সকাল মানেই ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘। যখন এই অনুষ্ঠান থেকে অনেক দূরে ছিলাম
শিলচরে তখনও, এখনও। পরিচিত অপরিচিত নামী অনামী গলায় গান শুনে দিনের কাজের শুরু। এই
অনুষ্ঠানকে ঘিরে একটা ভালোবাসা তখনও ছিল। যদিও তখন সেটা ছিল দূরের ভালোবাসা। ওখানে
অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সুবাদে সেই দূরের ভালোবাসা আত্মীয়তার বন্ধনে পরিণত হয়েছে। উপস্থাপক,
প্রযোজক সকলেই যেন বন্ধুজন। এখন আমার মেয়েও নিয়মিত যায়। ফলে সম্পর্কটা পারিবারিকই হয়ে
উঠেছে। সেদিন সকালে ট্রেন ধরার তাড়া, তৈরি হওয়ার অস্থিরতার মাঝেই হঠাৎ চোখে পড়ল স্ক্রিনে
লাইভ কথাটা লেখা নেই। কী ব্যাপার! ভাবলাম নির্ধারিত শিল্পী হয়ত একেবারে শেষ মুহূর্তে
অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই পুরোনো অনুষ্ঠান দিয়েই শূন্যস্থান পূরণ হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানের
মাথার ওপর কখনো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোপ নেমে আসবে, কখনো এই চ্যানেল উঠে যাওয়ার অবস্থায়
এসে দাঁড়াবে, এ তো কল্পনা করাই যায় না। যদিও ব্যবসার জগতের ওঠা নামায় সবই সম্ভব। এটা
আমাদের জীবনের মত। জানি, আমরা কেউই অমর নই, যে কোনও মুহূর্তেই মৃত্যু এসে সব কান্না
হাসি লীলা খেলা সাঙ্গ করে দিতে পারে, তাই বলে সর্বক্ষণ কি মৃত্যুর কথা ভেবে ভেবে বাঁচতে
পারি আমরা? পারি না। অবচেতনে নিজেদের মধ্যে অমরত্বের এক অলীক ধারণা বাসা বাঁধে।
পরদিনই সন্ধ্যায়, সঙ্গীতমেলায় এক তরুণশিল্পী বললেন, শুনেছেন? তারার লাইভ
অনুষ্ঠান তো বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে রাতে
ফোন করি তারা মিউজিকের এক বন্ধুকে। সেখান থেকেই জানতে পারি মালিক নিখোঁজ, ফোন বন্ধ।
এর আগে উনি জানিয়েছিলেন, চ্যানেল আর চালাতে পারবেন না। কর্মীরা তখন বলেছেন, চ্যানেলটি
নতুন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দিতে। ক্রেতা তারাই জোগাড় করবেন। মালিক প্রথমে রাজি হলেও
তারপর থেকে বেপাত্তা। কয়েকদিন ধরেই তারার কর্মীবন্ধুরা বাড়ি ফিরছেন না। অফিসে থেকে
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চ্যানেলটাকে চালু রাখতে। দুয়েক দিনের মধ্যেই তাঁরা সাংবাদিক
সম্মেলন করে শ্রোতার দরবারে, শিল্পীদের দরবারে তাঁদের কথা জানাবেন। আমি বলি, সারা পৃথিবী
জুড়ে এই চ্যানেলের প্রতি মানুষের এত ভালোবাসা! এই চ্যানেল কখনো বন্ধ হতে পারে না! বলি
ঠিকই, কিন্তু বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কা ক্রমেই জমাট বাঁধতে থাকে। শুধু ভালোবাসার শক্তি
দিয়ে এত বড় বাণিজ্যিক সংস্থাকে কীভাবে বাঁচানো সম্ভব! এটা সত্যিই ‘তারা‘-র শুভানুধ্যায়ী
সারা পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে শুভানুধ্যায়ীদের এক জায়গায় জড়ো করা যাবে
কী করে! সাংবাদিক বৈঠক করে বড়োজোর কয়েকটি সংবাদপত্র আর চ্যানেলের হাজার খবরের কোণে
একটু ঠাঁই পাওয়া যাবে, সেও তো স্থানীয় স্তরে। কিন্তু ‘তারা‘-র সংসার যে আবিশ্ব। তার
হৃদয়ের কান্না, চোখের জলকে সমস্ত আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারে এমন সংবাদ মাধ্যম
কোথায়!
আমরা কী তবে ‘তারা‘-হারা হয়ে যাবো! এ কথা মনে হতেই চলচ্চিত্রের মত অনেকগুলি
মানুষের মুখ সামনে ভেসে ওঠে। প্রথমে ভেসে ওঠে ‘তারা‘-র উপস্থাপকদের মুখ, প্রযোজকদের
মুখ, কর্মীদের মুখ। আর দেখবো না ওই লোগো, ওই সিগনেচার টিউন, দেখবো ওই প্রারম্ভিক কথা,
শুনবো না এক গভীর রুচিবোধের গান! তারপরই যেন ক্যামেরার চোখ কোণবদল করে। ভেসে ওঠে অসংখ্য
মানুষের মুখচ্ছবি। বাংলাদেশের শাহজাদপুরের ওই বোরখাপরা গ্রামীণ রমণী, রবীন্দ্র জন্মোৎসবের
হাজার হাজার মানুষের ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা করে এনে যে হাজির হয় মঞ্চের পেছনে। মুখের
সামনে থেকে বোরখার আবরণ তুলে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনেরে দেখছি তো আমি টিবির
মধ্যে, তারার প্রোগ্রামে। আমি অবাক! বাংলাদেশের শাহজাদপুরের এক গ্রামীণ রমণী, যার পৃথিবীর
বেশিরভাগটাই হচ্ছে তার গৃহকোণ, সেও আমাকে চেনে! সেও শোনে আমার গান! মনে পড়ে বর্ধমান-কলকাতা
এক্সপ্রেসওয়ের ধাবাতে দেখা হওয়া পুলিস অফিসারের কথা! ধাবা থেকে বেরোবার পথে আমাকে দেখেই,
যেন কতদিনের পরিচিত, বলে উঠলেন, আরে শুভ বাবু যে! সঙ্গী পুলিস অফিসারকে বললেন, চিনেছ?
সঙ্গীতশিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। খাকি পোষাক পরিহিত পুলিস অফিসার কবে আমার এতটা
পরিচিত হলেন? কোনও অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন কি তিনি? হয়ত তখন সাধারণ পোষাকে
ছিলেন। সাধারণ পোষাকের লোক উর্দি পরিহিত হয়ে এলে চেহারা পাল্টে যায়, এটা জানি। হঠাৎ-ই
চোখে পড়ল, বুকের নেমপ্লেটে লেখা নামটা! আরে, এই ভদ্রলোক কি তিনি যিনি নিয়মিত ফোন করেন
‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘? ভদ্রলোকই বাকিটা খোলসা করলেন, সেদিনের অনুষ্ঠানে আপনাকে যে
গানের অনুরোধ করেছিলাম, সেটা আমার বড়ো প্রিয়! ভদ্রলোক আর বেরিয়ে গেলেন না। ফিরে এলেন,
বসলেন আমাদের টেবিলেই। ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে সামনে পেয়ে গিয়েছি। আপনাদের একটু
সেবা করার সুযোগ দিতেই হবে‘। অনেক কথা। প্রতিদিন দেখেন ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘। সারারাত
চোর ডাকাতের পেছনে ছুটোছুটি করে এলেও সকালে কোয়ার্টার্সে ফিরে আগে দেখবেন ‘আজ সকালের
আমন্ত্রণে‘। তারপর ¯স্নান করে বিশ্রাম। একদিকে তিনি পুলিস অফিসার, অন্য দিকে বাংলা
গানের এক ব্যতিক্রমী শ্রোতা। যে কোনও যুগের যে কোনও বাংলা গানের উল্লেখ করলেই মুহূর্তের
মধ্যে বলে দেবেন কে গীতিকার, কে সুরকার, কে শিল্পী, কোন কোম্পানি, কবে বের করেছিল সেই
রেকর্ড। এই মানুষকে আমার চেনার কী কথা ছিল? জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি দেশের এক
প্রত্যন্ত অঞ্চলে। গান বাজনা যা করেছি, মূলত ওখানেই। আমার যা পরিচিতি, যা ‘খ্যাতি‘,
সবই ওই ভূগোলে! এই পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলের এক পুলিস অফিসার তিনি গরগর করে বলে যাচ্ছেন
আমার পরিচিতি তাঁর সঙ্গী পুলিস অফিসারকে। আমি অবাক, এতটাই পরিচিত আমি তাঁর কাছে!
মনে পড়ে, পুরুলিয়ার মানবাজারের সেই স্কুল শিক্ষককে, মনে পড়ে উত্তরবঙ্গের
রায়গঞ্জের ঘরের বউকে, মনে পড়ে বাঁকুড়ার সেই তরুণবন্ধুকে, মনে পড়ে মার্কিনমুলুকের হিউজটনের
বাংলাদেশী তরুণ জাকিরকে। জাকির ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘ অনুষ্ঠানে শুনেছিল আমার বাড়ি
বরাক উপত্যকা। বরাক উপত্যকা আর জাকিরের বাড়ি বাংলাদেশের সিলেটের বিয়ানি বাজারের দূরত্ব
খুব কম, মাঝে শুধু কাঁটাতারের বেড়া। আমার ফোন নম্বর কী করে জোগাড় করল জাকির, সেও এক
অসম্ভবের উপাখ্যান। তারপর থেকে ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘-র প্রতিটি পর্বের আগের রাতে জাকিরের
ফোন। ‘দাদা, কাল লাইন পাবো কী না জানি না, অমুক অমুক গান গাওয়া চাই-ই‘। কোথায় হিউজটনের
জাকির আর কোথাকার আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরের মালুগ্রাম পাড়ার, শুভ! এই যোগাযোগ কী
কখনো সম্ভব হত, যদি না তারা মিউজিক মধ্যে থাকত! বন্ধ হয়ে যাবে সেই চ্যানেল! এ সব ভাবতে
ভাবতেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছলাম বর্ধমানে। নাটক দেখতে গিয়ে
দেখা কবি অংশুমান করের সাথে। বলল, মন খুবই খারাপ। শ্রীজাতদের চাকরি শেষ হয়ে যাচ্ছে।
‘পরমা‘ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিন দিন ধরে মালিক ফোন সুইচঅফ করে উধাও। আমি বললাম, একই অবস্থা
তো তারা মিউজিকেরও। ও বলল, একই তো মালিক। সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন করি তারা মিউজিকের বন্ধুকে।
‘কিছু হল কি তোমাদের?‘ ও বলল, ‘না, শুভদা, এখনও কিছুই হয় নি। আমরা সাংবাদিক বৈঠক করি
নি। তবে কাল নববর্ষের সকালে আমরা একটা অনুষ্ঠান করছি। সব শিল্পীদের ডেকেছি। দেখো অবশ্যই।‘
পরদিন সকাল থেকেই ঘটে গেল অভূতপূর্ব অসম্ভব ঘটনাটি। নববর্ষের অনুষ্ঠানে
অশ্রুসজল চোখে উপস্থাপক জানালেন গভীর সংকটের মুখে তাঁদের চ্যানেল। তারা জানেন না কী
ভবিতব্য তাঁদের প্রতীক্ষায়। তবে প্রত্যয় যদি শিল্পীরা পাশে দাঁড়ান, শ্রোতা দর্শকরা
পাশে দাঁড়ান তবে তাঁরা নিজেদের প্রাণাধিক প্রিয় চ্যানেলকে বন্ধ হতে দেবেন না। বললেন,
তাঁরা সকলে কয়েকদিন ধরেই তাঁদের অফিস ছেড়ে যাচ্ছেন না। না, কাউকে কোনো দোষারোপ নয়,
কারো বিরুদ্ধে আঙুল তোলা নয়, শুধু বললেন এক বুকভরা বিষাদের কথা। চোখের জলে ভেসে যেতে
যেতে বললেন, এক আলো ঝলমল ভবিষ্যতে পৌঁছনোর প্রত্যয়ের কথা। শিল্পীরা, বাংলা গানের প্রথিতযশা
শিল্পীরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেন বাংলা গানের এক উন্নত রুচিকে তুলে ধরতে এই চ্যানেলের
অবদানের কথা। তাঁরা বললেন, তাঁরা আছেন সর্বান্তকরণে পাশে। বিশ্বাস করেন, এই চ্যানেল
কিছুতেই বন্ধ হবে না। অনুষ্ঠানের দৃশ্যপটও ছিল অভূতপূর্ব। সাধারণত অনুষ্ঠানচলাকালীন
অনুষ্ঠান প্রয়োজক ও কর্মীরা দৃশ্যপটে থাকেন না। সেদিন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। কোনও
আনুষ্ঠানিকতা নেই। পরতে পরতে যা আছে, তা এক অন্য আন্তরিকতা। অনুষ্ঠান চলছে, অপলক দেখছেন কর্মী প্রযোজকরা।
তাঁদের চোখেও জল। সারা পৃথিবী থেকে মানুষের সহমর্মিতার কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। বিষাদ ধীরে
ধীরে যেন কাটছে। কোথাও একটা সোনালী রেখা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কী সেই সোনালী রেখা কেউ
জানেন না। শুধু জানেন, মানুষ পাশে আছে।
এ সবই আমার শোনা। অনুষ্ঠানচলাকালীন আমি গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলাম বর্ধমান থেকে
কলকাতা। মুহূর্তে মুহূর্তে ফোন, ম্যাসেজ। কলকাতা থেকে শিলচর, গুয়াহাটি থেকে দিল্লি,
মুম্বই থেকে বাংলাদেশের ঢাকা, ঢাকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সকলের প্রশ্ন, কী সংকটে
পড়েছে তারা মিউজিক? তাঁরাই জানাচ্ছেন আমাকে অনুষ্ঠানের ধারাবিবরণী। শিলচর থেকে সম্মিলিত
সাংস্কৃতিক মঞ্চের সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস ফোনে বলছেন, আমরা শিলচর থেকে মাসে এক লক্ষ
টাকা তুলে পাঠাবো। কয়েক জন কর্মীর দায়িত্ব নেবো আমরা। চ্যানেলটা যেন বন্ধ না হয়। শিলিগুড়ি
থেকে একজন ফোন করে বললেন প্রায় কাঁদতে কাঁদতে, এতগুলো বছর ধরে আমার সকাল আর তারা মিউজিক
একাকার হয়ে গেছে। যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে আমার সকালের কী হবে! চলন্ত গাড়ি থেকে আমিও
ম্যাসেজ পাঠাই তারা মিউজিকের বন্ধুদের, এত এত মানুষের ভালোবাসা কখনো বৃথা যেতে পারে
না। আবার আশঙ্কায় ভুগি, পৃথিবীর দেশে দেশে যখনই কোনও মালিকের মর্জি হয়েছে তার শিল্পসংস্থা
বন্ধ করে দেবে, বন্ধ করে দিয়েছে। শ্রমিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মূল্য নেই এখানে। কয়েক
শ বছরের আধুনিক সভ্যতায় গণতন্ত্র যতই বিকশিত হোক, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে তার কোনও প্রভাব
নেই বললেই চলে। আবার এও ভাবছিলাম, এটা তো সাধারণ শিল্প কারখানা নয়। এখান থেকে মানুষ যা পায় তা খাবার জিনিস নয়, গায়ে পড়ারও নয়। এই শিল্পের যা সৃষ্ট বস্তু, মানুষ তা গ্রহণ করে হৃদয়ে।
সকালে যা সে হৃদয়ে ধরে, সারাদিন তাই বহন করে সে গড়ে তোলে তাঁর দৈনন্দিন। এ ভাবে ভোক্তাও শিল্পী হয়ে ওঠে। আশ্চর্য বাংলাভাষার অন্য সংবাদমাধ্যমগুলো এই নিয়ে নীরব। তবে পরের দিন জাতীয় স্তরের সংবাদপত্রে এই অভূতপূর্ব ঘটনার প্রতিবেদন বেরোল। সন্ধ্যে থেকে ‘তারা‘-র চ্যানেলের তলায় সংবাদ-শিরোনামে জানানো হযল, চ্যানেল বন্ধ হচ্ছে না, মুখ্যমন্ত্রী
পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। অসংখ্য মানুষ দেশ বিদেশ থেকে সম্ভাব্য ক্রেতার সন্ধান দিয়েছেন। এ ভাবেই চালু থেকে যায় তারা মিউজিক। এ এক ইতিহাস। অন্যদিকে, মালিকপক্ষ
চ্যানেলের সাথে ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে চ্যানেল
বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তাঁরা যেন হাত গুটিয়ে নেন। যাঁরা উপগ্রহ মারফৎ চ্যানেলের অনুষ্ঠানকে
মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন, জানানো হল তাঁদের, আপনারা সম্প্রচার বন্ধ করে দিন। না,
তাঁরা বন্ধ করলেন না। তারার কর্মীরা নিজেদের কর্মী সংস্থা গড়ে চ্যানেল চালিয়ে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুনে তারাও আপাতত টাকার কথা মূলতুবী রেখে চ্যানেল আপলিঙ্ক অব্যাহত
রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। একই সিদ্ধান্ত নিলেন বিজ্ঞাপনদাতারাও। শ্রোতা, শিল্পী, কর্মী-
এই ত্রয়ীর শক্তি যে ঘটনা ঘটালেন তা এক ইতিহাস। আগামীতে যাঁরা বিনোদনবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা
করবেন, ‘তারা‘ তাঁদের পাঠক্রমে এক ঝড়ের হাওয়ার পাঠ সংযোজন করল। কর্পোরেট বাণিজ্যের সাম্রাজ্যে
সাধারণ মানুষের সমবেত রুচিবোধ যেন গেরিলা আক্রমন চালিয়ে বাঙালির সঙ্গীতরুচির এক মুক্তাঞ্চলকে রক্ষা করল। কেউ কি কখনো ভাবতে পারেন সিরিয়ালসর্বস্ব যে সব চ্যানেলে সন্ধের পর থেকে
হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রামশহরের ঘরের মা বউরা, সেগুলোর কোনোটা বন্ধ হলে এ ভাবে সোচ্চার
হবেন সাধারণ দর্শক? মালিকের অন্যায় আক্রমনের মুখে গড়ে তুলবেন এমন দুর্বার মানব-ঢাল? বাংলা সঙ্গীত
চ্যানেল নাকি আরো আছে, যদিও সেগুলো দেখিই না প্রায়। এ গুলো বন্ধ হলে সামান্যতম ঢেউ কি উঠবে চরাচরে? শ্রোতা শিল্পী
ও কর্মীর এমন আত্মীয়তা গড়ে তুলেছে কি কোনো দেশবিদেশের চ্যানেল এর আগে?
ছোটবেলায় শিশুতোষ সব পাঠের শেষেই নীতিবাক্য থাকত। যে ভাবে শত্রুর মুখে
ছাই দিয়ে সাধারণ মানুষের সমবেত রুচিবোধের সম্মিলিত প্রতিরোধের সামনে জয়ী হল ‘তারা মিউজিক‘,
এই উপাখ্যানের নীতিবাক্যটি কী? একজন গাইয়ের পরিচয়ের বাইরে বিগত কয়েক দশক ধরেই আমার
পরিচয় একজন সাংস্কৃতিক কর্মীর। শিলচর, বর্ধমান, কলকাতা- সর্বত্রই নানা ধরনের অনুষ্ঠান
উৎসব আয়োজনের সাথে জড়িত হয়ে আছি বেশ কয়েকটি দশক ধরেই। অনুষ্ঠান সাজানোর কাজ করতে বসলেই
এক শ্রেণীর লোক সব সময় মনে করিয়ে দেন, আপনাদের রবীন্দ্র, নজরুল, শাস্ত্রীয় আর গভীর
বোধের আধুনিক গান ওগুলো সাধারণ মানুষ শোনে না। নতুন প্রজন্মকে ধরতে হলে, বেশিরভাগ মানুষকে
অনুষ্ঠানে টানতে হলে, একটু চটুল গান নাচ রাখতেই হবে। হাজার হোক গণতান্ত্রিক দেশে বেশিরভাগ
মানুষের রুচিকে সম্মান জানাতে তো হবেই!!
‘তারা মিউজিক‘-এর ঘুরে দাঁড়ানোর এই উপাখ্যান এমন মনোভাবের মুখে এক জোরালো চপেটাঘাত! বেশিরভাগ মানুষ কোন
গান কোন কবিতা কোন অনুষ্ঠানকে পছন্দ করে, কোন সংস্কৃতির জন্যে রাষ্ট্র, রাজ্য, অঞ্চল
নির্বিশেষে এমন উদ্বেল হয়ে ওঠে মানুষ, আমরা চোখের সামনেই দেখলাম। ‘তারা‘-র জয় মুষ্টিমেয়
রুচিহীনের বিরুদ্ধে সামাজিক মানুষের রুচিবোধের জয়। তারার জয় কর্পোরেট দেউলিয়াপনার
বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জয়। ‘সাধারণ‘-তন্ত্র রুখে দাঁড়ালে চুরমার হয়ে যায় কর্পোরেটতন্ত্রের
সব ছলাকলা। ‘তারা‘-র জয় তাই ফিরিয়ে আনে নি শুধু ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে‘-কে। এই জয়কে অনুভব করতে
গিয়ে দেখি আগের চেয়ে অনেকবেশি প্রিয় মনে হচ্ছে ভোরের আলোকে, পাখির গানকে, সন্ধের আকাশকে,
মানুষের মুখের হাসিকে। নববর্ষের সকালের চোখের জল এক শুভ্র পৃথিবীর দুয়ার খুলে দিয়েছে।
জয় অজানার জয়! জয় অসম্ভবের জয়!
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনতারা মিউজিক আমাদের হৃদয়ে থাকবে । কোন অশুভ শক্তি আর কোন
উত্তরমুছুনদিন একে বন্ধ করতে পারবে না ।
তন্ময়
বিষণ ভাল লাগল সুভদা এই লেখাটি। তারা বাচবেই, তারাকে বাচতেই হবে।
উত্তরমুছুনতারার সাথে ছিলাম , আছি , থাকব .........
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনসকলে বলছে "পাশে আছি, থাকব" কিন্তু কেমন করে? এখন ক্রেতার দরকার । কিন্তু এত ঋণের বোঝা বাজারে...জেনেশুনে কে কিনতে আসবে? মুখ্যমন্ত্রী যতই বলুন আসলে তো দরকার টাকার ! আর দরকার শাস্তির । অত্তগুলো মানুষের রুজিরোজগার যে চ্যানেলকে ঘিরে, তাদের কি হবে???
উত্তরমুছুনmegh kete jabei,amar biswas................
উত্তরমুছুনAlways with YOU Tara..always be with the Tara team.JoyBanglarJoy.Noor from dhaka-bangladesh
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনমেঘে ঢাকা "তারা" আবার রাতের অন্ধকার চিড়ে একদিন আকাশে জ্বলে উঠবে...এই বিশ্বাস আমি রাখি...
উত্তরমুছুন