বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৪

কী হবে পশ্চিমবঙ্গে?

সারা দেশ যদিও মোদী প্রধানমন্ত্রী হবেন কিনা এই নিয়ে তর্কে মেতে আছে। তার মধ্যেই দেশের এক বড় অংশে মানুষের মধ্যে এটাও আগ্রহের বিষয়, কী হবে পশ্চিমবঙ্গে। বামপন্থীদের প্রতি যাদের কিছুটা হলেও দুর্বলতা রয়েছে , তারা তো আগ্রহী বটেই, আগ্রহী পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকা সাধারণ বাঙালিরাও। সারা দেশেরও এক বড় অংশের মানুষর মধ্যে জিজ্ঞাসা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল নিয়ে। তারা জানতে চায়, বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াবে, নাকি বড় বড় সংবাদপত্রের সমীক্ষা অনুযায়ী আরো দুর্বল হয়ে পড়বে বামপন্থীরা?



তবে এবারের নির্বাচন বিভিন্নভাবেই অভূতপূর্ব পশ্চিমবঙ্গের জন্যে। পশ্চিমবঙ্গের ভোট মানেই এতকাল আমরা জানতাম পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান, রাস্তার ঠেক, বাস ট্রাম ট্রেনে নির্বাচন নিয়ে অন্তহীন মুখরতা। প্রতিটি পরিসরে তর্কে ঝগড়ায় বিদ্রুপ ভাবাবেগ চেঁচামেচিতে মুখর থাকত মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতির এই মুখরতা দিয়েই বলা যায় বাইরের মানুষেরা এই রাজ্যকে চেনে। বাংলা সিনেমা গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের এই রাজনৈতিক মুখরতার কত কত রূপায়ণ আমরা দেখেছি। এবার এই মুখরতাই উধাও হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। চায়ের দোকান, ট্রেন বাস ট্রাম পাড়ার রক আড্ডার ঠেক অফিসের টেবিল- সবত্র আশ্চর্যজনকভাবে বিরাজ করছে এক শীতল নীরবতা। কেউ কারো সাথে ভোট নিয়ে কোনো তর্ক করছে না, কোথাও কেউ বাজি ধরছে না ফলাফল নিয়ে, কোথাও কেউ কাউকে বিদ্রুপ করছে না, আবেগে গদগদ হয়ে কারো সমর্থনে গলাও ফাটাচ্ছে না কেউ। ট্যাক্সিওয়ালা রিক্সাওয়ালা সেলুনের কর্মচারী- যারা নাকি আগে এমন মরশুমে নির্বাচনী হাইলাইট এবং নানা ধরনের স্কুপ খবর দিয়ে স্বাগত জানাত গ্রাহকদের, তারা এবার কথায় বার্তায় এড়িয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের প্রসঙ্গ। প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন শীতলতা নেমে এল কেন? কেউ হয়ত বলবেন, রাজনীতি নিয়ে মানুষের বীতশ্রদ্ধ হওয়াই কারণ। না, এটা পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যমান পরিস্থিতির সত্য মূল্যায়ণ কখনোই নয়।


গ্রাম থেকে শহর হয়ে মহানগরের সমাজজীবনকে এই মুহূর্তে শাসন করছে এক সর্বগ্রাসী ভয়। এই ভয় শুধু যে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থকের মধ্যেই তা নয়, ভয়ের আবহে বাস করছে অফিস আদালত ব্যবসা বাণিজ্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত মানুষেরা।  এমন কি এ থেকে মুক্ত নন চলচ্চিত্র নাটক সঙ্গীতের মত সৃষ্টিশীল কাজের সাথে জড়িয়ে থাকা বিশিষ্টজনেরাও। পেট্রোল বা ডিজেলের সামান্য দাম বাড়লেই বাসভাড়া পরিবহণ ভাড়া বাড়ানোর জন্যে যারা কথায় কথায় ধর্মঘট করত, তারা এখন শত চড়েও রা কাড়েন না। সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতার বড়ো একটি অংশ দীর্ঘদিন থেকে বকেয়া, সরকার স্পষ্টই জানিয়েছে, তারা দেবে না, পেনশন পাচ্ছেন না সরকারি নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা, ট্রেড ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের নানা জায়গায় বদলি করে দেওয়া হয়েছে, তবু পশ্চিমবঙ্গের ‘সংগ্রামী‘ শ্রমিক কর্মচারীরা নীরব, কোনো আন্দোলন নেই। যে সমস্ত সঙ্গীতশিল্পীরা আগের জমানায় অনুষ্ঠানে গানের ফাঁকে ফাঁকে নানা রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতেন, অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করতেন, সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করতেন, তারাও এখন নীরব। অনুষ্ঠানে গানের পর গানই গেয়ে যান, সমাজ সংসার নিয়ে কোনো কথা বলেন না। যেন ‘সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব‘! আসলে সবই ভয়ের সর্বগ্রাসী রাজ্যবিস্তারের ফল। ভয় এমন কি বিরাজ করছে যারা শাসকপক্ষের রাজনীতির সাথে যুক্ত তাদের মধ্যেও। প্রতিনিয়ত ভয়ে ভয়ে থাকেন নিজেদের অপর গোষ্ঠীর গতিবিধি নিয়ে। ভয় থেকে মুক্ত নন সম্ভবত ক্ষমতাসীন দলের ওপরতলার নেতৃবৃন্দও। এক গভীর অনিশ্চয়তায় কাটে তাদেরও ‘দিনরজনী‘। আজ যার প্রতি নেত্রীর অকুন্ঠ বিশ্বাস, যার শত অপরাধকে জনসমক্ষে সমর্থন করতেও পিছপা নন তিনি, পরিস্থিতির হঠাৎ পরিবর্তনে সেই আস্থাভাজন নেতাই পরের দিন হয়ত স্থান পেতে পারেন কারাগারের অন্ধকারে। বলা যায় না, হয়ত ভয় পেছন ছাড়ছে না প্রধানা নেত্রীকেও। কারণ শপথ নেওয়ার পর যিনি ঘোষণা করেছিলেন কোনো ধরনের পুলিসী নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকবেন না, এই মুহূর্তে তিনি যে মাত্রার পুলিসী নিরাপত্তা নিয়ে ঘোরাফেরা করেন, স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গে কোনো মুখ্যমন্ত্রীই এই পর্যায়ে করেন নি।


এই সর্বগ্রাসী ভয়ের আবহেই এবারের ভোট। এই নির্বাচনের আরো দু’টি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েছে কারো কারো। প্রথমত, ২০০৯ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে এবং ২০১১ সালের নির্বাচনের সময় সাধারণ মানুষের এক বড়ো অংশের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তার দল তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে যে ইতিবাচক উচ্ছাস ছিল, তার অনেকটাই এখন স্তিমিত। কট্টর সমর্থকরা তাদের দিদিকে হয়ত আরেকটু সময় দিতে চান, কিন্তু সাধারণ সমর্থকরা যারা বামেদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে সোৎসাহে ভোট দিয়েছিলেন মমতার দলকে তারা কিছুটা হতাশ। এমনটা তারা চান নি। এই মানুষগুলির একটি অংশ ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছেন বামশিবিরে। তবে এদের বড়ো অংশ, বিশেষ করে যারা ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু, মনে করছে এই মুহূর্তে ভরসা করা উচিত নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বেই। তাদের একটা বাড়তি রাগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচ্চকিত মুসলিম-রাজনীতি। সভা সমিতিতে কথায় কথায় ইনশাল্লাহ বলা, মাথায় হিজব পড়ে ধর্মীয় সমাবেশে হাজির হওয়া, মুসলিমদের জন্যে আলাদা হাসপাতাল করতে চাওয়া, কাজে কিছু না হলেও কিছুদিন পর পর আলাদা করে শুধু মুসলিমদের জন্যে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা, এই সমস্ত কিছুর ফলে এই মানুষগুলির মধ্যে এক ধরনের চাপা হিন্দু-ভাবাবেগ তৈরি হচ্ছে। বাসে ট্রেনে চায়ের দোকানে অফিসে আদালতে যে কোনো আড্ডায় একটু প্রশ্রয় পেলেই আলোচনা সাম্প্রদায়িক দিকে মোড় নিচ্ছে। এমন প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের প্রকাশ স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবাংলায় অভূতপূর্ব। মর্মান্তিক হলেও সত্য, চিরাচরিত বাম-ভোটারদের একটা অংশকেও ঘনিষ্ঠবৃত্তে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের শিকার হতে দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর্যায়ে হয়ত এর সরাসরি প্রকাশ ঘটবে না, কারণ তাদের এই আচরণটা যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিকতার।


অনেক কথার পর এবার আশা যাক ফিরে কী হবে পশ্চিমবঙ্গে এই আলোচনায়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যে মতামত সমীক্ষাগুলি প্রকাশিত হচ্ছে তার মোদ্দা কথা প্রধানত তিনটি। এক, সব দলকে ছাড়িয়ে এখনও অনেকটা এগিয়ে আছে তৃণমূল। দুই, বিজেপির ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং তিন, বামেদের আরো শক্তিক্ষয় হবে। এই সমীক্ষাগুলি নানা কারণেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। প্রথমত, জাতীয়স্তরেই এটা এখন প্রমাণিত সত্য যে, বৃহৎ সংবাদ মাধ্যমগুলি কর্পোরেট মহলের অর্থানুকূল্যে এবার অতীতের তুলনায় অনেকবেশি পূর্ব-নির্ধারিত মতকে প্রচার করছে সমীক্ষা এবং প্রতিবেদনে। এই পূর্বনির্ধারিত মতকেই তুলে ধরা হচ্ছে সত্য হিসেবে। এই মুহূর্তে কর্পোরেট মহলের নয়নমণি নরেন্দ্র মোদী। মোদীর প্রতি তাদের দুর্বলতা এতটাই প্রবল যে নিজের দল তাকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার বহু আগেই তারা তাকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, এই মহলের চাপেই একাধিক প্রবীণ নেতার মতামতের বিরুদ্ধে গিয়েই নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে তার দলও। সাধারণের অভিমত সত্যিই কি উঠে আসছে মতামত সমীক্ষাগুলিতে এই নিয়ে সারা দেশজুড়েই নানা সন্দেহ সংশয়। এমন সন্দেহ প্রকাশিত হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী সমীক্ষা নিয়েও। যে সমীক্ষাগুলি প্রকাশিত হয়েছে তা কতটা বাস্তবসম্মত? প্রথমত, যে অভূতপূর্ব ভয়ের বাতাবরণ বিরাজ করছে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে তাতে মানুষের মতামত সমীক্ষা বস্তুনিষ্ঠ হবে তার গ্যারান্টি কতটা? ধরা যাক, আধুনিক সংখ্যাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম প্রণালীর মাধ্যমে সেই বাধাগুলিকেও দূর করা হল। তারপরেও এই প্রকাশিত সমীক্ষাগুলিকে একটু মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করলে ধরা পড়বে নানা ত্রুটি। খুঁজে পাওয়া যাবে একদেশদর্শিতার নানা দৃষ্টান্ত।


২০১১ সালের নির্বাচনে যখন স্মরণাতীত কালের মধ্যে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে বামপন্থীরা বিদায় নেয়, তখন তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোটের মোট ভোট ছিল ২৩,০৮৫,২১৩ এবং সর্ব অর্থে পর্যুদস্ত বামফ্রন্টের মোট ভোট ছিল ১৯,৫৫৫,১৩৫। দু’টি জোটের ভোটের ব্যবধান ছিল ৩,৫৩০,০৭৮।  শতাংশের বিচারে তৃণমূল জোট পায় ৪৮.৫৪% এবং বামফ্রন্ট পায় ৪১.১২%। পশ্চিম বাংলার সংবাদ মাধ্যমে একটি মত প্রায়শই ব্যক্ত করা হয়, যা মূলত রাজ্যের বর্তমান শাসকদেরও মত। এই মত অনুযায়ী ২০১১ সালের পরাজয়ের পর বামপন্থীদের সমর্থন ক্রমেই হ্রাস পেয়ে চলেছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই অনুমান কতটা বাস্তবসম্মত?


এবারের ভোটেই প্রথম একক শক্তিতে তৃণমূল লড়ছে। স্মরণ করা যেতে পারে বিগত কোনো লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনেই তারা একা লড়ে নি। কখনো বিজেপি কখনো কংগ্রেসের সাথে জোটে ছিল তৃণমূল। ২০১১ সালের তৃণমূল জোট ছিল আরো বড়ো। তাতে কংগ্রেস থেকে শুরু করে এসইউসিআই পর্যন্ত অনেকেই ছিল অন্তর্ভুক্ত। ২০১৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে পূর্বাভাস করতে গিয়ে বিভিন্ন সমীক্ষায় তৃণমূলের সম্ভাব্য ভোটের পরিমাণ বলা হয়েছে ৩৬%-৩৮% শতাংশ। হেডলাইনস টুডে চ্যানেলের সমীক্ষায় তৃণমূলের সম্ভাব্য ভোটের হার বলা হয়েছে ৩৪%। ওই চ্যানেলের অনুষ্ঠানেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তৃণমূলের সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, তৃণমূল ভোট পাবে ৪০% শতাংশ। অর্থাৎ তৃণমূলের সাংসদই স্বীকার করে নিয়েছেন ২০১১ সালের তুলনায় এবার তাদের ভোট কমবে ৮% এর কাছাকছি। এই সমীক্ষায় আরো বলা হয়েছে কংগ্রেসের ভোট ২০০৯ সালে পাওয়া ১৩.৫% থেকে বেড়ে হবে ১৭% এবং বিজেপির ভোট ৬.১% থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৯%। এই হিসেবের সাথে সঙ্গতি রাখার জন্যেই সম্ভবত তারা বামেদের সম্ভাব্য ভোট অনুমান করছেন ২৩%। বলা বাহুল্য, এই সমীক্ষাটি ত্রুটিপূর্ণ। ২০০৯ সালের যে ভোটকে কংগ্রেসের ভোট বলে অভিহিত করা হয়েছে, তা মোটেই কংগ্রেসের একক ভোট নয়। তৃণমূলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে লড়া সেই নির্বাচনের ভোটে যোগ করা আছে তৃণমূলের ভোটও। একইভাবে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের ৪৮% ভোটের মধ্যে নয় নয় করেও রয়েছে কংগ্রেসের অন্তত ১০% শতাংশ ভোট এবং এসইউসিআই-এর মত ছোট দলের ০.৮ শতাংশ থেকে ১% শতাংশ ভোট। সুতরাং ২০১১ সালের নিরিখেও পাটিগণিতের হিসেবেই তৃণমূলের একক ভোট ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১১%-১২% কমে যাওয়ার কথা।


বামপন্থীদের ভোট সম্পর্কে পূর্বানুমান করার আগে কয়েকটি তথ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। ২০১১ সালে বামেদের যে ভরাডুবি হয় তার সবচেয়ে বড়ো আঘাত ঘটে হুগলি, হাওড়া, কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায়। হুগলি জেলায় তৃণমূল জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল প্রায় ৫৯%। ২০১১ সালের পর কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে প্রথম বড় ভোট হয় ২০১৩ সালে হাওড়া সংসদীয় আসনে। ২০০৯ সালে এই আসনে বামফ্রন্ট পরাস্ত হয়েছিল ১,৮৪,০০০ ভোটে। শতাংশের হারে বামফ্রন্টের ভোট ছিল ৪৩.৮৫%। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের সময় এই ভোট আরো হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৩৭%-এ। বিপর্যয়ের এই ধরনটি ব্যাপ্ত ছিল মেদিনীপুর থেকে হুগলি হাওড়া হয়ে কলকাতা দুই চব্বিশ পরগণা অবধি।  তৃণমূল সাংসদ অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর হাওড়ায় উপনির্বাচন হলে সেখানে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্লেখযোগ্য বিষয়, তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান এক ধাক্কায় ১,৮৪,০০০ থেকে নেমে আসে ২৭,০০০-এ। ৩৭% থেকে বামেদের ভোট বেড়ে দাঁড়ায় ৪১.৮৫%। চমকপ্রদ একটি তথ্য এখানে যুক্ত করা যেতে পারে, এই উপনির্বাচনে শেষ মুহূর্তে বিজেপি তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়। ২০১৩ সালের যে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বামেদের বা এক অংশের সংবাদ মাধ্যমেরও প্রচুর অভিযোগ, সেখানেও একটু গভীরে আলো ফেললে অনেক চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসবে।


নির্বাচন অবাধে হয়েছে কি না, তা আলাদা করার জন্যে আমরা সেই সমস্ত জেলা পরিষদের আসনের দিকে নজর দিতে পারি, যেখানে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি থেকে জেলা পরিষদ অবধি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সম্পন্ন হয় নি। এই ধরনের আসনের ফলাফলের বিচার করলে দেখা যাবে ২০১১ সালের তুলনায় অনেকটাই ভোট বেড়েছে বামেদের এবং একইভাবে হ্রাস পেয়েছে তৃণমূলের ভোটও। ২০১১ সালে বামেদের সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় হওয়া জেলাগুলির অন্যতম উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা। বাসন্তী হাইওয়ের দু’ধারে দুই চব্বিশ পরগণার নিচের স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এমন একান্নটি জেলা পরিষদ আসন এলাকা বাদ দিয়ে উত্তর ২৪ পরগণার ৩১টি (মোট আসন ৫৭) ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার ৫৬টি (মোট আসন ৮১) জেলা পরিষদের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বামেদের প্রাপ্ত ভোট ৪৩.৫%, যা ২০১১ সালের তুলনায় প্রায় ৪%-৫% বৃদ্ধি বেশি। কারচুপির অভিযোগগুলিকে যদি নাও মানি তবেও সামগ্রিকভাবেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের মোট প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ৩৯%, যা ২০১১ সালে তুলনায় মাত্র ২% কম। এই সংখ্যাকে প্রকৃত অবস্থার সূচক ধরে নিলেও হেডলাইনস টুডে সহ বিভিন্ন সমীক্ষায় বামফ্রন্টের প্রায় ১৮%-২০% ভোট হ্রাস পাওয়ার অনুমানটি ভিত্তিহীন বলেই ধরে নিতে হবে। নির্বাচনী হিসেব ছাড়াও বা দিলেও সাদা চোখেই দেখা গেছে গত এক বছরে বামেদের যে সমস্ত সভা সমাবেশ মিছিল আন্দোলনে আগেকার তুলনায় অনেক বেশি মানুষকে যোগ দিতে।


এই নির্বাচনে বিজেপি-র ভোট বাড়বে এই নিয়ে কোনো পক্ষেরই মতপার্থক্য নেই। কিন্তু এই ভোট কতটা বাড়বে এবং সেটা কাদের ভোটের ক্ষয় ঘটিয়ে ঘটবে, এ নিয়ে সমীক্ষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। সর্বোপরি, বিজেপি-র এই শক্তি বৃদ্ধি কি আসন প্রাপ্তিতে পরিণত হবে নাকি সীমাবদ্ধ থাকবে অন্য দলের পরাজয়ের কারণ হয়ে, তা নিয়েও নানা মত রয়েছে। এটা ঠিক পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশের মানুষ গভীরভাবেই চাইছে নরেন্দ্র মোদীকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তবে এদের এই চাওয়ার রাজনৈতিক বাস্তবায়নের পথে বাদ সাধছে রাজ্যে বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতা। সারা দেশে যাই হোক, এখানে নিজেদের কোমরের জোরে লোকসভার আসন তারা জিততে পারবেন এমন ভরসা সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই। সাম্প্রতিককালে সাধারণভাবে হিন্দু-ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া মানুষদের বেশিরভাগ অংশটি গতবারের ভোটে ছিলেন তৃণমূলের পক্ষে। মমতার উচ্চকিত মুসলিম-রাজনীতিতে এরা হতাশ হয়েই এমন ভাববেগের শিকার হয়েছেন। বাবুল সুপ্রিয় বা বাপী লাহিড়ীর মত প্রার্থীর প্রচারে যে একটা হাওয়া কিছুটা উঠেছে তা শেষ পর্যন্ত সংগঠিতভাবে কতটা ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হবে তা নিয়ে এই নতুন সমর্থকেরা কিছুটা ধন্দে। এই মুহূর্তে ভাসমান ভোটারের বৃহত্তর অংশ তারাই।


দক্ষিণবঙ্গের বেশির ভাগ অঞ্চলে ২০১১ সালে ভোটের নিরিখে বিজেপির উপস্থিতি নিতান্ত সামান্যই। দক্ষিণবঙ্গে বোলপুরের মধ্যেকার ময়ূরেশ্বর,বীরভূম আসনের অন্তর্ভুক্ত  রামপুরহাট, বসিরহাটের সন্দেশখালি, বর্ধমান-পূর্ব আসনের পূর্বস্থলী-উত্তর, হাওড়ার হাওড়া-উত্তর ও উলুবেড়িয়া আসনের উলুবেড়িয়া-পূর্ব, কলকাতা-উত্তরের জোড়াসাঁকো বিধানসভা চক্র ছাড়া আর কোথাও তারা দশ শতাংশের বেশি ভোট পায় নি। বাকি সমস্ত বিধানসভা এলাকায় তারা ভোট পেয়েছে গড়ে পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি। তবে উল্লেখ্য, ২০১১ সালে উত্তরবঙ্গের বাকি আসনগুলির মধ্যে আলিপুরদুয়ার লোকসভা আসনের অন্তর্ভুক্ত মাদারিহাটে ২৬%, মালদা-উত্তরের হাবিবপুরে ২০% এবং মালদা-দক্ষিণের ফরাক্কায় ১৯% শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। দশ শতাংশের আশে পাশে ভোট পেয়েছিল আলিপুরদুয়ারের তুফানগঞ্জ, কুমারগ্রাম, জলপাইগুড়ি আসনের মধ্যেকার ধূপগুড়ি, মালদা-দক্ষিণের বৈষ্ণবনগর ও বহরমপুরের বেলডাঙায়। এবারের নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে কিছু সর্বভারতীয় আদিবাসী সংগঠন বিজেপির প্রতি সমর্থন জানানোয় ২০১১ সালের হিসাবে আরো চার পাঁচটি বিধানসভা এলাকায় বিজেপি কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় যেতে পারে বলে মনে হতে পারে। ২০০৯ সালের প্রাপ্ত ভোট ৬% থেকে বিজেপি যদি সত্যিই ১৯% এর কাছাকাছি ভোট পায় তবে এই ভোটটি তারা কোথা থেকে পাবে? অর্থাৎ কাদের ভোট ক্ষয়ের মাধ্যমে এই সংখ্যায় পৌঁছবে বিজেপি? নিজেদের বিচ্ছিন্ন পকেট ছাড়াও বিজেপির সম্ভাব্য সম্প্রসারণের এলাকা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিন্দিভাষী ভোটাররা। এদের মধ্যে বিজেপির প্রতি সমর্থনের প্রবণতা লক্ষ্যও করেছেন অনেকে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলির পূর্ববঙ্গীয়মূলের ভোটারদেরও মনে করছেন অনেকে বিজেপির সম্ভাব্য নতুন ভোটার। এ ছাড়াও নদীয়ার তেহট্ট, উত্তর ২৪ পরগণার দেগঙ্গা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার ক্যানিং অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয়ভাবে কতগুলি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। এই অঞ্চলগুলিতে পরবর্তী সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা গেছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের নানা সংগঠনকে। এর ফলে এই অঞ্চলগুলিতেও খানিকটা হলেও হিন্দু ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে পারে বিজেপি। তবে যে সমস্ত বিধানসভা এলাকার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হল ২০১১ সালের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিগত নির্বাচনে এর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটই গিয়েছিল তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের বাক্সে। ফলে এই সমস্ত অঞ্চলে পক্ষ পরিবর্তনের ঘটনা ঘটলে  দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৃণমূলই। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ মিলিয়ে সব ক’টি লোকসভা আসনে এভাবে গড়ে ৬%-৮% ভোট তৃণমূলের থেকে সরে যেতে পারে বিজেপি-র দিকে। অন্যদিকে তৃণমূলের বাড়তি ক্ষতি কংগ্রেসের সাথে জোটের অবসান।


এটা ঠিক এই মুহূর্তে সারা দেশেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে হাওয়া বইছে। এখানে বিজেপি-র উত্থান যদি জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন হয়, তবে একই অনুষঙ্গে এই রাজ্যে কংগ্রেসের সমর্থনভিত্তিতেও ক্ষয় আসার কথা। এ ছাড়াও সংসদীয় পদের টোপ, অর্থকরী প্রাপ্তির প্রলোভন দেখিয়েও উত্তর থেকে দক্ষিণ বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তিকে অনেকটাই কোণঠাসা করে দিয়েছে তৃণমূল। এই শক্তিহীনতার প্রতিফলন কিছুটা ভোটে নিশ্চয়ই পড়বে।  তবে সাংগঠনিক শক্তি যতই কমুক সারা রাজ্যে গড়ে ন্যূনতম ৮%-১০% ভোট কংগ্রেসের বাক্সে পড়বেই। বলা বাহুল্য এই ভোটও তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের ২০১১ সালে পাওয়া ৪৮% ভোটকেই ক্ষয় করবে। এই সমস্ত বিয়োগ ফলের পর ২০১৪ সালের ভোটে তৃণমূলের ফলাফল যা দাঁড়াবে তা আর যাই হোক সর্বভারতীয় সমীক্ষার অনুরূপ হবে না তা একরকম নিশ্চিতই।



আমাদের অভিজ্ঞতা বলে নির্বাচনী ফলাফল শেষ পর্যন্ত সবসময়ই প্রচুর চমক নিয়ে আসে। এবারের পশ্চিমবঙ্গের ভোটে সেই চমকের একটি হয়ত হবে ছোট পরিসরে হলেও বিজেপির উত্থান। আসনের বিচারে বিরাট কিছু না হলেও ভোটের শতাংশের বিচারে তা অবশ্যই হবে উল্লেখযোগ্য বিষয়। এ ছাড়া আরো দু’টি চমক হয়ত আসবে আগামী মাসের ১৬ তারিখ দিনটিতে। এক, তৃণমূলের শক্তিহ্রাস এবং দুই, নিশ্চিতভাবেই বামপন্থীদের পুনরুত্থান। যার প্রভাব পরবর্তী দিনগুলির জাতীয় রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন