সোমবার, ২০ আগস্ট, ২০১২

আমার ঈদ

যে নিজের ধর্মেরই চর্চা করে না, তার আবার অন্যের ধর্মে আগ্রহ কিসের! প্রথম যৌবনের দিনগুলির পর থেকে যে ধর্মের আচার নিয়ে বা ধার্মিকতা নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখায় নি, তার কাছে ধর্ম বা ধর্মীয় উৎসব নিয়ে কোনও কথা শোনার কোনও প্রয়োজন আছে কি? এমনটা ভাবতেই পারেন কোনও পাঠক। যাঁদের পশ্চিমবঙ্গের হালফিলের রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে, তাঁরা ভাববেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যেমন মাথায় হিজব দিয়ে ইফতার পার্টিতে গিয়ে মোনাজাতের ভঙ্গীতে ছবির পোজ দেন বা জনসভায় বক্তৃতা দিতে দিতে অর্থ না বুঝে যত্রতত্র ইনশাল্লাহ বলেন, এই নিবন্ধও কি এমন ধরনেরই একটি ইলেকশনবাজী ? গেরুয়াবাদী রাজনীতিবিদরা নাক লাল করে ‘সংখ্যালঘু তোষণ চলছে’ বলে নিন্দা প্রস্তাবও নিতে পারেন আমার বিরুদ্ধে। তেমনটা হয়ত হবে না, কারণ আমি এমন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নই যাঁর কথায় ভোটের এদিক ওদিক হবে। আর যা নিয়ে ভোটেরই এদিক ওদিক হবে না তা নিয়ে ভোটবাদীদের মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? তবে এই সমস্ত কথা বলার পরও আমার দু’টি কথা বলার আছে। হ্যাঁ, আমার ঈদ আছে। ধর্ম মানি আর নাই মানি আমার পুজাও আছে। ধর্মচর্চায় আমার আগ্রহ নেই সত্যি, কিন্তু ধার্মিক মানুষদের বিষয়ে আমার আগ্রহের অন্ত নেই।। এই আগ্রহ সৎ-ধার্মিক থেকে শুরু করে বক-ধার্মিক অবধি বিস্তৃত। আমার ভাবনা ঘুরে বেড়ায় এই মানুষের সমাজটা নিয়ে। পরলোকে বলা বাহুল্য আমার আগ্রহ নেই। ইহলোকের হিত-অহিত নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি এড়িয়ে যেতে পারি না সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাবনার পৃথিবীকে। মনে আছে, আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে কলেজের সহকর্মীদের কলকাতার দ্রষ্টব্যস্থান দেখাতে বেরিয়েছিলাম। বেলুড় মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের ভেতরের পরিবেশ দেখে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। বিশাল হলঘরের নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিলেন বেশ কিছু নারীপুরুষ। একটি কোণে যদি একজন চোখ বন্ধ করে ধ্যাণমগ্ন হয়ে বসেছিলেন, তো আরেকটি কোণে এক মহিলা একটি বই খুলে নীরবে পড়ে যাচ্ছিলেন পাতার পর পাতা। হলঘরের ঠিক মাঝামাঝি এক ভদ্রলোক পদ্মাসনে বসে অপলক তাকিয়ে রয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তির দিকে। আমার সঙ্গীরা তখন ব্যস্ত মর্মরমূর্তিতে প্রণিপাতে। আমার চোখ সরছিল না ওই মানুষগুলি থেকে। হঠাৎই আমার এই স্তব্ধ চেয়ে থাকা দেখে একজন সহকর্মী বললেন, ঠিক ঠিক জায়গায় এলে বহু নাস্তিকও ভক্ত হয়ে ওঠে দেখছি। কী কমিউনিস্ট, ঈশ্বরবিশ্বাস এল? আমি মুচকি হেসে বললাম, হ্যাঁ, আমার সত্যিই ঈশ্বরদর্শন হল আজ। তবে ঈশ্বরকে আমি দেখছি না মর্মরমূর্তিতে। আমি দেখছি এই বিশ্বাসী ধার্মিক মানুষগুলির মধ্যে। এই মানুষই হয়ত এখান থেকে বেরিয়ে মিনিবাসে উঠে কনডাকটারের সাথে ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করবে অথবা বাড়ি গিয়ে জড়িয়ে পড়বে দাম্পত্য কলহে। কিম্বা হয়ত পাড়ার ক্লাব বা কর্মস্থানে রাজনীতিবাজীতে মেতে উঠবে কাল সকালেই। কিন্তু এখন? এখন সে সব কলুষকে তাঁর পায়ের জুতোর পাশে বসিয়ে রেখে এসেছে বাইরে। ভেতরে নিয়ে এসেছে তাঁর ভেতরের মানুষটাকে। একটা মর্মরমূর্তিকে সাক্ষী রেখে এখন সে হয়ত নিজের কাছেই নিজে কবুল করছে নিজের সমস্ত ক্ষুদ্রতাকে। ঈশ্বরের সমীপবর্তী হওয়ার উপলক্ষ্যে হয়ত সে প্রকৃতপক্ষে এক উন্নততর মানুষ হয়ে ওঠারই সাধনা করছে। এমনই এক উন্নততর মানুষ যে এই পঙ্কিল পৃথিবীকে সুন্দরতর করার জন্যে নিজেকে সঁপে দিতে পারে অকাতরে। আমার কাছে এঁরাই এই মুহূর্তে ঈশ্বর। প্রকৃত ধার্মিক মানুষ যাঁর অন্তঃকরণটা ফুলের মত সুন্দর, যার হাসি সূর্যের আলোর মত ছড়িয়ে পড়ে চারধারে, যে পীড়িত মানুষকে দেখলে আচারের বেড়া ভেঙে মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের মাঝে, তাঁর সাথে একজন অবিশ্বাসী প্রকৃত সমাজবিপ্লবীর তফাৎ কোথায়? এঁরাই তো নিরীশ্বরের ঈশ্বর, আমাদের আরাধ্য। অন্যদিকে, কখনো ভাবি সেই বক-ধার্মিকদের কথা, যাঁদের কাছে ধার্মিকতাটা একটা পোষাক মাত্র। আচারের বড় বড় আড়ম্বরের তলায় ঢেকে রাখে তাঁদের জাগতিক চাওয়া পাওয়ার হিসেব। তাঁর কাছে আচারটাই সব। আচার পালনের ক্ষেত্রে পান থেকে চূণ খসলে তাঁদের কাছে মহাভারত বা কোরানশরীফ অশুদ্ধ হয়ে যায়। ধর্ম একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার বা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ধর্মপালন একজন ব্যক্তির একান্তের বিষয়। বক-ধার্মিকদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য কে কোথায় ধর্মপালন করছে অথবা করছে না কিংবা করলেও তাঁর চোখে যাকে যথার্থ ধর্মপালন বলে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে না, তার খোঁজ নিয়ে বেড়ায় এবং নিজেরাই ধর্মপালনে তথাকথিত শিথিলতা প্রদর্শনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিপ্রদানের অধিকার নিজের হাতে তুলে নেয়। এমন বক-ধার্মিক বলা বাহুল্য সব ধর্মেই বর্তমান। মুশকিলটা এটাই, সকলেই অন্য ধর্মের বক-ধার্মিকদের চিনতে পারেন কিংবা অন্য ধর্মের কুসংস্কারকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেন, শুধু নিজের ধর্মের বেলাতেই তাঁদের দৃষ্টি কেমন অন্ধ হয়ে যায়। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, সেইসব ধার্মিকদের কথা, যাঁরা আচার পালন করতে গিয়ে মনুষ্যত্বের অপমান করেন। ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ মানেন, হিন্দু মুসলমান মানেন। মানে ধর্মের দোহাই দিয়ে এই সমস্ত তথাকথিত শিক্ষিতজনেরা ছোঁয়াছুঁচির অন্ধ নেশায় মেতে থাকেন। গতকালই ঘুম ভাঙল পাকিস্তানের বিমান ঘাঁটিতে মৌলবাদী জঙ্গীদের আক্রমণের খবর পেয়ে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আচ্ছা, যাঁরা আক্রমণ হানলেন তাঁরা সকলেই নাকি ইসলামের অনুগত সৈনিক। এ বিশ্বকে ইসলামের রঙে রাঙানোর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এঁরা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে অঙ্গীকার বদ্ধ। তাঁদের বিশ্বাস এই পবিত্র কর্মটি করার পুরস্কার স্বরূপ মৃত্যুর পর তাঁদের স্বর্গ বা বেহেশতের স্থান পাকা। আমরা যতদূর জানি রমজান মাস সংযমের মাস। কাম ক্রোধ রিপু লালসা লোভ সবকিছুকে দূরে রেখে এই একমাস মুসলিম জাহান সংযমের সাধনা করে। এই সাধনাকেই সিয়াম সাধনা বলা হয়। একমাসের সিয়াম সাধনার পর আসে পবিত্র ঈদ, খুশির ঈদ। যাঁরা এই রমজান মাসে বাস দাঁড় করিয়ে নিরীহ নারীপুরুষকে হত্যা করে কিংবা বিমান ঘাঁটিতে নিষ্ঠুর হামলা চালায়, তাঁরা কি সিয়াম সাধনা করেন? এই আক্রমণ হিংসা কি তাঁদের সিয়াম সাধনার অঙ্গ। নাকি রমজান মাসে এমনতর কাজে যিনি অবতীর্ণ হন তিনি ধর্মের মূল শিক্ষাকে অপমান করেন। কেউ রোজা পালনে দুর্বলতা প্রদর্শন করলে, নমাজ ঠিকভাবে এবং নিয়মিত না পড়লে শাস্তি দেওয়ার জন্যে লোকের অভাব নেই। কিন্তু রমজান মাসে যাঁরা নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে হত্যালীলা সংগঠিত করে, তাঁদেরকে কেউ মুরতাদ ঘোষণা করেছেন কি? দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ অবধি এমন খবর পাই নি। এই বক-ধার্মিকেরা আমাদের সমাজকে কলুষিত করে চলেছেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। এঁরা কখনো মুখে ‘আল্লাহু আকবর’ জপে, কখনো ‘জয় শ্রীরাম’ বলে, কখনো এ বিশ্বকে সন্ত্রাসমুক্ত করার খ্রিস্টিয় জেহাদের নামে মসজিদে গুরুদ্বারে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এঁদের আমি ঘৃণা করি, সারা পৃথিবীতে নানা ধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে আমার সমমতের মানুষদের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে আমি প্রতিবাদে সোচ্চার হই। এই প্রতিবাদের অবস্থান থেকেই নানা ধর্মের এই ছদ্মবেশী ধার্মিকদের বিষয়ে জানার আমার প্রয়োজন রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিকের কথা মনে পড়লেই শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসে। নব্বইয়ের রাম-বাবরির হিংসাত্মক বিবাদের সময় অযোধ্যার রাম মন্দিরের পুরোহিত মোহন্ত লাল দাসের কথা মনে পড়লে তেমন শ্রদ্ধা আসে মনে। তখন সারা দেশের ধর্মব্যবসায়ীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে অযোধ্যায়। কপালে তিলক আর হুঙ্কারে কাঁপিয়ে তুলেছে চারধার। মঞ্চের অদূরেই অপেক্ষারত তখন দেশের শাসনক্ষমতায় আরোহণের স্বপ্নে মশগুল লালকৃষ্ণ আদবানি ও অটলবিহারীরা। সে সময় অযোধ্যার রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মোহন্ত লাল দাস প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, যুগল শহর অযোধ্যা ও ফৈজাবাদের মানুষই নিজেদের মধ্যে সরাসরি সংলাপের মাধ্যমে রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম। বহিরাগত ভোটভিখিরি হিন্দু ও মুসলিম নেতারা দয়া করে এই বিবাদ থেকে দূরে থাকুন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। অনমনীয় প্রতিজ্ঞায় মোহন্ত লাল দাস অযোধ্যার আরো বহু আখড়ার মোহন্তদের সঙ্গে নিয়ে সৃদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে। অযোধ্যা ও ফৈজাবাদের সাধারণ হিন্দু মুসলিম মানুষের মধ্য থেকে ২২ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল নিয়ে দেখা করলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কটরমনের সঙ্গে। দেখা করলেন জামা মসজিদের শাহী ইমামের সঙ্গেও। শাহী ইমাম মোহন্ত লালদাস ও তাঁর হিন্দু মুসলিম সঙ্গীদের মতামতের সাথে একমত পোষণ করেলেন। শুভবুদ্ধির এই শুভ উদ্যোগের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের দাঙ্গাবাজ মুখ্যমন্ত্রী অন্যায়ভাবে মোহন্ত লাল দাসকে রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের পদ থেকে অপসারণ করলেন। মোহন্ত লাল দাসের শুভবুদ্ধির জেহাদ তবু থেমে থাকে নি। তিনি তাঁর প্রতিবাদের অবস্থানে অটল রইলেন। বর্বরতার নিকষ অন্ধকারে মানবতার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার কর্মযজ্ঞে অটল থাকার পুরস্কারস্বরূপ ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর আততায়ীর হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হল। ভারতের সাম্প্রদায়িক ঐক্য রক্ষার সংগ্রামের ইতিহাসে এক অমর শহিদ হিসেবে আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিলেন অযোধ্যার রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মোহন্ত লাল দাস। যে রাম মন্দির নিয়ে এত রক্তপাত এত দাঙ্গা এত হত্যা, সেই রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিতই হলেন এই বর্বরতা বিরোধী সংগ্রামের মহান শহিদ। এই ধার্মিক মানুষটি ছাড়া আর কে আমার আরাধ্য হতে পারে? বলা নিষ্প্রয়োজন, মোহন্ত লালদাসের হত্যা রহস্য আজো উন্মোচিত হয় নি আদালতের দরবারে। একজন সাধারণ ধার্মিক মানুষের কথা বলি এবার। বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় ফেরার পথে পদ্মায় ফেরির দোতলার চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি। আমার পাশের শূন্য চেয়ারে এসে বসলেন মৌলানা-সদৃশ এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। বসতে বসতেই দীর্ঘশ্বাসের সাথে বিড়বিড় করলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ.....’। আপনমনে বলে গেলেন আরো অনেক কিছু। আমি তো বিন্দুবিসর্গও বুঝি না। কোরানের কোনও সুরা হয়ত আয়াৎ করলেন। হঠাৎ মনে পড়ল, পরের দিনই আমার বাঁকুড়ায় একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করলাম এক বন্ধুকে। আমার কথা শেষ হতেই প্রৌঢ় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় আপনার দেশ-বাড়ি’? আমি হেসে বলি, ‘দেশ আমার ভারত, আর দেশ-বাড়ি সিলেট’। ভদ্রলোক বললেন, ‘ও আপনি সিলেট থেকে ভারতে মাইগ্রেট করেছেন বুঝি?’ আমি বললাম, ‘মাইগ্রেট করেছিল আমার বাবা মায়ের পরিবার, সেই সাতচল্লিশ সালে। এখন আর এখানে কোন রক্তের সম্পর্কের স্বজন নেই, তবে প্রচুর আত্মীয় আছে, সাংস্কৃতিক-আত্মীয়। তাঁদের টানেই আসি বারবার। ১৯৯৯ সালে প্রথম এসেছিলাম বড় হয়ে। তার আগে ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল একবার এসেছিলাম বাবার সাথে। সরকারি-চাকুরে বাবার বাংলাদেশে সরকারি সফরের সঙ্গী হয়ে।’ মৃদু হেসে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগে এই দেশটাকে?’ আমি বললাম, ‘আসতে আসতে এখন কেমন নেশা হয়ে গেছে, মায়া হয়ে গেছে এই দেশটার প্রতি। কিছুদিন পরপর কি একটা দুর্নিবার আকর্ষণে যে এই মাটি শয়নে-স্বপনে আমাকে ডাকে, তা বলে বোঝাতে পারব না। আসলে এই দেশটার জল-মাটি-বাতাস, এমন কি মানুষ, সব কিছুর মধ্যেই কেমন যেন একটা মায়া আছে। জানি না, আমার পূর্বপুরুষের মাটি বলে এই দেশটার প্রতি আমার আবেগ বেশি কিনা।’ ঘাড় নাড়লেন ভদ্রলোক, আত্মবিশ্বাসের ঘাড় নাড়া। আস্তে আস্তে বললেন, ‘ই-িয়া থেকে যারাই আসে, তাঁদের বেশির ভাগই এই কথাগুলি বলে। কথাটা বাস্তবিকও বটে। এই দেশে একটা মায়া সত্যি সত্যিই আছে। তবে..!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু থেমে যেন স্বগতোক্তির মতো আবার বলতে শুরু করলেন, ‘একটা গোষ্ঠী এই মায়াটাকে শেষ করে দিতে চায়! জানেন কি সেটা আপনি?’ অবাক আমি বলি,‘না’। ‘জেএমবি নাম শুনছেন? সন্ত্রাসী!’ আমি বলি, ‘জেএমবি মানে জমিয়তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ তো? নাম শুনেছি।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ, যারা একদিকে মুখে আল্লার নাম নেয় সারাক্ষণ আর অন্যদিকে মসজিদে বোমা ফাটায়। এরা এই দেশটাকে একেবারে ধ্বংস করে দিতে চায়। এই মৌলবাদীরা হচ্ছে এই দেশের শত্রু। এঁদের ঠোঁটে সবসময় আল্লাহ রসুল আর কোরানশরীফ। মনে রাখবেন ঠোঁট হচ্ছে এক ধরনের লেবাস বা পোষাক। কারো অন্তর নোংরা হলে সে বাইরের পোষাকটাকে বেশি ঝকঝক রাখার চেষ্টা করে। শুধু পোষাক দেখে যেমন মানুষ বিচার করা যায় না, তেমনি এঁদের মুখের কথা আর কপালের দাগ দেখে বিচার করলে ভুল হবে।’ সত্যিই, চেয়ারে বসতে বসতে আপনমনে আল্লাহ রসুলের নাম নিয়েছিলেন। তাঁর বলার মনে এমন এক গভীর উচ্চারণ ছিল যে নিরীশ্বর আমিও সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে না তাকিয়ে পারি নি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি বুক অবধি নেমে আসা শুভ্র শ্মশ্রু, মাথায় টুপি, পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া মৌলবাদের বিরুদ্ধে বিষ উগরে দেওয়া এই মৌলবীকে। ভদ্রলোককে না, যেন আবহমান বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ করছি আমি। ধার্মিকতা আর মৌলবাদ যে সম্পূর্ণ দুটি পৃথক জীবনপথ সেটা বাংলাদেশে না গেলে এমনভাবে কি জানতাম? আমার ঈশ্বর থাক আর না থাক, এই প্রৌঢ় আমার আরাধ্য। আমি গোটা বিশ্বকে দেখতে চাই একটু অন্য চোখে এবং সেখানেই আমার ঈদ পুজা বা অন্য ধর্মীয় উৎসবের তাৎপর্য। বহুত্বের এই পৃথিবীতে আমরা নানা পরিচয়ের আলাদা আলাদা গ-ীতে বাস করি। এই গ-ীগুলি কখনো ধর্মের কখনো ভাষার কখনো সংস্কৃতির ভিন্নতায় বাস করি। কিন্তু এই সমস্ত ভিন্নতার মধ্যেও আমাদের একটা অভিন্নতার ভুবন আছে, যে ভুবনের মাতৃভাষা হচ্ছে ভালোবাসা আর ধর্মের নাম সহমর্মিতা। আমি বা আমার মত অসংখ্য মানুষেরা যাঁরা ধর্ম ভাষা সংস্কৃতির নানা গ-ীর বাসিন্দা, তাঁদের নিরন্তর সাধনা একান্ত পরিচয়ের বেড়া ভেঙে একে অপরের দিকে ছুটে যাওয়ার। আমরা এত কাছাকাছি থাকি, তবু পরিচয়ের ভিন্নতা আমাদের অনেক সাধারণ বিষয়েই আমাদের অজ্ঞ করে রাখে। সারা পৃথিবীকে ভুলে, আপাতত বরাক উপত্যকার কথাই বলি। এই যে সংখ্যায় প্রায় সমান সমান আমরা দু’টি সম্প্রদায়ের মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এত পাশাপাশি বাস করি, আমরা কতটুকু চিনি একে অপরকে। আমার স্কুলশিক্ষা সরকারি বালক বিদ্যালয়ে, যেখানে শিক্ষক ছাত্র দুই অংশেই দু’টি সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। কলেজেও প্রায় একই পরিবেশ ছিল। আমার কর্মজীবনেও এর ব্যতিক্রম নয়। এমন সহ-বসবাসের অভিজ্ঞতা তো আমাদের সকলেরই। তবু আমরা অন্য সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরের জীবন সম্পর্কে কতটুকু খবর রাখি। ক’জন হিন্দু শিক্ষিত বলতে পারবেন, তাঁর পাশের টেবিলে বসে যিনি কাজ করছেন সেই মুসলিম ভদ্রলোক তাঁর মাসি কিংবা মেসোকে, পিসি কিংবা পিসেমশায়কে কী বলে সম্বোধন করেন! আমরা ক’জন জানি আমাদের প্রতিবেশি মুসলিম ঘরে নতুন শিশুর জন্ম হওয়ার পর তাঁর নামকরণের যে অনুষ্ঠান হয়, তাকে ওঁরা কী বলেন? মুসলিম বাড়িতে বিয়ের পর ছেলের বাড়ির যে অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের আপ্যায়িত করা হয়, তাকেই বা কী বলে? আমরা জানি না। আমরা পরস্পরকে চিনি না। মুসলিমরা হয়ত হিন্দুদের সামাজিক রীতিনীতি বেশি জানেন, কারণ হিন্দুরা এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। এঁদের সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে সমাজে অনেক বেশি চর্চা হয়, তাই। শুধু হিন্দু মুসলিম কেন। এই উপত্যকায় নানা জাতিগোষ্ঠী নানা ভাষাগোষ্ঠীর বাস। তাঁদের প্রায় সকলেই সামাজিক স্তরে আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন আমাদের মাতৃভাষায়। ফলে তাঁদের সমাজের অন্তর প্রদেশের খবর নেওয়ারও আমাদের তেমন প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন কথাটা বোধহয় খুব সাধারণ অর্থেই বলা যায়। যদি বৃহত্তর সামাজিক বা মানবিক প্রয়োজনের কথা ভাবি, তবে বলতে হয়, এই পারস্পরিক সেতু নির্মানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। উৎসবের দিনগুলিতে মানুষের হৃদয়ের দরজা খুলে যায়। তখন মানুষ একে অপরের কাছে আসে। দুর্গাপুজাই হোক আর ঈদই হোক, এই উৎসবগুলির ধর্মীয় তাৎপর্য ছাড়িয়ে একটি সামাজিকতার দিক রয়েছে। সবাই মিলে এই উৎসবগুলি পালিত হয়। পুজোর প্রস্তুতি যেমন চলে মাসাধিক কাল ধরে। তেমনি একমাসের সিয়াম সাধনা করেন মুসলিম সমাজ সামাজিকভাবেই। সারা বছর আমরা একে অপরের কাছে হৃদয়টাকে গুটিয়ে রাখলেও এ সময়ে তাকে মেলে ধরি। ঈদে মুসলিম বন্ধুর বাড়ি যাই। আমি খেয়াল করে দেখলাম, আমার মুসলিম বন্ধুদের বেশিরভাগের বাড়ির লোকেদের সাথে প্রথম পরিচয় ঈদের দাওয়াত রক্ষা করতে গিয়েই। তারপর এই পরিচয়গুলি ধীরে ধীরে গভীর হয়েছে। আমরা সুজন থেকে স্বজন হয়ে উঠেছি। এখানেই আমার ঈদ, এখানেই আমার পুজা। অপরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে আত্মীয়তার এক পথ উন্মোচিত হয় এই ধার্মিক উৎসবগুলিতে। নিরীশ্বর আমার উৎসব এখানেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন