বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

দোহার- আমার স্বজন, সুজন

দোহারের কথা বললেই আমার চোখে ভেসে ওঠে এক স্বপ্নচারী মানুষের মুখ! প্রথম জীবনে সেই মানুষটি এতটাই সৌখিন ছিলেন যে তাঁর কেতাদুরস্ত জামা কাপড় তৈরি হয়ে আসত তখনকার বোম্বাই শহরের নামী দামি দোকান থেকে। পেশায় ফিল্ম ডিভিশনের ফোটোগ্রাফার এই মানুষটির লেন্সে চিত্রিত হতে বিশেষ পছন্দ করতেন নাকি স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীও। মানুষটির অন্য পরিচয় তিনি ছিলেন লোকগানের ভিতরমহলের স্বজন। তবলা ছাড়াও নানা ধরনের যন্ত্রবাদনে তার ছিল অপরিসীম সহজাত দক্ষতা। পঞ্চাশের স্বর্ণযুগে গুয়াহাটিতে গণনাট্যের সম্মেলনে মহারাষ্ট্রের লোকশিল্পী ওমর শেখের সাথে সঙ্গত করতে গিয়ে যখন দিকপাল তালবাদ্যের শিল্পীরা কুপোকাত, তখন ক্যাম্পের খড়ের ওমে ঘুমিয়ে থাকা বালক বয়সের সেই মানুষটিকে তুলে নিয়ে ঢোল হাতে ওমর শেখের সামনে বসিয়ে দিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। চোখ কচলে ঘুমের আচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া বালকটিকে দেখে বিদ্রুপ করেছিলেন ওমর শেখ। ‘হেমাঙ্গবাবু, এই বাচ্চা ক্যায়া বাজায়গা!‘ নিরুপায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস উত্তরে বলেছিলেন, ‘অউর কোয়ি নেহি বাচা। অগর সাকেগা তো ইয়ে বাচ্চাই সাকেগা!‘

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জহুরির চোখ সেদিনও সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। হাল ফ্যাশনের আদবকায়দায় আদ্যোপান্ত সাবলীল মানুষটির জীবনে হঠাৎই একদিন বিপ্লব নিয়ে এল এক রিক্সাওয়ালা, নাম তুরফান আলি। রিক্সা চালানো তার পেশা হলেও সে ছিল এক লোকশিল্পী। বিলাসের বাহারি পোশাক ছেড়ে দিলেন তিনি। সাদা কুর্তা আর পাজামা গায়ে রিক্সাওয়ালা তুরফানকে সঙ্গী করে বরাকের মোকামে মোকামে আখড়ায় আখড়ায় মাটির গানের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। হয়ে উঠলেন বরাকের লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারী। তিনি অনন্তকুমার ভট্টাচার্য। হাজার হাজার গান সংগ্রহ করেছেন। কত কত লোকশিল্পীকে তুলে ধরেছেন সাধারণ্যে। তাঁদের ব্যক্তিজীবনের সুখদুঃখের সাথে এক হয়ে গেছেন। গড়ে তুলেছিলেন এমন একটি লোকগানের দল লোকবিচিত্রা, যা আকাশবাণীর বিচারে ভারতের প্রথম এ-গ্রেড পাওয়া লোকগানের দল। মানুষটাকে স্বপ্নচারী বলেছি প্রথমে। কারণ সময়ের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে ছিলেন অনন্ত কুমার। তাঁর স্বপ্নকে বুঝতে পারত না তাঁর সমকালের বেশিরভাগ মানুষ। এখন দৈনন্দিন জীবনের নানা ধরনের বাহ্যিক শব্দকে সঙ্গীতে ব্যবহার করার কথা বলছেন অনেকে এবং কিছু কিছু প্রয়োগ তারও শুরু হয়েছে।

তখন নব্বুইয়ের গোড়াতেই আকাশবাণীর মনোরেকর্ডিং-এর সীমাবদ্ধতাকে তুচ্ছ করে হাঁড়ি বাসন থালা কাঠের টুকরো সহ সঙ্গীতে সাধারণভাবে অনাবশ্যক নানা উপকরণকে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে এক অতুলনীয় সঙ্গীতসজ্জা তৈরি করেছিলেন অনন্তকুমার। স্বপ্ন দেখতেন আমাদের আধুনিক সঙ্গীত দক্ষিণের ইলিয়া রাজার মত লোকঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে এগোবে। সময় থেকে এগিয়ে যাঁরা স্বপ্ন দেখেন তাঁদের অনেকেরই জীবন শেষ পর্যন্ত কাটে গভীর হতাশায় ও অপূর্ণতায় চরম দুঃখে। অনন্তকুমার স্বপ্নসম্ভাবনার অসংখ্য কুঁড়ি ফুটিয়েও অকালে চলে গিয়েছিলেন এই পৃথিবী থেকে। দোহার-এর প্রাণপুরুষ কালিকাপ্রসাদ অনন্তকুমারের ভাইপোই শুধু নয়, সে তাঁর সঙ্গীতাদর্শের উত্তরাধিকারীও। কাকার অপূর্ণ স্বপ্নকে বাস্তব করার ব্রত থেকেই তৈরি করেছিল দোহার। অনেক পথ পেরিয়ে দোহার আজ শুধু সাবালক নয়, বাংলা গানের অন্যতম প্রধান নাইয়া। যে স্বপ্ন দেখতেন অনন্তকুমার ভট্টাচার্য তারই সার্থক রূপায়ণ আজ দোহারের মধ্যে। লোকসঙ্গীতের যে কোনো ধরনের বিকৃতির বিরুদ্ধে আমৃত্যু সোচ্চার ছিলেন অনন্তকুমার। যদিও লোকসঙ্গীতের আঞ্চলিকতাকে অস্বীকার না করে সৃজনশীল প্রয়োগের বিরোধী ছিলেন না তিনি। তরুণ কন্ঠের আধুনিক প্রয়োগকে ভালোই বাসতেন। জানতেন, গ্রামীণ লোকশিল্পীর গায়ন আর নাগরিক লোকসঙ্গীতশিল্পীর কখনো গায়ন এক হবে না। কিন্তু বাণিজ্যিক বিকৃতির ঔদ্ধত্য ও মূর্খতা কখনোই মেনে নিতে পারেন নি। কোনো প্রতিযোগিতা মঞ্চে হয়ত কেউ ইচ্ছেমত বিকৃত করছে কোনো পরম্পরাগত গানকে, বিচারাসন থেকে ‘হোল্ড!‘ বলে বজ্র গর্জনে থামিয়ে দিয়েছেন শিল্পীকে। রাগে ঠকঠক করে কাঁপতেন তখন। গভীর যন্ত্রণাবোধ থেকে জন্ম নেওয়া এই আপোষহীন মনোভাবকে ক‘জনই বা বুঝত! এখন যখনই দেখি সমকালে ঘটে যাওয়া লোকসঙ্গীতের নানা বিকৃতির বিরুদ্ধে দোহারের অনুষ্ঠানে গানের মাঝে সোচ্চার হয়ে উঠছে কালিকা, কানে যেন শুনতে পাই অনন্তকুমার ভট্টাচার্যের ‘হোল্ড!‘।


দোহারের কথা বলতে গিয়ে অনন্তকুমার ভট্টাচার্যের কথা এতটা সবিস্তারে বলার কারণ শুধু কালিকা বা অনন্তকুমারের সাথে আমার ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ ভাবে সম্পর্কিত থাকা নয়। এটা বলা এই কথা বোঝাতেই যে, দোহার হঠাৎ একদিন আকাশ থেকে পড়ে নি। তারও একটা পূর্ব-ইতিহাস আছে, একটা ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছে দোহার। শুধু দোহারই নয়, ব্যক্তি হিসেবে কালিকাও। একটা পরিবার, একটা প্রতিষ্ঠান, অসংখ্য মানুষ, একাধিক সংগঠন আন্দোলন, একটা বিরামহীন স্বপ্ন, সাধনার বহমানতায় জন্ম নিয়েছে দোহার। এখানেই তাঁরা কলকাতা শহরে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বহু গানের দল থেকে আলাদা। আরেকটা কথা, শুধুমাত্র পূর্বসূরীর চর্চার যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি করে বা পূর্বসরীদের তৈরি করা ভাণ্ডারকেই সম্বলমাত্র করেও উত্তরাধিকার নির্মিত হয় না। উত্তরাধিকার নির্মিত হয় পূর্বসূরীদের চলা পথ বেয়ে নিজের সমসময়ে পথ হেঁটে। কালিকা শুধু তাঁর কাকার ভাণ্ডারকে ভেঙে গান গাইছে না। নিত্যনতুন লোকগানের খোঁজে নিজেও ঘুরে বেড়িয়েছে অসংখ্য গ্রাম শহর চাবাগিচা কয়লাখনিতে। শেকড় উৎখাত হয়ে পরবাসী হওয়া লোকসমাজের মানুষের লোকগানে কীভাবে ছায়া ফেলে নতুন সমাজকাঠামো এবং পরিবর্তিত জীবনপ্রবাহ, তারও সন্ধান করেছে সে একজন গবেষক হিসেবে। খালেদ চৌধুরী রণজিৎ সিংহ রণেন রায় চৌধুরী হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা আমৃত্যু প্রান্তবাসী মানুষের গান নিয়ে সাধনা করেছেন এক অর্থে প্রান্তবাসী হয়েই। এটা নিয়ে আমাদের এক সশ্রদ্ধ মুগ্ধতা আছে ঠিকই। কিন্তু এর মাধ্যমে প্রান্তবাসী মানুষের গান নিয়ে মূলধারার সঙ্গীতচর্চায় সে অর্থে কোনো অন্তর্ঘাত ঘটানো যায় না। দোহার এক্ষেত্রে অনন্য। প্রান্তবাসী মানুষের গানকে সঙ্গী করে, কোনো বৈদ্যুতিন যন্ত্রের অনাকাঙ্খিত অনুপ্রবেশ ছাড়াই মূলধারার সংস্কৃতির আসরে নিজেদের জোরালো উপস্থিতি ব্যক্ত করেছে তাঁরা। প্রত্যাহ্বান জানিয়েছে সমাজের ওপরতলার সংস্কৃতির উদ্ধত মিনারকে। আজ মহানগরীর সঙ্গীতের আসরে নাগরিক স্রষ্টাদের পাশে একই সম্মানে গীত হচ্ছে শাহ আবদুল করিম, রাধারমন, দ্বিজদাস, মলয়া, দীন ভবানন্দ থেকে শুরু করে মুকুন্দ তেলির গান। বাণিজ্যিক সঙ্গীতের পরিমণ্ডলে এইসব মহাজনদের গান এবং লোকায়ত বাদ্যযন্ত্রকে একমাত্র নির্ভর করে যে মর্যাদার আসনে নিজেদের অধিষ্ঠিত করেছে দোহার, তা নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়। সত্যি কথা বলতে কী বাংলা গানের সর্বাত্মক আকালের সময়েও আমরা যে এখনও স্বপ্ন দেখার সাহস পাই, তার অনেকটাই দোহারের জন্যে। সে জন্যেই দোহার আমার কাছে ভালোবাসার, শ্রদ্ধার এবং ভরসার একটি নাম।

পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া

বছরে একবার আমাদের মত অকিঞ্চিৎকর মানুষেরও একটা জন্মদিন আসে। জন্ম যেহেতু হয়েছে বছরে একবার জন্মদিন তো আসবেই। তেমনি এক জন্মদিনে বাংলাদেশের এক তরুণ শুভেচ্ছা পাঠালো ছোট্ট একটি লেখায়। বলল, জন্মদিনে শুভেচ্ছার পাশাপাশি দাবি এবার আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্যানপ্যানানি ছাড়ুন। এখন থেকে বলিষ্ঠ কন্ঠে গণসঙ্গীতই শুনতে চাই আপনার গলায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেক হয়েছে। এমন দাবি প্রথম নয়। ছাত্রজীবন থেকেই শুনছি। আমার জীবনে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃত্ততা এবং আকাশবাণীতে বড়োদের গ্রুপে গান গাওয়া একই সময় থেকে। যখন প্রথমদিন রেডিও থেকে আমার গান সম্প্রচারিত হওয়ার পর যখন পার্টি অফিসে এলাম, তখন আমার সাফল্যে সমবেত অহংকার প্রকাশের পাশাপাশি সমবয়সের কমরেড সহ অগ্রজরা বললেন, ভালো খুব ভালো, কিন্তু তোমার প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজেকে একজন গণসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলা। রবীন্দ্রসঙ্গীত টঙ্গীত এগুলো ঠিকই আছে, কিন্তু গান নিয়ে যদি বিপ্লবী রাজনীতির কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়, তবে গণসঙ্গীতই গাইতে হবে। তখন আমাদের অঞ্চলে গণসংস্কৃতি আন্দোলনের ভাঁটা চলছে। অতীতের গণসঙ্গীত গায়করা সমাজপটে দৃশ্যমান নন। কর্তব্যবোধের তাগিদেই গণসঙ্গীত শেখার জন্যে ভেতরে একটা অস্থিরতা। প্রথম শিক্ষক হল এক বন্ধু, যে শুনে শুনে কয়েকটি গণসঙ্গীত তুলেছে। মুশকিল হচ্ছে, তার গলায় সুর নেই। অগত্যা একটাই পথ বের করতে হল। ওকে দিয়ে পরিচিত কিছু গান গুণগুণ করিয়ে ঠাওর করার চেষ্টা করলাম, কোন সুরটা বিকৃত হয়ে ওর গলায় কী চেহারা নেয়। এভাবেই প্রকৃত সুরের একটা কাঠামো আন্দাজ করে ওর কাছ থেকেই আমার প্রথম দু’টি গণসঙ্গীত শেখা। হেই সামালো ও ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার তুফান। পরে মূল গান শুনে দেখেছি কয়েকটি কোমল শুদ্ধ সুরের এদিক ওদিক ছাড়া বাকিটা ঠিকই আছে। সেই থেকে সভাসমিতিতে মূলত গণসঙ্গীত গাই আর রেডিও টেলিভিশন অনুষ্ঠান জলসায় প্রধানত গাই রবীন্দ্রসঙ্গীত। অনেকটা দিন অবধি দুটো যেন সমান্তরাল ধারা এই মনে করেই চলছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতেও ভাগ করে নিয়েছি দু’টি ধারার গান। সভাসমিতিতে যখন গাইছি ‘আগুণ জ্বালো‘ তখন রেডিওতে গাইছি ‘যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো প্রভু’। দু‘টি ধারার মধ্যে যেন কোনো যোগাযোগ নেই। আমি যেন এক পিরাদেল্লো কথিত স্প্লিট পারসোনালিটির মানুষ। ড০ জ্যাকেল এন্ড মিঃ হাইড।

একটা বয়সের পর মনে ধন্ধ লাগতে থাকল। কিছু গান প্রশ্ন তুলতে থাকল মনে। যেমন, ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন সেইখানেতে চরন তোমার রাজে‘। কিংবা ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো‘। এই গানগুলি কি ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন? নাকি যে মানুষগুলি সবার নীচে সবার পিছে সবার অধম সেই সবহারাদের ঈশ্বরত্বের উচ্চতায় উন্নীত করার আকাক্সক্ষা? তবে কী কোথাও যোগ সাধিত হয় আমার কাছে এতদিন পরস্পর সম্পর্কহীন সমান্তরাল গানগুলির মধ্যে? এই ভাবতে ভাবতেই চলে যায় দিন মাস বছর। কখনো প্রশ্ন করি নিজেকে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর কি আচারশাসিত ধর্মের ইশ্বরই? নাকি অন্য আরো কিছু। এবং সেটা এমন কিছু যার সাথে কোথাও একটা সংলাপ রচনার অবকাশ রয়েছে প্রগতিভাবনার?

এমন ভাবতে ভাবতেই দিন পাল্টে গেল পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্যজুড়ে শুরু হল প্রেতনৃত্য। বন্ধুরা বললেন, এবার কন্ঠ ছেড়ে গণসঙ্গীত গাইতে হবে বুঝলি? মানুষ বিভ্রান্ত, মানুষ আতঙ্কে। আতঙ্ক বন্ধুসুজনদের মধ্যে। এই ভয়ভাঙানোর কাজ শুরু করতে হবে। আবার পুরনো খাতা ঝেড়ে গানগুলিকে উদ্ধার কর। হলও, ফিরে এলো প্রচুর হারিয়ে যাওয়া গণসঙ্গীত। ভুলেই গিয়েছিলাম পল রোবসন গানটি। সভাসমিতিতে আবার গাইতে শুরু করলাম। কমরেডরা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
ফিরে এল অনেক অনেক রবীন্দ্রনাথের গান। এমন গান যাকে কখনো ভাবি নি সংগ্রামের সঙ্গী হিসেবে। কামদুনি থেকে পার্কস্ট্রিট- রাজ্যের দিকে দিকে নারীর ওপর সীমাহীন অত্যাচার যেন বিধিসম্মত হয়ে গেল। ক্ষমতার উচ্চ মিনার থেকে ভেসে আসা অমানবিক হৃদয়হীন কথাগুলি বুকের ভেতর অস্থিরতার ঢেউ তোলে। জাতীয় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের উদাসীন অমানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে রচিত হওয়া ‘কেন চেয়ে আছো গো মা মুখপানে‘ ঋত্বিক দেবব্রত বিশ্বাসের হাত ধরে বিভক্ত বাংলার আর্তনাদকে মূর্ত করেছিল একদিন। এবার সেটিই হয়ে উঠল কামদুনি-পার্কস্ট্রিট-উত্তর পশ্চিমবাংলায় আমাদের ক্রোধের সাঙ্গীতিক উচ্চারণ।

এমন করে আরো অনেক অনেক গান পেল নতুন চেহারা। নতুন মাত্রা। ২০১১ সালের ১৩ মে অবধি জনৈক সহকর্মী নিজেকে প্রায় আমার নেতার পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। অনেকে তাকে অনভিপ্রেত গুরুত্বও দিচ্ছিলেন। বামপন্থার এতদিনের সাহচর্য তার অন্তস্থ সুবিধাবাদকে অনুমাত্রও দুর্বল করতে পারে নি। চাপা দেওয়া ছিল মাত্র। ১৩ মে পেরোতেই তিনি স্বমূর্তি ধারণ করলেন এবং আমাদের কর্মক্ষেত্রে বামপন্থী হেনস্থা ও দুর্বল করার প্রতিটি প্রয়াসের নিষ্ঠাবান সহযোগী হলেন। প্রাক্তন বন্ধুরা অনেকেই মুষড়ে পড়েন তার এই ভোলবদলে। এমন ঘটনা নানা জায়গায় ঘটতে থাকেই। বিমর্ষ বন্ধুদের এমন এক সমাগমে উজ্জীবনের গান গাইতে গিয়ে বিনা প্রস্তুতিতেই হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল চালাতেই উঠে এল ‘তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে‘ তা বলে ভাবনা করা চলবে না’। গান যত এগোয় তত নিজেই অবাক হই। অন্যকে উজ্জীবিত করব কি, এতদিনের পরিচিত গানটি যেন আমার কাছেই নতুন হয়ে আসছে, আমাকে প্রাণিত করছে আরো আরো বেশি করে। সুবিধাবাদের মনপবনে যারা সঙ্গত্যাগ করেছে তাদের একেক জনের মুখ মিছিলের মত চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

এভাবেই এক একটি গান নতুন রূপ পেয়ে আঘাতে শোকে উজ্জীবনে প্রতিবাদে ভাষা দিয়েছে আমাকে। শাহবাগের আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে আকাদেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে ছাত্রযুবদের সমাবেশে পরিচয় হয়েছিল একটি ঝকঝকে তরুণের সাথে। সপ্রতিভ সেই তরুণটি এমন যার চোখ কথা বলে, হাসি কথা বলে, তার চলা ফেরা যেন বাক্সময় করে তোলে প্রতিবেশকে। গানের আগে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে ফোন নম্বর চেয়ে নিল। হেসেই দিলাম। হঠাৎই একদিন টিভির পর্দায় ভেসে উঠল সেই মর্মান্তিক সংবাদ। আইন অমান্য আন্দোলনের পর পুলিসের কাস্টোডিতে থাকার সময় পুলিসেরই লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়ল তার অমূল্য প্রাণ। সে মৃত্যুহীনের নাম সুদীপ্ত গুপ্ত। দিন রাত শোকে গুমড়ে গুমড়ে ভেতরে বাজতে থাকল, ‘তরুণ হাসির আড়ালে কোন আগুণ ঢাকা রয়/ একী গো বিস্ময়, অস্ত্র তোমার গোপন রাখো কোন তূণে? এতদিন যে বসে ছিলেন পথ চেয়ে আর কালগুণে, দেখা পেলেম ফাল্গুণে‘।


ভেবেছি এবারের আমার জন্মদিনে সেই তরুণটিকে একটি চিঠি পাঠাবো। বলব, ‘হ্যাঁ, তোর কথা মতই গলায় তুলে নিয়েছি গণসঙ্গীত। তবে রবীন্দ্রনাথ যে এত গণসঙ্গীত লিখেছেন জানা ছিল না। আমাদের বাইরের ভেতরের সমবেত একক- নানা ধরণের সংগ্রামের সঙ্গীত জানিস তো রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন। আমাদের দোষ আমরা কখনো সেভাবে শুনি নি। পড়িনি। চল আবার শুনি, পড়ি সেই গান‘।