মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৩

নববর্ষকথা



আবার একটি নতুন বছর এল। বাংলা নতুন বছর। এই সময়ে শুধু বাংলা নয়, অবিভক্ত ভারতের নানা প্রান্তেই নানা জাতির নববর্ষ অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। বাংলা নববর্ষের শুরু কবে এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন সম্রাট আকবর এই সনের প্রচলন করেছিলেন। মূলত খাজনা আদায়ের ব্যবস্থার সুবিধের জন্যে হিজরী চান্দ্র মাসকে তিনি সৌর মাসে পরিবর্তন করেন। আবার কারো মতে এই সনের জন্ম সুলতানী আমলে। কেউ আবার তিব্বতের একজন রাজা এই সন প্রবর্তন করেছেন বলে দাবি করেন। সাম্প্রতিক সময়ের একটি গবেষণায় বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে বিক্রমপুরের রাজা দ্বিতীয় বল্লাল সেনের নাম উঠে এসেছে। এই বল্লাল সেন সেন বংশের কেউ নন। ইনি আরাকান অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে ঢাকা বিক্রমপুর অঞ্চলে রাজত্ব স্থাপন করেন।  তিনি মঙ্গদ রায়, মুকুট রায়, রাজা ধর্মপাল ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন। দিল্লীর মোগল সম্রাটদের প্রতি বশ্যতা ব্যক্ত করে তিনি সপরিবার ও সপরিজন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেও তিনি আরাকানের সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ ধর্মের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এর আগে ফসল কাটার সূত্র ধরে বঙ্গদেশে অগ্রহায়ণ মাসে নববর্ষ পালিত হত। বৌদ্ধদের জন্যে বৈশাখ মাস বিশেষভাবে পবিত্র, যেহেতু এই মাসের পূর্ণিমাতেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি এবং দেহত্যাগ। আরাকান অঞ্চলের লৌকিক সনের ক্ষেত্রেও সেজন্যেই বৈশাখ মাস দিয়েই বছর শুরু হয়। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনও বাংলা সনকে মগী সন বলা হয়, যা তার আরাকানি উৎসের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নববর্ষের উৎস নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। পণ্ডিতেরা এ নিয়ে গবেষণা করে আমাদের সঠিক তথ্য দেবেন। আমরা তার প্রতীক্ষায় থেকে নববর্ষ সম্পর্কে কয়েকটি অন্য কথা বলতে পারি। 
            
একটি বিষয় আমাদের মধ্যে আগ্রহের জন্ম দিতে পারে। দেশের অন্য প্রান্তে আয়োজিত নববর্ষ অনুষ্ঠানের মধ্যে যদি আমরা একটি সাংস্কৃতিক আবহমানতা খুঁজে পাই, বাংলার ক্ষেত্রে, বাংলা বলতে বোঝাচ্ছি ধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় পরিচয় নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর বঙ্গভাষীদের, তাঁদের কাছে নববর্ষ শুধু মাত্র এক ঐহিত্যের সংরক্ষণ নয়। এর সত্য আরো গভীরতর এবং বৃহত্তর। সম্ভবত বাঙালিরাই প্রথম ঐহিত্য বা আবহমানতার মধ্যে থেকেও নববর্ষকে এক নতুন তাৎপর্যে উপস্থিত করেছে। ফলে, যদি শুধুমাত্র কতগুলো আচার আর উৎসবমুখরতাকেই একমাত্র নববর্ষের বৈশিষ্ট্য হিসেবে না দেখি, তবে দেখব সমকালীন পৃথিবীতে বাঙালিকে সমাজপথে জীবনপথে চালিত করার ক্ষেত্রে নববর্ষ একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে এর আগে একটি কথা বলা আবশ্যক। নববর্ষ পালিত হতে পারে, দু’টি ভাবে। প্রথমত, কতগুলি আচারের পুনরাবৃত্তি, উৎসবমুখরতার কতগুলি প্রতীককে পুনরাবৃত্ত করার মধ্য দিয়ে। যে ভাবে পালিত হয় ধর্মীয় নানা কৃত্য বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে একইভাবে কৃত্যপালনের মধ্য দিয়ে। আরেকটি পন্থা হতে পারে বিচারের। সমকালের বুকে দাঁড়িয়ে আবহমানের দিকে তাকানো। তাকে হৃদয়ে বসিয়ে আবার বাইরে এনে নতুন করে সাজিয়ে তোলা। আবহমানের যা কিছু পরিত্যাজ্য, তাকে নির্দ্বিধায় ত্যাগ করা আর আবহমানের যা কিছু নতুন হয়ে ফুটে ওঠার শক্তি রাখে, তাকে বরণ করা। নববর্ষ এ ভাবেও পালিত হতে পারে। আমরা কীভাবে দেখবো নববর্ষকে।   

আসলে, জীবনকে দেখারই নানা ধরন রয়েছে আমাদের সামনে। কিংবা কথাটাকে বলা উচিত, আবহমান কাল থেকেই জীবনকে দেখার দু’টি পন্থা রয়েছে। আচারের এবং বিচারের। ব্যক্তি, সমাজ, জীবন, সভ্যতা- সবকিছুকেই আমরা দেখতে পারি, বুঝতে পারি দু’ধরনের দৃষ্টি দিয়ে। একটি আচারের দেখা, আরেকটি বিচারের দেখা। আমরা কীভাবে দেখবো, কোন্টি আমাদের জীবনাদর্শ হওয়া উচিত? সভ্যতার প্রত্যুষকাল থেকেই এই দু’টি পন্থা আমাদের ঘিরে রেখেছে। এদের একটি আমাদের মুক্তির দিকে প্রাণিত করেছে, আরেকটি আমাদের আটকে রেখেছে বন্ধনে। ধর্ম, রাজনীতি, নন্দন, সমাজবোধ- সর্বত্রই এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব। ধর্মের ইতিহাসে আমরা দেখেছি, যখনই কোনও একটি ব্যবস্থা আচারের বেড়ায় আটকে পড়ে জীবনের সহজাত প্রবাহকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে, তখনই এক উন্নত বিচারবোধের আলোয় একটি নতুন ধর্মবোধ আত্মপ্রকাশ করেছে। এই আবির্ভাব ঘটেছে কখনো একটি ধর্মের অভ্যন্তরের সংস্কার আন্দোলনে, কখনো বা সম্পূর্ণ নতুন একটি ধর্মের চেহারায়। এই নতুন ধর্মবোধ যখন আবার সমাজের স্থিতাবস্থার রক্ষক হয়ে আচারের গ্রাসে পড়েছে, তখনই আবার সামাজিক বিদ্রোহের চেহারায়, নতুন ভাব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে নতুন ধর্মবোধ। আবির্ভাব ও তিরোভাবের এই চিরন্তন দোলায় এ ভাবে নতুন নতুন রূপ ধারণ করেছে রাজনীতি, সমাজবোধ, নন্দনও। এই যাত্রাপথে আচারসর্বস্বতার ভূমিকা প্রতিক্রিয়ার, আর মানুষের সামূহিক ও ব্যক্তিগত বিচারবোধ প্রগতির পতাকা উর্ধে তুলে ধরেছে। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই আমরা সমান্তরাল দু’টি ধারাকে প্রবহমান দেখি। একটি ধারা তার সংগঠিত রূপ, আরেকটি লৌকিক। সংগঠিত ধর্ম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আচারের শৃঙ্খল দিয়ে মানুষকে বাঁধতে চায়। অন্যদিকে লৌকিক ধর্ম মূলগতভাবেই বিচারবোধে বিশ্বাসী। রবীন্দ্রনাথের চণ্ডালিকার গানে আমরা শুনেছি, ‘ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ, ও যে চণ্ডালিনীর ঝি/ নষ্ট হবে যে দই সে কথা জান না কি?’ এখানে আমরা শুনি আচারের কন্ঠস্বর। ওই নৃত্যনাট্যেই শুনি ‘যে মানব আমি, সেই মানব তুমি কন্যা/ সেই বারি তীর্থবারি যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে’। এই স্বরটিও ধর্মের, তবে এই ধর্ম এক বিচারবোধের। আচারের ধর্ম যুগে যুগে বিচারের ধর্মকে গ্রাস করতে চেয়েছে। ফলে সংঘাত এসেছে, কখনো আচারের জয় হয়েছে, কখনো বিচারের। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি সমাজের কথা ভেবেছিলেন যেখানে চিত্ত যেখানে ভয়শূন্য, যেখানে আচারের মরুরাশিতে বিচারের গতিধারা হারিয়ে যায় নি।

একটি কথা মনে আসা স্বাভাবিক। নববর্ষের প্রেক্ষিতে এই কথাগুলির প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু। প্রাসঙ্গিকতা এখানে, আমরা নববর্ষ পালনকে কী শুধুমাত্র কতগুলো কৃত্য পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব? নববর্ষ পালন ইলিশ মাছ, পান্তাভাত, নতুন কাপড়, হালখাতা এগুলোতেই আটকে থাকবে? নাকি সমকালের মাটিতে দাঁড়িয়ে জীবনের নানা ক্ষেত্রে আমরা যে প্রত্যাহ্বানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তার নিরিখে আমাদের নববর্ষ পালনকে দেখবো? বাংলা নববর্ষ যে-ই প্রচলন করে থাকুক, বাংলা সনের আত্মপ্রকাশও একটি নির্দিষ্ট সময়পর্বে একটি বিচারবোধের আলোতেই ঘটেছিল। রাজ্যশাসনের বাস্তব চাহিদার সাথে সামাজিক মানুষের আচার উৎসবের মিশেল ঘটিয়ে তৈরি হয়েছিল বাংলা সন। পরবর্তীতে এই উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে কতগুলি আচার তৈরি হয়েছে। পূর্ববঙ্গে গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে যখন ওখানকার বাঙালিরা নিজেদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করছে ধার্মিকতার বাইরে বেরিয়ে এসে, তখনই বর্তমান কালের নববর্ষের আদল তৈরি হয়। এই সৃজন এতটাই সময়োপযোগী ছিল যে কালক্রমে সামাজিক মানুষ এই উৎসবকে নিজেদের একান্ত উৎসব হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই উৎসবের মধ্যে একই সাথে মিশে আছে ঐতিহ্য ও সমকাল। ফসলকাটার উৎসবের আচার, বাংলার লোকশিল্প, লোকখাদ্য এগুলির সাথে সমকালীন অসাম্প্রদায়িক আদর্শের আহ্বানকে এই উৎসবের মধ্যে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন নববর্ষকেই বলতে পারি আচারের কারাগার থেকে মুক্ত বিচারবোধের মুক্তচর্চার নববর্ষ।
বাংলার ভারতীয় অংশে নববর্ষকে ঘিরে এমন বিচারবোধের প্রকাশ এখনও সীমিত। এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখনও নববর্ষ মানে গণেশ পুজো, হালখাতা ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের নির্মানের কাজটির গুরুত্ব এখানেও অপরিসীম। যে কোনও প্রগতিশীল চর্চা, রাজনীতি হোক কিংবা সংস্কৃতিই হোক, এখানে পূর্ণতা পাবার পথে আটকে যাচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতার সামাজিক সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবের জন্যে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এবং পরে নিজেকে সরিয়ে আনার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ব্যাধির প্রতিকারের কথা বলেছিলেন, তার উদ্যোগ আমরা নিতে পারি নববর্ষকে উপলক্ষ্য করেই। ধর্মনির্বিশেষে বাঙালিদের সামাজিক মিলনের সেতু বাঁধার উৎসব হয়ে উঠতে পারে নববর্ষ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন