সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৩

সুদীপ্ত নিমিত্ত মাত্র!


সারদা নামক বেলুনটি চুপসে গেছে। তারই হাত ধরে কারো কারো রাজনীতির নটেগাছটিও মুড়োতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। অন্তত, সততা ত্যাগ গরিবের প্রতি দরদের যে মুখোসটা ছিল তা ভেঙে পড়ছে, দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের মত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা, যারা পূর্বাভাস করেছিলেন, মোহভঙ্গটা শুধু সময়ের অপেক্ষা, ষোলো অব্দি গড়াবে না, তারা উৎফুল্ল। রাজ্যের রাহুমুক্তির দিন বুঝি ঘনিয়ে এলো। যারা রাহুমুক্তি ঘটাবেন, তারা নিজেরা কতটা অগ্নিশুদ্ধি সমাপন করেছেন, সেটা এখন আলোচনার কেন্দ্রে নেই। যারা তখ্ত আলো করে আছেন এই মুহূর্তে, তাদের অনেকের মনেই দিনান্তের আকাশ উঁকি মারছে। যারা মার খেয়ে তাড়া খেয়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা একটা সকালকে যেন খুব কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছেন। হয়ত কথাগুলি অসত্য নয়, বাস্তব হয়ত এমনই দিকে মোড় নিচ্ছে। একের পর এক নেতা কর্মী জড়াচ্ছেন জালে। নিঃস্ব মানুষের কান্নায় ভরে উঠছে আকাশ বাতাস। মিছিলে মিটিং-এ আবার স্বতস্ফূর্ত মানুষের সমাগম দেখা যাচ্ছে। সবই সত্যি! কিন্তু একজন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে আমার মনের ভেতর আরো কতগুলো কথা জাগে, এখনকার ঘটনাবলীকে আরো এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখি। ট্রেনে বাসে মানুষের কথাবার্তায় দূরস্থান কিংবা বাণিজ্যিক মিডিয়ার টান টান উত্তেজনার সংবাদ ও গরমাগরম আলোচনা বিতর্কের আসরে হয়ত এটার প্রতিফলন আশা করে লাভ নেই, কিন্তু বামপন্থীদের বক্তৃতা, আলোচনা, শ্লোগানে, মিছিলেও সেই কথাগুলি এখনও জোরালোভাবে ভাষা পেল না, সেটাই একটুখানি অবাক করা।


আমার অনেক দিন থেকেই মনে হচ্ছে, পশ্চিমবাংলায় রাজনীতি থেকে রাজনীতিকে বর্জন করে শুধুমাত্র কতগুলো গা-গরম করা সংবাদ, কেউ-কারো-কথা-না-শোনা তর্ক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা কুতর্ক - এগুলো দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে রাজনীতিটা যেন মমতা আর সিপিএম-এর দ্বৈরথ। কবে কোন আলোচনায় মমতা একটু কোণঠাসা হলেন, কবে আবার সিপিএম নেতারা হঠাৎ কোনও ঘটনার সূত্রে একটু বেকায়দায়, বা কিঞ্চিৎ আমতা আমতা করছেন, সেটাই এখন সংবাদ, সেটাই এখন সব আলোচনার কেন্দ্রে। অর্থনীতি, রাজনীতির যে বৃহত্তর বিষয় এবং তার নিরিখে বিভিন্ন দল ও নেত্রানেত্রীর অবস্থান, এই আলোচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। যে সমস্ত নেতা বা আলোচকরা একটু ধীর-স্থির বা উচ্চকন্ঠে কথা বলতে পছন্দ করেন না, তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই এই ছোট পর্দার আলোচনা নামক চেঁচামেচির আসরগুলিতে পার্সনা ননগ্রাটা। এখানে তারাই আসেন, যারা প্রতিদিন আসেন। শিল্পী আক্রান্ত হলে যে প্যানেল, চিটফা- কেলেঙ্কারিতেও একই প্যানেল। সন্ধে হলেই তারা গলা সেধে হাজির হন। সবার একেকটা পক্ষ নির্দিষ্ট রয়েছে। যাই ঘটুক না কেন, সকলে যার যার নির্দিষ্ট পক্ষের হয়ে গলা ছেড়ে সাফাই গাইবেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা কোনও আলোচনার অনুষ্ঠান নয়, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলার সরাসরি সম্প্রচার। যাঁরা একটু অন্যরকম, ধীরে কথা বলেন, চাতুরি নয়, হৃদয় থেকে বলতে পছন্দ করেন, কখনো হয়ত একটি পক্ষের প্রতি দায়বদ্ধতা সত্ত্বেও একটু অন্যভাবে কথা বলতে চান, তারা এখানে ব্রাত্য। সবসময়ই একটা ডু অর ডাই ব্যাটল। ফলেই সন্ধে হলেই টান টান উত্তেজনা, একেক দিন একেকটি পর্দাফাঁস এবং তৎসঙ্গে গলাবাজী!


এখন মিডিয়া গরম সুদীপ্ত-দেবযানী নিয়ে। কোন্ চিঠিতে কার দিকে অঙ্গুলি নির্দিষ্ট হচ্ছে, ফলে কারা ল্যাজে-গোবরে হচ্ছে থেকে শুরু করে আজ দেবযানী চা খেলেন, না পিৎজা খেলেন, এই সমস্তই আলোচনার বিষয়। একটি সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে, দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে দেবযানীর দাঁত ঠিকঠাক করা হলেও এখনও হাতে মুখ দিয়ে কথা বলার আশৈশব মুদ্রাদোষ দেবযানীর যায় নি। যেন একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য একটু একটু করে বলা হচ্ছে। ছবির হিরো সুদীপ্ত, প্রধান নায়িকা দেবযানী। জেমস বন্ডের মত নায়িকা আরো অনেক। ললিতা পাওয়ার, জীবন, প্রেম চোপড়া, প্রেমনাথের ভূমিকায় রাজ্যের শাসক দলের কেষ্টবিষ্টুরা। কেলেঙ্কারি ফাঁস হচ্ছে!


সুদিন এল বলে! বামপন্থীদের জন্যে বিষয়টা কী এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে? কিংবা সাধারণ মানুষ কি শুধু একটি চলচ্চিত্রের দর্শক হয়েই থাকবেন? নাকি আরো বৃহত্তর ও গভীরতর সমাজসত্য সম্পর্কে তাঁদের ওয়াকিবহাল হওয়াটা তাদের জন্যে এখন জরুরি। মিডিয়ার পর্দায় আর পাতায় যে ভাষায় কিংবা বাস্তবতার যে উপরিতলের চর্চার মধ্যে দিয়ে আজকের সর্বনাশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বামপন্থীদের মিটিং মিছিল কি সেই সুরেই বাঁধা থাকবে শুধু? যে বৃহত্তর ও গভীরতর সমাজসত্যটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, সে সম্পর্কে বামপন্থীরা ছাড়া আর কে মানুষকে সচেতন করবে!


এটা সত্য ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আসার পর পশ্চিমবাংলায় সরকারি ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং সরকারি প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সজ্ঞানে বেসরকারি চিটিংবাজ অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলিকে গরিবের টাকা লুঠ করতে দেওয়া হয়েছে। দল হিসেবে তৃণমূল এবং নেত্রী হিসেবে মমতা এই সর্বনাশের জন্যে সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু যে সর্বনাশা অর্থনৈতিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে এ ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি গরিবের ধন হরণ করার সুযোগ পায় তাকে ভুলে গেলে চলবে না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৯১ সাল থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে আর্থিক উদারীকরণের নীতি ভারতে চালু করেছে, সেই নীতির প্রতি আস্থাপ্রকাশে কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে চরিত্রগত দিক থেকে বিশেষ ফারাক নেই। কেউ একটু ধীরে চান, কেউ চান দ্রুত, এই যা তফাৎ। দেশের আর্থিক কাঠামোর বড়লোকমুখী এই উদারীকরণের নীতি নিয়ে তারা দু‘দলই গদগদ। আমরা এটা জানি, নয়া উদারনীতির লক্ষ্যই হচ্ছে, বুনিয়াদি শিল্পে বিনিয়োগের চাইতে শেয়ার বাজারে তরল বিনিয়োগে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোমড় ভেঙে দিয়ে বেসরকারি ফাটকাবাজদের উৎসাহিত করা। নয়া উদারবাদ চায়, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের টাকা যাক শেয়ার বাজারে এবং গরিবের টাকা ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প ছেড়ে চিট ফান্ড বা অন্য চটজলদি লাভের মরীচিকা দেখানো প্রতিষ্ঠানের দিকে ছুটুক। এই লক্ষ্য নিয়েই দিনের পর দিন, কি কংগ্রেস কি বিজেপি, সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিরাষ্ট্রীয়করণ করতে চেয়েছে। অলাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেচে দেওয়ার আওয়াজ দিয়ে শুরু করে শেষ পর্যন্ত জোর দিয়েছে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে জলের দরে বেচে দিতে। ব্যাঙ্ক বীমা থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের স্পর্শকাতর পরিসরগুলিতে দেশি বিদেশি বেসরকারি পুঁজিকে ঢালাও আমন্ত্রণ জানিয়েছে। গ্রামে শহরে ফাটকাবাজদের রমরমার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে।

এই নীতির নিষ্ঠাবান প্রয়োগের জন্যেই আজ সারদাদের উত্থান ও গরিবের এই দুরবস্থা। এখন পর্যন্ত যে দুরবস্থাকে ঠেকিয়ে যাওয়া গিয়েছিল, তা প্রধানত বামপন্থীদের জন্যেই। কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছিলাম মার্কিন মুলুক সহ বেশিরভাগ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শেয়ার বাজারের ধ্বসের সাথে ওই দেশগুলিতে অর্থব্যবস্থার ওপর প্রগাঢ় ধাক্কা লেগেছিল। ভারত সে যাত্রায় বেঁচে যায়। এ নিয়ে মনমোহন প্রণববাবুরা যথেষ্ট ‘হেঁ হেঁ‘ দেখিয়েছেন সাধারন্যে, কিন্তু প্রকৃত সত্যটি বলেন নি। প্রথম ইউপিএ সরকার যদি বামপন্থীদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল না হত, তবে আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি অনেক আগেই বেচে দেওয়া হত। ব্যাঙ্ক বীমা শিল্পে দেশি বিদেশি পুঁজিপতিদের রররমার সাথে দেশের শেয়ার বাজারে সারা পৃথিবীর তরল অর্থের আগম হত এবং শেয়ার বাজারের ওই ধ্বস এলে ভারতও ভেসে যেত। ওই বিপর্যয় যে হয় নি, তার জন্যে কৃতিত্ব মনমোহন চিদাম্বরম প্রণববাবুদের নয়। কৃতিত্ব প্রাপ্য বামপন্থীদের। প্রথম ইউপিএ-তে বামপন্থীদের কার্যকরী বাধাদানের কর্মকাণ্ড না থাকলে কবেই দেশি-বিদেশি ফাটকবাজদের মৃগয়াভূমিতে পরিণত হত ভারত।


সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে যে বিপর্যয়টি এসেছে, সেটাও বামপন্থীদের জমানায় হয় নি। নীতিগতভাবেই বামফ্রন্ট সরকারের সময় ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলির স্বপক্ষে দাঁড়িয়েছিল সরকার। নব্বইয়ের দশকে এই নীতিগত অবস্থান থেকেই বহুবিধ ফাটকাবাজ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দিয়েছিল সরকার। কার্যকরী এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থেই প্রণয়ন করার চেষ্টা হয়েছে আইন প্রণয়নের। মূলত এই কারণেই ২০০৮ সালের পর থেকে যে সমস্ত শক্তি বুঝতে পেরেছিল সবাই মিলে লাগলে বামফ্রন্টকে হঠানো সম্ভব, তারা সকলে জোট বাঁধছিল। এই জোটে সারা দেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমাজকর্মী থেকে ছোট বামপন্থী, শিল্পী বুদ্ধিজীবী থেকে শিল্পবাণিজ্য মহল একত্রিত হয়েছে। বামেরা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে নিশ্চিতই নিজেদের সুদিন আসবে এটা জেনে এই জোটে যোগ দিয়েছে সুদীপ্ত সেনদের দল। এখন বর্তমানে সরকারের হালহকিকতে বিরূপ হওয়া এক শ্রেণির শিল্পী বুদ্ধিজীবী নানা কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু যখন ২০১১-এর নির্বাচনের আগে তৎকালীন মন্ত্রী গৌতম দেব এই চিট ফা- কোম্পানিগুলি ও তৃণমূলের অশুভ আঁতাতের কথা বলেছিলেন তখন তাঁকে ব্যঙ্গ করেছিলেন এঁরা প্রত্যেকে। পয়লা বৈশাখের আগে মমতা জানতেন না কথাটা যত বড় মিথ্যে, তার চেয়ে কম মিথ্যে নয় একদা পরিবর্তনপন্থী, বর্তমানে মমতা-বিরূপদের ‘তখন বুঝতে পারি নি‘ বলা।
           

ক‘দিন থেকেই ভাবছিলাম, এই বিপর্যয় নিয়ে এত কথা হচ্ছে চারদিকে, কিন্তু কেউ এটা বলছে না কেন, এটা নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। আজ মমতা ক্ষমতায় না থেকে অন্য কোনও নয়া উদারনীতির সমর্থক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলেও তো একই হত। হয়ত মমতা থাকায় সর্বস্তরের চটজলদি লুটপাটের সংস্কৃতিটা একটু বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে। গতকালই কোনো একটি কাগজে দেখলাম বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ সিপি চন্দ্রশেখর বলেছেন, চিট ফাণ্ডের রমরমার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিও দায়ী। ডাক বিভাগের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের সুদের হার কমিয়ে দেওয়ার জন্যেই প্রাথমিকভাবে চিট ফাণ্ডগুলির কর্মতৎপরতা বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আজকের গণশক্তিতে আরেকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক একটি নিবন্ধে বলেছেন আরো কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, ফ্যাসীবাদীরা প্রথম অবস্থায় একটি বাম মুখোস পড়ে হাজির হয়। তাদের কথাবার্তায় থাকে নানা ধরনের পুঁজিপতিবিরোধী গরিবদরদী বক্তব্য। ইতিহাস দেখিয়েছে, এতে ওই সময়েও অনেক প্রগতিপন্থী শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা প্রলুব্ধ হন। তাঁদের মনে হয় এই ফ্যাসীবাদীরা বামপন্থীদের চেয়েও বেশি বামপন্থী। আন্দোলন সংগ্রামের নতুন নতুন আগ্রাসী কর্মসূচিতে মনে হয় জনসাধারণের দুঃখদুর্দশা নিয়েও বুঝি এরা অন্য সবার চাইতে বেশি মুখর। তারপর এরা একবার ক্ষমতায় এলে পুঁজির সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীতদাসে পরিণত হয়। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে এদের কর্মতৎপরতা, শক্তিসঞ্চয় এবং সবশেষে ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতায় এসে তারা প্রথমেই আঘাত হানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলে। হরণ করতে থাকে একের পর এক গণতান্ত্রিক অধিকার। ক্ষমতায় আরোহণের পথে এদের বামমুখোসকে বিশ্বাসযোগ্য করতে যাদেরকে সাথি হিসেবে বেছে নিতে হয়, ক্ষমতায় এসে এদেরকেই টুঁটি টিপে হত্যা করে ফ্যাসীবাদীরা। বিগত শতকের চল্লিশের দশকের জার্মানি ইতালি ও অন্য দেশের ফ্যাসীবাদী শক্তির পর্যালোচনা করে যে কথাগুলি লিখেছিলেন বুলগেরিয়ার প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা জর্জি ডিমিট্রভ, সে কথাগুলি কী আশ্চর্যভাবে সত্য হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ইতিহাসে! আমাদের নিশ্চয়ই ভুলে যাই নি, ২০০৮ থেকে ২০১১ কীভাবে পশ্চিমবাংলায় কৃষক দরদি, গরিব দরদি পুঁজিপতিদের লুন্ঠন বিরোধী এক গণতান্ত্রিক ঝড়ের পাখি হিসাবে নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিভাত হয়েছিলেন বাণিজ্যিক মিডিয়া ও শিল্পী-বুদ্ধিজীবী মহলে। তাঁর মুখের অসংযত ভাষা, এককেন্দ্রিক কর্মপদ্ধতি, কথায় কথায় হিংসাত্মক ধর্মঘট, এ সমস্ত কিছুই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল এক শ্রেণির বামপন্থীদের কাছেও। ক্ষমতায় আসতে না আসতেই ধর্মতলার তথাকথিত অনশনের মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ছোট বামপন্থী নেতা নেত্রীরা একে একে ঘাড়ধাক্কা খেলেন। জঙ্গলমহলে বন্দুক নাচানো কিষেণজী লাশ হয়ে গেলেন। ছত্রধর যেমন জেলে ছিলেন তেমনই রইলেন জেলে, জঙ্গলমহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীও রইল। একদিন যিনি টাটার কারখানার জন্যে সরকারি জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন, ক্ষমতায় এসে তিনিই পশ্চিম বাংলার গ্রাম শহরে লেলিয়ে দিলেন জমি হাঙরদের। চিট ফা- কোম্পানিদের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা সরকারি আশীর্বাদপ্রাপ্ত হল। একদিন যিনি গোবিন্দপুর গিয়ে উচ্ছেদ হতে যাওয়া মানুষের দুঃখে কেঁদে চেঁচিয়ে ভাসিয়েছেন, ক্ষমতায় এসেই তিনি নোনাডাঙা লোবা ঘটালেন। এই সত্য জানে কিষেণজীর লাশ, জানে হাজতবাসী-মাওবাদী দেবলীনা, জানেন একদা পরিবর্তনপন্থী চিত্রশিল্পী সঙ্গীতশিল্পীরা, আর মর্মান্তিভাবে জানে লক্ষ লক্ষ প্রতারিত নিঃস্ব গরিবমানুষেরা।


এই সমস্ত ঘটনার মধ্যেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে। খবরের কাগজে টেলিভিশন চ্যানেলে শিল্পবাণিজ্য মহলের আলোচনা সভাগুলিতে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভারতবর্ষের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গুজরাট নাকি উন্নতির অগ্রগতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষ নাকি বাঁচবে যদি নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী হন। যেন তিনি আরএসএস নন। যেন তার রাজ্যে সরকারি ষড়যন্ত্রে সংঘটিত গণহত্যায় দশ হাজার মানুষ প্রাণ দেয় নি। যেন তার রাজ্য মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বহু পেছনে নয় অর্থাৎ শিক্ষা স্বাস্থ্য গ্রামোন্নয়ন অনুসূচিত জাতি সংখ্যালঘু উন্নয়নের নানা কর্মসূচির রূপায়ণে যেন বহু রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে নেই গুজরাট। সব ভুলিয়ে দিতে একটি কৃত্রিম আধুনিক মুখচ্ছবি তৈরির উদ্দেশ্যে জিনস ও টি-শার্ট পরে সমুদ্রতীরে পায়চারিরত নরেন্দ্র মোদির ছবি প্রচারিত হচ্ছে মিডিয়ায় মিডিয়ায়। স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী নিয়ে এমন ধরনের প্রচার আর কখনো হয়েছে বলে জানি না। ভারতবর্ষের সংসদীয় ব্যবস্থায় মার্কিনি রাষ্ট্রপতিধাঁচের সরকারি সংস্কৃতি আমদানি হচ্ছে। আমাদের রাজ্যেরও বাণিজ্যিক সংবাদ মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে যে আদিখ্যেতা হচ্ছে তা দেখে ২০১১-পূর্ব তাঁদের মমতা-বন্দনা ও মমতা-ভাবমূর্তি নির্মান কর্মসূচির কথা মনে পড়ছে। কেন নরেন্দ্র মোদি? কারণ তিনি এই মুহূর্তে নয়া উদারবাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেবক, আর্থিক সংস্কারের সোচ্চার সমর্থক। তিনি ক্ষমতায় এলে খোলাখুলিভাবে নয়া উদারনীতির নীতি প্রয়োগ করা হবে। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সবই বাধাহীনভাবে চলে যাবে বেসরকারি হাতে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতে ধনীদের স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিটি দলকেই নির্বাচনের আগে গরিবের কথা বলতে হয়, নানা ধরনের দারিদ্র দূরীকরণের আওয়াজ দিয়ে ভোটের আসরে নামতে হয়েছে। এই প্রথম কোনও একজন প্রার্থীকে সামনে রেখে একটি দল সরাসরি শিল্পবাণিজ্য মহলের প্রবক্তা হিসেবে ভোট চাইতে নেমেছে। ষাটের শেষে পিলু মোদি, বিজু পট্টনায়েকদের স্বতন্ত্র পার্টি এবং জনসঙ্ঘ জোটও বোধহয় এমন আগ্রাসী দক্ষিণপন্থা নিয়ে ভোটের আসরে সেদিন নামে নি।


মোদি এবং মমতা, দুই-ই নয়া উদারবাদের মুখ। ফ্যাসীবাদের ভিন্ন ভিন্ন চেহারা। একজন প্রথমে জনদরদের মুখোস পরে পরবর্তীতে লুম্পেন-নির্ভর অগণতান্ত্রিকতার একনিষ্ঠ সেবক। রাজনীতি থেকে শিষ্টাচার সৌজন্য শিক্ষাদীক্ষাকে নির্বাসন দিয়ে গা-জোয়ারি মস্তানিকে প্রতিষ্ঠিত করাই তার পথ। আরেকজন তীব্র সংখ্যালঘু বিদ্বেষ, পাশ্চাত্য বিদ্বেষ, সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধে আপাদমস্তক ডুবে থাকা নেতা পরিকল্পিত অপপ্রচারের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চরম দক্ষিণপন্থা প্রতিষ্ঠায় তৎপর। মমতা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এক অভূতপূর্ব কেলেঙ্কারি দেখল পশ্চিমবাংলা, নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলে নয়া উদারনীতির জোয়ারে ভাসবে দেশ। শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিষেবা সমাজ উন্নয়ন- সমস্ত ক্ষেত্রের দখল নেবে দেশি বিদেশি পুঁজিবাদী রাঘব বোয়ালরা। জনকল্যাণের সমস্ত পরিসর থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেবে রাষ্ট্র। অতীতে আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারের পতনেও যে সার্বিক আর্থিক বিপর্যয় গ্রাস করতে পারেনি ভারতকে, তাও বাস্তব হয়ে উঠবে।


ফলে সুদীপ্ত নিয়ে আলোচনায় টেলিভিশনের পর্দায় যখন কংগ্রেস বিজেপির নেতারাও নানা কথা বলেন, তখন প্রশ্ন ওঠা উচিত, যারা নয়া উদারনীতির প্রবক্তা তাদের কতটা অধিকার আছে সবহারা নিঃস্ব মানুষগুলির হয়ে কথা বলার। এ ক্ষেত্রে তৃনমূল, কংগ্রেস এবং বিজেপি একই জায়গাতেই অবস্থান করছে।
           

গরিব মানুষদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্দোলন হতেই হবে। দোষী চিট ফাণ্ড ও তাদের রাজনৈতিক মদতদাতাদের শাস্তির দাবিতেও আন্দোলন হতে হবে। কিন্তু এই আন্দোলনেই আওয়াজ তুলতে হবে সর্বনাশা আর্থিক উদারীকরণের নীতি অবিলম্বে প্রত্যাহারের। নয়া উদারনীতিবাদের কুফলকে গ্রাম শহরের সাধারণ গরিব খেটে খাওয়া মানুষকে বুঝিয়ে বলার মত এতটা অনুকূল পরিস্থিতি বোধহয় এর আগে কখনো আসে নি। সেজন্যেই একটি যথার্থ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব এখন বামপন্থীদেরই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন