বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া

বছরে একবার আমাদের মত অকিঞ্চিৎকর মানুষেরও একটা জন্মদিন আসে। জন্ম যেহেতু হয়েছে বছরে একবার জন্মদিন তো আসবেই। তেমনি এক জন্মদিনে বাংলাদেশের এক তরুণ শুভেচ্ছা পাঠালো ছোট্ট একটি লেখায়। বলল, জন্মদিনে শুভেচ্ছার পাশাপাশি দাবি এবার আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্যানপ্যানানি ছাড়ুন। এখন থেকে বলিষ্ঠ কন্ঠে গণসঙ্গীতই শুনতে চাই আপনার গলায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেক হয়েছে। এমন দাবি প্রথম নয়। ছাত্রজীবন থেকেই শুনছি। আমার জীবনে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃত্ততা এবং আকাশবাণীতে বড়োদের গ্রুপে গান গাওয়া একই সময় থেকে। যখন প্রথমদিন রেডিও থেকে আমার গান সম্প্রচারিত হওয়ার পর যখন পার্টি অফিসে এলাম, তখন আমার সাফল্যে সমবেত অহংকার প্রকাশের পাশাপাশি সমবয়সের কমরেড সহ অগ্রজরা বললেন, ভালো খুব ভালো, কিন্তু তোমার প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজেকে একজন গণসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলা। রবীন্দ্রসঙ্গীত টঙ্গীত এগুলো ঠিকই আছে, কিন্তু গান নিয়ে যদি বিপ্লবী রাজনীতির কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়, তবে গণসঙ্গীতই গাইতে হবে। তখন আমাদের অঞ্চলে গণসংস্কৃতি আন্দোলনের ভাঁটা চলছে। অতীতের গণসঙ্গীত গায়করা সমাজপটে দৃশ্যমান নন। কর্তব্যবোধের তাগিদেই গণসঙ্গীত শেখার জন্যে ভেতরে একটা অস্থিরতা। প্রথম শিক্ষক হল এক বন্ধু, যে শুনে শুনে কয়েকটি গণসঙ্গীত তুলেছে। মুশকিল হচ্ছে, তার গলায় সুর নেই। অগত্যা একটাই পথ বের করতে হল। ওকে দিয়ে পরিচিত কিছু গান গুণগুণ করিয়ে ঠাওর করার চেষ্টা করলাম, কোন সুরটা বিকৃত হয়ে ওর গলায় কী চেহারা নেয়। এভাবেই প্রকৃত সুরের একটা কাঠামো আন্দাজ করে ওর কাছ থেকেই আমার প্রথম দু’টি গণসঙ্গীত শেখা। হেই সামালো ও ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার তুফান। পরে মূল গান শুনে দেখেছি কয়েকটি কোমল শুদ্ধ সুরের এদিক ওদিক ছাড়া বাকিটা ঠিকই আছে। সেই থেকে সভাসমিতিতে মূলত গণসঙ্গীত গাই আর রেডিও টেলিভিশন অনুষ্ঠান জলসায় প্রধানত গাই রবীন্দ্রসঙ্গীত। অনেকটা দিন অবধি দুটো যেন সমান্তরাল ধারা এই মনে করেই চলছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতেও ভাগ করে নিয়েছি দু’টি ধারার গান। সভাসমিতিতে যখন গাইছি ‘আগুণ জ্বালো‘ তখন রেডিওতে গাইছি ‘যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো প্রভু’। দু‘টি ধারার মধ্যে যেন কোনো যোগাযোগ নেই। আমি যেন এক পিরাদেল্লো কথিত স্প্লিট পারসোনালিটির মানুষ। ড০ জ্যাকেল এন্ড মিঃ হাইড।

একটা বয়সের পর মনে ধন্ধ লাগতে থাকল। কিছু গান প্রশ্ন তুলতে থাকল মনে। যেমন, ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন সেইখানেতে চরন তোমার রাজে‘। কিংবা ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো‘। এই গানগুলি কি ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন? নাকি যে মানুষগুলি সবার নীচে সবার পিছে সবার অধম সেই সবহারাদের ঈশ্বরত্বের উচ্চতায় উন্নীত করার আকাক্সক্ষা? তবে কী কোথাও যোগ সাধিত হয় আমার কাছে এতদিন পরস্পর সম্পর্কহীন সমান্তরাল গানগুলির মধ্যে? এই ভাবতে ভাবতেই চলে যায় দিন মাস বছর। কখনো প্রশ্ন করি নিজেকে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর কি আচারশাসিত ধর্মের ইশ্বরই? নাকি অন্য আরো কিছু। এবং সেটা এমন কিছু যার সাথে কোথাও একটা সংলাপ রচনার অবকাশ রয়েছে প্রগতিভাবনার?

এমন ভাবতে ভাবতেই দিন পাল্টে গেল পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্যজুড়ে শুরু হল প্রেতনৃত্য। বন্ধুরা বললেন, এবার কন্ঠ ছেড়ে গণসঙ্গীত গাইতে হবে বুঝলি? মানুষ বিভ্রান্ত, মানুষ আতঙ্কে। আতঙ্ক বন্ধুসুজনদের মধ্যে। এই ভয়ভাঙানোর কাজ শুরু করতে হবে। আবার পুরনো খাতা ঝেড়ে গানগুলিকে উদ্ধার কর। হলও, ফিরে এলো প্রচুর হারিয়ে যাওয়া গণসঙ্গীত। ভুলেই গিয়েছিলাম পল রোবসন গানটি। সভাসমিতিতে আবার গাইতে শুরু করলাম। কমরেডরা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
ফিরে এল অনেক অনেক রবীন্দ্রনাথের গান। এমন গান যাকে কখনো ভাবি নি সংগ্রামের সঙ্গী হিসেবে। কামদুনি থেকে পার্কস্ট্রিট- রাজ্যের দিকে দিকে নারীর ওপর সীমাহীন অত্যাচার যেন বিধিসম্মত হয়ে গেল। ক্ষমতার উচ্চ মিনার থেকে ভেসে আসা অমানবিক হৃদয়হীন কথাগুলি বুকের ভেতর অস্থিরতার ঢেউ তোলে। জাতীয় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের উদাসীন অমানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে রচিত হওয়া ‘কেন চেয়ে আছো গো মা মুখপানে‘ ঋত্বিক দেবব্রত বিশ্বাসের হাত ধরে বিভক্ত বাংলার আর্তনাদকে মূর্ত করেছিল একদিন। এবার সেটিই হয়ে উঠল কামদুনি-পার্কস্ট্রিট-উত্তর পশ্চিমবাংলায় আমাদের ক্রোধের সাঙ্গীতিক উচ্চারণ।

এমন করে আরো অনেক অনেক গান পেল নতুন চেহারা। নতুন মাত্রা। ২০১১ সালের ১৩ মে অবধি জনৈক সহকর্মী নিজেকে প্রায় আমার নেতার পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। অনেকে তাকে অনভিপ্রেত গুরুত্বও দিচ্ছিলেন। বামপন্থার এতদিনের সাহচর্য তার অন্তস্থ সুবিধাবাদকে অনুমাত্রও দুর্বল করতে পারে নি। চাপা দেওয়া ছিল মাত্র। ১৩ মে পেরোতেই তিনি স্বমূর্তি ধারণ করলেন এবং আমাদের কর্মক্ষেত্রে বামপন্থী হেনস্থা ও দুর্বল করার প্রতিটি প্রয়াসের নিষ্ঠাবান সহযোগী হলেন। প্রাক্তন বন্ধুরা অনেকেই মুষড়ে পড়েন তার এই ভোলবদলে। এমন ঘটনা নানা জায়গায় ঘটতে থাকেই। বিমর্ষ বন্ধুদের এমন এক সমাগমে উজ্জীবনের গান গাইতে গিয়ে বিনা প্রস্তুতিতেই হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল চালাতেই উঠে এল ‘তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে‘ তা বলে ভাবনা করা চলবে না’। গান যত এগোয় তত নিজেই অবাক হই। অন্যকে উজ্জীবিত করব কি, এতদিনের পরিচিত গানটি যেন আমার কাছেই নতুন হয়ে আসছে, আমাকে প্রাণিত করছে আরো আরো বেশি করে। সুবিধাবাদের মনপবনে যারা সঙ্গত্যাগ করেছে তাদের একেক জনের মুখ মিছিলের মত চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

এভাবেই এক একটি গান নতুন রূপ পেয়ে আঘাতে শোকে উজ্জীবনে প্রতিবাদে ভাষা দিয়েছে আমাকে। শাহবাগের আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে আকাদেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে ছাত্রযুবদের সমাবেশে পরিচয় হয়েছিল একটি ঝকঝকে তরুণের সাথে। সপ্রতিভ সেই তরুণটি এমন যার চোখ কথা বলে, হাসি কথা বলে, তার চলা ফেরা যেন বাক্সময় করে তোলে প্রতিবেশকে। গানের আগে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে ফোন নম্বর চেয়ে নিল। হেসেই দিলাম। হঠাৎই একদিন টিভির পর্দায় ভেসে উঠল সেই মর্মান্তিক সংবাদ। আইন অমান্য আন্দোলনের পর পুলিসের কাস্টোডিতে থাকার সময় পুলিসেরই লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়ল তার অমূল্য প্রাণ। সে মৃত্যুহীনের নাম সুদীপ্ত গুপ্ত। দিন রাত শোকে গুমড়ে গুমড়ে ভেতরে বাজতে থাকল, ‘তরুণ হাসির আড়ালে কোন আগুণ ঢাকা রয়/ একী গো বিস্ময়, অস্ত্র তোমার গোপন রাখো কোন তূণে? এতদিন যে বসে ছিলেন পথ চেয়ে আর কালগুণে, দেখা পেলেম ফাল্গুণে‘।


ভেবেছি এবারের আমার জন্মদিনে সেই তরুণটিকে একটি চিঠি পাঠাবো। বলব, ‘হ্যাঁ, তোর কথা মতই গলায় তুলে নিয়েছি গণসঙ্গীত। তবে রবীন্দ্রনাথ যে এত গণসঙ্গীত লিখেছেন জানা ছিল না। আমাদের বাইরের ভেতরের সমবেত একক- নানা ধরণের সংগ্রামের সঙ্গীত জানিস তো রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন। আমাদের দোষ আমরা কখনো সেভাবে শুনি নি। পড়িনি। চল আবার শুনি, পড়ি সেই গান‘।

1 টি মন্তব্য: