শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০০৯

বদরুজ্জামান চৌধুরীর গল্পের ভুবন- এক অজানা প্রতিবেশের মুখোমুখি


একজন পরিশ্রমী গল্পকারের সৃষ্টি নিয়ে কোনো অর্বাচীন পাঠকের মন্তব্য করার অধিকার কতটুকু? সাহিত্য যেমন একটি শিল্প, সাহিত্য সমালোচনাও তেমনি একটি মননশীল শিল্পকর্ম। ফলেই এই জগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো ব্যক্তির আলটপকা মন্তব্যকে সাহিত্য সমালোচনা হিসাবে গ্রহণ করার কোনো যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই। সেজন্যেই এ লেখার শুরুতেই এই আত্মপক্ষ হাজির করা জরুরী যে বর্তমান নিবন্ধটি বদরুজ্জামান চৌধুরীর মত গল্পকারের গল্পগ্রন্থের কোনো সমালোচনা নয়। সমালোচনা লিখবেন নিশ্চয়ই কোনো না কোনো যোগ্য সমালোচক। এটা এক অর্বাচীনের দীন প্রতিক্রিয়া।
গল্প লিখছেন বদরুজ্জামান অনেক দিন ধরেই। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন, দৈনিক সংবাদপত্রের সাহিত্য পাতায় তার গল্প দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশিত হয়ে আসছে। বরাক উপত্যকার গল্প বিষয়ক নানা সঙ্কলনে তার গল্প স্থান পেয়েছে সসম্মানে। বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন তাঁকে সম্বর্ধিত, পুরস্কৃত করেছে অনেকবার। কিন্তু তবু তাঁর গল্পচর্চার একটা নিভৃত পরিসর রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরেই। শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে তিনি শুধু থাকেনই না, তার গল্পের ভুবন, তার গল্পচর্চা, খুব কাছেই, কিন্তু একধরণের প্রান্তিকতায় স্থান পেয়ে আছে দীর্ঘদিন। অথচ তাঁর গল্পে তিনি উন্মোচন ঘটিয়েছেন বৃহত্তর বরাক উপত্যকার সমাজের এক বৃহৎ অনালোকিত অংশের। বদরুজ্জামান চৌধুরীর গল্পের ভুবন আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশ হওয়া সত্ত্বেও তলিয়ে আছে আমাদের অজ্ঞানতার অতলে। এখানে ‘আমাদের’ শব্দটি একটি কুহকের সৃষ্টি করতে পারে। এই ‘আমরা’ কারা? এই আমরা তারাই যারা এই উপত্যকার সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতির বেশীর ভাগ পরিসর আলোয় আলো করে রেখেছি। এই আমাদের আমিত্বে একটা সামগ্রিকতার ভ্রম আছে। কিন্তু ভ্রম কেটে গেলে দেখা যায়, এই আমরা আসলে একটি খণ্ডিত ‘আমরা’। বরাক উপত্যকার সমাজের এক বৃহৎ অংশ সম্পর্কে অজ্ঞানতা এই খণ্ডিত ‘আমরা’ এর পরতে পরতে। মাঝে মাঝে মানবিক তাগিদ থেকে কেউ কেউ যে ও পাড়ার প্রাঙ্গনের ধারে যান নি তা নয়, কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করার মত আন্তরিক জানাশোনা কারোরই ছিল না। ফলেই একটা খণ্ডিত চিত্রায়ন ছিল আমাদের সাহিত্যে। এই খণ্ড চিত্রকে পূর্ণতা প্রদানের চর্চা দীর্ঘ দিন ধরেই করছেন বদরুজ্জামান। তিনি গল্প লিখেছেন বরাক উপত্যকার সাধারণ ভাবে মুসলিম সমাজের নানা সুখ, দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস, উল্লাসকে উপজীব্য করে। সেখানে গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত, দরিদ্র মানুষ যেমন আছেন, আছে আধা গ্রাম আধা শহরের মধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী পরিবারও । আর্থিক সঙ্গতির বিভিন্নতার জন্যে এই মানুষগুলির জীবনযাত্রায় যেমন আছে বৈচিত্র্য, আবার ধর্মীয় কুসংস্কারের জোয়ালে ক্রন্দনরত আর্ত মানবতার হাহাকার ঘুরে বেড়ায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রায় একই ভাবে। ধর্মীয় আচারের কারাগারে বন্দী বিচারহীন মানুষের দেখা যেমন মেলে বিভিন্ন গল্পে নানা ভাবে, আবার মানবিকতায় উজ্জ্বল বিভিন্ন চরিত্রও সাজিয়েছেন বদরুজ্জামান চিত্র শিল্পীর মতই। সঙ্কলনের প্রথম গল্প ১৯৭৭ সালে লেখা, আর শেষ গল্প একেবারের হালের, ২০০৩ সালের। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে লেখা ১৮টি গল্প সঙ্কলিত হয়েছে তার সম্প্রতি প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘লাখ টাকার মানুষ’ এ। প্রকাশ করেছেন সাহিত্য প্রকাশনী। সাহিত্য প্রকাশনীকে বরাক উপত্যকার সাহিত্য কর্মীদের একান্ত নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বলা চলে। ফলে এই সময়োচিত উদ্যোগ তারা ছাড়া আর কেই বা নিতে পারেন। বর্তমান সময়ে মানুষকে নিজের নিজের পরিচয়ের কারাগারে বন্দী করার আয়োজন চলছে সর্বত্র। ধর্ম, ভাষা, জাত পাত, বর্ণ- নানা পরিচয়ে মানুষ বন্দী হয়ে পড়ছে ক্রমশ। আমাদের দেশে ধর্মীয় পরিচয়ের বেড়াজালে মানুষকে বন্দী করে রাখাটা একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের তো কর্মসূচীতেই পরিণত হয়েছে। এই খণ্ডিত পরিচয় ভেঙে মানুষ মাঝে মাঝেই মিলিত হয় হৃদয়ের মেলবন্ধনে। আর এভাবেই গড়ে তোলে ইতিহাস। মিলিত হৃদয়ের উষ্ণতায় অভিন্ন ইতিহাস নির্মান তাদের পছন্দ নয়, যাদের আমরা বলি মৌলবাদী। মৌলবাদীদের হুকুমকে অগ্রাহ্য করে মানুষ গড়ে তোলে এক মানবিক পৃথিবী। কিন্তু এই মানবিক নির্মানের প্রথম শর্ত হচ্ছে, পারস্পরিক পরিচয়, অন্তরঙ্গ জানাশোনা। বদরুজ্জামানের গল্প সঙ্কলন আমাদের অপরিচয়ের ঘাটতি মেটাবে অনেকটাই। অথচ গল্পের ভুবন যেমন আমাদের বাড়ির পাশের আরশি নগর, ঠিক তেমনি চরিত্রগুলোও আমাদের ভীষন চেনা। হাটে বাজারে, কর্মস্থলে আমাদের প্রতিদিনই দেখা হয় বদরুজ্জামানের গল্পের চরিত্রগুলির সাথে। শুধু কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি কুশল বা হৃদয় বদল হয় নি হয়ত, তাই তাদের একান্তের জগৎ আমাদের এতটা অজানা। ১৯৭৭ সালে লেখা গল্প ‘জানোয়ার’ থেকে শুরু করে ২০০৩ সালে লেখা গল্প ‘লাখ টাকার মানুষ’ বা‘অন্নদাত্রী’ অবধি- দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে লেখা গল্পগুলোয় লেখার ধরণ হয়ত বদলে গেছে, বুনোটেও এসেছে রীতিমত পরিবর্তন, কিন্তু মূল সুর রয়ে গেছে অভিন্ন। অর্থনৈতিক দিক থেকে যারা নিঃস্ব, বাস্তবতার দুঃসহ অবস্থানে যাদের বাস কিম্বা ধর্মান্ধতার অমানবিক কারাগারে শেকলপরা মানুষগুলি, বিশেষ করে মুসলিম নারীর গোপন অশ্র“ তাঁর গল্পে ফিরে ফিরে আসে নানা ভাবে বারবার। এদিক থেকে বদরুজ্জামান শুধুমাত্র একজন গল্পবলিয়ে নন, নিপীড়িত নারী শিশুর প্রতি সমব্যথী এক সমাজ সংস্কারক, নিস্তরঙ্গ বরাক ভূমির এক নিভৃত ক্রুসেডার। তাই তাঁর গল্প সঙ্কলনের সাহিত্যমূল্যের চেয়েও সামাজিক মূল্য অনেক বেশী। গল্পসঙ্কলনের প্রথম গল্প ’জানোয়ার’ এ ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত আমাদের গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় পরিচয়কে মূল্যহীন করে দিয়ে হ্যাভ্স্ এবং হ্যাভ ্নট্স্ এর বিভাজন মূল সত্য হয়ে উঠতে দেখি ধীরে ধীরে , শাশ্বত এই সত্যকে ঢেকে রাখার জন্যেই আর বাকী সব পরিচয়। ধর্ম জাত পাতের সংকীর্ণ পরিচয়গুলোকে যতই কারাগারের চেহারা দেওয়ার আয়োজন যুগ যুগ ধরে চলে আসুক না কেন, মানুষ যুগ যুগ ধরেই পরিচয়ের অর্গল ভেঙে একে অপরের সাথে বিনিময় করেছে। বিনিময়ের দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাস থেকে শুরু করে সজীব বর্তমান অবধি প্রতিনিয়তই দেখে আসছি। মনে পড়ছে আজ থেকে বছর খানেক আগে ধর্মনগর করিমগঞ্জ ট্রেনে দেখা হওয়া বাদাম বিক্রেতা শিশুটির কথা। দারিদ্র্যের মলিন বেশ সত্ত্বেও শিশুসুলভ মায়াকাড়া অতল দীঘির মত চোখ দেখে হঠাৎই জিজ্ঞেস করি, ‘কি নাম তোর?’ জিজ্ঞেস করতেই শুধু বিস্ময় নয়, আবহমান ভারতবর্ষ উন্মোচিত হয় আমার সামনে। ‘গৌর মিয়া’, উত্তর দেয় ছেলেটি ভাবলেশহীন ভাবে। চেতনায় একের পর এক বেজে ওঠে বড়ে গোলাম আলীর মিঠে সুরে গাওয়া ‘হরি ওম তৎ সৎ’, টোরী রাগে পণ্ডিত যশরাজের গাওয়া ‘আল্লা জানে,আল্লা জানে’, দোতারা হাতে শিলচরের কাছাড়ির মাঠে শোনা কোনো লোক শিল্পীর গান,‘ মিরাজ আলীর মন, শ্রীকৃষ্ণ ধন লাভ করতে মানুষ, আছেরে কয়জন, বিফলে কাটাইলাম জনম প্রেমের গান গাইয়া’। ঐ শিশুর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই যেন তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল মানুষকে কারাগারে বন্দী করার বাল থ্যাকারে-নিজামীদের যুগ যুগের চক্রান্ত। এই পৃথিবীটা আসলে ‘মানুষ এখনো মানুষ’ গল্পের মতই। এখানে মাহফুজার সন্তান বাপনের চেহারায় মাধবী নিজের সন্তান শোভনের আদল খুঁজে পায়। সারা পৃথিবীর মানুষ তো একই মায়ের সন্তান। কারগিল যুদ্ধের সময় তাই আমাদের বরাক উপত্যকার তরুণ গীতিকার হৃষিকেশ লেখেন,‘এপার ওপার দুপারের চোখে জল, প্রিয়তমাসুর দুরুদুরু কাঁপে বুক,এপারের কোল খালি হলে যেন ভাসে এ মায়ের চোখে ও মায়ের ছেলের মুখ’। বদরুজ্জামান চৌধুরীর গল্পের ভুবনেও এই অযান্ত্রিক মানবিক বিনিময়ের, মিলিত প্রাণের পৃথিবীর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত। ‘বিসর্জন’ গল্পে দরিদ্র আমজাদ যখন হঠাৎ বড়লোক হওয়া মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে অপমানিত হয়ে সপ্তমীর ম্লান বিকেলে ধীর পদক্ষেপে ফেরার পথে কুশিয়ারার তীরে বসে পড়ে চোখের জলের বাঁধ মুক্ত করেন। সপ্তমীর বিকেলের আমজাদের চোখের জল একাকার হয়ে যায় দশমীর বিকেলের দেবী বিসর্জনের ঘাটে ভক্তের চোখের জলের সাথে। এই মানবিক মিলন প্রতিহত করে আছে কি কোনো জেহাদী বা সঙ্ঘ পরিবার? ‘বহুবল্লভা’র মৌলবী সাহেবও শেষ পর্যন্ত বিচারহীন আচারের অমানবিকতায় শিউরে ওঠেন। এমনতর অমানবিকতায় শিউরে উঠতে না পারা অবধি আমরা সকলেই ব্যবস্থার সামনে যেন যন্ত্রবৎ দাস। মনে পড়ে দিল্লীর নিশা শর্মার কথা। বিয়ের আসরে দরকষাকষির এক চূড়ান্ত মুহূর্তে শিউরে ওঠে নিশা। আবিষ্কার করে নিজেকে বাজারের নিলামের পণ্যসামগ্রী হিসেবে। উঠে পড়ে বিয়ের পিঁড়ি থেকে। তবে আমাদের বেশীর ভাগ মেয়ে জানেই না যে সে এক বিপণনের সামগ্রী, ধর্মের মোড়কে চলা অন্যায় ব্যবস্থায় এক অসহায় ক্রীড়নক। গোপন চোখের জলকে একমাত্র আশ্রয় সম্বল করে সে যন্ত্রবৎ স্থানু বসে আছে এখনো ব্যবস্থার সামনে।‘অশ্লীল’,‘এক খানা জীবনীর প্রথম অধ্যায়’ বা ‘লাখ টাকার মানুষ’ এর পারুল, মণিরা, আসমানতারা বা গফুরের স্ত্রীর মত। হয়ত একদিন সোচ্চার হবে। শহর গ্রামের নানা প্রেক্ষাপটে গল্পগুলো লেখা। এবারে প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্য হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বইটির মুদ্রন প্রমাদ আরেকটু কম হলে ভালো হত। তা ছাড়া কয়েকটি গল্পে ব্যবহৃত উপভাষার সংলাপের স্থানিক পরিচয় বের করা অসম্ভব হয়ে যায়, কতগুলো প্রমাদের জন্যে। ত্র“টি হয়ত আরো আছে যা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা আলোকপাত করবেন, কিন্তু বদরুজ্জামান চৌধুরীর মত গল্পকারের গল্প সংকলন প্রকাশিত হওয়া নিশ্চয়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বদরুজ্জামান চৌধুরীর কলম আমাদের দৃষ্টি আরো প্রসারিত করুক। এই প্রান্তিক জনপদের সংস্কৃতি আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে আমি বদরুজ্জামান চৌধুরীকে সতীর্থের অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই। সমস্ত ধরণের সামাজিক আবিলতামুক্ত পৃথিবীর যারা স্বপ্ন দেখেন, তাদের সারির একদম পেছনে থাকা একজন হিসেবে আমি এই বইয়ের বহুলপ্রচার কামনা করি।

২টি মন্তব্য:

  1. কিতারেবা ইতা আগর লেখানি? অতো তাড়াতারি লেখো লেমনে?
    আইচ্ছা ঃ ওকটা দেখো, তুমি পাগলাই যাইবায়ঃ
    http://kalsrot.blogspot.com/

    উত্তরমুছুন
  2. এই লেখার জন্যে তোমার সঙ্গে খোয়াব কাগজের মাল্যবান যোগাযোগ করতে পারেন।

    উত্তরমুছুন