সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬

আছে তাঁবু অন্তরে বাহিরে

এই দিনটা এলে কী করব ভেবে পাই না। আনন্দ? নাকি বিষাদ? জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই ধন্দেই চলেছে জীবন! এই দিনে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর রক্তদানের মধ্য দিয়ে লালকেল্লা থেকে ইউনিয়ন জ্যাক নেমে তেরঙ্গা উঠেছিল, এটা তো কম আনন্দের নয়। সেই তেরঙ্গা আজকের কলঙ্কিত তেরঙ্গা নয়।কিন্তু আমি তো শুধু ভারতীয় নই, আমি বাঙালিও। আসামের তৎকালীন রাজধানী শিলং শহরে জন্মানো বাঙালি, যার মা বাবা সাতচল্লিশের এই দিনে নিজের ভিটেমাটি হারিয়েছে। মা বাবার প্রজন্মের ভিটেমাটি হারানোর যন্ত্রণা তো আমাকেও ছুঁয়ে আছে আজন্ম। তবে এই দিনটিকে কী করে আনন্দের দিন বলি!

মনে আছে প্রতি বছর এই দিনটা এলে বাবা একটি গল্প বলত। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। বাবা তখন আসামের জোরহাট শহরে। বাবা আর বাবার প্রাণের বন্ধু বীরেন সন্ধেবেলা পায়চারি করছিলেন জোরহাট শহরের রাস্তায়। বীরেনকাকাও ছিলেন সিলেটের লোক। একটু বড়ো হয়ে জেনেছি বীরেনকাকা আমার নিজের কাকা নন এবং তিনি বাঙালিও নন। মনিপুরি। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি। তবে সিলেটেরই। বাবা আর বীরেনকাকা যখন সন্ধেবেলা পায়চারি করছে জোরহাট শহরের রাস্তায়, তখন চারধারে বাজি পুড়ছে, আলোর রোশনাই। দেশ স্বাধীন হয়েছে। মানুষ সেই স্বপ্নের স্বাধীনতা অর্জন উদযাপন করছে মহানন্দে।বাবা বীরেনকাকাকে বলল, ভাবতে পারিস বীরেন, দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো! ব্রিটিশ সত্যি সত্যি এ দেশ ছেড়ে চলে গেল! এখন আমরা স্বাধীন! আমরা কি কখনো ভেবেছিলাম, ব্রিটিশ সত্যি সত্যি এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে? এই কথার উত্তরে বীরেনকাকা বলেছিল, দেশ স্বাধীন হল ঠিকই, কিন্তু আমাদের সিলেটটা বিদেশ হয়ে গেল! একথা শোনার পর বাবাও স্তব্ধ হয়ে যায়। দুজনে নীরবে আরো কিছুক্ষণ পাশাপাশি অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে থাকে। একটা লাইটপোস্টের কাছাকাছি আসতেই আবিষ্কার করে, দুজনেরই চোখ দিয়ে অঝোরে নেমে আসছে অশ্রু। প্রতি বছর পনেরো আগস্ট এলে আমার বাবা এই গল্পটা দিনের কোনো না কোনো সময় একবার অন্তত বলে উঠতোই। বাবার এই ঘোরলাগা স্মৃতিকাতরতা আমাকে ছুঁয়ে আছে আজও। ‘আমার মন কান্দেরে পদ্মার চরের লাইগ্যা‘ গানটা গাইতে গেলেই বাবার ওই গল্প মনে পড়ে। প্রিলিউডের মত প্রতিটি আসরে ওই গানটি গাইতে গেলে আমি অবধারিতভাবেই বাবার গল্পটি বলি। আমার বাবাদের প্রজন্মের অনেকেরই ধারণা ছিল দেশভাগের ঘটনাটি একটি ক্ষণস্থায়ী ভ্রান্তিমাত্র। একটা অতিক্রান্তিকালীন পর্বে এক ধরনের বিকৃত উন্মাদনার শিকার হয়েছে মানুষ। এ কখনো স্থায়ী হতে পারে না। কিছুদিন পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে দেশ আবার এক হয়ে যাবে। আমার মণিকাকাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা সাতচল্লিশে আসার সময় বাড়িটা বিক্রি না করে ওই হরিবাবুর জিম্মায় রেখে চলে এলে কেন? মণিকাকা বলল, আমরা ভেবেছিলাম দেশভাগটা একটা সাময়িক গণ্ডগোল। কিছুদিন গেলে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। দেশটাও আবার এক হয়ে যাবে, আমরাও ফিরে যাবো সিলেটে। বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল মণিকাকা। নেতাজী থাকলে দেশটা ভাগ হত না।  আমি এটাও লক্ষ্য করেছি, আমাদের এপারের ভিটেহারা মানুষের একটা বড়ো অংশ সারাজীবন বিশ্বাস করেছেন, নেতাজী থাকলে দেশটা ভাগ হত না। অনেকেই প্রতীক্ষায় থাকতেন, নেতাজী আত্মপ্রকাশ করবেন। একবার নেতাজী আত্মপ্রকাশ করলেই ভারত-পাকিস্তান এক হয়ে যাবে। 

আমি যখন বড়ো হয়ে ভোটাধিকার পাবার বয়সে পৌঁছে গিয়েছি, তখনও আমার ভোটাধিকার প্রাপ্তি হয় নি। কারণ আসামে তখন নতুন ভোটার তালিকা তৈরি বন্ধ। দেশভাগের বলি হয়ে ওপার থেকে এপারে মানুষ এসে নাকি আমাদের রাজ্যের অস্তিত্ত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। সেজন্যেই এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু হল আমাদের রাজ্যে। ‘দেশ থেকে বিদেশীদের বিতাড়ণ করতে হবে। ভোটার তালিকায় লক্ষ লক্ষ বিদেশীদের নাম। এগুলো বাদ না দেওয়া অবধি নতুন ভোটার তালিকা তৈরি বন্ধ রাখতে হবে।‘ বছরের পর বছর চলল অবরোধ, বন্ধ্, স্কুল কলেজ বন্ধ। আমাদের পরীক্ষা শিকেয় উঠলো। দিকে দিকে বাঙালিদের হত্যা হচ্ছে। আমার দাদার বন্ধু, আমাদের নিজের দাদারই সমতুল ডাক্তার অঞ্জন চক্রবর্তী গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে খুন হয়ে গেল। কী আশ্চর্য, আমার দাদা যখন এই খবরটি আমাকে দেয় তখন আমি আমাদের সংগঠন ‘দিশারী‘র মহড়ায় অসমীয়া গানই গাইছিলাম। জ্যোতিপ্রসাদের গান। দাদা ডাকল, তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। অঞ্জনকে গুয়াহাটিতে খুন করেছে। মনে একবারও দ্বিধা এল না, যে আন্দোলনকারী ঘাতকদের হাতে অঞ্জনদা খুন হল ওরা অসমীয়াই। ওরা জ্যোতিপ্রসাদের গান গেয়েই মিছিল করে। তাঁর গানের পংক্তি দিয়ে দেওয়াল লেখে। এটা একটা অদ্ভুত পরিহাসই।

যখন আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা গান নিষেধ, প্রকাশ্যে বাংলায় কথা বললে হেনস্থা হওয়ার সম্ভাবনা, যখন আনন্দবাজার পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে গোটা উপত্যকায়, যখন খুন হয়ে গেলেন অঞ্জন চক্রবর্তী, রবি মিত্ররা, তখন আমরা শিলচরে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে শুরুতে গাইতাম জ্যোতিপ্রসাদের ‘মোরে ভারতরে মোরে সপোনরে চিরসুন্দর সংস্কৃতি‘। আরও কত কত গান। প্রকৃতপক্ষে ওই সময়পর্বেই সবচেয়ে বেশি অসমীয়া গান গেয়েছি। একবারও মনে হয় নি কেন গাইব এই গান। আমাদের অনুষ্ঠানগুলিতে ভরা অডিটোরিয়ামে কোনো কোণ থেকে একজন মানুষও কখনো আপত্তিকর মন্তব্য করে নি একটিও। আসামের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী সমাজচিন্তক সুজিৎ চৌধুরী বলেছিলেন, উত্তর পূর্ব  ভারতে যারা ১৫ আগস্ট বা ২৬ জানুয়ারি এলে কালো পতাকা তোলে, যারা নিজেদের ভারতীয় বলতে অস্বীকার করে, যারা ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় হাতে, রাষ্ট্রের চোখে তাঁদের ভারতীয়ত্ব প্রশ্নাতীত। আর, আমরা যারা ১৫ আগস্ট নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়েছি। যারা এপারে এসেও প্রতি পদে পদে সয়ে চলেছি বৈষম্য, অপমান এবং তারপরও ১৫ আগস্ট ২৬ জানুয়ারি এলে যারা নিষ্ঠাভরে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে ‘বল বল সবে শতবীণাবেণুরবে‘ ‘জনগণমনঅধিনায়ক‘ গাই, তাদের নাগরিকত্ব প্রতি মুহূর্তে প্রশ্নের মুখে। তাঁদের তাড়ানোর জন্যেই বারবার দাঙ্গা হয়। কখনো বঙ্গাল খেদা নাম নিয়ে, কখনো বিদেশী বিতাড়ণ নাম নিয়ে, আবার কখনো বাংলাদেশী বিতাড়ণ নাম নিয়ে। তাদের তাড়াতেই সারাদেশে একমাত্র আসামে চলছে নাগরিকপঞ্জীর নবায়ন। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ নাগরিকত্ব হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে।

যে দেশ ছিল পূর্বপুরুষের তা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে বিদেশি হয়েছে। যে রাজ্যে জন্মেছি সেখানে আমার কোনো অধিকার নেই। যে রাজ্যে বড়ো হয়েছি সেখানে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে গিয়েও পদে পদে বাধা। আমি তখন রাজনৈতিক কর্মী। ভোটে প্রচার করি, বুথে এজেন্ট থাকি, কিন্তু আমার ভোটাধিকার নেই। তখন ভোটাধিকারের বয়স ছিল ২১। আমার বয়স যখন ২৮, তখনই সুযোগ এলো ভোটার তালিকায় নাম তোলার। কারণ এর আগে সমস্ত নির্বাচন হয়েছে ১৯৭৯ সালে তালিকা অনুযায়ী।  যেহেতু আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন বিদেশী বিতাড়ণ না করে নতুন তালিকা তৈরি হবে না। শুধু আমার জন্মের সনদ দিয়েই আমার নাগরিকত্ব চূড়ান্ত হবে না। হাতের কাছে প্রমাণ রাখতে হবে ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় আমার পিতামাতার অন্তর্ভুক্তির। আমার বাবার ১৯৬২ সালের ভারতীয় পাসপোর্টও তখন প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হল না। নাছোড়বান্তা নির্বাচনী আধিকারিক বললেন, আমার কাছে নির্দেশ ৬৬ সালের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকার প্রমাণ ছাড়া নাম তালিকাভুক্ত করা যাবে না। ৬৬ সালে আমরা থাকতাম আসামের পশ্চিমপ্রান্তের শহর ধুবড়ীতে। তার মানে আমাকে ধুবড়ীতে গিয়ে দিনের পর দিন নির্বাচনী দপ্তরে ঘুরে ভোটার তালিকার প্রত্যায়িত প্রতিলিপি সংগ্রহ করতে হবে। নচেৎ ভোটার তালিকায় নাম উঠবে না। আসামে ভোটার তালিকায় নাম না থাকা মানে বিদেশী ঘোষিত হওয়ারই নামান্তর। ভাগ্যিস, ঘরে খুঁজে পেয়েছিলাম ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে বাবার সরকারি দায়িত্বের একটি নথি। সেটা দিয়েই পার পেলাম। প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না আধিকারিক। আমি যখন তাঁকে বললাম, কোনো বিদেশী নাগরিক ১৯৬৭ সালের ভোটে জোনাল অফিসারের দায়িত্বে থাকা সম্ভব কি না, তখনই রাজি হলেন।

১৯৭২ সালে আমরা সপরিবারে একবেলার জন্যে সিলেট গিয়েছিলাম। বাবার ছিল সরকারি কাজ। আমরা তাঁর সঙ্গ নিয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে সেদিনই বাংলাদেশে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দুপুরবেলা আমরা যখন সিলেট শহরের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন রেডিওতে ভেসে আসছিল ঢাকার রমনা ময়দানের ইন্দিরা গান্ধীর জনসভার ধারাবিবরণী। মা আর বাবার সাথে সারাদিন তাঁদের বাড়ি, স্কুল, কলেজ, এক কথায় তাঁদের অতীতে ভ্রমণ সেরে রাতে যখন আমরা সীমান্ত অতিক্রম করছি, তখন দাদা বলল, আমরা বিদেশ থেকে এখন স্বদেশে ঢুকছি। মা অস্ফুট স্বরে বলল, স্বদেশ বিদেশ আমার গুলিয়ে গেছে। কোথায় গিয়েছিলাম, আর কোথায় ফিরলাম, আমি জানি না। মা‘র অস্ফুটস্বরে বলা সেই কথাটা সেই কিশোরবেলা থেকে এখনও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।

পরে ১৯৯৯ সালে আবার সিলেট গেলাম। বলা যায়, ১৯৯৯ সাল থেকে সিলেট যাচ্ছি। এর আগে ভারত সরকারের একটি বিশেষ নিয়মের জন্যে সিলেট বা বাংলাদেশের মানুষ এখানে আসতে পারতেন না সহজে। ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে কোনো বিদেশি নাগরিককে আসতে হলে ভিসা ছাড়াও রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া পারমিট নিতে হত দিল্লি থেকে। সে এক বিষম হ্যাঁপা। ফলে যোগাযোগ না থাকায় আমরাও তাঁদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পাই নি। এখানে ইন্দ্রকুমার গুজরাল ও ওপারে শেখ হাসিনার সরকার আসার পর আমাদের দুপারে যাতায়াত সহজ হল।১৯৯৯ সালে সিলেটে গিয়ে প্রথম দিন মদনমোহন কলেজে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে পরিচয় হল সেখানকার গণশিল্পী ভবতোষ চৌধুরীর সাথে। পরিচয়পর্ব শেষ হতেই বললেন, এসেছেন পূর্ব পুরুষের ভিটে দেখতে? পুকুরটা একই রয়েছে কি না? নারকেল গাছটা যেমন ছিল তেমন রয়েছে কি না, তাই দেখতে তো? না, এদেশে আপনাদের কোনো অধিকার নেই। ল্যাজ তুলে আপনাদের বাপ ঠাকুরদারা পালালেন। আমরা এদেশে থেকে যাওয়া হিন্দুরা এদেশের মুসলিম ভাইদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একুশের লড়াই লড়েছি, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে লড়েছি, স্বাধিকারের সংগ্রাম করেছি, মুক্তিযুদ্ধ লড়েছি, বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর একসাথে দুর্দিনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, এরশাদ বিরোধী লড়াই লড়েছি, পাকিস্তানের চিহ্ন মুছে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনেছি। এখন আপনি এসেছেন নারকেল গাছ আর পুকুর দেখতে। না, আপনার আবেগ আমাকে ছোঁয় না। প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। কোনো কথাই মুখ দিয়ে বেরোল না। পরে চিন্তা করে দেখলাম, এটাও তো একটা দৃষ্টিকোণ যার সাথে আমাদের কোনো পরিচয়ই নেই। ভবতোষদা যা বললেন, এটাও একটা সত্য যা আমি কখনো ভাবি নি।

মনে পড়ল, শিলচরে একবার আমাদের সংস্থায় অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন বাংলাদেশের শিল্পী সাদী মহম্মদ ও শম্পা রেজা। ওরা যেদিন ফিরে যাবেন সেদিনই সকালেই জানলাম শম্পা আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিলেটের যুগভেরী পত্রিকার সম্পাদক আমিনুর রশিদ চৌধুরীর পুত্রবধু। বাবার কাছে আমিনুর রশিদ সাহেবের অনেক গল্প শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলচর এসে তিনি বাবার সাথে দেখাও করেছিলেন। তারপর থেকে অনেক বছর অবধি ডাকে আমাদের বাড়িতে যুগভেরী পত্রিকা আসত। কথা সূত্রেই জানলাম শম্পার বাবারা ছিলেন মুর্শিদাবাদের লোক। কলকাতায় পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ওদের একটা বাড়ি ছিল। দেশভাগের সময় সেই বাড়ি ঢাকার কোনও এক হিন্দু পরিবারের সাথে বিনিময় করেছেন তাঁরা। শম্পার ও দেশভাগ নিয়ে আমার মতই আবেগ। বললেন, শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় কলকাতায় এলেই পার্ক সার্কাসের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেন। কল্পনা করতেন, বারান্দা দিয়ে তাঁর দাদী হেঁটে যাচ্ছেন। সাদীদের পরিবার পূর্ববঙ্গীয় মূলের। ফলে দেশভাগের ফলে তাঁদের কোনো স্থানান্তর হয় নি। আমার আর শম্পার কথা শুনে সাদী বললেন, ১৯৪৭ সালে শম্পার আব্বারা যদি পার্ক সার্কাস ছেড়ে ঢাকা না আসতেন, কিংবা আপনার বাবা মায়েরা যদি সিলেট ছেড়ে ভারতে চলে না যেতেন, তবে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হওয়ার জন্যে আমাদেরকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি অপেক্ষা করতে হত না। আরো আগেই আমরা দ্বিজাতি তত্ত্বের অন্ধগলি থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দিতে পারতাম। সিলেটে ভবতোষদার ষ্পষ্ট কথাটি সরাসরি শুনে আমার আবার সাদীভাইয়ের মুখে শোনা কথাই মনে পড়ল। এই সত্যটি আমাদের এপার থেকে কখনোই অনুভব করা যায় না। ফলেই এই কথাগুলি আমরা কখনো ভাবি নি। মায়ের মুখেই শুনেছিলাম। সিলেটে মায়ের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন হোসনে আরা বেগম। গণভোটের সময় দুজনের একটু খানি দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তাঁদের দুজনের মধ্যে। কারণ মায়েরা ছিল সিলেটের ভারতভুক্তির পক্ষে প্রচারে। হোসনে আরা বেগমেরা ছিলেন পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে। পরে সিলেট যখন সত্যি সত্যি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হল এবং আমার মায়েদের এপারে চলে আসতে হল, তখন আসার সময় মা‘কে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন হোসনে আরা। মা বলত, হোসনে আরা কেঁদে বলল, আমরা ভেবেছিলাম পাকিস্তান মানে বাড়তি কতগুলি সুযোগ সুবিধা, কতগুলি না পাওয়া অধিকার। পাকিস্তান মানে দুই বন্ধুর জন্যে দুটি দেশ, এটা যদি বুঝতাম তবে বোধহয় পাকিস্তান চাইতামই না। তবু পাকিস্তান হল। আমার মায়েরা এদিকে চলে এল। ওপারে চলে গেলেন শম্পার বাবা মায়ের মত কলিম শরাফী হাসান আজিজুল হকেরা। তবে ওরা ভিটে হারালেও ওপারে পেয়েছেন অকুন্ঠ সম্মান। উত্তর পূর্ব ভারতের বাঙালির মত জীবন অভিশপ্ত হয়ে ওঠে নি। ভিটের বদলে পেয়েছেন একটি দেশ।

আমার কী কোথাও আদৌ দেশ আছে। শিলং-এ আমরা ডখার, বহিরাগত। আসামে বাংলাদেশী। কলকাতায় বাঙালি, ভারতীয়, তবে বাঙাল। এমএসসি ক্লাসে বর্ধমানে আমার পাশে বসা আমার সহপাঠী ববি যে কথাটা বলেছিল সেটাও কোনো দিন কি ভুলতে পারি। ববি বলেছিল ভালোবেসেই। কিন্তু সে ভালোবাসাটা তীরের মত বিঁধে আছে সেই থেকে। বলেছিল, শুভ, তুই বাঙাল হলেও বাঙালদের মত নোস। তুই খুব ভালো, অন্যরকম। ববিকে বিষয়টা বোঝাতে আমি বললাম, তার মানে আমার বাবা মা কাকা কাকী আমার পরিজন স্বজন সক্কলেই খারাপ, শুধু আমি ভালো? এই প্রশংসাটা কী করে নিই বল্? অবিচলিত ববি বলল, তুই সেন্টিমেন্টাল হোস না। বাঙালরা সত্যি তোর মত না। কী চেঁচিয়ে কথা বলে। সর্বক্ষণ ঝগড়া করে। পাড়ায় একটা বাঙাল যদি ভাড়া আসে, দশ বছর পর দেখবি গোটা পাড়াটা বাঙাল হয়ে গেছে।

