতে এইউডিএফ নামে একটি ধর্মীয় পরিচিতি-কেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করার মধ্যে। এই দলের রাজনীতিতে মুসলিম ধর্মীয় গুরুরা প্রধান ভূমিকা পালন করলেও এর পতাকা তলে সামিল হয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বঙ্গভাষী মুসলিমদের এক বিরাট অংশ। কখনো বিদেশি, কখনো বহিরাগত, কখনো বাংলাদেশি নাম দিয়ে যাদের দশকের পর দশক ধরে নির্যাতিত করা হয়েছে, তারা এখন মুখর হয়েছেন। এই দলের সমর্থকরা কংগ্রেসের আদি ভোটার, এই দলের নেতারা কংগ্রেসেরই হয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দশকের দশক ধরে সংখ্যালঘু ভোট আদায় করেছেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বলতায় তারা পৃথকত্বের পথে হাঁটলেও এই প্রচেষ্টার গভীরে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের আর্তি লুকিয়ে আছে, তা বিস্মৃত হলে বোধহয় চলবে না। আসামের ভৌগোলিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও ভাষিক বহুত্ব একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা, যে বাস্তবতাকে অস্বীকার করাই স্বাধীনতা পরবর্তী আসামের শাসকশ্রেণির রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। উল্টোদিকে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বামপন্থীদের নেতৃত্বে এবং এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষা ও জনগোষ্ঠীর আন্দোলনগুলি এই বহুত্বকেই রাজনৈতিক ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এখান থেকেই ‘আসাম’, ‘অসম’-এর ব্যাপারটি বোঝা সহজ হবে। সঙ্ঘ পরিবার যেমন উগ্র হিন্দুত্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতবর্ষকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান এর ফর্মুলায় সাম্প্রদায়িক একীকরণের যোজনা নিয়েছে, তেমনি আসামেও উগ্র জাতীয়তাবাদীরা আসাম-অসম-অসমীয়া এর ফর্মুলায় ভাষিক আগ্রাসনের প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকে। কংগ্রেসের শরীর থেকে তথাকথিত সংখ্যালঘু তোষণের গন্ধ মুছে ফেলে উগ্র অসমীয়া সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের কৃপালাভের আশায় গত নির্বাচনের পর মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-র ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার উদ্যোগে রাজ্য মন্ত্রিসভা আসামের নাম সরকারিভাবে বদলে অসম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর পর অসমীয়া অনসমীয়া নির্বিশেষে সারা আসামে বিরাট বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাজ্যে একের পর এক বন্ধ্ পালিত হয়। বিদেশে বসবাসরত অসমীয়াভাষীদের সংগঠনগুলিও সরকারকে এই আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত থাকতে আবেদন জানায়। তারপরই পিছিয়ে আসে সরকার। আসামে সরকারিভাবে রাজ্যের নাম আসাম-ই রয়ে যায়। অসমীয়া ভাষায় আগের মতই রাজ্যকে লেখা হয়, অসম, উচ্চারণে যা অহম। এখন ফিরে আসা যাক, আনন্দবাজারের আসামকে অসম লেখার ইতিহাসে। এই ইতিহাসও কম চমকপ্রদ নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, গত শতকের আটের দশকে আসামের যে তথাকথিত বিদেশী বিতাড়ণ আন্দোলন সারা ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তার শুরুয়াৎ ছিল আনন্দবাজারের গণবহ্ন্যুৎসব দিয়ে। আটাত্তরের আসাম বিধানসভা নির্বাচনে প্রথমবার সিপিআই(এম) ১১ টি আসন সহ বামপন্থীরা সর্বমোট ২৫ টি আসন পেলে আনন্দবাজারের পাতায় বিশিষ্ট সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, আসামে সিপিএমের অগ্রগতি মানে বাঙালিদের আধিপত্য বিস্তার। এই লেখা প্রকাশিত হতেই আসাম জুড়ে তৈরি হল উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট উন্মাদনা, যার লক্ষ্য, একদিকে বঙ্গভাষীরা এবং অন্যেিদক তাদের দোসর ঠাউরে রাজনৈতিকভাবে অসমীয়াভাষী বামপন্থী কর্মীরা। অভূতপূর্ব হিংসাত্মক আক্রমণের জেরে প্রাণ হারালেন একদিকে শতাধিক অসমীয়াভাষী সিপিআই(এম) কর্মীরা, অন্যদিকে স্থানে স্থানে দেখা দিল বঙ্গভাষী মানুষের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ। আনন্দবাজার সহ সমস্ত বাংলা সংবাদপত্র এবং বাংলা চলচ্চিত্রের উপর ঘোষিত হল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। এক দশক ধরে এই অবস্থা চলার পর কুখ্যাত আসাম চুক্তির পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় এল আন্দোলনকারীদের তৈরি নতুন রাজনৈতিক দল অসম গণ পরিষদ বা অগপ। সেই গণউন্মাদনার নায়ক প্রফুল্ল মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এক মাস পরই এলেন ক’লকাতা সফরে। এসেই আশ্চর্য, এতদিন ধরে ঘোষিত ‘গণশত্র“’ আনন্দবাজার পত্রিকা দফতর পরিদর্শনে গেলেন। এই সফরের পর প্রায় রাতারাতি আনন্দবাজার তাদের সমস্ত প্রকাশনায় আসামকে ‘অসম’ লিখতে শুরু করল। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের স্বঘোষিত অভিভাবক যখন এমন পরিবর্তন করলেন, তখন পিছিয়ে থাকলেন না অন্যান্য সংবাদপত্র বা লিটল ম্যাগাজিনগুলোও। আসামের ভাষা-রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে অতটা সচেতনতা না থাকায় অনেকেই ভাবলেন আসামের নাম পরিবর্তনটি বোধহয় ঔপনিবেশিক চিহ্ন মোছারই প্রয়াস, যা চলছে সারা দেশ জুড়েই। ব্যতিক্রম, দৈনিক গণশক্তি এবং দৈনিক আজকাল। ভাষিক আগ্রাসনের এই প্রচেষ্টায় যোগ না দিয়ে বহুভাষিক বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত আসামের সরকারি নামেই এখনও স্থিত আছেন। এই অবস্থান আসামের বহুত্বের প্রতিরোধ ও উগ্র ভাষিক আগ্রাসনের মধ্যে চলা লড়াইয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিগত অবস্থান, যা গণতান্ত্রিক কন্ঠস্বরকে শক্তিশালী করছে। লড়াই চলছে। যদিও এর শেষ কোথায় এখনও জানা নেই।

শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০০৯

বদরুজ্জামান চৌধুরীর গল্পের ভুবন- এক অজানা প্রতিবেশের মুখোমুখি


একজন পরিশ্রমী গল্পকারের সৃষ্টি নিয়ে কোনো অর্বাচীন পাঠকের মন্তব্য করার অধিকার কতটুকু? সাহিত্য যেমন একটি শিল্প, সাহিত্য সমালোচনাও তেমনি একটি মননশীল শিল্পকর্ম। ফলেই এই জগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো ব্যক্তির আলটপকা মন্তব্যকে সাহিত্য সমালোচনা হিসাবে গ্রহণ করার কোনো যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই। সেজন্যেই এ লেখার শুরুতেই এই আত্মপক্ষ হাজির করা জরুরী যে বর্তমান নিবন্ধটি বদরুজ্জামান চৌধুরীর মত গল্পকারের গল্পগ্রন্থের কোনো সমালোচনা নয়। সমালোচনা লিখবেন নিশ্চয়ই কোনো না কোনো যোগ্য সমালোচক। এটা এক অর্বাচীনের দীন প্রতিক্রিয়া।
গল্প লিখছেন বদরুজ্জামান অনেক দিন ধরেই। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন, দৈনিক সংবাদপত্রের সাহিত্য পাতায় তার গল্প দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশিত হয়ে আসছে। বরাক উপত্যকার গল্প বিষয়ক নানা সঙ্কলনে তার গল্প স্থান পেয়েছে সসম্মানে। বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন তাঁকে সম্বর্ধিত, পুরস্কৃত করেছে অনেকবার। কিন্তু তবু তাঁর গল্পচর্চার একটা নিভৃত পরিসর রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরেই। শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে তিনি শুধু থাকেনই না, তার গল্পের ভুবন, তার গল্পচর্চা, খুব কাছেই, কিন্তু একধরণের প্রান্তিকতায় স্থান পেয়ে আছে দীর্ঘদিন। অথচ তাঁর গল্পে তিনি উন্মোচন ঘটিয়েছেন বৃহত্তর বরাক উপত্যকার সমাজের এক বৃহৎ অনালোকিত অংশের। বদরুজ্জামান চৌধুরীর গল্পের ভুবন আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশ হওয়া সত্ত্বেও তলিয়ে আছে আমাদের অজ্ঞানতার অতলে। এখানে ‘আমাদের’ শব্দটি একটি কুহকের সৃষ্টি করতে পারে। এই ‘আমরা’ কারা? এই আমরা তারাই যারা এই উপত্যকার সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতির বেশীর ভাগ পরিসর আলোয় আলো করে রেখেছি। এই আমাদের আমিত্বে একটা সামগ্রিকতার ভ্রম আছে। কিন্তু ভ্রম কেটে গেলে দেখা যায়, এই আমরা আসলে একটি খণ্ডিত ‘আমরা’। বরাক উপত্যকার সমাজের এক বৃহৎ অংশ সম্পর্কে অজ্ঞানতা এই খণ্ডিত ‘আমরা’ এর পরতে পরতে। মাঝে মাঝে মানবিক তাগিদ থেকে কেউ কেউ যে ও পাড়ার প্রাঙ্গনের ধারে যান নি তা নয়, কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করার মত আন্তরিক জানাশোনা কারোরই ছিল না। ফলেই একটা খণ্ডিত চিত্রায়ন ছিল আমাদের সাহিত্যে। এই খণ্ড চিত্রকে পূর্ণতা প্রদানের চর্চা দীর্ঘ দিন ধরেই করছেন বদরুজ্জামান। তিনি গল্প লিখেছেন বরাক উপত্যকার সাধারণ ভাবে মুসলিম সমাজের নানা সুখ, দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস, উল্লাসকে উপজীব্য করে। সেখানে গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত, দরিদ্র মানুষ যেমন আছেন, আছে আধা গ্রাম আধা শহরের মধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী পরিবারও । আর্থিক সঙ্গতির বিভিন্নতার জন্যে এই মানুষগুলির জীবনযাত্রায় যেমন আছে বৈচিত্র্য, আবার ধর্মীয় কুসংস্কারের জোয়ালে ক্রন্দনরত আর্ত মানবতার হাহাকার ঘুরে বেড়ায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রায় একই ভাবে। ধর্মীয় আচারের কারাগারে বন্দী বিচারহীন মানুষের দেখা যেমন মেলে বিভিন্ন গল্পে নানা ভাবে, আবার মানবিকতায় উজ্জ্বল বিভিন্ন চরিত্রও সাজিয়েছেন বদরুজ্জামান চিত্র শিল্পীর মতই। সঙ্কলনের প্রথম গল্প ১৯৭৭ সালে লেখা, আর শেষ গল্প একেবারের হালের, ২০০৩ সালের। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে লেখা ১৮টি গল্প সঙ্কলিত হয়েছে তার সম্প্রতি প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘লাখ টাকার মানুষ’ এ। প্রকাশ করেছেন সাহিত্য প্রকাশনী। সাহিত্য প্রকাশনীকে বরাক উপত্যকার সাহিত্য কর্মীদের একান্ত নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বলা চলে। ফলে এই সময়োচিত উদ্যোগ তারা ছাড়া আর কেই বা নিতে পারেন। বর্তমান সময়ে মানুষকে নিজের নিজের পরিচয়ের কারাগারে বন্দী করার আয়োজন চলছে সর্বত্র। ধর্ম, ভাষা, জাত পাত, বর্ণ- নানা পরিচয়ে মানুষ বন্দী হয়ে পড়ছে ক্রমশ। আমাদের দেশে ধর্মীয় পরিচয়ের বেড়াজালে মানুষকে বন্দী করে রাখাটা একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের তো কর্মসূচীতেই পরিণত হয়েছে। এই খণ্ডিত পরিচয় ভেঙে মানুষ মাঝে মাঝেই মিলিত হয় হৃদয়ের মেলবন্ধনে। আর এভাবেই গড়ে তোলে ইতিহাস। মিলিত হৃদয়ের উষ্ণতায় অভিন্ন ইতিহাস নির্মান তাদের পছন্দ নয়, যাদের আমরা বলি মৌলবাদী। মৌলবাদীদের হুকুমকে অগ্রাহ্য করে মানুষ গড়ে তোলে এক মানবিক পৃথিবী। কিন্তু এই মানবিক নির্মানের প্রথম শর্ত হচ্ছে, পারস্পরিক পরিচয়, অন্তরঙ্গ জানাশোনা। বদরুজ্জামানের গল্প সঙ্কলন আমাদের অপরিচয়ের ঘাটতি মেটাবে অনেকটাই। অথচ গল্পের ভুবন যেমন আমাদের বাড়ির পাশের আরশি নগর, ঠিক তেমনি চরিত্রগুলোও আমাদের ভীষন চেনা। হাটে বাজারে, কর্মস্থলে আমাদের প্রতিদিনই দেখা হয় বদরুজ্জামানের গল্পের চরিত্রগুলির সাথে। শুধু কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি কুশল বা হৃদয় বদল হয় নি হয়ত, তাই তাদের একান্তের জগৎ আমাদের এতটা অজানা। ১৯৭৭ সালে লেখা গল্প ‘জানোয়ার’ থেকে শুরু করে ২০০৩ সালে লেখা গল্প ‘লাখ টাকার মানুষ’ বা‘অন্নদাত্রী’ অবধি- দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে লেখা গল্পগুলোয় লেখার ধরণ হয়ত বদলে গেছে, বুনোটেও এসেছে রীতিমত পরিবর্তন, কিন্তু মূল সুর রয়ে গেছে অভিন্ন। অর্থনৈতিক দিক থেকে যারা নিঃস্ব, বাস্তবতার দুঃসহ অবস্থানে যাদের বাস কিম্বা ধর্মান্ধতার অমানবিক কারাগারে শেকলপরা মানুষগুলি, বিশেষ করে মুসলিম নারীর গোপন অশ্র“ তাঁর গল্পে ফিরে ফিরে আসে নানা ভাবে বারবার। এদিক থেকে বদরুজ্জামান শুধুমাত্র একজন গল্পবলিয়ে নন, নিপীড়িত নারী শিশুর প্রতি সমব্যথী এক সমাজ সংস্কারক, নিস্তরঙ্গ বরাক ভূমির এক নিভৃত ক্রুসেডার। তাই তাঁর গল্প সঙ্কলনের সাহিত্যমূল্যের চেয়েও সামাজিক মূল্য অনেক বেশী। গল্পসঙ্কলনের প্রথম গল্প ’জানোয়ার’ এ ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত আমাদের গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় পরিচয়কে মূল্যহীন করে দিয়ে হ্যাভ্স্ এবং হ্যাভ ্নট্স্ এর বিভাজন মূল সত্য হয়ে উঠতে দেখি ধীরে ধীরে , শাশ্বত এই সত্যকে ঢেকে রাখার জন্যেই আর বাকী সব পরিচয়। ধর্ম জাত পাতের সংকীর্ণ পরিচয়গুলোকে যতই কারাগারের চেহারা দেওয়ার আয়োজন যুগ যুগ ধরে চলে আসুক না কেন, মানুষ যুগ যুগ ধরেই পরিচয়ের অর্গল ভেঙে একে অপরের সাথে বিনিময় করেছে। বিনিময়ের দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাস থেকে শুরু করে সজীব বর্তমান অবধি প্রতিনিয়তই দেখে আসছি। মনে পড়ছে আজ থেকে বছর খানেক আগে ধর্মনগর করিমগঞ্জ ট্রেনে দেখা হওয়া বাদাম বিক্রেতা শিশুটির কথা। দারিদ্র্যের মলিন বেশ সত্ত্বেও শিশুসুলভ মায়াকাড়া অতল দীঘির মত চোখ দেখে হঠাৎই জিজ্ঞেস করি, ‘কি নাম তোর?’ জিজ্ঞেস করতেই শুধু বিস্ময় নয়, আবহমান ভারতবর্ষ উন্মোচিত হয় আমার সামনে। ‘গৌর মিয়া’, উত্তর দেয় ছেলেটি ভাবলেশহীন ভাবে। চেতনায় একের পর এক বেজে ওঠে বড়ে গোলাম আলীর মিঠে সুরে গাওয়া ‘হরি ওম তৎ সৎ’, টোরী রাগে পণ্ডিত যশরাজের গাওয়া ‘আল্লা জানে,আল্লা জানে’, দোতারা হাতে শিলচরের কাছাড়ির মাঠে শোনা কোনো লোক শিল্পীর গান,‘ মিরাজ আলীর মন, শ্রীকৃষ্ণ ধন লাভ করতে মানুষ, আছেরে কয়জন, বিফলে কাটাইলাম জনম প্রেমের গান গাইয়া’। ঐ শিশুর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই যেন তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল মানুষকে কারাগারে বন্দী করার বাল থ্যাকারে-নিজামীদের যুগ যুগের চক্রান্ত। এই পৃথিবীটা আসলে ‘মানুষ এখনো মানুষ’ গল্পের মতই। এখানে মাহফুজার সন্তান বাপনের চেহারায় মাধবী নিজের সন্তান শোভনের আদল খুঁজে পায়। সারা পৃথিবীর মানুষ তো একই মায়ের সন্তান। কারগিল যুদ্ধের সময় তাই আমাদের বরাক উপত্যকার তরুণ গীতিকার হৃষিকেশ লেখেন,‘এপার ওপার দুপারের চোখে জল, প্রিয়তমাসুর দুরুদুরু কাঁপে বুক,এপারের কোল খালি হলে যেন ভাসে এ মায়ের চোখে ও মায়ের ছেলের মুখ’। বদরুজ্জামান চৌধুরীর গল্পের ভুবনেও এই অযান্ত্রিক মানবিক বিনিময়ের, মিলিত প্রাণের পৃথিবীর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত। ‘বিসর্জন’ গল্পে দরিদ্র আমজাদ যখন হঠাৎ বড়লোক হওয়া মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে সপ্তমীর ম্লান বিকেলে ধীর পদক্ষেপে ফেরার পথে কুশিয়ারার তীরে বসে পড়ে চোখের জলের বাঁধ মুক্ত করেন। সপ্তমীর বিকেলের আমজাদের চোখের জল একাকার হয়ে যায় দশমীর বিকেলের দেবী বিসর্জনের ঘাটে ভক্তের চোখের জলের সাথে। এই মানবিক মিলন প্রতিহত করে আছে কি কোনো জেহাদী বা সঙ্ঘ পরিবার? ‘বহুবল্লভা’র মৌলবী সাহেবও শেষ পর্যন্ত বিচারহীন আচারের অমানবিকতায় শিউরে ওঠেন। এমনতর অমানবিকতায় শিউরে উঠতে না পারা অবধি আমরা সকলেই ব্যবস্থার সামনে যেন যন্ত্রবৎ দাস। মনে পড়ে দিল্লীর নিশা শর্মার কথা। বিয়ের আসরে দরকষাকষির এক চূড়ান্ত মুহূর্তে শিউরে ওঠে নিশা। আবিষ্কার করে নিজেকে বাজারের নিলামের পণ্যসামগ্রী হিসেবে। উঠে পড়ে বিয়ের পিঁড়ি থেকে। তবে আমাদের বেশীর ভাগ মেয়ে জানেই না যে সে এক বিপণনের সামগ্রী, ধর্মের মোড়কে চলা অন্যায় ব্যবস্থায় এক অসহায় ক্রীড়নক। গোপন চোখের জলকে একমাত্র আশ্রয় সম্বল করে সে যন্ত্রবৎ স্থানু বসে আছে এখনো ব্যবস্থার সামনে।‘অশ্লীল’,‘এক খানা জীবনীর প্রথম অধ্যায়’ বা ‘লাখ টাকার মানুষ’ এর পারুল, মণিরা, আসমানতারা বা গফুরের স্ত্রীর মত। হয়ত একদিন সোচ্চার হবে। শহর গ্রামের নানা প্রেক্ষাপটে গল্পগুলো লেখা। এবারে প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্য হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বইটির মুদ্রন প্রমাদ আরেকটু কম হলে ভালো হত। তা ছাড়া কয়েকটি গল্পে ব্যবহৃত উপভাষার সংলাপের স্থানিক পরিচয় বের করা অসম্ভব হয়ে যায়, কতগুলো প্রমাদের জন্যে। ত্র“টি হয়ত আরো আছে যা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা আলোকপাত করবেন, কিন্তু বদরুজ্জামান চৌধুরীর মত গল্পকারের গল্প সংকলন প্রকাশিত হওয়া নিশ্চয়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বদরুজ্জামান চৌধুরীর কলম আমাদের দৃষ্টি আরো প্রসারিত করুক। এই প্রান্তিক জনপদের সংস্কৃতি আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে আমি বদরুজ্জামান চৌধুরীকে সতীর্থের অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই। সমস্ত ধরণের সামাজিক আবিলতামুক্ত পৃথিবীর যারা স্বপ্ন দেখেন, তাদের সারির একদম পেছনে থাকা একজন হিসেবে আমি এই বইয়ের বহুলপ্রচার কামনা করি।

বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০০৯

সন্ত্রাস : তুমি কার, কে তোমার?

একটা প্রশ্ন আমায় প্রায়ই ধন্দে ফেলে। খবরের কাগজ পড়ে বা নেতাদের ভাষণ শুনে সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না কিছুতেই। কিন্তু প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতেই থাকে।
মাস কয়েক আগে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণ হল। আমরা সকলেই জানি, এমন কি ভালো করে যারা দুইয়ের সাথে তিন যোগ করতে জানি না বা যারা ভারতবর্ষ শব্দটি নির্ভুল বাংলায় লিখতে জানি না, তারাও জানি যে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছে আইএসআই বা পাকিস্তানের গুপ্তচর বিভাগ। কিন্তু যে কথাটা জানি না বা জানতে পারার মত কোনও সুযোগই আমাদের কাছে নেই, তা হল, সেই বিস্ফোরণের দিন কয়েকের মধ্যেই ওই কাবুলেই পাকিস্তানী দূতাবাসের সামনেও একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় ঘটনাটি আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমে খুব একটা গুরুত্বের সাথে প্রচারিতও হয় নি। ইন্টারনেটে বাউণ্ডুলেপনার সুবাদে অন্যান্য দেশের সংবাদপত্র থেকে জানলাম, ওই দ্বিতীয় বিস্ফোরণটিও তীব্রতায় বা হানাহানির অঙ্কে খুব একটা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আমার মনে ধন্দ লাগে, এই দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি তবে কে ঘটালো? একই ভাবে, মুম্বাইয়ের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের একমাত্র জীবিত সন্ত্রাসীর স্বীকারোক্তি-সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিবেদন থেকে আমরা প্রতিদিনই পাকিস্তানের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণও পাচ্ছি, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় সংসদ হামলা বা দেশের রাজধানী দিল্লীর বুকে ধারা বিস্ফোরণের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের ভূমিকার কথাও জেনেছি আমরা অনেকবারই। কিন্তু আবারো ধন্দ, যদি এই ঘটনাগুলিরও মূল পরিকল্পনা পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-ই করে থাকে, তবে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভূট্টোর হত্যা কাদের চক্রান্ত? কিংবা, মুম্বাই হানার মতোই ইসলামাবাদের হ্যারিয়ট হোটেলে বিস্ফোরক ভর্তি ট্রাক নিয়ে হামলা চালিয়ে কয়েকশ দেশি বিদেশী নাগরিকের হত্যার সন্ত্রাসী হামলাটি কারা করেছিলেন? ওটাও কি আইএসআই-এর কাণ্ড, নাকি অন্য আরো কেউ রয়েছে পর্দার অন্তরালে?
এ দেশে বা ও দেশে যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলা হলে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ বা এক শ্রেণীর সংবাদ ভাষ্যকারার খুবই সক্রিয় হয়ে ওঠেন, টেলিভিশনের পর্দায় তাঁদের মুহুর্মুহু উপস্থিতি বা সংবাদপত্রের পাতায় এঁদের লিখিত কলামের মাধ্যমে এরা প্রমান করার চেষ্টা করেন ভারত বা পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসাবেই এই চক্রান্তগুলির সাথে যুক্ত। একই ভাষা, একই অভিযোগ, একই ঢং, শুধু পাত্রপাত্রী ভিন্ন। ওই ধরনের প্রচারের প্রবল ঢেউয়ে দু’টি দেশের মানুষের আবেগের বানে ভেসে যাওয়ার ধরনটাও তখন একই রকম ঠেকে। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে, তখনও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনও দেশের পত্রপত্রিকা আমাদের কাছে সহজলভ্য হয় নি, একটি ভারতীয় সংবাদপত্রের সাংবাদিক ভারতের কোনও একটি শহর থেকে পাকিস্তানী বিমানে চেপে করাচী বা লাহোর যাচ্ছিলেন। প্লেনে চড়ার আগে লাউঞ্জে ভারতীয় খবরের কাগজ পড়ে প্লেনের ভেতর গিয়ে বসে পাকিস্তানী সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বোলাতেই চক্ষু চড়ক গাছ। লাউঞ্জে পড়া পত্রিকায় যেমন ছিল দেশের কোন প্রান্তে আইএসআই-এর যোগসাজশে ঘটা অন্তর্ঘাত মূলক ঘটনার সংবাদ প্রতিবেদন, তেমনি প্লেনের ভেতর পাওয়া সংবাদপত্রে দেখলেন পাকিস্তানের নানা জায়গায় কিভাবে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’-এর চক্রান্তে অন্তর্ঘাতের ঘটনা ঘটছে তার নানা সংবাদ। তাঁর মনে হয়েছিল, সংবাদগুলি আসলে একই। শুধু স্থান ও পাত্রপাত্রীর পরিবর্তন হয়েছে। এই ঘটনাটি উল্লেখ করার অর্থ এটা নয় যে ভারতে কোথাও আইএসআই কোনও ধরনের অন্তর্ঘাতের ঘটনা ঘটায় না বা ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’ও ভারতের মাটিতে বসে শুধু রামধুন গায়। এটা সত্য কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাকামী বিভিন্ন উগ্রপন্থী সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানী গুপ্তচর সংস্থার সক্রিয় যোগাযোগ রয়েছে। একই ভাবে এটাও সত্য যে শ্রীলঙ্কার তামিল উগ্রপন্থী সংগঠন এলটিটিই ভারত সরকারেরই তৈরি। শ্রীলঙ্কার তামিল রাজনীতিতে যারা ভারত ও শ্রীলঙ্কার শাসকশ্রেণী থেকে সমদূরত্ব রেখে চলার চেষ্টা করত সেসব সশস্ত্র গেরিলা সংগঠনগুলিকে খতম করে শ্রীলঙ্কার তামিল রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা পালন করার জন্য ভারত সরকার এলটিটিই উগ্রপন্থীদের কয়েক দশক ধরে সামরিক ট্রেনিং ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেছে। সেই ট্রেনিং ও অস্ত্রশস্ত্রের দৌলতে এলটিটিই শ্রীলঙ্কায় সাধারণ নিরীহ মানুষ হত্যা ও ধ্বংসের যে কাজকর্ম চালিয়েছে, তার তুলনা পৃথিবীতে পাওয়া ভার। আজকের পাকিস্তানপন্থী জঙ্গীরা যে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে এ দেশের বুকে তার তীব্রতার কথা মাথায় রেখেও বলতে পারি, আঘাত হানার ক্ষমতা ও বিগত দিনে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়ার খতিয়ান পাশাপাশি রাখলে এখনও এগিয়ে থাকবেন শ্রীলঙ্কার এলটিটিই-ই। এই মুহূর্তে এলটিটিই-ই একমাত্র জঙ্গী সংগঠন যাদের নিয়মিত স্থলসেনা, নৌসেনা ও বায়ুসেনা রয়েছে। তাদের এই মারণক্ষমতা অর্জনের জন্য যদি একটি দেশ বা সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে, তবে তা ভারত-ই। শিখ জঙ্গীদের হাতে ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কার সরকারের সাথে তামিল জঙ্গীবাদ দমনে সহযোগিতার হাত না বাড়ালে রাজীব গান্ধীকে ঘাতকের হাতে মরতে হত না এবং এলটিটিই ও ভারত সরকারের মধুচন্দ্রিমারও অবসান হত না। তবে ভারত সরকারের সাথে এলটিটিই-র আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ শেষ হয়ে গেলেও এখনও তামিলনাড়–র তামিল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এলটিটিই ভারতের মাটি থেকে তার নানা কাজকর্ম এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতে নির্বাচন এলে তামিলনাড়–র ডিএমকে, এমডিএমকে ইত্যাদি রাজনৈতিক দলগুলি মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, কে কতটা শ্রীলঙ্কার তামিলদের জন্য সমব্যথী প্রমাণ করার। শ্রীলঙ্কার এলটিটিই ঘাঁটিতে গিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার কৃতিত্ব অর্জনকারী তামিল নেতা গোপালাস্বামীর কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কোনও অসুবিধাই হয় নি বা কংগ্রেসের পক্ষেও তাদের নেতার হত্যাকারী সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা রাজনৈতিক দলের সাথে নির্বাচনী আঁতাত গড়তে কোনও অসুবিধা হয় নি। তামিল উগ্রতার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শ্রীলঙ্কার সরকার যেমন সিংহলী জাতীয়তাবাদের হিংসাত্মক প্রতিভূ জনতা বিমুক্তি পেরুমনাকে বস্তুগত ও আদর্শগত সমর্থন জুগিয়েছে, আজকের সাধ্বী প্রজ্ঞা বা সেনা অফিসার শ্রীকান্ত পুরোহিতকে দেখলেও সেই কথাই মনে হয়।
১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় ঘটে যাওয়া দু’টি ছ্ট্টো সংবাদ কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও এখন খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। দেশভাগের সময় লাহোর হাইকোর্টের জনৈক বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, আজ তোমরা ধর্মের নামে দেশভাগ করছ। ভাগের কোনও শেষ নেই। একবার আরম্ভ করলে শেষ না দেখে ছাড়ে না। একদিন এমনও দিন আসবে যেদিন একই পরিবার স্বামী ও স্ত্রী’েত দু’টি দেশে বিভক্ত হতে চাইবে। এই মন্তব্যে হয়ত আবেগটাই আছে। কিন্তু সত্য কি নেই? আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতাদের, কি কংগ্রেস কি মুসলিম লীগ ধারণা ছিল, ভারত ও পাকিস্তান এই দু’টি দেশের জন্ম হলে দু’টি দেশই বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে। তা কি হয়েছে? নাকি, লাহোর হাইকোর্টের সেই বিচারপতির ভবিষ্যৎবাণীর হাত ধরেই ছোট ছোট নানা সংকীর্ণ পরিচয়ের ভিত্তিতে দু’টি দেশই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভেদ বিচ্ছিন্নতার ঘূর্ণীপাকে জড়িয়ে গেছে দিনের পর দিন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার সময় যখন নানা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেরও আনুষ্ঠানিক বিভাজন হচ্ছিল তখন সেনাবাহিনীর বিভাজন অনুষ্ঠানে দু’টি দেশের দু’টি সেনাবাহিনীতে বিভক্ত হওয়া সেনা অফিসাররা অশ্রুসজল কন্ঠে শপথ নিয়েছিলেন, আমরা পরাধীন দেশে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি। দেশ স্বাধীন হচ্ছে বিভাজনের মধ্য দিয়ে, আমরা বিভক্ত হচ্ছি দু’টি সেনাবাহিনীতে। আমাদেরকে যেন কখনো পরস্পরের বিরুদ্ধে বন্দুক তুলে নিতে হয় না, আমরা সেই শপথ-ই নিচ্ছি। আমরা দু’টি দেশের মৈত্রী ও সুরক্ষার জন্যে হাতে হাত ধরে কাজ করে যাবো আজীবন। বলা বাহুল্য, বিভেদের পঙ্কিলে জন্ম নেওয়া দু’টি স্বাধীন দেশ তাঁর সেনা অফিসারদের বিভাজনকালের আবেগকে সম্মান জানাতে পারে নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তথাকথিত সার্বভৌমত্বের দিনমজুরের মত তাঁদের একজনকে বন্দুক হাতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অন্য জনের বিরুদ্ধে।
বিভেদের কালো অঞ্জন চোখে মেখে আজ এমন সময়ে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি, যখন অভিন্ন শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারছি না শত্রুর বিরুদ্ধে। যারা বেনজিরকে হত্যা করেছে, তারাই যে ভারতের বুকেও একের পর এক অন্তর্ঘাতের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। যারা ইসলামাবাদের হোটেলে হামলা চালিয়েছিল, তারাই যে মুম্বাইয়ের হোটেলেও আঘাত হেনেছে, তা জেনেও না জানার ভান করছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সর্বোপরি এ দেশের সরকার। এটা ঠিক, পাকিস্তানী গুপ্তচর বিভাগের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়েই গড়ে উঠেছিল এই জেহাদিরা, কিন্তু পাকিস্তানী রাজনীতির এক বিচিত্র ইতিহাসের পথ ধরে আইএসআই যে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যার সর্বাঙ্গে পাকিস্তান সরকারেরও নিয়ন্ত্রন নেই। এ কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জানে, ব্রিটেন সরকার জানে। ভারত সরকার জেনেও না জানার ভান করছে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ঘোলাজলে ভোট শিকারের আশায়। আবার ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা বালুচিস্তানে যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য করত আফগানিস্তানের কান্দাহারের কনস্যুলেট থেকে, তা যে এখন অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে তালিবানি রাজনীতির জালে পড়ে, তাও পাকিস্তান সরকার জানে। অবশ্য এ কথা সত্য, পাকিস্তান সরকার বা সেখানকার সংবাদ মাধ্যম অনেকটাই দায়িত্বশীল কথাবার্তা বা লেখালেখি করছে। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটা এমন অ™ভুত হয়ে গেছে বছরের পর বছর ধরে যে একটি দেশ দায়িত্বশীল কথাবার্তা বললে তাঁকে নিজের দেশের কট্টরপন্থীদের যেমন সমালোচনার শিকার হতে হয় তেমনি অন্য দেশের সরকার তাঁকে তখন বেকায়দায় পড়ে নরম হয়েছে বলে অভিহিত করে। পাকিস্তানের বর্তমান সরকার যে ইসলামি জঙ্গী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেই ক্ষমতায় এসেছে বা ক্ষমতায় এসেও রাষ্ট্রের জঙ্গী অংশের সাথে যে তাঁকে প্রতিদিন লড়াই করতে হচ্ছে, তা ভারতের সংবাদ মাধ্যম বেশিরভাগ সময়ই এড়িয়ে যায়। মৌলবাদী কট্টরপন্থার আক্রমণের নিশানা যে শুধু ভারত নয়, পাকিস্তানের মন্ত্রী শেরি রহমান বা সেখানকার প্রাক্তন মন্ত্রী আনসার বার্ণি ও তাঁদের সমমনস্করাও, এটা ভুলে গেলে কি চলবে।
কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই মানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, এটা বোঝার সময় আজকেই হয়ত সবচেয়ে জরুরি। আইএসআই-এর দ্বারা জঙ্গীরা প্রশিক্ষিত হয়েছে এই অভিযোগে যদি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়, তবে আফগানিস্থানের বামপন্থী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে মার্কিন সরকার সেখানকার ও পাকিস্তানের মৌলবাদীদের যে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করেছিল, তার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলার সাহস আছে কি অত্যুৎসাহী জাতীয়তাবাদীদের?
এখনই হয়ত উপযুক্ত সময় যখন সীমান্তের দুপারে থাকা মানুষকে পরস্পরের সাথে আরো বেশি মিলিত হতে দেওয়ার। মানুষের সাথে মানুষ হাত মেলালেই বোঝা যাবে কারা আমাদের অভিন্ন শত্রু। যে ধ্বংসের মুখোমুখি আমাদের উপমহাদেশ, আমাদের এই পৃথিবী, সেই ধ্বংসের সামনে নির্বাচনী রাজনীতি খুবই ছোট জিনিস। ক্ষমতার রাজনীতির কারবারীরা একে ছোট হতে দেবে না। কারণ ওটাই তাদের অক্সিজেন। উদ্যোগটা নিতে মানুষকেই। ইন্টারনেটে বিদ্বেষের বিষ না ছড়িয়ে এখন সময় ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর। ইংল্যান্ডের সাথে ক্রিকেট সিরিজ খেলার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি করাচী ও মুম্বাইতে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ হওয়া। নাটক গান ক্রিকেট আত্মীয়তা, যেভাবেই পারা যাবে, সেভাবেই পৌছতে হবে দুপারের মানুষকে একে অপরের কাছে। আমাদের নেতারা তা করতে দেবেন না। আগে তারা চান সংসদীয় নির্বাচনের তরী পার হতে। তার জন্যে তাঁদের মধ্যে এখন দেশপ্রেমের তুমুল প্রতিযোগিতা। অথচ আগেকার বহুবারের মত এবারও নির্বাচন শেষ হলেই সব জঙ্গীপনার অবসান হবে, এবং দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কও আবার ঠিকঠাক হবে। মাঝখানে শুধু কয়েকটা দিন সাধারণ মানুষকে উন্মাদ করার প্রতিযোগিতা। ওরা এটা বোঝেন না, নির্বাচন গেলে রাজনৈতিক দলগুলি শান্ত হয়ে গেলেও। যে উন্মাদনা তারা মানুষের মধ্যে তৈরি করেন ভোট বৈতরণী পার হওয়া জন্য, সেটা থেকে যায়। সেখান থেকেই জন্ম নেয় জৈশ-ই-মহম্মদ বা অভিনব ভারত।
এই উন্মাদনায় আমরা ভুলে যাবোনা আনসার বার্নিকে, যার জন্যে পাকিস্তানের জেলের অন্ধ কুঠুরীতে থাকা ভারতীয় বন্দী আশার আলো দেখে, মুম্বাই হানার সঙ্গে সঙ্গে যিনি নিজের দেশের মৌলবাদীদের ভ্রƒকুটিকে উপেক্ষা করে মুম্বাইয়ের হাসপাতালে এসে আক্রান্তদের জন্যে রক্তদান করে যান। আমরা ভুলে যাবো না কুলদীপ নায়ার বা নির্মলা দেশপাণ্ডেকে, যারা বছরে পর বছর ভালোবাসার বার্তা নিয়ে ওয়াগা সীমান্তে স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালান।
বন্দুক, মিলিটারি, যুদ্ধ তো অনেক হল। এত এত যুদ্ধের বিজয়েও তো শান্তি এল না। আসুন, এবার অন্য যুদ্ধ লড়ি। আঁধারের বুকে ভালোবাসার অসংখ্য প্রদীপ জ্বেলে দিই। অনেক যুদ্ধ তো নিস্ফলা গেল। আরেকটা না হয় নিস্ফলাই যাবে। তবু এ যুদ্ধে মানুষ তো মরবে না। চোখের জলে তো ভেসে যাবে না অসংখ্য সংসার।

বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০০৯

সতেরো আগস্টের ভাবনা

সন্ধ্যাবেলায় বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে বলল আমাকেই ডায়িং স্টেটমেন্ট নিতে হল। ছেলেটার নাম বাচ্চু চক্রবর্তী, সিপিএম করে। এভাবেই ক্লাস ফাইভের বালক আমার জীবনের সাথে যুক্ত হয় ভাষা আন্দোলনের দ্বাদশ শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীর নাম। তার পরদিনই বোধহয় শিলচর শহরের সেই ঐতিহাসিক শেষ যাত্রা। ভাষা আন্দোলনের সময় প্রতিদিন যেমন আমাদের মিছিলে নিয়ে যাওয়া হত, সেদিনও একইভাবে স্কুল থেকে শেষযাত্রায় নিয়ে যায় ওপরের ক্লাসের ছাত্ররা। তারপর শহরময় শুধু একই আলোচনা, আলোচনা আমার সরকারি আমলা বাবার অন্দরমহলেও। ভাষা আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্যেই এই খুন করা হয়েছে। অবিভক্ত কাছাড় জেলার সর্বত্র ছাত্র সমাজ সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বাচ্চু চক্রবর্তীকে বরণ করে নিলেন ভাষা আন্দোলনের দ্বাদশ শহীদ হিসেবে। পরের বছর ১৯ শে মে গোটা জেলায় পালিত হল দ্বাদশ শহীদ দিবস হিসেবে। সেদিন বাবার সরকারি গাড়িতে বিলপারে দাদুর বাড়ি যাবার পথে নানা জায়গায় শহীদ বেদি দেখে দেখে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথাও কোনও শহীদ বেদিতে দ্বাদশ না লিখে একাদশ লেখা দেখলেই দাদা বলে উঠেছে, বেইমান। নিশ্চয়ই কংগ্রেসী ক্লাব। বলা বাহুল্য, সেদিন শিলচর শহরে খুব অল্প কয়েকটি বিচ্ছিন্ন জায়গায়ই আমরা একাদশ শহীদ স্মরণে কথাটা লেখা দেখেছিলাম। সারা শহরের অধিকাংশ শহীদ বেদিতেই লেখা ছিল দ্বাদশ শহীদ স্মরণে। বাচ্চু চক্রবর্তীর শহীদত্ব নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে প্রায় কারোর মধ্যেই কোনও সংশয় ছিল না। ‘প্রায়’ কথাটা এজন্যেই লেখা, সে বছর কংগ্রেস অফিসের ভেতরের শহীদ বেদি ও খুব অল্প কয়েকটি পাড়ার ক্লাবে লেখা ছিল একাদশ শহীদ কথাটি। ওই সময়ে তৎকালীন কাছাড় জেলায় কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে জনমতের কি প্রবল হাওয়া বইছিল তা পুরোনো লোকেদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ১৯৭৪ সালেও ১৯ মে দ্বাদশ শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হল কাছাড় জেলার সর্বত্র। চিত্রটা পাল্টে দিল জরুরি অবস্থা। ১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থার সময়ে ১৯ মে’র আগে ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে একটি ডিমাই সাইজের লিফলেট বের হয়। সেখানে বড় বড় হরফে লেখা ছিল ১৯ মে একাদশ শহীদ দিবস পালন করুন। বাচ্চু চক্রবর্তীর সহযোদ্ধা ছাত্রনেতারা বা ভাষা সংগ্রামীরা হয় তখন জেলে, নয়ত জরুরি অবস্থার নিষেধাজ্ঞায় প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে অপারগ। ছাত্র পরিষদের তখনকার নেতারা এখন কেউই আর সক্রিয় রাজনীতি করেন না। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই কেউ বিস্মৃত হন নি, কিভাবে তারা সেদিন জরুরী অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবগুলোকে দিয়ে দ্বাদশ শহীদকে ভুলিয়ে দেওয়ার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এখনও মনে আছে, আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় কে জানি বলেছিলেন এক সান্ধ্য আসরে, ইমারজেন্সির সুযোগ নিয়ে কেমন বিকৃত হয়ে গেল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। শুধু শহীদ বেদি নয়, কিছুদিন পর জানা গেল শহীদ বাচ্চুর প্রধান হত্যাকারীরা মুক্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৩, ১৯৭৪ সালে যেমন সারা জেলাতেই ১৯ মে পালিত হয়েছিল দ্বাদশ শহীদ দিবস হিসেবে, আর শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন জায়গায় ১৯ মে ছিল একাদশ শহীদ দিবস, তেমনি ১৯৭৭-পরবর্তী সময়ে হিসেবটা উল্টে গেল। দেখা গেল জরুরী অবস্থায় বাচ্চুকে যেভাবে জনমন থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তার রেশ রয়ে গেছে। তখন ‘দ্বাদশ শহীদ’ শব্দবন্ধটি নির্বাসিত হয়ে পড়ল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন জায়গায়, আর উপত্যকার সাধারণ পরিসরে নানা যুক্তি দেখিয়ে ১৯ মে’কে একাদশ শহীদ দিবসে পরিবর্তিত করে দেওয়া হল। আমরা যখন বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়েছি, তখন, সম্ভবত ১৯৮০ বা ১৯৮১ সালে শিলচর শ্মশান ঘাটে শহীদ বেদি নির্মাণকে কেন্দ্র করে আবার বরাকের রাজনীতিতে বাচ্চু চক্রবর্তীর নাম প্রবলভাবে উঠে এল। সন্তোষ মোহন দেবের নেতৃত্বাধীন শিলচর পুরসভা শিলচর শ্মশান ঘাটে দ্বাদশ শহীদ শিলা তুলে দিয়ে একাদশ শহীদ বেদি নির্মাণ করতে গেলে এসএফআই-এর নেতৃত্বে শিলচরে এক তুমুল ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। আমরা শহরের স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিশাল মিছিল করে তৎকালীন পুরপতি সন্তোষ মোহন দেবের সামনে হাজির হলে, আমাদের জোরালো দাবির উত্তরে তিনি বলেন, বাচ্চুকে আমি শহীদ হিসেবে স্বীকার করি, কিন্তু এ কথাটি বলতে আমার রাজনৈতিক অসুবিধা আছে। আমরা তখন তাঁকে বলি, আপনি বারোটি শিলা তুলে এগারোটি বেদি তৈরি করছেন কেন? তিনি বলেন, বারোটি বেদি তৈরি করারও আমার রাজনৈতিক অসুবিধা রয়েছে। আমাদের জোরালো প্রতিবাদের উত্তরে তিনি খানিকটা চ্যালেঞ্জের সুরে বলেন, তোমরা যদি চাও তো নিজেরা কর না কেন? তোমরা তৈরি করলে আমার আপত্তি নেই। তখনকার এসএফআই নেতা ও বামপন্থী দলীয় নেতারা মুহূর্তের মধ্যে এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে গেলেন। তখন শিলচর পুরসভায় চারজন বামপন্থী সদস্য ছিলেন। তাঁদের সাথে পরামর্শ করে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই দ্বাদশ বেদি তৈরির কাজে নেমে পড়ি। পুরসভা কর্তৃপক্ষ ভাবতেই পারেন নি যে আমরা এই চ্যালেঞ্জ এভাবে গ্রহণ করতে পারব। তারপরও তারা বাধা দান করলেন এই বলে, দ্বাদশ বেদিটি অন্য এগারোটি বেদি থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে তৈরি করতে হবে। আমরা বললাম, আমরা তাতেও রাজি। আমরা জানতাম, শহীদ বেদির দূরত্ব দিয়ে বাচ্চু চক্রবর্তীর মত ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দান করে শহীদত্ব বরণ করা নেতাকে মানুষের মন থেকে কেউ মুছতে পারবে না। শিলচর পুরসভা কর্তৃপক্ষ স্থির করলেন ১৯ মে একাদশ বেদির আবরণ উন্মোচন করবেন। আমাদেরকেও ওইদিনই বাচ্চু চক্রবর্তীর বেদিটি ওই সময়েই উদ্বোধন করতে হবে এমন জেদ থেকে এসএফআই কর্মীরা রাজমিস্ত্রির সাথে সহায়কের ভূমিকায়ও লেগে গেলেন। পদে পদে বাধা অপমান সত্ত্বেও রাতদিন কাজ করার পর ১৯ মে সূর্যোদয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চু চক্রবর্তীর বেদিটিও তৈরি হয়ে গেল। পুরসভা কর্তৃপক্ষ একাদশ বেদি উন্মোচনের জন্যে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে শ্মশানের গেট থেকে পদযাত্রা করে শহীদ বেদির কাছে আসার কর্মসূচি নিয়েছিলেন। সকাল থেকে নানা স্তরের শাসক দলের নেতারা আমাদের বারবার বলে আসছিলেন, আমাদের পদযাত্রা এলে ভাই, তোমরা জায়গা ছেড়ে দিও। আমাদেরটা উদ্বোধন হওয়ার হবে, তারপর তোমরা যা করার কোরো। সেদিন এই দাম্ভিকতার মুখে চুন মাখিয়ে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ প্রেমেন্দ্র মোহন গোস্বামী। পুরসভার পদযাত্রাটি নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে আসার সময় প্রেমেন্দ্রবাবু প্রথমেই দাঁড়িয়ে পড়লেন শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীর স্মরণে নির্মিত কিছুক্ষণ আগে শেষ হওয়া শহীদ বেদির সামনে। ফুল দিলেন সেখানে, মাথা নত করে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীর প্রতি। সেই মুহূর্তে আমাদের কাছে এক কত বড় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন প্রেমেন্দ্রবাবু এখনও মনে আছে। মনে আছে, আবেগে আমাদের কারো কারো চোখের কোণে তখন জলের রেখা দেখা দিয়েছে। দুঃখ হয় এই ভেবে যে, বাচ্চু চক্রবর্তীই বোধহয় একমাত্র ভাষা শহীদ, যাকে শহীদত্ব বরণ করার পরও বারবার খুন হতে হয়েছে কায়েমী স্বার্থাণ্বেষীদের হাতে। এ জন্যেই বাচ্চু চক্রবর্তীর শহীদ বেদির ফলকের জন্যে বিশিষ্ট শিক্ষক সুহাস রঞ্জন কর বেছেছিলেন এই দু’টি লাইন
বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না তোমাদের দেওয়া ক্ষতে
আমার ঠিকানা খোঁজ কোরো শুধু সূর্যোদয়ের পথে।
মনে হয় যেন কবি সুকান্তের এই দুটি পংক্তি শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীর জন্যেই লেখা।
একাদশ দ্বাদশের লড়াই আবার আরেকবার চাগিয়ে উঠল ১৯ মে’র ২৫ বছর পূর্তির সময় ১৯৮৬ সালে। শহরের প্রাজ্ঞজনেরা তখন মতামত দিলেন, একাদশ দ্বাদশ বাদ দিয়ে দিবসটি পালিত হোক ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে। সেই থেকে ১৯ মে’র দিনটিকে বিতর্ক মুক্ত করার এই সমাধানটি মেনে আসছেন সকলেই। এখন গোটা বরাক উপত্যকা জুড়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ১৯ মে’র পাশাপাশি পালিত হয় আরো তিনটি দিন। শহীদ বাচ্চুর স্মৃতিমাখা ১৭ আগস্ট, জগন-যীশুর বলিদানের দিন ২১ জুলাই ও শহীদ সুদেষ্ণার আত্মত্যাগের দিন ১৬ মার্চ।
লড়াই শেষ হয় নি নানা দিক থেকেই। শুধু বাচ্চু চক্রবর্তীর মূল্যায়নই নয়। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির নিরিখে মূল্যায়নের কাজটি আজও শুরুই হল না। যে বামপন্থীরা ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দান করেছিলেন পরবর্তীতে ভাষা সংস্কৃতির প্রশ্নগুলিকে রাজনৈতিক সংগ্রামের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কিছু কিছু দোদুল্যমানতা কাজ করেছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অথচ এ কাজটি বামপন্থীরাই করতে পারেন। অন্যেরা এই উদ্যোগ নিলে সর্বনাশ ছাড়া হওয়ার আর কিছু নেই। উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির যে একটি সাংস্কৃতিক মাত্রা রয়েছে, সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে বামপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিও আজ এই কথা বলছেন। কিন্তু ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এই নীতির প্রয়োগ এখনও আমরা দেখতে পাই নি। এই উদ্যোগ যদি কখনো গ্রহণ করা হয়, তখন বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখে এর যথার্থ মূল্যায়ন করার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তী শুধু একজন ভাষাসৈনিক ছিলেন না, ছিলেন বামপন্থী যুব আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতা। গুয়াহাটির একটি সভায় তাঁর ভাষণ শুনে আসামের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট নেতা অচিন্ত্য ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অচিন্ত্যবাবু, কাছাড়ে আপনাদের দলে এমন ছেলে আর ক’জন থাকে। যদি একাধিক থাকে, তবে সেখানে আপনাদের দলের ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল, তা বলতে পারি। এমন একজন নেতার মৃত্যুবার্ষিকী থেকেই তো বামপন্থার সাথে ভাষা রাজনীতির একটি সংলাপ রচনার সূত্রপাত হতে পারে। এখন সময়টা বড় খারাপ। দূর থেকে ইন্টারনেটের পাতায় খবর পড়েও বুঝতে পারি উত্তর পূর্বাঞ্চলের আকাশে অনেক শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। সুতরাং এক বিকল্প সাংস্কৃতিক-রাজনীতির চর্চা শুরু করার এটাই প্রকৃষ্ট সময়।

ইরানি ছবি ‘রামি’- সীমান্তহীন ভালোবাসার সফরনামা

চলচ্চিত্রের আমি বোদ্ধা নই। চলচ্চিত্রচর্চা একটি স্বতন্ত্র বিষয়, যা অনুশীলন প্রত্যাশা করে। এর ভাষা শিখতে হয়, এর জাদু বুঝতে হয়। আমি তার কিছুই জানি না। কিন্তু কেন জানি না, বাবাক শিরিনসাফেক-এর ‘রামি’ নামের ছবিটি দেখার পর থেকে গুণগুণ করে চলেছি রবীন্দ্রনাথের একটি গান, ‘যে পথ গেছে সব ছাড়ায়ে/ উদাস হয়ে যায় হারায়ে/ সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন অচিনপুরে/ দূরে কোথায় দূরে/আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে’। সেই যে ভালোবাসার দেশটির খোঁজে যুগ যুগ ধরে কত প্রেমিক কত শিল্পী কত মানুষ ধেয়ে চলেছে, যাকে মনে হয় এই বোধহয় পেলাম, কিন্তু অধরা মাধুরীর মত যা শুধু দূরে দূরেই সরে সরে যায়। সেই দেশের খবর যেন বয়ে আনল ইরান-আজারবাইজানের ছবি ‘রামি’। মনে হল, ‘অনেকদিনের আমার যে গান/আমার কাছে ফিরে আসে/তারে আমি শুধাই তুমি ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে/ যে ফুল গেছে সকল ফেলে গন্ধ তাহার কোথায় পেলে/ যার আশা আজ শূন্য হল/ কী সুর জাগাও তাহার আশে’। ভালোবাসাহীন এই অসময়ে ভালোবাসার এমন আকুল বাঁশির সুর যে বয়ে আনবে এই ছবিটি তা ভাবিই নি। বরং প্রেক্ষাগৃহে অন্ধকার নেমে আসতেই অস্বস্তি বোধ হয়েছিল প্রথমে। অজানা ভাষায় অজানা দেশের কথা বলবে একটি অজানা শিল্পমাধ্যম, বুঝতে পারব কি তার কিছুটা? পর্দায় ছবি ফুটে ওঠার আগেই নেপথ্যে বেজে উঠল একটি এশিয়া মাইনর মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের লোকগান। সাবটাইটেল পড়ে বুঝতে পারি কোনও এক চণ্ডীদাস-রজকিনী বা হির-রনজা বা এমনই কোনও সীমান্তভাঙা প্রণয়ীযুগলের ভালোবাসার আখ্যান গাওয়া হচ্ছে। ছবি ভেসে উঠতেই আরো চমক, ইরানী কার্পেটে আঁকা পটুয়ার ছবির মত সেই লোকগানের লোকচিত্রাবলী। আজারবাইজানের লোকঐতিহ্যের কারাম-আসলির প্রেমোপাখ্যানের লোকগানের পটের ওপর দিয়ে ফুটে ওঠে টাইটেল কার্ড। আর এভাবেই অশিক্ষিত-আমি এক ঘোরের মধ্য দিয়ে করি এক ভালোবাসার অন্য প্রদেশে। ভাষা জানি না, সাংস্কৃতিক সূত্রগুলিও অচেনা, তবু মনে হয়, এত আমারই চেনা প্রতিবেশের ছবি। এই ভালোবাসারই তো গল্প প্রতিদিন শুনি আমার বাড়ির কাছের আরশি নগরের পড়শির বচনে।
ছবির গল্পের ভূগোল হয়ত আলাদা, কিন্তু গল্পটি আমাদের খুবই চেনা। একটি আজারবাইজানীয় লোকগায়ক ভালোবেসে বিয়ে করেছিল এক আরমেনীয় রমণীকে। যদিও পড়শি, তবু ভাষা আলাদা, ধর্মবিশ্বাসও আলাদা। তাই প্রবল বাধা এসেছিল নিজের নিজের সম্প্রদায়ের তরফ থেকে। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সবই জুটেছে, আর সব বাধাকে উপেক্ষা করেই চিরন্তন ভালোবাসার মানুষ-মানুষীর মতই তারাও ঘর বেঁধেছিল এক স্বপ্নের পৃথিবী গড়বে বলে। বাধ সাধে মানুষের ভাষা-ধর্মের পরিচিতির কাঁটাতার ঘেরা কূপমণ্ডুকতা। সেই অন্ধতার পথ ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার অশান্ত সময়ে আজারবাইজান ও আরমেনীয়দের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঁধে। বিচ্ছেদের লোকগানের গায়কের জীবনেও নেমে আসে বিচ্ছেদের কালো অন্ধকার। কারে-বাঘ সংঘর্ষ যুদ্ধের জেরে তার শিশুসন্তান সহ হারিয়ে যায় তার প্রেয়সী স্ত্রী রামি। তাদের শহর জিব্রাইল দখলীকৃত অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই লোকগায়কের স্থান হয় সাবিরাবাদের শরণার্থী শিবিরে। ইতোমধ্যে কেটে যায় একটা দশক। হঠাৎ-ই একদিন স্বপ্নে সেই লোকগায়ক দেখে তার হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীকে, আর তারপরই সে বেরিয়ে পড়ে ইরানের উদ্দেশ্যে। সে খবর পায় সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিল তার স্ত্রীর পরিবার। পেরিয়ে যায় ভূগোলের সীমান্ত, অতিক্রম করে ভাষা সংস্কৃতির কাঁটাতার। যা অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে প্রেমের খোঁজে ঘুরে ফিরেছে প্রেমিক, সে পথ বেয়েই যায় এই প্রেমিকও। দেখা মেলে না তার প্রেয়সীর। তার পৌঁছনোর আগেই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে সে। সেই লোকগায়ক আবার ফিরে আসে নিজের দেশে, নিজের মাটিতে, সেই গাছের নীচে। যেখানে পরম্পরাগত বিশ্বাসে গাছকে জড়িয়ে তাঁরা অঙ্গীকার করেছিল ভালোবাসার। আবার সে জড়িয়ে ধরে সেই গাছকেই। প্রেয়সী তার হারিয়ে গেছে সংঘর্ষমুখর পৃথিবীর হিংসার ছোবলে, তবু গাছকে আঁকড়ে ধরেই সে জাগরুক রাখে তাঁর প্রেমকে, তাঁর বাঁচাকে।
ছবির শুরু এই শেষের দৃশ্য থেকেই। এখান থেকেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলতে থাকে গোটা ছবি। ফিরে আসে আবার সেখানেই। অনবদ্য ফটোগ্রাফিতে ধরা পড়ে দু’টি ভিন্ন ভূগোলের অপরূপ ছবি। আজারবাইজান ও ইরানের লোকগানের সুরে বাঁধা এ ছবির আবহ বুকের ভেতরকে তোলপাড় করে দেয়। এই গানও আমাদের ভীষণ চেনা, চেনা এজন্যেই, গানের ভেতর থেকে মর্মবেদনা আছড়ে পড়ে আমাদের লোকগানের মতোই। ছবি দেখতে বারবারই মন ফিরে ফিরে এসেছে নিজের দেশে। নিজের পড়শি ঘরে। এমন সংঘর্ষমুখর পরিচিতি-স্পর্শকাতরতায়ই তো হারিয়ে যায় রিজওয়ানুর তার প্রেয়সী প্রিয়াঙ্কা থেকে। কে জানে, এই মুহূর্তে যখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সংঘর্ষমুখর বোড়ো ও বাঙালি মুসলমানেরা, তখন এমন কারো প্রেমের মাঝখানে প্রাচীর তুলেছে কিনা কোনও পরিচয়ের কাঁটাতার কে জানে? এই দাঙ্গার আগুনে কোনও অসহায় প্রেমিক হয়ত খুঁজে বেড়াচ্ছে তার প্রেমিকাকে। এভাবেই হয়ত অন্য কারও প্রেম হারিয়ে গেছে মনিপুরের কুকি-নাগা সংঘর্ষের দাঙ্গার আগুনে। এই ছবির নায়ক সীমান্ত পেরিয়ে ইরানে প্রবেশ করার মুহূর্তে মিলিত হয় একটি বিয়ের দলের সাথে। একপারের মানুষ অন্যপারে বাস করা আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতে যাবে। সীমান্ত পেরোতেই গানে নাচে স্বাগত জানায় কাঁটাতারে বিভক্ত হয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া আত্মীয়েরা। দেখেই মনে হয় বিয়ের মরসুমের সুতারকান্দি বা করিমগঞ্জের কালীবাড়ি ঘাটের সীমান্তের দৃশ্য।
ছবিটি দেখে বেরিয়ে আসছি। বোদ্ধা লোকেরা ছবি নানা আলোচনায় ব্যস্ত। সকলেই মুগ্ধ। কেউ বলছেন এটি চিরন্তন ভালোবাসার ছবি। কেউ বললেন মানুষের চিরন্তন প্রকৃতি-সংলগ্নতার ছবি। আবার কেউ কেউ বললেন একটি প্রাচীন লোকগাঁথার সমকালীন হয়ে ওঠার ছবি এই সিনেমাটি। আমি মুগ্ধ, হতবাক, এক ঘোরের মধ্য দিয়েই রাতের নির্জন পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি। আমার চলচ্চিত্র-অজ্ঞতা থেকে মনে হল, কেন এই ছবিটিকে দাঙ্গার আগুনে ঝলসে যাওয়া এই সংঘর্ষমুখর পৃথিবীতে একটি প্রতিবাদের রাজনৈতিক সিনেমা বলব না? এখানে ভালোবাসা একটি অস্ত্র। হিংসার বিপরীতে, কাঁটাতারের বেড়ার বিপরীতে সীমানাহীন ভালোবাসার পৃথিবী গড়ার একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘রামি’।

Interview on Protest Music issues

It was an interview