রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

একুশ, শাহবাগ ও আমরা

এবারের একুশে এসেছি আমার নিজের মাটি আসামের বরাক উপত্যকায়। সীমান্ত-শহর করিমগঞ্জের অদূরে ছোট জনপদ বারৈগ্রাম। উনিশো একষট্টির ভাষা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী এই জনপদ। এই জায়গারই সন্তান প্রভাংশু দত্ত। আজীবন অধ্যাপনা করেছেন বদরপুর কলেজে। বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সংগ্রামী মানুষ। অধ্যাপক আন্দোলনে অংশ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ছিলেন বরখাস্ত অবস্থায়। সম্প্রতি চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। চাকরি জীবনের শেষে সারা জীবনের উপার্জন থেকে কুড়ি লক্ষ টাকা দান করেছেন পার্টির তহবিলে। আরো দশ লক্ষ টাকা দান করেছেন বারৈগ্রামে এক বিশাল ভাষা শহীদ স্মারক তৈরি করার জন্যে। করিমগঞ্জ জেলার পার্টি উদ্যোগ গ্রহণ করে শামিল করেছেন সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে। অংশ গ্রহণ করিয়েছেন বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদেরও। শহীদ স্মরণ সমিতি গঠন করে এক বিশাল সুদৃশ্য শহীদ স্মারক তৈরি করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বারৈগ্রামের জফরগড় স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলের ভেতরে এই শহীদ স্মারক বসানোর অনুমতি দিয়েছেন। আজ একুশের সকালে বরাক উপত্যকার বৃহত্তম শহীদ স্মারকের আবরণ উন্মোচন করলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সোমনাথ দাশগুপ্ত। শহীদ স্মরণ সমিতি সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন, এই শহীদ স্মারক শুধু একুশের বা বরাকের ভাষা সংগ্রামের উনিশের শহীদদের স্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত নয়। সারা পৃথিবীর সমস্ত ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে এই স্মারক নির্মিত হয়েছে। ভাষা শহীদ স্মারকের উন্মোচনের পর আলোচনা সভায় বক্তাদের বক্তব্যে উঠে এল সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা সংগ্রামের কথা। উনিশে বাহান্ন সালের একুশের সংগ্রাম আর বরাকের একষট্টি বাহাত্তর ছিয়াশি ও ছিয়ানব্বুই সালের ভাষা সংগ্রামের শহীদরা মিলেমিশে গেলেন। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক আসামের মন্ত্রী সিদ্দেক আহমেদও। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বরাকের শিল্পীদের পাশাপাশি অংশ নিলেন বাংলাদেশ থেকে আসা লোকশিল্পীরাও। এমন এক বিরাট কর্মযজ্ঞ সম্ভব হয়েছে একটি মানুষের এই মহৎ অবদানের জন্যেই। আমাদের সমাজে যাঁরা বিরাট ধনসম্পদের অধিকারী তাঁরা তাঁদের আয়ের একটি অংশ মহৎ নানা সামাজিক কাজে ব্যয় করে থাকেন এটা কোনো বড়ো কথা নয়। আজকাল এই অঞ্চলে কালোটাকার মালিক রাজনৈতিক নেতারা কথায় কথায় টাকা দান করেন। প্রভাংশুবাবুর ব্যাপারটি তা নয়। তিনিই মোটেই ধনাঢ্য ব্যক্তি নন, সাধারণ  মধ্যবিত্ত সংসারী মানুষ। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও গভীর মানবিক আবেগ এটাই শিখিয়েছে জীবন শুধু নিজের জন্যে বা নিজের পরিবারের জন্যে নয়। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। তাঁর জন্যেই এবারের একুশের সকাল দুপুর রাত এ অঞ্চল উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। তবে একুশ বা উনিশ তো শুধু আবেগের প্রকাশ নয়, সাংস্কৃতিক রাজনীতির লড়াইয়ের অভিন্ন অংশ।
         
  ওপারে বাংলাদেশে একুশ এবার এসেছে এক রক্তঝরা সময়ের মধ্যে। একদিকে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ একুশের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত হয়ে বাংলাদেশের সমাজকে মৌলবাদ ও ঘাতক দালালদের হাত থেকে মুক্ত করতে মুখর হয়েছেন। অন্যদিকে এর উত্তরে বাংলাদেশের মৌলবাদী ঘাতক দালালরা ও তাদের দোসর রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করে তুলেছেন। বাংলাদেশে সবসময়ই একুশের উদযাপন নিছক শহীদ স্মরণ হিসেবে উদযাপিত হয় না। প্রতিবারই এই দিনকে তাঁরা উদযাপন করেন বিদ্যমান সময়ের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতার বুকে দাঁড়িয়ে। একুশের সংগ্রামকে তাঁরা নবীকরণ করেন চলমান সময়ের সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে। গতবার একুশ ও শাহবাগ ছিল একে অপরকে জড়িয়ে। একুশের উদযাপনে ছিল শাহবাগের সংগ্রামের ছায়া। তরুণ সংস্কৃতিকর্মী রাজীব হায়দার তখন সদ্য শহীদ হয়েছেন জামাতের কর্মীদের হিংস্র আক্রমণে জীবন দিয়ে। উনিশো সাতচল্লিশের ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অন্ধ আবেগকে সঙ্গী করে। দ্বিজাতি তত্ত্বের মোহাচ্ছন্ন ওপারের বাঙালি মুসলিম জেনেছিল জাতি নির্মিত হয় ধর্মের ভিত্তিতে, ভাষার ওপরে নয়। উনিশো বাহান্নর ভাষা সংগ্রাম ওপারের বাঙালিকে মুক্ত করল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্ধগলি থেকে। একুশ বার্তা দিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের। ওপারের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা এই বাঁক বদলকে বলেন, ওপারের বাঙালির ঘরে ফেরা। এই অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের পথে হেঁটে এগিয়েই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান রূপান্তরিত হল বাংলাদেশে। ২০০০ সাল থেকে একুশ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘোষণার মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই নানা ভাষী মানুষরা পালন করছেন এই দিন। প্রশ্ন উঠতে পারে ২০০০ সালের আগে একুশের কতটা তাৎপর্য ছিল আমাদের রাজনীতির জন্যে বা সংস্কৃতির সংগ্রামের নিরিখে। ওটা কী ছিল শুধুই ওপারের বাঙালির একটা অর্জন? শুধুমাত্র অভিন্ন মাতৃভাষার জন্যেই আমাদের কর্তব্য ছিল ওই দিন পালনের এর বাইরে কী কোনো তাৎপর্য ছিল ওই দিনের আমাদের জন্যে? এটা ঠিকই ওই দিনটি বাঙালির ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনের একটি মাইল ফলক। তবু এর তাৎপর্য আরো গভীরে। আমরা মনে করতে পারি উনিশো পাঁচ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পথে নেমেও পরে সরে গিয়েছিলেন। সরে গিয়েছিলেন এজন্যেই, তিনি দেখতে পেয়েছিলেন বাঙালির মজ্জার ভেতরে যুগ যুগ ধরে গেড়ে বসে আছে বিভাজনের চিহ্ন। হিন্দু বাঙালি ও মুসলিম বাঙালি পাশাপাশি বাস করেও রয়েছে দূরত্বে। এই দূরত্ব থেকেই জন্ম নিয়েছে দ্বিজাতি তত্ত্বের ধর্মীয় রাজনীতি। একুশ শুধু ভাষার অধিকারকেই প্রতিষ্ঠিত করে নি। রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যাধির প্রতিকার` প্রবন্ধে যে ব্যাধির কথা বলেছিলেন, সেই ব্যাধির প্রতিকারের পথেই হেঁটেছিল একুশ, শাহবাগ তাঁকেই পূর্ণতা দিতে চেয়েছে ঘাতক-দালাল মৌলবাদীদের বিচার ও শাস্তির মধ্যে দিয়ে। এই লড়াইয়ের তাৎপর্য এপারেও অপরিসীম। এই বঙ্গে এখনো ‘ব্যাধির প্রতিকার` হয় নি। এখনো হিন্দু-বাঙালি ও মুসলিম-বাঙালি পাশাপাশি বাস করেও রয়েছে দূরত্বে। বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য নির্মানের কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। এই কাজে একুশ আমাদেরকে আলো দেখাতে পারে।

শাহবাগ নিয়ে আমাদের প্রাথমিক উচ্ছাসের সীমা ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে এ দেশে অনেকেরই ধারণা শাহবাগের লড়াই ব্যর্থ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কোন মাটিতে দাঁড়িয়ে শাহবাগের তরুণরা কোন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তা তাঁরা জানতেন। কিন্তু এপারে অনেকেরই ধারণা ছিল, যে দ্রুততায় শাহবাগে লক্ষ জনতার জমায়েত হয়েছে, সেই দ্রুততাতেই বোধহয় মৌলবাদীরা বাংলাদেশে নিঃশেষ হয়ে যাবে। ঘটনাটি ওভাবে ঘটেনি বলে এখানে অনেকের ধারণা শাহবাগ ব্যর্থ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শাহবাগ তো ব্যর্থ হয়ই নি, বরং শাহবাগের লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালির প্রতি গৃহকোণে। আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি সংস্কৃতি ও সমাজজীবনে মৌলবাদী ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কী স্থান হবে তা নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র। এমন কি জামাত-সম্পৃক্ততার বিষয় নিয়ে বিএনপি দলে নেতৃত্ব থেকে নীচের স্তর পর্যন্ত বিতর্ক ছড়িয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ নিয়ে এমন বিস্তৃত আলোচনা ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েনি বাংলাদেশের সমাজ। এখানেই শাহবাগের উপস্থিতি এবং সাফল্য। আজ আমাদের এ পারে যখন দাঙ্গাবাজ অতীতকে ভুলিয়ে দিয়ে উন্নয়নের মুখোস পড়ে নির্বাচনী আসরে নেমেছেন নরেন্দ্র মোদী ও তার দল, তখন ওপারের ওই সংগ্রাম বিতর্ক কী আমাদের জন্যে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে না? শুধু নরেন্দ্র মোদী কেন, মুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতাকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সুক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা ও পৃথকত্বের রাজনীতি করছেন, সেখানেও কী শাহবাগ বা একুশ আমাদের পথ দেখাতে পারে না? স্মরণ করা যেতে পারে, ওপারে যখন শাহবাগের লড়াই চলছে তখন এখানে মৌলবাদীরা শাহবাগ-বিরোধী জমায়েত মিছিল করেছেন। এই প্রচেষ্টাগুলি নেপথ্যে ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দলের নীরব আশীর্বাদ। এটা অজ্ঞানতা প্রসূত কোনো ঘটনা নয় বলা বাহুল্য। কারণ কেউ জানুক আর না জানুক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল জানে, শাহবাগের বাতাস এপারের হিন্দু ও মুসলিম সমাজকে ছুঁলে তাঁর রাজনীতি দুর্বল হবে। কারণ মৌলবাদ বিরোধিতা গণতন্ত্রের পথ সুগম করে। আর সমাজের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়ে যাওয়া মানে ফ্যাসীবাদের দিন শেষ।


এ জন্যেই একুশ উদযাপন, শাহবাগের প্রতি সহমর্মিতা প্রগতিপন্থীদের জন্যে একটি জরুরি রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কাজ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন