মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

সেই আদ্যিকালের পশুর ঠ্যাং ও আজকের রাজনীতি

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এই গল্প। ‘মন্দিরের সামনে গরুর ঠ্যাং রেখে দিয়ে গেছে ব্যাটারা`। কিম্বা ‘মসজিদের সামনে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা শুয়োরের ঠ্যাং রেখে গেছে`। সব গল্পের শেষ এক দৃশ্যে, দাঙ্গা। দাঙ্গা, রক্তপাত, পাথর ছোঁড়া, নিরীহ মানুষের মৃত্যু, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া, কারফিউ, নিরাপত্তা বাহিনীর টহল ইত্যাদি। এত গেল আইনশৃঙ্খলার দিক। তারচেয়েও মারাত্মক যে কাজটি এই গল্প করে যায়, যার রেশ থেকে যায় কারফিউ ওঠার, সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ারও অনেক অনেকদিন পর অবধি, তা হল- দীর্ঘদিন ধরে সুখে শান্তিতে পাশাপাশি বাস করা প্রতিবেশীর মধ্যে অবিশ্বাসের বিষ-হাওয়া ঢুকিয়ে দেওয়া। এই গল্পের শুরু ব্রিটিশ আমল থেকে। মায়ের মুখে ছোটবেলায় শুনেছি, মন্দির বা মসজিদের সামনে বিশেষ পশুর হাড় বা মাংসের টুকরো, তারপরই দু`দিক থেকে ‘বন্দে মাতরম` আর ‘আল্লাহো আকবর` রণধ্বনি। তারপর দেশ স্বাধীন হল। কত কত রঙের সরকার এল আর গেল। তবু এই গল্পের শেষ নেই।


মনে পড়ে ১৯৮০ সালের লোকসভার নির্বাচনের সময়ের কথা। মনে পড়ে ১৯৮৬-৮৭ থেকে শুরু করে ১৯৯২-৯৩ সাল অবধি সময়পর্বের কথা। তারপর বরাক কুশিয়ারা জিরি চিরি দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। পুরনো গল্প কার্যকারিতা হারানোয় নতুন গল্প এসেছে। সে জন্যেই হয়ত, কিছুদিন আগে শুনেছি অন্য গল্প। কে কাকে বিয়ে করল, সেই নিয়ে উপত্যকা জুড়ে চলল ফিসফিসানি আর চক্রান্তের জাল বোনা। অনেকদিন এই গল্প শুনিনি বরাক উপত্যকায়। আজ সকালে ইন্টারনেটের পাতায় শিলচরের খবরের কাগজের সংবাদ শিরোনাম ভেসে উঠতেই চমকে উঠলাম, শিউরে উঠলাম এবং সত্য কথা বললে, এক নিদারুণ যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝেই ভাবি, আমরা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা কি সত্যিই নিতান্ত ক্ষমতাহীন? আমাদের শুভবুদ্ধির কোনও শক্তি নেই, নেই এর কোনও দাম? যার যখন ইচ্ছে হল, তখনই মুহূর্তে এক সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভরিয়ে দিল গোটা সমাজের আকাশ। তবে আমরা যে প্রতিদিন একসাথে বাঁচি, একসাথে হাসি, একসাথে কাঁদি, শিলচর থেকে গুয়াহাটি বাসযাত্রা করতে গিয়ে ধর্মনির্বিশেষে এক সাথে নাজেহাল হই, তা কি আমাদের দু’টি হৃদয়ের মধ্যে কোনও শক্তিশালী সেতু গড়ে তুলতে পারে না? কেন কোনও সমাজবিরোধীদের ইচ্ছা হলেই এক মুহূর্তে, সেটা কারো বিয়ে হোক বা কোনও শিশুর মর্মান্তিক হত্যা হোক বা কোনও জনপ্রিয় চিকিৎসকের অপহরণের ঘটনা হোক, তাকে ব্যবহার করে এই শহরে এই উপত্যকাকে বিষের হাওয়ায় ভরিয়ে দিতে পারে? পারে জনজীবনকে তছনছ করে দিতে? এটা কী কারো বুঝতে বাকি থাকে, গতকাল যে ঘটনা দিয়ে শহরকে অস্থির করে উপত্যকায় আবার একটা সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ আনার চেষ্টা হল, সেটা সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত। নয়ত হঠাৎ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট শহর ও গঞ্জগুলিতে আবার নব্বইয়ের কায়দায় সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে কেন? কেনই বা হঠাৎ আবার অযোধ্যা নিয়ে সিংঘল, তোগাড়িয়ারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন? মাঝে দেশের মানুষ সিংঘল কোম্পানির নামই ভুলে গিয়েছিলেন হয়ত। তাদেরও রাম জনমভূমি বা অন্য ইস্যু নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না। প্রায় নির্বাসনই হয়ে গিয়েছিল সংবাদ পত্র থেকে। এখন সিংঘলও সক্রিয়, গ্রামে শহরে বানর বাহিনীও সাজসজ্জা শুরু করেছে।


ক‘দিন ধরেই মনে মনে আতঙ্কে রয়েছি বরাক উপত্যকা নিয়ে। যে দিন থেকে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করার স্বপ্ন ফেরি শুরু হয়েছে আমাদের দেশের কর্পোরেট মিডিয়া ও কর্তাদের তরফে, তখন থেকেই এই আতঙ্ক। গুজরাট গণহত্যার নায়ক নরেন্দ্র মোদী যতই উন্নয়নের মুখোস পড়ুন এবং ঈদের দিন মুসলিমদের টুপি নিজের মাথায় দিন, তার যে কোনও রাজনৈতিক প্রচারাভিযান উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ব্যতিরেকে কখনো হয় নি আর হবেও না। মজার কথা, একসময়ে মুলায়ম সিং যাদব ঈদের সময় মুসলিমদের মত টুপি পড়ায় নরেন্দ্র মোদী ও সারা দেশজুড়েই সঙ্ঘপরিবারের লোকেরা মুলায়মকে মৌলানা মুলায়ম বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই সঙ্ঘ পরিবারওয়ালাদের এইটেই মজার ব্যাপার, নিজেরা বাঁশকান্দির মৌলানার কাছেই যান আর জামা মসজিদের ঈমামর কাছে যান, ওরা গেলে সেটা ধর্মনিরপেক্ষতা। যদি অ-বিজেপি কেউ এই একই কাজ করেন, তবে সেটা মুসলিম তোষণ। যাইহোক, এবার ঈদের সময় নরেন্দ্র মোদী তাঁর নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষতায় মুসলিমদের টুপি মাথায় পড়লেও, তাকে নিয়ে বিজেপি ও কর্পোরেট মিডিয়ার উৎসাহী প্রচার শুরু হতেই দেশের নানা জায়গায় নব্বইয়ের কায়দায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর কাজও শুরু হয়ে গেছে। বিহারে অশান্তি, কর্ণাটকে অশান্তি, উত্তরপ্রদেশে তো বাঁদর-নৃত্য শুরু হয়েছে। আমার ভয় ছিল, কবে এই বাঁদর-বাহিনী বরাকের মাটিতে থাবা বসায়। গতকালের ঘটনা আমার কাছে সেই দেশব্যাপী অশুভ পরিকল্পনারই অংশ বলে মনে হয়েছে।


খবরের কাগজে এই যন্ত্রণাদায়ক সংবাদ প্রতিবেদনটি পড়েই ফোন করেছিলাম কয়েকজন বন্ধুকে। সবাই বললেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত। চিন্তার কোনও কারণ নেই। তাঁদের কথায় আমি আশ্বস্ত হয়েছি ঠিকই, তবু কয়েকটি কথা বলব। আমার মনে হয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে পথে নামতে হবে। আমরা যাঁরা বরাক উপত্যকার মানুষ, কিন্তু এই মুহূর্তে বাইরে থাকি, তাঁরা এ ধরনের খবর শুনলে অস্থির হয়ে ওঠেন। নাট্যকর্মী সুব্রত রায় ফেসবুকে বলেছেন, এই মুহূর্তে পথে না নামাই উচিত। তাঁর মতে, এতে উত্তেজনা বাড়তে পারে। তাঁর স্পষ্ট বিশ্বাস, বরাক উপত্যকার নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনটি অনেক বেশি শক্তিশালী। গুটিকয়েক সমাজবিরোধীরা একে বিনষ্ট করতে পারবে না। ওর এই কথা সাথে অনেকাংশে একমত হয়েও আমার ধারণা, পথে নামা উচিত। এই মুহূর্তে সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন যারা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের তীব্র বিরোধী, তাঁদের পথে নামতে হবে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্যেই। যাঁরা ভাবছেন গরু ছাগল শুয়োরের ঠ্যাং দেখিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন, তাদের দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে যে, বেশির ভাগ মানুষ এসব গরু ছাগল শুয়োরের সুড়সুড়িতে বশ হন না। অবিশ্বাস আর বিষের অপশক্তির চেয়ে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের মিছিল অনেক বেশি শক্তি ধরে।


শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৩

তেলেঙ্গানা-গোর্খাল্যান্ড-বোড়োল্যান্ড ও সতেরো আগস্ট

বাহাত্তরের পর থেকে সতেরো আগস্ট প্রতি বছর আসছে। আসছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে। শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তী যে মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন, সেখানে শহীদ দিবস পালন মানে ইতিহাসের চর্বিত চর্বন নয়। প্রতি বছর বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেখতে হবে শহীদের আত্মদানের ইতিহাসকে। দু‘টোকে যুক্ত করেই পালিত হবে শহীদ দিবস। এবার যখন সতেরো আগস্ট পালিত হবে তখন গোটা দেশের রাজনীতি মুখর হয়ে আছে ছোট রাজ্যের দাবিতে। আসামও আবার উত্তাল হয়ে উঠেছে বোড়োল্যান্ড ও কামতাপুরের দাবিতে। বরাক উপত্যকায় কেউ কেউ পৃথক বরাকের আওয়াজ নিয়ে আবার সক্রিয় হতে চাইছেন। অন্য কেউ কেউ বলছেন পৃথক অর্থনৈতিক পরিষদের কথা। দেশের নানা প্রান্তেই এখন নতুন নতুন রাজ্যের আওয়াজ। এমন একটি পরিস্থিতিতে যখন সতেরো আগস্ট পালিত হবে, তখন আমরা কী এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারব? বাচ্চু চক্রবর্তীর মতাদর্শই বলে, এই পরিস্থিতিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনার মধ্যে না রাখলে শহীদ দিবস পালন অর্থহীন হয়ে যাবে।
           

ছোট রাজ্যের দাবিদার সমস্ত আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, তাঁদের সংগ্রাম ভাষা-সংস্কৃতি-আত্মপরিচয় রক্ষার সংগ্রাম। শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীদের সংগ্রামও ছিল ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সংগ্রামই। বাচ্চু চক্রবর্তীর স্মরণ দিবস পালন করতে গিয়ে এই বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হবে। যদিও নীতি হিসাবে এই দাবিকে গ্রহণ করা একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল বিজেপি সবসময় ছোট রাজ্য গঠনের স্বপক্ষে থাকার যুক্তি হিসাবে প্রশাসনিক সুবিধার কথাই তুলে ধরেছে। কিন্তু এই দাবি নিয়ে যারা আন্দোলন সংগ্রাম করছেন, তাদের কারো কাছেই প্রশাসনিক সুবিধাটি কোনো বিষয়ই নয়। প্রত্যেকটি পক্ষই ছোট রাজ্য গঠনের সাথে ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের প্রশ্নকে যুক্ত করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই একটা প্রশ্ন করা যায়, সত্যিই কি ছোট রাজ্য গঠনের সাথে ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সম্পর্ক রয়েছে? ভাষা সংস্কৃতির অধিকারের সংগ্রাম এবং ছোট রাজ্যের দাবিতে লড়াই কি সত্যিই সমার্থক? তা ছাড়া, ভাষা-সংস্কৃতি-আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আন্দোলন লড়াইয়ে কি মিশে নেই আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার প্রশ্ন? আমরা দেখব, আত্মপরিচয়ের দাবির মধ্য দিয়ে মূলত আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার সমস্যাগুলিই প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভাষা সংস্কৃতি আত্মপরিচয়ের দোহাই দিয়ে বড় রাজ্য ভেঙে ছোট রাজ্য গড়ার ঘটনা কম ঘটেনি। প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে স্বাধীনতার পর থেকে যতগুলি ছোট রাজ্য গঠনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলি কি তার প্রার্থিত লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে? আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্ন কিংবা আত্মপরিচয়ের প্রশ্নই হোক, ছোট রাজ্যগুলির অবস্থা বড়ো রাজ্যগুলির চাইতে এখনও খুব একটা উন্নত নয়।  বেশিলভাগ ছোট রাজ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বপ্ন কিংবা ভাষা সংস্কৃতির উন্নতির স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। আজকের ঝাড়খন্ড বা ছত্তিশগড়ের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।


অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার সমস্যাগুলি মূলত রাজনৈতিক সমস্যা, যদিও তার মধ্যে গভীরতর অর্থে কতগুলি সাংস্কৃতিক প্রশ্নও যুক্ত হয়ে আছে। এই বিষয়ে লড়াই সংগ্রাম করার সময় শুধু রাজনৈতিক দিকটিকে গুরুত্ব প্রদান করলে যেমন লড়াইটি খঞ্জ হয়ে যায়, তেমনি রাজনীতি অর্থনীতির বৃহত্তর প্রশ্নটিকে খাটো করে গোটা সংগ্রামটিকে আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে পর্যবসিত করলেও লড়াইটি শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিকতার গহ্বরে হারিয়ে যায়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের দীর্ঘদিনের রোগটি হল এই যে সেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রশ্নগুলি যথাযথ গুরুত্ব পায় নি। রাজনীতি শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবাজীতে আটকে পড়ে। আবার গত কয়েক দশকে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের এই দুর্বলতাগুলির প্রত্যাখান হিসাবে যে লড়াই সংগ্রামগুলি আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে এই মুহূর্তে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রান্তে সেখানে রাজনীতি অর্থনীতির বৃহত্তর প্রশ্নগুলি প্রায় ব্রাত্যই। এমন কি সমস্যাগুলির বৈশ্বিক তাৎপর্যের দিকে নজর না দিয়ে সমস্ত কিছুকে এক ধরনের আঞ্চলিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতাই বেশি। এই আঞ্চলিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ফলাফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, এক জায়গার সংগ্রামরত জনগোষ্ঠী প্রায়শই অন্য আরেকটি স্থানের সংগ্রামরত মানুষের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন। এ ভাবেই কাবেরীর জলবন্টনের মত একটি সমস্যাও প্রতিবেশী দু’টি রাজ্যের মানুষকে সংঘাতের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। এভাবেই কখনো দার্জিলিং-এর গোর্খা হয়ে যায় কলকাতার বাঙালির প্রতিপক্ষ। কখনো গুয়াহাটির সাধারণ অসমীয়া হয়ে যান বরাকের সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ। কখনো আবার একই ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে বসবাস করা দুটি জনগোষ্ঠীর মানুষ পরস্পর পরস্পরের শত্রু হয়ে যান এবং গোষ্ঠীগত হিংসার জন্ম হয়। অনেকেই মনে করেন, সারা পৃথিবী জুড়ে ছোট ছোট পরিচয়ের দ্বীপে মানুষকে বন্দী করে ছোট ছোট সত্তার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেই বিপ্লবী সংগ্রামের একমাত্র রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার মধ্যে একটি নয়া উপনিবেশবাদী ছক রয়েছে। শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্যকে এ ভাবেই দুর্বল করতে চেয়েছে দেশে দেশে কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূরা। আমাদের দেশেও দেখব, কখনো মারাঠী সত্তা, কখনো গোর্খা আত্মপরিচয়, কখনো অসমীয়া জাতিসত্তা, কখনো তেলেঙ্গানার বঞ্চনা দূরীকরণ- এই সমস্ত প্রশ্নকে সামনে এনে শোষিত নিপীড়িত মানুষের ঐক্যে বিশ্বাসী বামপন্থীদের ওপরই প্রথম আঘাতটি সংঘটিত হয়েছে। এ কাজে রাষ্ট্রশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলি এক অদ্ভুত সখ্যে আবদ্ধ হয়েছে।


এরই মধ্যে আরেকটি মুশকিলের ব্যাপার হচ্ছে, বামপন্থীদের একটি অংশের ধারণা, ছোট ছোট রাজ্য গঠন ঐ সব অঞ্চলের সামগ্রিক পশ্চাদপদতা এবং বঞ্চনার দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে। এঁদের অনেকেই ছোট রাজ্যের দাবির বিরোধিতাকে শাসকশ্রেণির লেজুড়বৃত্তি বলেও অভিহিত করেন। এই আদর্শগত বিবেচনা থেকেই বামপন্থীদের ওই অংশগুলি একসময় পৃথক ছত্তিশগড় ও ঝাড়খ-ের প্রবল প্রবক্তা ছিলেন। এখনও তাঁদের ওই অংশ একইভাবে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের সোচ্চার সমর্থক। কিন্তু তাঁদের তরফে পৃথক ছত্তিশগড় এবং পৃথক ঝাড়খ- গঠন পরবর্তী অভিজ্ঞতার কোনো মূল্যায়ন চোখে পড়ে নি।
ছোট রাজ্য গঠনের যাঁরা বিরোধিতা করেন, তাঁদের অবস্থানটিও কখনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসাবে এই মুহূর্তে গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতায় সমগ্র পশ্চিমবাংলা জুড়ে যে বক্তব্যগুলি উপস্থিত করা হচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতা করতে গিয়ে দু’ধরনের বক্তব্য এই মুহূর্তে শোনা যাচ্ছে। প্রথম বক্তব্য, বাংলার অখ-তা বারবার বিপন্ন হয়েছে। আর কোনো অবস্থাতেই এই অখ-তাকে ধ্বংস করতে দেওয়া যায় না। দ্বিতীয় বক্তব্য, মাত্র সাড়ে তিনটি মহকুমা নিয়ে কোনো রাজ্য গঠিত হতে পারে না। তাই গোর্খাল্যান্ড এর দাবিকে মান্যতা উচিত নয়। আমার মতে, দুটি বক্তব্যই বিভ্রান্তিকর।


দার্জিলিং কখনোই অখ- বাংলার অংশ ছিল না। ব্রিটিশ শাসকদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্যেই একে বাংলার সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। যে সময়পর্বে এই সংযুক্তির ঘটনা ঘটে তখন থেকেই ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পৃথকত্বের দাবি উঠে আসছে। এই দাবি উত্থাপনের পেছনে ভাষা সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যই মুখ্য কারণ ছিল। দার্জিলিংকে ঘিরে বাংলা ভাগ হতে দেবো না গোছের সোচ্চার ধ্বনি যত উঠছে, ততই দার্জিলিং-এর মানুষ বিপন্নতা বোধ করেন নিজেদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে। এখানে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের বিরোধিতা করতে হবে অনেক বেশি সংবেদনশীলতার সঙ্গে। ওই অঞ্চলের মানুষের সমব্যথী হয়ে তাঁদের সামনে তুলে ধরতে হবে পৃথকত্বের নিস্ফলতার কথা। আচার আচরণে বোঝাতে হবে যে ওই অঞ্চলের পশ্চাদপদতায় বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গের মানুষও একই ভাবে ক্ষুব্ধ। দ্বিতীয়ত, মাত্র সাড়ে তিন মহকুমা নিয়ে রাজ্য হয় না, যুক্তি হিসেবেও এটা অত্যন্ত দুর্বল যুক্তি। যে দেশে গোয়ার মত রাজ্য রয়েছে, সিকিমের মত রাজ্য রয়েছে, দিল্লির মত রাজ্য রয়েছে, সেখানে আয়তনের প্রশ্নে দার্জিলিং-এর দাবিকে প্রত্যাখান করা যায় না। বিরোধিতার স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে মানুষকে বলা উচিত যে, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে এই পথ সমস্যার কানাকড়ি সমাধান করতেও সক্ষম নয়। যে সমস্যায় দশকের পর দশক ধরে তাড়িত হয়ে মানুষ আলাদা রাজ্য চাইছেন, সেই সমস্যার যদি কিছুই না হয়, তবে শুধু শুধু একটি রাজ্য গঠনের কী সার্থকতা রয়েছে। আমার ধারণা বিরোধিতা করতে হলে, এমন একটি অবস্থান থেকেই করতে হবে। কোথাও একটি পৃথক রাজ্যের আওয়াজ উঠলেই তাকে সংবিধান বিরোধী, বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে নিন্দা করলে অনেক সময়েই সেখানকার মানুষকেই দূরে ঠেলা হবে।


সারা পৃথিবী জুড়েই এক ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং বিদ্বৎজনেরভ দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের তাত্ত্বিক চর্চা করে আসছেন, যেখানে অর্থনীতির প্রশ্ন, শ্রেণির প্রশ্নকে লঘু করে এবং সর্বোপরি শ্রমজীবী মানুষের বিশ্ববীক্ষাকে প্রত্যাখান করে আত্মপরিচয়ের সংগ্রামকেই সর্বরোগহর বিপ্লবী পন্থা হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। বিশ্বায়নের হাত ধরে এই আন্তর্জাতিক রোগ আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চায় এবং প্রতিটি অঞ্চলের তথাকথিত বিকল্পের রাজনীতির কর্মসূচিতে স্থান করে নিয়েছে। ছোট ছোট জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে থাকা মানুষের মধ্যে পৃথকত্ব সম্পর্কিত মোহ সৃষ্টিতে এ ধরনের জ্ঞানচর্চার এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।


এবার দেখা যাক, বরাক উপত্যকার পৃথকত্বের দাবির দিকে। আমার মতে, বরাক উপত্যকায় পৃথকত্বের দাবি এখানকার মানুষকে নিশ্চিতভাবেই এক অভূতপূর্ব গৃহবিবাদের দিকে ঠেলে দেবে। বরাক উপত্যকার আধুনিক ইতিহাসটি অন্য অঞ্চলের মত নয়, একটু ব্যতিক্রমীই। অন্যত্র অঞ্চলগুলি পৃথকত্ব চায়, আর রাজ্য বা কেন্দ্র তা মানতে চায় না। বরাকে বিষয়টি উল্টো। বরাকে পৃথক হতে চাওয়াটা কখনোই গণদাবী ছিল না। যাঁরা পৃথকত্ব চান তাঁরা সবসময়েই এখানকার রাজনীতিতে ব্রাত্য। মজার কথা, বরাকের চেয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নানা মহল বিভিন্ন সময়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন বরাক উপত্যকাকে আসাম থেকে কেটে ফেলতে। ফলে আমরা দেখব বরাকের পৃথকত্বের বিষয়টি বরাক উপত্যকায় যতটা আলোচিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়, সেখানকার নানা  সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন সংগঠনের সভাসমিতির বক্তৃতায় ও প্রস্তাবাবলীতে। যখনই বরাক উপত্যকার মানুষ তাদের অধিকারের প্রশ্নে সংগ্রামমুখর হয়েছেন, তখনই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কোনো না কোনো সংবাদপত্রে নিবন্ধ বা চিঠিপত্র লিখে কেউ না কেউ বলেছেন, বরাককে আসাম থেকে আলাদা করে দেওয়া হোক। অন্যদিকে, বরাকে দীর্ঘদিন ধরে কিছু সংগঠন পৃথকত্বের দাবি জানালেও বরাকের মানুষ এই দাবিকে বলা যায় পাত্তাই দেন নি। এই দাবি নিয়ে অনেকে নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, কিন্তু কোনো নির্বাচনেই তাঁরা জামানত রাখাই দায় হয়েছে। বরাকের সাধারণ দাবি হচ্ছে, আসামের মধ্যে থেকে আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের ন্যায্য দাবির পূরণ। এ ছাড়াও মনে রাখা উচিত, হাজার বিবাদ বিসম্বাদ সত্ত্বেও বরাকে এখন পর্যন্ত কোনও তীব্র গৃহবিবাদ হয় নি। নানা অভাব অভিযোগ বঞ্চনা সত্ত্বেও এখানকার ভাষা ও সম্প্রদায়ের মানুষ সদ্ভাবে সম্প্রীতিতেই বসবাস করছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে পৃথকত্বের পথে হাঁটবে এ অঞ্চল নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ বিবাদ বিসম্বাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বরাককে পৃথক রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করলেই এখানেও নানা ভাষাগোষ্ঠী ও জনসম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হবে ক্ষমতা দখলের লড়াই। ক্ষমতার কেকটি কে খাবেন, উদ্বাস্তু বাঙালি না স্থানীয় বাঙালি, মনিপুরি না চা শ্রমিক সম্প্রদায় না অন্য কেউ- এ নিয়েও তখন শুরু হবে বিচ্ছিরি ধরনের বিভেদপন্থী রাজনীতি। বরাক উপত্যকায় সামাজিক শান্তি ও সৌহার্দ্যরে স্বার্থেই এখানে পৃথকত্বের দাবি দাওয়া নিয়ে রাজনীতি না করাই বাঞ্ছনীয়। আমাদের দাবি করা উচিত বৃহত্তর বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের। এই দাবি শুধুমাত্র বরাক উপত্যকার জন্যে নয়, সারা দেশেই যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রচলনের জন্যে কেন্দ্র থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে জেলা, জেলা থেকে গ্রামস্তর পর্যন্ত যথার্থ অর্থে বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।এরই সঙ্গে আমাদের অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের বিভিন্ন দাবিদাওয়াগুলি পূরণের দাবিতেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মিলিত অংশগ্রহণে জোরদার গণআন্দোলন গড়ে তোলা উচিত।


বামপন্থীদের এই মুহূর্তে একটি বড় ভূমিকা পালনের প্রয়োজন রয়েছে। এই ভূমিকা পালন করতে হলে, বামপন্থীদেরও চিরাচরিত রণনীতি ও কৌশলের আবর্ত থেকে বেরিয়ে নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। আমরা দেশের নানা প্রান্তে দেখেছি, বিকাশমান বামপন্থী আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে কায়েমী স্বার্থান্বেষীরা বারবার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার ও ভাষা সংস্কৃতির প্রশ্নে জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তুলে শ্রেণি আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই দুর্বলতার পটভূমিতেই বামপন্থীরা নিজেদের শক্তি ধরে রাখতে না পেরে ওই অঞ্চলগুলির রাজনীতিতে প্রান্তিকায়িত হয়ে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে শুরু করে দার্জিলিং, মুম্বইয়ের শ্রমিক মহল্লা থেকে কৃষক আন্দোলনের দুর্জয় ঘাঁটি তেলেঙ্গানা, সর্বত্র আমরা একই ঘটনার সাক্ষী থেকেছি। এতদিন অবধি বামপন্থীদের নীতিগত অবস্থান ছিল যে, ভাষা সংস্কৃতি জাতিসত্তা ইত্যাদির প্রশ্নগুলি জীবনজীবিকার স্বার্থে গড়ে তোলা দুর্বার শ্রেণি আন্দোলন ও গণআন্দোলনের আঘাতে দুর্বল হয়ে পড়বে। বাস্তবে ঘটেছে ঠিক উল্টো। জাতিসত্তা ও ভাষাসংস্কৃতির প্রশ্নই শ্রেণি আন্দোলনকে দুর্বল ও কোণঠাসা করে দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হলে, বামপন্থীদের শুধু নীতিগতভাবে নয়, কর্মক্ষেত্রেও শ্রেণি আন্দোলনের সাথে ভাষা সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রশ্নগুলিকে যুক্ত করতে হবে। এই সমস্ত বিষয়কে একসাথে নিয়েই গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এভাবে সংগ্রাম গড়ে তুললেই সংঘাতের পরিবর্তে এক অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ অন্য অঞ্চলের সংগ্রামরত মানুষের সাথে এক লড়াকু মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হবে। শুধু শ্রেণি আন্দোলন দিয়ে এই কাজটি সমাধা করা অসম্ভব। আমরা অনেকেই এই মুহূর্তে লাতিন আমেরিকার বামপন্থার পুনর্জাগরন নিয়ে খুবই আলোড়িত। লাতিন আমেরিকার দিকে তাকালে দেখব, সেখানে যে নতুন বামপন্থা আত্মপ্রকাশ করছে, তার মূল বৈশিষ্ট্য শ্রেণি আন্দোলনের সাথে সামাজিক আন্দোলনের মৈত্রীবন্ধন। ভেনিজুয়েলা থেকে পেরু, ব্রাজিল থেকে ইকুয়েডর, সর্বত্রই যে বামপন্থী মুখচ্ছবিগুলি আমাদের এই অনুপ্রাণিত করছে, তাঁদের বেশিরভাগই সামাজিক আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসা ব্যক্তিত্ত্ব। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রামের যে বামধারা, তার সাথে রাজনৈতিক বামপন্থার ঐক্যই সেখানে পুনর্জাগরিত বামপন্থাকে এক নতুন ভাষা জুগিয়েছে। এই নতুন বামপন্থার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে সংস্কৃতির সংগ্রাম। এই নতুন বামপন্থা একই সঙ্গে স্থানীয় বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, আবার একই সঙ্গে মার্কিনী পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিকল্পে এক নতুন বিশ্ববীক্ষারও জন্ম দিচ্ছে। আমাদের দেশে জাতিসত্তার আন্দোলনগুলি যখন এক অঞ্চলকে অন্য অঞ্চলের প্রতিপক্ষ হিসাবে উপস্থিত করছে, লাতিন আমেরিকায় বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সংগ্রামগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক বৃহত্তর লাতিন আমেরিকীয় সত্তার নির্মানও করছে। আমাদেরকেও হাঁটতে হবে সেই পথে।



২০১৩ সালের শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তী স্মরণ অনুষ্ঠান সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়ের স্বপ্ন দেখতে যদি আমাদের প্রাণিত করতে পারে, তবেও বলতে পারব, আমরা সঠিক দিশায় আমাদের যাত্রারম্ভ করতে পেরেছি। নচেৎ এক প্রতিযোগিতামূলক আঞ্চলিকতাবাদের নীরব দর্শক হয়ে আমরা আমাদের স্বপ্নগুলির সমাধি রচিত হতে দেখব চোখের সামনে।

শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই



অনেকে বলেন পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ এলেই আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে আমরা শুধু ওই দুটো দিনে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি এটা সত্য নয়। আমার কাছে সমস্যাটা মনে হয় অন্য। এতগুলো বছর ধরে আমাদের জীবনের ওপর আলো ফেলছেন যে রবি, যিনি আবার প্রখরতাপে বটের ছায়াও দেন, তাঁর কাছে আমরা কী চাই তা কি আমরা জানি? কিংবা আমাদের তিনি যা দিয়েছেন এবং আমরা তাঁর কাছে যা চাই, তার মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে কি? পণ্ডিতেরা তাঁর রচনাবলীর সমস্ত প্রান্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাঁর সম্পর্কে আমাদের আলোকিত করেন। আমি সামান্য একজন গায়ক। গানের ভেতর দিয়েই তাঁর সাথে আমার প্রধানত সখ্য। শুধু তাঁর সাথে নয়, তাঁর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, নাটক, চিঠিপত্রের যে সামান্যটুকুতে আমার যাতায়াত হয়েছে, সেই যাতায়াতের পথেও তাঁর গানই আমাকে আলো জুগিয়েছে। এই ছোট্ট পরিসরে যা বলব, তা তাঁর গানের সুরের পথিক হিসেবেই বলব। পথিক শব্দটা বলতে গিয়েও একটু বাঁধল। একটা ন্যূনতম জীবন-পর্যটন না হলে বোধহয় কাউকে পথিক বলা সঙ্গত নয়। এটা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অনুভবেও আমরা জেনেছি, আবার একটি ইংরেজি গানের বাংলা ভাবান্তর করতে গিয়ে আমাদের সম্প্রতি সময়ের এক কবিয়াল বলেছেন, কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়! সম্প্রতি একটি কবিতায় পড়লাম একটি অবিস্মরণীয় পংক্তি, হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে পথ হয়ে গেছি। কবি কী অর্থে বলেছেন এই কথা জানি না। পথ হাঁটার ক্লান্তিতে, নাকি পথ হারানোর ভ্রান্তিতে, নাকি দীর্ঘ পথযাত্রার পরিশেষে পথের সমার্থক হয়ে উঠেছেন আমাদের আদর্শ পথিক, জানি না। সে অর্থে নিজেকে পথিক বলে অভিহিত করব না, করব পথচারী হিসেবে। পথচারীও হয়ত পথিকের মত পথের সাধনা না থাকলেও পথের নেশায় আকুল হয়ে ওঠেন কখনো কখনো। এই নেশার আলো থেকেই বলব কয়েকটি কথা।


রবীন্দ্রনাথকে আমরা তাঁর সমগ্রতায় বিচার করেছি কি? বোধহয় নয়। আমরা সবসময়ই আমাদের খণ্ড সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের খণ্ডিত জীবনবোধের দ্বারা আমাদের তাৎক্ষণিক চাওয়া পাওয়ার নিরিখে তাঁকে বিচার করতে চেয়েছি। স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলিতে, যখনও রবীন্দ্রনাথের শিল্পকীর্তি জনসাধারণ্যে এতটা চর্চিত ছিল না, তখন আমাদের জাতীয় নেতারা চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের সেই সময়ের চাওয়া পাওয়ার নিরিখে পেতে, তাঁর সৃষ্টিকে গ্রহণ করতে। তখন আমাদের কাছে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল রবীন্দ্রনাথের পররাজ্যগ্রাস বিরোধী স্বাধীনতাস্পৃহা উদ্রেককারী উচ্চারণগুলি এবং তাঁর সে ধরনের শিল্পসৃষ্টিগুলিকে বিবেচনার মধ্যে আনার। সেই সময়ে তাঁর যে সৃষ্টিকেই মনে হয়েছে তাঁদের সেই চাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাকেই তাঁরা এবং তাঁদের অনুবর্তী হয়ে আমরা বর্জন করেছি। আবার পরবর্তীতে যখন আমাদের খণ্ড সময়ের প্রয়োজনে মনে হয়েছে নানা পরিচয়ে বিভক্ত সমাজের উর্ধে উঠে একটি বহুত্বের আদর্শকে তুলে ধরার, তখন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীনতাকে, তাঁর ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ-এ উত্তরণের বার্তাগুলিকে আমরা খুঁজে নিয়েছি। রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করার এমন প্রয়োজনভিত্তিক চর্চা থেকেই কখনো ‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ কথাটি মন্ত্র হয়েছে, কখনো ‘যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে/ ভাঙো ভাঙো আজ ভাঙো তারে নিঃশেষে’ আমাদের অস্ত্র হয়েছে। কিংবা ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। কেউ বলবেন এই পাওয়াগুলিও পাওয়া এবং মহার্ঘ পাওয়া। সময়ের প্রয়োজনে যিনি পাশে এসে দাঁড়ান তিনিই তো পান্থজনের সখা। এ ভাবেই তো তাঁকে আমরা সহ-পথিক করে নিই। তবে আর অভিযোগ কীসের! প্রশ্ন জাগে মনে, তবে কী ‘দিনের প্রয়োজনের’ রসদের বাইরে আর যা কিছু রবীন্দ্রনাথের, সবই আমাদের জন্যে বিবেচনায় অপাংক্তেয় হয়ে থাকবে?


অন্যভাবে দেখলে, হয়ত দেখব, আমরা আসলে আমাদের নানা প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের প্রয়োজনের আসরে আমন্ত্রণ জানিয়েছি মাত্র, তাঁর কাছে আমরা এগিয়ে যাই নি। তিনি যেমন তাঁর ঈশ্বরকে বলেন, ‘আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায় তুমি ছিলে আমার কাছে/ আমি তোমার কাছে যাই নি’। হয়ত এটাই সত্যি, আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে যাই নি। তাঁকে আমরা ডেকে এনেছি আমাদের সমস্ত দৈনন্দিন বাঁচামরায়। এ ভাবে তাঁকে পেয়েই ভেবেছি আমাদের পাওয়া যথেষ্ট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জীবনকে বা দেবতার রূপকল্পে জীবনদেবতাকে এই দৈনন্দিন চাওয়া পাওয়ার গণ্ডীর ভেতরে সীমিত করে রাখতে চান নি। তাঁর জীবনদেবতাকে তিনি বলেছেন, ‘সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে/ এসেছি সকল চাওয়ার বাহির দেশে/ নেব আজ অসীমধারার তীরে এসে/ প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে’। আসলে আমাদের জীবনসাধনা, প্রকৃতিসাধনা, এমন কি রবীন্দ্রসাধনা-সবই প্রয়োজনের গণ্ডীতে বাঁধা। সে জন্যেই সেই তাৎক্ষণিক চাওয়ার দাবি পূরণ করতে গিয়ে আমরা হিরোসিমা তৈরি করি, উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় তৈরি করি, তৈরি করি উগ্র জাতিভাবনা বা সম্প্রদায়ভাবনাকেও। এমন কী ঈশ্বরবিশ্বাসীর ধর্মসাধনাও কখনো তাৎক্ষণিক জাগতিক চাওয়া পাওয়াকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। জীবনের প্রতি এমন একটি দৃষ্টিকোণ আমাদেরকে সমগ্রের সমীপবর্তী হতে দেয় না। আমাদের ভালো-মন্দ বিবেচনা আমাদের হিত-অহিত বোধ সবই স্থান এবং কালের নিরিখে ক্ষুদ্রতার ঘেরাটোপে বন্দী। সাধারণভাবে একটি মানুষের জীবন স্থান এবং কালের নিরিখে সংকীর্ণ পরিসীমাতেই বাঁধা থাকে। বাঁধা থাকে ব্যক্তির জন্ম এবং মৃত্যু দিয়ে ঘেরা পরিসরে। কিন্তু ব্যক্তিকে যখন মানবপ্রবাহ বা জীবনপ্রবাহের অঙ্গ হিসেবে দেখব, তখন সে অসীমের সন্তান। তখন এই গ্রহ-তারা-মহাকাশের, এই পৃথিবীর, এই সভ্যতার ভালো-মন্দ হিত-অহিত একজন ব্যক্তির বোধির অবিভাজ্য অংশ হয়ে ওঠে।


একজন প্রকৃত দার্শনিক, কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাধক, বিপ্লবী- এই বোধিতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। দূর এবং নিকট, ক্ষণকাল এবং চিরকালের মধ্যে সেতুরচনার আর্তিতেই বেজে ওঠে তাঁদের জীবনবীণা। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা কখনোই সমকাল কিংবা প্রতিবেশ সম্পর্কে উদাসীন থাকেন না। আবার দৈনন্দিনের নেশায়ও অন্ধ হন না। দৈনন্দিনের চাওয়া-পাওয়াকে বৃহত্তর অর্জনের বা মহত্তর প্রত্যাশার সাথে একাত্ম করে নেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধও তাই। সে জন্যেই তিনি যখন ‘ঘরে-বাইরে’ রচনা করেন, তখন তাঁর সামনে দেশের স্বাধীনতা-স্পৃহাটিই একমাত্র সত্য নয়, তার চেয়েও বড়ো কিছু সভ্যতার সত্যের দায় পূরণ করেই তিনি দেশের দায় মেটানোর কথা ভাবেন। যাদের চেতনার তার ‘কাছের সুরে বাঁধা’, তারা তাঁর ওই সৃষ্টির গভীরে যে ‘দূরের বাঁশি’ বাজে তা শুনতে পান না। এমনকি দেশপ্রেমও তাঁর কাছে নিছক স্বদেশবাজী নয়। প্রথমত, দেশ তাঁর কাছে কোনো রাষ্ট্র বা কাঠামোর চেহারায় আসে না, আসে দেশের অঙ্গাঙ্গী অংশ সাধারণ মানুষ ও প্রকৃতির সহজাত প্রকাশের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ কখনোই দেশপ্রেমকে বিদেশ-বিদ্বেষের চেহারায় হাজির করেন নি। তিনি দেশের মাটির ’পরে মাথা ঠেকাতে চান এ জন্যেই কারণ তাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা আছে। তাঁর সমসময়ের একজন কবি যখন স্বদেশকে সকল দেশের রাণী হিসেবে তুলে ধরে তার বন্দনা করতে চান, তখন রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ আটপৌরে ঘরের জননী। সে জন্যেই সমকালীন কবির সেই রাণীতত্ত্বকে প্রত্যাখান করে ঘরের মা’কে বরণ করতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, জানি নে তোর ধনরতন আছে কী না রাণীর মতন/শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে। ভিখারিণী মায়ের শতচ্ছিন্ন নোংরা আঁচলেও তার নিজের শিশু যে পরম আশ্রয় খুঁজে পায়, সেখানেই, সেই সাধারণ্যেই রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছেন দেশকে। তাঁর স্বদেশকে তাই রাণীর অবয়বে পাই না, পাই আমাদের প্রতিদিনের ঘরের মায়ের ¯স্নেহদৃষ্টিতে। উগ্র জাতীয়তাবাদী উল্লাস ব্যক্ত করার প্রহরে স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের এমন উচ্চারণ অ-প্রাসঙ্গিকই মনে হয়েছে আমাদের। আবার অন্যদিকে এটাও সত্য, দেশ থেকে ব্রিটিশ চলে গেলেও রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার গান বা স্বদেশভাবনা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না। আমাদের অন্যান্য স্বদেশচেতনার গানের বর্তমান পরিণতির নিরিখে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের গান ওই গানগুলির মত শুধুমাত্র পনেরো আগস্ট আর ছাব্বিশে জানুয়ারিতে বন্দী হয় নি।


রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরবিষয়ক গানগুলি যত শুনি, যত পড়ি, যত গাই, নতুন নতুন উপলব্ধি জন্মায়। মাঝে মাঝেই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরবিষয়ক গানের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এই গানগুলিকে কোনোভাবেই ধর্মচর্চার অঙ্গ বলেও মনে হয় না। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ধর্ম কথাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক বা সংগঠিত ধর্ম হিসেবে দেখেই বলছি। রবীন্দ্রনাথের গানগুলি একান্তভাবেই একটি ব্যক্তিগত সংলাপ, কোনো সঙ্ঘসঙ্গীত নয়। আমি জানি না, লোকায়ত ধর্মের গভীর থেকে যে গানগুলি সৃষ্ট হয়েছে, সেগুলিকে আপাতত আলোচনার বাইরে রেখে, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া নাগরিক বা আধা-নাগরিক আর কোনো ঈশ্বরবিষয়ক সঙ্গীত বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সকলের এত প্রাণের গান হয়ে ওঠে কি না। এটা কেন? রবীন্দ্রনাথের গানের এই প্রাণময়তা কি শুধুই এর কাব্যগুণের জন্যে বা সঙ্গীতগুণের জন্যে? নাকি অন্য কোনও সত্যও নিহিত আছে এতে? একটি অন্য কথা মাঝে মাঝেই মনে হয়। মানুষের সমাজে বা মনোজগতে ঈশ্বরের উদভাস এসেছে ধর্মের জন্মের অনেক আগেই। জগৎ-জীবন সম্পর্কিত তার বিস্ময়বোধ, তার অন্তহীন জিজ্ঞাসাকে ঘিরে জন্ম নেওয়া তার নিজের সাথে সংলাপকে যে প্রতিকল্পে সে ব্যক্ত করেছে, সেই তার ঈশ্বর। সেই ঈশ্বর তার দূরের স্বপ্ন, কাছের বন্ধু। ধর্ম এসে তার এই কাছের ঈশ্বরকে ছিনিয়ে নিয়ে স্থাপন করেছে দুর্লঙ্ঘ উচ্চতায়। তাকে ঘিরে তৈরি করেছে অসংখ্য আচার আর সংহিতা। তৈরি হয়েছে নিষেধের প্রাচীর। আমার কখনো মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গানের ঈশ্বর ধর্মকারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে যান তাঁর সেই আদিকল্পে, যার সাথে মানুষের হয়েছিল সভ্যতার প্রথম সংলাপ। সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরকে ঘিরে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলের এমন প্রাণবন্ত সংলাপ জমে ওঠে। আচারসর্বস্বতার বাইরে আমাদের লোকায়ত ধর্মের যে ঈশ্বর তার বাসও প্রায় সেখানেই। প্রায় বললাম এ জন্যেই লোকায়ত গানের যেখানে আচারধর্ম আর বিচারধর্মের সংঘর্ষের চিহ্ন রয়েছে, সেখানে আচারসর্বস্ব ধর্মের গভীরে অন্তর্ঘাত করতে গিয়ে বিচারধর্ম কখনো কখনো কতগুলি ছদ্মবেশ ধারণ করে, যাকে প্রকৃত চেহারায় না চিনলে ভ্রম হতে পারে। এই ভ্রম শুধু বাইরের শ্রোতার কাছে নয়, যাঁরা এই অন্দরের সাধক তাঁদেরও বিভ্রান্ত করে।


কবির কবিতায় যেমন শব্দ শব্দার্থের শেকল ছিঁড়ে ভাবার্থের দিকে পা বাড়িয়ে এক মায়ালোক তৈরি করে, রবীন্দ্রনাথের গান, নাটক, নিবন্ধেও তেমনি ঘটে। শব্দার্থে তার সবটা ধরা পড়ে না। শব্দার্থের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যদি আমরা তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকাই, তবে দেখব তাঁর গান নাটক চিঠিপত্র গদ্য ছবি সবকিছুর মধ্যে একটি অচ্ছেদ্য সূত্র রয়েছে। প্রেমের গান, পুজার গান, দেশের গান, প্রকৃতির গান এ ধরনের জলবিভাজন রেখা দিয়ে যেমন তাঁর গানকে বিভাজিত করা যায় না। সবগুলো একে অপরের সাথে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। তেমনি সব মিলিয়ে তাঁর সৃষ্টি যেন এক জীবন-বেদ। এর কেন্দ্রে তাঁর সামগ্রিক জীবনবোধ। এই জীবনবোধের প্রকাশকে খণ্ড খণ্ড করে তুলে এনে নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার করাটাই আমার বিবেচনায় আমাদের এতদিনকার সাধারণ রবীন্দ্রচর্চার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে। জগৎ-সংসারের যে কোনো বিষয় নিয়ে বক্তৃতা দিতে উঠে একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা প্রবন্ধের উদ্ধৃতি না থাকলে বাঙালি বুদ্ধিজীবী থেকে রাজনৈতিক নেতা নেত্রী কারোরই যেন ঠিক জাতে ওঠা হয় না। বিবাহ-বার্ষিকী থেকে ছেলের জন্মদিন, প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন- এখানেও চাই রবীন্দ্রনাথের এক আধটা পংক্তি। আর আমাদের শ্লাঘা ঝরে পড়ে এমনতর সংলাপে, জীবনের একটিও ক্ষেত্র নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছু বলে যান নি। আমাদের এমনতর রবীন্দ্রচর্চাতেই চারপাশ সদাসর্বদা সরগরম। এই খণ্ডিত চর্চা শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে আটকে নেই। মে দিবস থেকে শ্রীশ্রী ঠাকুরের জন্মদিন অবধি এমন কোনোদিন নেই যেদিন আমরা রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করি নি। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে মনে পড়ে তাঁর গানেরই লাইন, তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল/সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল।



এই হলাহল আর কোলাহল ছেড়ে কবে এক ভিন্নতর রবীন্দ্রচর্চায় আমরা রত হব তারই পথ চেয়ে আপাতত থাকতে হবে।