১৫ আগস্ট এলে এসব কথা ঘুরে ফিরে মনে পড়ে। এমনিতেও দেশপ্রেম কথাটায় আমার খুব অস্বস্তি হয়। বাংলাদেশ এবং আমাদের দেশে বিষয়টা ঠিক উল্টো। বাংলাদেশে দেশপ্রেম বিষয়টা একটা ইতিবাচক অবস্থান। কারণ সেখানে মৌলবাদী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা একটি ধর্মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের কথা বলে দেশপ্রেমের প্রতিকল্পে।সেই অবস্থান থেকেই তারা প্রত্যাখান করে একুশ, একাত্তরকে। আমাদের দেশে উল্টো। এখানে ধর্মকে জাতির সাথে একাকার করে এক বিকৃত জাতীয়বাদ ও জঙ্গী দেশপ্রেম হাজির করা হয় আন্তর্জাতিকতাকে প্রত্যাখান করতে। যদিও বিশ্বায়নে এই গৈরিক জাতীয়তাবাদের আপত্তি নেই। আপত্তি সাধারণ মানুষের আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্যে।আমার কাছে দেশ মানে সেই মাটি যেখানে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা থাকে। বিদেশ-বিদ্বেষের মুখরিত দেশপ্রেমে আমার কোনো আস্থা নেই।

আজ যখন নরেন্দ্র মোদীকে দেখি লালকেল্লা থেকে ভাষণ দিতে তখন মনে পড়ে ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরালের ভাষণ। গুজরালই ভিটেহারা জনগোষ্ঠী থেকে আসা এদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। গুজরালের সেদিনের বক্তৃতায় ১৯৪৭ সালের আমার বাবা এবং বীরেনকাকাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। গুজরাল বলেছিলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে যখন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, সেদিন আমাদের এক চোখে ছিল আনন্দের উচ্ছাস। আর অন্য চোখে ছিল বিষাদের অশ্রুজল।

এক চোখে আনন্দ আর অন্য চোখে বিষাদ নিয়ে ফিরে ফিরেই আসে ১৫ আগস্ট। বুকের ভেতর একটা অন্তর্লীন আশঙ্কা নিয়েই আমাদের বাঁচা।আবার কোনো রাজনীতির ঘুঁটি চালাচালিতে আমরা ভিটেহারা হব না তো? যে মাটিকে নিজের ভেবে নিয়েছি, কোনো এক র‌্যাডক্লিফ এসে পেনসিলে টানে সে মাটিকে বিদেশ বলে ঘোষণা করবে না তো? এজন্যেই কি প্যালেস্তাইনের নাটক দেখে আমার চোখে নেমে আসে আমার বাবা মায়ের প্রজন্মের অশ্রু?


আমাদের ঘর নেই। আছে তাঁবু অন্তরে বাহিরে।

রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

কথার কথা

আগুণঝরা দিনের শেষে দগ্ধ-আমি বাড়ি ফিরি। একটু শীতল হাওয়ার জন্যে ভেতর ও বাহির অস্থির হয়ে ওঠে। ঘরে ঢুকে ফ্যানের সুইচ অন করতেও সেই গরম হাওয়ারই ঝাপট লাগে সারা অঙ্গে। না হাওয়ায় কোনো শুশ্রুষা নেই। অগত্যা মন ঘোরাতে টিভির নব ঘোরাই।যদি একটি গানের কলি বা নিদেন পক্ষে একটি সুর কিংবা কিছু ভালো লাগায় ভাসিয়ে দেওয়া দু’চারটি কথা শুনি। আলো গিয়ে পড়ে সরাসরি এক সংবাদ ও ভাষ্যের চ্যানেলে। সেখানে তখন ভেসে ভেসে উঠছে একটি ব্রেকিং নিউজের চাঞ্চল্যকর উপস্থাপনা। পেছনে মানানসই আবহসঙ্গীত। একটি শিশুর শরীরে ভেসে ওঠা আঘাতের চিহ্নের ছবি ভেসে ভেসে ওঠে পর্দায়। বড়দের রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কোপ থেকে বাঁচে নি এই শিশুটিও। একটু পরেই শুরু হয় আলোচনার প্রহর। আলোচনা বা বিতর্কের কি কোনো সুযোগ আছে এখানে? এমন একটি জঘন্য পাশবিকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে সবাই! 

হঠাৎই যেন অনুভব করি দুপুরের খররোদের দহন। আমার শ্রবণজুড়ে ঝাপটাতে থাকে তপ্তহাওয়ার ঝড়। এই পাশবিকতারও তবে রঙ আছে? এই হিংস্রতারও তবে একটি এ-পক্ষ ওপক্ষ রয়েছে? তার মানে আমাদের সমস্ত কথাই কি পূর্ব নির্ধারিত। শুধু মাত্র উপলক্ষ্য বদলে বদলে যায়! বিশ্বব্রহ্মা- এদিক ওদিক হলেও এই সান্ধ্য আলোচনায় কোলাহলটিই শুধু একমাত্র সত্য? কার কন্ঠস্বর কীভাবে চাপা দেওয়া যাবে তারই বুঝি শিল্পিত উপস্থাপনা পর্দা জুড়ে? এই চীৎকৃত উল্লাস ও ক্রোধ- এর বাইরে বুঝি এই পৃথিবীতে কোনো কান্না নেই, মৃদু হাসি নেই, ¯িস্নগ্ধতায় ¯স্নাত করে দেওয়ার মত সুবাতাস নেই। এই দানবীয় হুঙ্কার থেকে রেহাই পেতে হঠাৎ আঙুলের চাপ পড়ে মিউট বোতামে। শব্দহীন দৃশ্যপট যেন আরো বীভৎস করে দেয় সবকিছুকে। না, সব বন্ধই করে দিতে হবে! 

বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দূরে আকাশে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে একটি দু’টি তারা। বুকের ভেতর থেকে হঠাৎই জেগে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। কে যেন গেয়ে ওঠে, ‘যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে/ তারা কথার বেড়া গাঁথে/ কেবল দলের পরে দলে‘। তার মানে সেই কবেই বুঝি ‘কথা দিয়ে‘ কথা বলায় বিতৃষ্ণ হয়েছিলেন কবিগুরু! শব্দহীন টিভির পর্দাটা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, আর গান জেগে ওঠে, ‘একের কথা আরে/ বুঝতে নাহি পারে/ বোঝায় যত কথার বোঝা তত বেড়েই চলে‘। এ যেন এ রাজ্যেরই ধারাবিবরণী! রাজ্য কেন, এই সমসময়ের পৃথিবী নয় কি? যেখানে সর্বক্ষণ চলে শুধু কথার চাতুরি কিংবা চীৎকৃত উল্লাস! কিন্তু কথারও একটা সাহিত্য রয়েছে, কথা ছাড়া কবিতারই বা জন্ম হবে কী করে! কথাকে বর্জন করতে বলছেন কবিগুরু? তবে মুক্তি কোথায়? গানের সঞ্চারী যেন উত্তর নিয়ে বসেই ছিল।

‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর/ তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর‘! সুরে? সঙ্গীতে? গীতে? তবে যে প-িতেরা বলেন কবিতার সমাজে গীতি কবিতারা তুলনায় তরলতর সৃষ্টি। উচ্চ সাহিত্যের পদবাচ্য নয় তারা। সত্যিই কি তাই? রবীন্দ্রনাথ বলছেন একটি প্রসঙ্গে, সাহিত্যে সঙ্গীতের প্রয়োজন কতটা? তাঁর মতে যে সাহিত্যে সঙ্গীত নেই তা সাহিত্যই নয়। সাহিত্যে সঙ্গীত থাকা বাঞ্ছনীয়। সঙ্গীতই সাহিত্যকে সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। তার মানে যে কথায় সুর নেই তা কথাই নয়? ওই যে উচ্চকিত কথার ¯্রােত চার পাশকে তপ্ত করে, দগ্ধ করে, তাতে আর যাই থাক সুর নেই। বুকের ভেতর বেজে যায়, ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর/ তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর/ বোঝে কি নাই বোঝে থাকে না তার খোঁজে/ বেদন তাদের মেলে গিয়ে তোমার চরণতলে‘। বারবার বেজেই যায়, ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর...‘।

চেন্নাইয়ের হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে মা। দূর থেকে দেখি তামিল আয়া মেয়েটি মায়ের সাথে হাত নেড়ে কথা বলে চলেছে। কখনো হেসে, কখনো একটু গম্ভীর, কখনো করুণ চোখে। মা-ও উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করছে। কখনো দুজনের হাসি মিলছে কথোপকথনে, কখনো দুজনের করুণ আঁখিতে জেগে উঠছে একই অশ্রুবিন্দু। দূর থেকে দেখি, শুনি না কিছুই। বিস্ময় জাগে, এখানে আয়ারাও ভালো হিন্দি বা ইংরেজি বলে তবে। সে জন্যেই মা পেয়ে গেছে ভিজিটিং আওয়ার পেরিয়ে যাওয়ার পরও কথার সাথি। সামনে এসে ঘোর ভাঙে। মেয়েটি কথা বলে চলে বিশুদ্ধ তামিলে। মা নিজের বহুভাষিকতার সর্বস্ব দিয়ে কখনো বাংলা কখনো মায়ের পরীক্ষা পাশ করা অথচ দুর্বল কথ্যের হিন্দি, কখনো ইংরেজিতে। আমি অবাক, মা পরিচয় করিয়ে দিল, আমার ছেলে। উত্তরে এক গাল হেসে কুশল জিজ্ঞেস করল মাতৃভাষাতেই সেই আয়া। মা’কে বললাম, এভাবেই বুঝি তোমাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে? কেউ কারো কোনো কথা না বুঝে? মা বলে, অত বোঝার কী আছে? খুব ভালো মেয়েটি। বুঝি, ওর স্বাভাবিক ভালোত্বটাই হচ্ছে মায়ের সাথে তার সংযোগ ভাষা। এটাই কি কথার গভীরে থাকা সুর যা সর্বত্রগামী। এটাকেই কি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সাহিত্যের সার্থকতার জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় সঙ্গীত?

তোমার চরণতলে! যারা বিশ্বাসী তাদের জন্যে তোমার মানে তো ঈশ্বরই। যে নিরীশ্বর, আমার মতো? এই তুমি হচ্ছে জীবন, আবহমান জীবন, আমার ঘিরে থাকা বিশ্ব, তার প্রাণ, যার সুরে সুর মেলাতে আমার বেলা যায় সাঁঝ বেলাতে। কাছের সুরের একতারার একটি তারের ধ্বনিতে সেই বেজে ওঠে না। বিশ্বসঙ্গীতের ‘সহস্র দোতারা’ বেজে ওই সঙ্গীতে যেখানে দূর হয় নিকট, নিকট হয় চিরকালের। ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর..‘। না, এটা সুরকে ধরতে চেয়ে কথাকে বর্জন করার কথা নয়। আমরা নিশ্চয়ই চাই না, কথা আর সুর চিরবিরহে থেকে যাক সমান্তরালে। চাই এমন কথা যা বেজে ওঠে সুরে, চাই এমন সুর যে এক গভীর গভীরতর কথা বহন করে।
পাশের বাড়ির টিভি থেকে অন্ধকার বারান্দায় ভেসে আসে হট্টগোল, সিরিয়ালের। হয়ত সংবাদ কিংবা ভাষ্যের অনুষ্ঠানেরই। একই রকম শোনায় যে দুটো, ধন্দ লেগে যায়!
‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে হলাহল
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল‘।