মঙ্গলবার, ২১ আগস্ট, ২০১২

ঈদের গান

এমন একটি বিষয়ে লিখতে যাচ্ছি, যা হয়ত অনধিকার চর্চাই। প্রথমত, ঈদ একটি ধর্মীয় উৎসব এবং যে ধর্মমতের উৎসব এই ঈদ, সেটি আমার প্রতিবেশীর ধর্ম। যে ধর্মমতে আমি জন্ম নিয়েছি তা থেকে সেই ধর্ম ভিন্ন। তারপর যৌবনের পর থেকে আমার পথ ধর্মের গতানুগতিক পথ থেকে ভিন্নতর দিকে ঘুরে গেছে। সে পথেরও শেষ কোথায় আমি জানি না, যেমন জানেন না আমার আবিশ্ব সহ-পথিকরাও। আবার ধর্মের পথ কোথায় গিয়ে মেশে তাও আমার অজানা। সেটা কোথাও মেশে না ঘুরপাক খায় একই বৃত্তে তাও জানি না। কারণ ধর্মপালনের ভেতর-পাড়া থেকে কবেই স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছি। তবে ধর্মের পথ কোন মঞ্জিলে পৌঁছয় সে নিয়ে ধার্মিক মানুষের একটা অখ- বিশ্বাস আছে। সেটা তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত। এটা আমাকে যেমন মানতেই হবে তেমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, আবার তাঁদের পবিত্র বিশ্বাসে ঘা দেওয়ারও অধিকার নেই আমার। তবে একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে মানুষ যেহেতু আমার আরাধ্য বিষয়, ফলে মানুষের বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে উদাসীন আমি থাকতে পারি না। সেটা যে ধর্মে আমার জন্ম সে বিষয়ে যতটা সত্য, যে ধর্ম আমার প্রতিবেশীর ধর্ম, সে বিষয়েও ততটাই সত্য। ঈদ সম্পর্কে একটি লেখা চেয়ে যখন অরিজিৎ বলল, ঈদের গান নিয়ে কোনও লেখা হতে পারে কিনা, তখন খানিকটা লোভ হল আবার সংশয়ও হল। এ বিষয়ে সুবিচার করার মত তথ্য বা জ্ঞান কি আমার আছে? নেই, তা আমি জানি। কিন্তু এই লেখাটার সূত্রেই তো খানিকটা জানার আরম্ভ হতে পারে, ক্ষতি কী তাতে? ইসলামে সঙ্গীতের স্থান নিয়ে নানা মুনির নানা মত। মুশকিলটা হচ্ছে এই নানা মত সম্পূর্ণভাবেই পরস্পর বিরোধী। কেউ যদি বলেন, সঙ্গীত ঈশ্বর থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়, তো অপর মত বলে সঙ্গীত ঈশ্বরের সাথে মিলন ঘটিয়ে দেয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে এ নিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। আমি ভাবি অন্য কথা। গান যদি নিষিদ্ধই হয়, তবে ভারত থেকে আরবভূমি অবধি সর্বত্র ইসলাম-অনুসারীদের প্রত্যক্ষ অবদানে শতাব্দী প্রাচীন এক সঙ্গীতধারা বহমান থাকল কী করে? আমাদের দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তো প্রকৃত অর্থেই হিন্দু-মুসলিম এর যৌথ সাধনারই ফসল। শুধু আমাদের দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কেন, ইসলামের জন্মভূমি আরব ভূখ-ের সঙ্গীতধারাও এক অত্যাশ্চর্য নান্দনিক সুষমায় ম-িত। এখন সেই সঙ্গীতে এক অর্থে বুঁদ হয়েই আছে সারা পৃথিবী। সঙ্গীতহীন কোনো মাটিতে যেমন ইসলাম আবির্ভূত হয় নি, তেমনি ইসলামও কোনো ভূখ-কে সঙ্গীতহীন করে দেয় নি। সবচেয়ে বড় কথা মুসলিম জাহানে সঙ্গীতচর্চা ধর্মসাধনার বাহির প্রদেশে ঘটে নি। ঘটেছে অভ্যন্তরে। আমার সামান্য জ্ঞানে দেখেছি, এই মানুষগুলির ঈশ্বরসাধনা ও সঙ্গীতসাধনা একসূত্রে গাঁথা ছিল। ফলে আমার মনে হয় সঙ্গীত ও ইসলামের মধ্যে এই দ্বৈরথ অজ্ঞানতারই ফল। সব ধর্মের ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত ধর্মব্যবসায়ীরা শুধু সঙ্গীত নয়, জ্ঞানচর্চাকেও অবরুদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন এক সময়। নারীসমাজকে রাখতে চেয়েছেন শিক্ষার আওতার বাইরে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বেগম রোকেয়া শিক্ষার ক্ষেত্রে এই অবরোধ থেকে মুক্ত করেছেন সমাজকে। ধর্ম এবং গানের প্রসঙ্গ থেকে আপাতত বিদায় নিই। ঈদের গান বললেই ছোটবেলা থেকে একটা গানের কথাই মনে পড়ে। আমাদের ছোটবেলায় অবশ্য আকাশবাণীতে ইসলামী গান শুনেছি এমনটা মনে পড়ছে না। হয়ত বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে সেই গানগুলি প্রচারিত হত আকাশবাণীতে। আমার ছোটবেলার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ বেতার। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ছোটবেলায় বাংলাদেশের রেডিওকে বাংলাদেশ বেতার নামেই জানতাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর যখন রেডিও-র নব ঘুরিয়ে ঢাকা কেন্দ্র শুনি, তখনই প্রথম শুনলাম রেডিও বাংলাদেশ কথাটি। তারপর পদ্মা নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেল। খোন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার শাসনকাল এলেও বাংলাদেশের রেডিও আর বাংলাদেশ বেতার হল না। যাইহোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তো, ওই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যখন বাংলাদেশ বেতার শোনাটা একটা নেশার মত হয়ে গেল, তখনই শুনি, ‘ও মন, রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটি। এখন অনুভব করি এই গানের মধ্যে ঈদের উৎসব এবং ধার্মিকতা দুটোই পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। একদিকে যেমন ভক্তির কথা আরেকদিকে উৎসবের আনন্দময় পরিবেশ, সব যেন ছবির মত ফুটে ওঠে এই গানে। যে সময়ে এই গানগুলি রচিত হয়েছে তখন বাংলা গানে ইসলামী সঙ্গীতের একটি পরিপুষ্ট ধারা ছিল। অসংখ্য গীতিকার, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে ইসলামি ভক্তিগীতি রচনা করেছেন। অসংখ্য গায়ক রেকর্ড করেছেন। গিরীন চক্রবর্তী, ধীরেন দাস, কে মল্লিক, আব্বাসউদ্দিন থেকে শুরু করে অসংখ্য পৃরুষনারী কন্ঠে প্রতি বছর প্রকাশিত হত ইসলামী গানের রেকর্ড। অবিভক্ত বাংলাদেশে মাতৃসঙ্গীত কীর্তনের পাশাপাশি ইসলামী গানেরও নিয়মিত প্রকাশ করতেন তখনকার সমস্ত রেকর্ড কোম্পানিগুলি। বিশিষ্ট সঙ্গীত গবেষক সুধীর চক্রবর্তী বলেছেন, দেশভাগের পর এ দেশের বাংলা সঙ্গীতের ক্রেতার বাজার থেকে যেহেতু পূর্ব বাংলার এক বিশাল মুসলিম জনগণ দূরে চলে গেলেন, ফলে ব্যবসায়ী রেকর্ড কোম্পানিগুলিও ভক্তিসঙ্গীতের প্রকাশনা থেকে ইসলামী গানকে ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিলেন। এরপর জনপ্রিয় নজরুলগীতির রেকর্ডের সূত্রেই একমাত্র ইসলামী গান প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে এই বাংলায়। ব্যবসায়িক এই সিদ্ধান্ত এই বাংলার বা এই দেশের বাঙালিদের জন্যে এই বিশেষ বর্গের গান থেকে দূরে সরিয়ে দিল। ভক্তি বা ধর্মচর্চার প্রেক্ষিত থেকে যদি নাও দেখি, সঙ্গীতের দিক থেকেও এই ক্ষতি অপূরণীয়। প্রথমত, রেকর্ড কোম্পানির সূত্রে এই গানগুলি প্রকাশনার আগে আধুনিক কোনও ইসলামী সঙ্গীত সৃষ্টির ধারা সম্ভবত আমরা দেখি নি। এর আগে লোকায়ত পরিসরে যে বাংলা ইসলামী গানঘুলি ছিল তা ছিল মূলত মারিফতি বর্গের গান। এর বাইরে জিকির বা হামদ বা নাতে রসুল বাংলা ভাষায় রচিত হয়ত হয়েছে। যোগ্য গবেষকেরা নিশ্চয়ই এর খবর রাখেন এবং তাঁদের সূত্রে আমরা সে সব তথ্য জানতে পারব। আমার আলোকপাত বাংলা আধুনিক গানের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে রেকর্ড কোম্পানিগুলির সূত্রে যে ইসলামী ভক্তিগুলি রচিত হয়েছে তার অবদানের কথা। গানের ভাষায় যেমন নতুন নতুন শব্দের সংযোজন হয়েছে, ঠিক তেমনি নানা বর্গের কাওয়ালি এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গীতের সাথে একটি সংলাপ রচিত হয়েছে এই গানগুলিতে। বাংলা আধুনিক গানকে এই সংলাপ সাঙ্গীতিক দিক দিয়ে যার পর নাই সমৃদ্ধ করেছে। বিভাগ-পরবর্তী পূর্ব বাংলায় এই গানগুলির চর্চা আরো বিস্তৃত হয়েছে। ঈদের ধার্মিক পরিসরে সঙ্গীতের কোনও স্থান নেই সত্যিই তবে ঈদের সামাজিক উদযাপনে সঙ্গীত বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করেছে । ঈদের আনন্দ উৎসবে এই গানগুলিই বিশেষভাবে চর্চা হয়েছে। এক মাসের রোজা পালনের পর যখন ঈদ আসে, বাঙালি জীবনে সেই উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গেছে সেই সময়ে রচিত নানা ইসলামী ভক্তিগীতিগুলি, যার মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখিত হবে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন, রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটি। এখন ঈদ মানে শুধু ধার্মিকতা নয়, এক সামাজিক উদযাপনও। সে জন্যেই পূর্ব বাংলায় ঈদকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক আয়োজনগুলি হয়, সেখানে শুধু ইসলামী গানের চর্চা হয় না। সাহিত্য সঙ্গীত নৃত্য, সব কিছুর ক্ষেত্রেই নতুন নতুন প্রযোজনা তৈরি হয় ঈদকে ঘিরে। সেই প্রযোজনাগুলির সাথে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। ঈদের ধর্মীয় দিকের কোনও প্রতিফলন থাকে না বেশিরভাগ গানে। এই যে ধর্মীয় কৃত্যের সাথে সম্পর্কহীন সাংস্কৃতিক প্রযোজনা হচ্ছে এখন ঈদের সময় এর সাথে তুলনীয় এই বাংলার শারদ সঙ্গীত সাহিত্য প্রকাশনার। শারদ সাহিত্য বা পুজোর সময় প্রকাশিত ক্যাসেট রেকর্ডের গানের সাথে যেমন দুর্গাপুজার কোনও সম্পর্ক নেই, ঠিক তেমন ওপার বাংলার ঈদের গানের বা নাটকের বা সাহিত্যপত্রের ঈদসংখ্যার। কট্টর ধর্মপন্থীরা হয়ত ঈদকে কেন্দ্র করে এমন ধরনের অধার্মিক আয়োজনকে খুব ভালো চোখে দেখবেন না। তবে আজকাল কিছু কিছু প্রযোজনা এমন চেহারা নিচ্ছে যা খুব একটা অভিপ্রেত নয়। ‘রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানটির কিছু রিমিক্স সংস্করণ এখন বাজারে শোনা যাচ্ছে তার সাথে ভক্তির বা আনন্দের কোনও সম্পর্ক নেই। ওই গানের সাথে উৎকট নাচ বা সঙ্গীতায়োজনকে বিকৃত রুচি ছাড়া কিছু বলা যাবে না। এই বিকৃত রুচির প্রযোজনা নিয়ে অন্য এক আতঙ্ক জাগে মনে। এই বিকৃতিকে দেখিয়ে কোনও এক ধর্মান্ধ হয়ত সামগ্রিকভাবে সঙ্গীতের উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসবে। শেষ করার আগে আবার ফিরে যাই ইসলাম ও সঙ্গীতের সম্পর্কের আলোচনায়। একটি কথা মাঝে মাঝেই আমাকে ভাবায়। কট্টর ধর্মপন্থীরা বলেন, সঙ্গীত মানুষকে ঈশ্বর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সুতরাং সঙ্গীতচর্চা করা উচিত নয়। কেউ কেউ বলেন, সঙ্গীত হতে পারে, তবে শুধু ঈশ্বর বা পয়গম্বরের প্রশস্তিসূচক গান কোনও ধরনের সুরযন্ত্র বাদ দিয়ে শুধু মাত্র তালবাদ্যের সাহায্যে গাওয়া যেতে পারে। এই বর্গের গান বাদ দিলে বাকি সব গানই নিষিদ্ধ। সঙ্গীত প্রসঙ্গে এতটা যান্ত্রিক ফতোয়া দিতে পারে কি ইসলামের মত একটি আধুনিক ধর্ম? আমার বিশেষ বন্ধু বাংলাদেশের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশিষ্ট শিল্পী মকবুল হোসেনকে জিজ্ঞেস করলাম আমার প্রশ্ন। মকবুলভাই গভীরভাবে ধার্মিক মানুষ। ধর্ম যদি সত্যিই সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করত, তবে নিশ্চিতভাবেই মকবুলভাই ধর্মীয় নির্দেশকে উপেক্ষা করে সঙ্গীতচর্চা করতেন না। মকবুলভাই বললেন, সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ বলে যে অভিমত পোষণ করা হয়, সেটা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অপব্যাখ্যা। যদি তাই হত, তবে যুদ্ধজয়ের পর মহানবী তাঁর সঙ্গীদের গান গেয়ে বিজয় উদযাপন করতে বলতেন না। মকবুলভাই বললেন, মহানবী কখনো কখনো রাত্রিবেলা বেরিয়ে পড়তেন সাধারণ মানুষ কেমন আছে দেখার জন্যে। একটি জায়গায় দেখলেন মানুষ গান গাইছে আত্মহারা হয়ে। মহানবী অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে গান শুনলেন। আবার বেরিয়ে পড়লেন সাধারণ মানুষের অবস্থা দেখতে। ফেরার পথে দেখলেন, আগে যাঁরা স্বতস্ফূর্তভাবে গান গাইছিল, তাঁরা তখন মদ্যপান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে বেসামাল কাপড়চোপড়ে বেহাল হয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিতে গান গেয়ে চলেছে। তখনই মহানবী বলেন, নৌজবিল্লা। তিনি নিষেধ করেছেন প্রকৃতপক্ষে এই বেসামাল অশ্লীল গায়নকে। গান যখন রুচিশীলভাবে হচ্ছিল তখন তো মহানবী নৌজবিল্লা বলেন নি। তিনি নৌজবিল্লা বলেছেন যখন নেশায় বেসামাল মানুষগুলি অশ্লীলভাবে গান গাইছিল। ওই একটি উচ্চারণকে পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে যত্রতত্র প্রয়োগ করে সঙ্গীত নিষিদ্ধ বলে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। মকবুলভাইয়ের কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। যে ধর্ম এত মহান সঙ্গীতশিল্পীর জন্ম দিয়েছে, সে সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করবে কেন, এত খুবই স্বাভাবিক কথাই। মকবুলভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ফেরার পর সোস্যাল সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ পড়ছিলাম বড়পীর খাজা মৈনুন্দিন চিশতি ও সঙ্গীত নিয়ে। বড়পীরের আসরে সঙ্গীত পরিবেশন নিয়ে নানা সময়ে নানা বিধি নিষেধ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সে সময়ের কাঠমোল্লারা। সেই সময়ে যে কথা বলেছিলেন খাজা মৈনুন্দিন চিশতি তা মনকে নাড়া দিয়ে গেল। সিয়ার-উল-আউলিয়া বইয়ের লেখক আমির খুরদ জানিয়েছেন, খাজা মৈনুন্দিন চিশতি চার ধরনের সঙ্গীতকে চিহ্নিত করেছেন। হালাল, হারাম, মকরুহ, মুবাহ। গায়ক যদি কিছুটা ঈশ্বরমুখী হন, তবে তাঁর গান মুবা মানে অনুমোদিত। গায়ক যদি জাগতিক চাওয়া পাওয়া বিষয়ে দুর্বলতার অধিকারী হন, তবে তাঁর গান মকরুহ বা অসহ্য। যদি গায়কের মন প্রাণ জাগতিক চাওয়া পাওয়া ছাড়া অন্য কিছু বুঝতে অক্ষম হয়, তবে তাঁর গান হারাম বা পাপকর্ম। যদি গায়ক ঈশ্বরে সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ হন, তবে তাঁর গান হালাল বা ধর্মসিদ্ধ। এই বক্তব্যকে মান্য করলে আমার মনে হয় না সঙ্গীত নিষিদ্ধ বলা যাবে। বরং সঙ্গীত নিয়ে সাহিত্য নিয়ে শিল্পচর্চা নিয়ে যত ধরনের বেলাল্লাপনা অন্তঃসারশূন্য বাণিজ্যপনা, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায়। অন্ধ আচার চর্চার বাইরে গিয়ে ঈশ্বরের প্রতি নিবেদনকে যদি জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখা যায়, তবে এই পৃথিবীর মহৎ সঙ্গীতের একটিও কোনও ধর্মের চোখে নিষিদ্ধ বিবেচিত হতে পারে না। তখনই হয়ত প্রতিটি ঈদের অনুষঙ্গে সমস্ত মহৎ সঙ্গীতের চর্চা অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন