বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০০৯

ইরানি ছবি ‘রামি’- সীমান্তহীন ভালোবাসার সফরনামা

চলচ্চিত্রের আমি বোদ্ধা নই। চলচ্চিত্রচর্চা একটি স্বতন্ত্র বিষয়, যা অনুশীলন প্রত্যাশা করে। এর ভাষা শিখতে হয়, এর জাদু বুঝতে হয়। আমি তার কিছুই জানি না। কিন্তু কেন জানি না, বাবাক শিরিনসাফেক-এর ‘রামি’ নামের ছবিটি দেখার পর থেকে গুণগুণ করে চলেছি রবীন্দ্রনাথের একটি গান, ‘যে পথ গেছে সব ছাড়ায়ে/ উদাস হয়ে যায় হারায়ে/ সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন অচিনপুরে/ দূরে কোথায় দূরে/আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে’। সেই যে ভালোবাসার দেশটির খোঁজে যুগ যুগ ধরে কত প্রেমিক কত শিল্পী কত মানুষ ধেয়ে চলেছে, যাকে মনে হয় এই বোধহয় পেলাম, কিন্তু অধরা মাধুরীর মত যা শুধু দূরে দূরেই সরে সরে যায়। সেই দেশের খবর যেন বয়ে আনল ইরান-আজারবাইজানের ছবি ‘রামি’। মনে হল, ‘অনেকদিনের আমার যে গান/আমার কাছে ফিরে আসে/তারে আমি শুধাই তুমি ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে/ যে ফুল গেছে সকল ফেলে গন্ধ তাহার কোথায় পেলে/ যার আশা আজ শূন্য হল/ কী সুর জাগাও তাহার আশে’। ভালোবাসাহীন এই অসময়ে ভালোবাসার এমন আকুল বাঁশির সুর যে বয়ে আনবে এই ছবিটি তা ভাবিই নি। বরং প্রেক্ষাগৃহে অন্ধকার নেমে আসতেই অস্বস্তি বোধ হয়েছিল প্রথমে। অজানা ভাষায় অজানা দেশের কথা বলবে একটি অজানা শিল্পমাধ্যম, বুঝতে পারব কি তার কিছুটা? পর্দায় ছবি ফুটে ওঠার আগেই নেপথ্যে বেজে উঠল একটি এশিয়া মাইনর মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের লোকগান। সাবটাইটেল পড়ে বুঝতে পারি কোনও এক চণ্ডীদাস-রজকিনী বা হির-রনজা বা এমনই কোনও সীমান্তভাঙা প্রণয়ীযুগলের ভালোবাসার আখ্যান গাওয়া হচ্ছে। ছবি ভেসে উঠতেই আরো চমক, ইরানী কার্পেটে আঁকা পটুয়ার ছবির মত সেই লোকগানের লোকচিত্রাবলী। আজারবাইজানের লোকঐতিহ্যের কারাম-আসলির প্রেমোপাখ্যানের লোকগানের পটের ওপর দিয়ে ফুটে ওঠে টাইটেল কার্ড। আর এভাবেই অশিক্ষিত-আমি এক ঘোরের মধ্য দিয়ে করি এক ভালোবাসার অন্য প্রদেশে। ভাষা জানি না, সাংস্কৃতিক সূত্রগুলিও অচেনা, তবু মনে হয়, এত আমারই চেনা প্রতিবেশের ছবি। এই ভালোবাসারই তো গল্প প্রতিদিন শুনি আমার বাড়ির কাছের আরশি নগরের পড়শির বচনে।
ছবির গল্পের ভূগোল হয়ত আলাদা, কিন্তু গল্পটি আমাদের খুবই চেনা। একটি আজারবাইজানীয় লোকগায়ক ভালোবেসে বিয়ে করেছিল এক আরমেনীয় রমণীকে। যদিও পড়শি, তবু ভাষা আলাদা, ধর্মবিশ্বাসও আলাদা। তাই প্রবল বাধা এসেছিল নিজের নিজের সম্প্রদায়ের তরফ থেকে। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সবই জুটেছে, আর সব বাধাকে উপেক্ষা করেই চিরন্তন ভালোবাসার মানুষ-মানুষীর মতই তারাও ঘর বেঁধেছিল এক স্বপ্নের পৃথিবী গড়বে বলে। বাধ সাধে মানুষের ভাষা-ধর্মের পরিচিতির কাঁটাতার ঘেরা কূপমণ্ডুকতা। সেই অন্ধতার পথ ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার অশান্ত সময়ে আজারবাইজান ও আরমেনীয়দের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঁধে। বিচ্ছেদের লোকগানের গায়কের জীবনেও নেমে আসে বিচ্ছেদের কালো অন্ধকার। কারে-বাঘ সংঘর্ষ যুদ্ধের জেরে তার শিশুসন্তান সহ হারিয়ে যায় তার প্রেয়সী স্ত্রী রামি। তাদের শহর জিব্রাইল দখলীকৃত অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই লোকগায়কের স্থান হয় সাবিরাবাদের শরণার্থী শিবিরে। ইতোমধ্যে কেটে যায় একটা দশক। হঠাৎ-ই একদিন স্বপ্নে সেই লোকগায়ক দেখে তার হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীকে, আর তারপরই সে বেরিয়ে পড়ে ইরানের উদ্দেশ্যে। সে খবর পায় সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিল তার স্ত্রীর পরিবার। পেরিয়ে যায় ভূগোলের সীমান্ত, অতিক্রম করে ভাষা সংস্কৃতির কাঁটাতার। যা অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে প্রেমের খোঁজে ঘুরে ফিরেছে প্রেমিক, সে পথ বেয়েই যায় এই প্রেমিকও। দেখা মেলে না তার প্রেয়সীর। তার পৌঁছনোর আগেই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে সে। সেই লোকগায়ক আবার ফিরে আসে নিজের দেশে, নিজের মাটিতে, সেই গাছের নীচে। যেখানে পরম্পরাগত বিশ্বাসে গাছকে জড়িয়ে তাঁরা অঙ্গীকার করেছিল ভালোবাসার। আবার সে জড়িয়ে ধরে সেই গাছকেই। প্রেয়সী তার হারিয়ে গেছে সংঘর্ষমুখর পৃথিবীর হিংসার ছোবলে, তবু গাছকে আঁকড়ে ধরেই সে জাগরুক রাখে তাঁর প্রেমকে, তাঁর বাঁচাকে।
ছবির শুরু এই শেষের দৃশ্য থেকেই। এখান থেকেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলতে থাকে গোটা ছবি। ফিরে আসে আবার সেখানেই। অনবদ্য ফটোগ্রাফিতে ধরা পড়ে দু’টি ভিন্ন ভূগোলের অপরূপ ছবি। আজারবাইজান ও ইরানের লোকগানের সুরে বাঁধা এ ছবির আবহ বুকের ভেতরকে তোলপাড় করে দেয়। এই গানও আমাদের ভীষণ চেনা, চেনা এজন্যেই, গানের ভেতর থেকে মর্মবেদনা আছড়ে পড়ে আমাদের লোকগানের মতোই। ছবি দেখতে বারবারই মন ফিরে ফিরে এসেছে নিজের দেশে। নিজের পড়শি ঘরে। এমন সংঘর্ষমুখর পরিচিতি-স্পর্শকাতরতায়ই তো হারিয়ে যায় রিজওয়ানুর তার প্রেয়সী প্রিয়াঙ্কা থেকে। কে জানে, এই মুহূর্তে যখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সংঘর্ষমুখর বোড়ো ও বাঙালি মুসলমানেরা, তখন এমন কারো প্রেমের মাঝখানে প্রাচীর তুলেছে কিনা কোনও পরিচয়ের কাঁটাতার কে জানে? এই দাঙ্গার আগুনে কোনও অসহায় প্রেমিক হয়ত খুঁজে বেড়াচ্ছে তার প্রেমিকাকে। এভাবেই হয়ত অন্য কারও প্রেম হারিয়ে গেছে মনিপুরের কুকি-নাগা সংঘর্ষের দাঙ্গার আগুনে। এই ছবির নায়ক সীমান্ত পেরিয়ে ইরানে প্রবেশ করার মুহূর্তে মিলিত হয় একটি বিয়ের দলের সাথে। একপারের মানুষ অন্যপারে বাস করা আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতে যাবে। সীমান্ত পেরোতেই গানে নাচে স্বাগত জানায় কাঁটাতারে বিভক্ত হয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া আত্মীয়েরা। দেখেই মনে হয় বিয়ের মরসুমের সুতারকান্দি বা করিমগঞ্জের কালীবাড়ি ঘাটের সীমান্তের দৃশ্য।
ছবিটি দেখে বেরিয়ে আসছি। বোদ্ধা লোকেরা ছবি নানা আলোচনায় ব্যস্ত। সকলেই মুগ্ধ। কেউ বলছেন এটি চিরন্তন ভালোবাসার ছবি। কেউ বললেন মানুষের চিরন্তন প্রকৃতি-সংলগ্নতার ছবি। আবার কেউ কেউ বললেন একটি প্রাচীন লোকগাঁথার সমকালীন হয়ে ওঠার ছবি এই সিনেমাটি। আমি মুগ্ধ, হতবাক, এক ঘোরের মধ্য দিয়েই রাতের নির্জন পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি। আমার চলচ্চিত্র-অজ্ঞতা থেকে মনে হল, কেন এই ছবিটিকে দাঙ্গার আগুনে ঝলসে যাওয়া এই সংঘর্ষমুখর পৃথিবীতে একটি প্রতিবাদের রাজনৈতিক সিনেমা বলব না? এখানে ভালোবাসা একটি অস্ত্র। হিংসার বিপরীতে, কাঁটাতারের বেড়ার বিপরীতে সীমানাহীন ভালোবাসার পৃথিবী গড়ার একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘রামি’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন