শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩

বরাকের ভাষা সংগ্রাম - একটি বামপন্থী মূল্যায়নের প্রতীক্ষায়


বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রাম নিয়ে যতটা আবেগের প্রকাশ, তার তুলনায় বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা বা রাজনৈতিক মূল্যায়ন খুবই কম। ভাষা সংগ্রামের প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়ে ষাটের শুরুতে, কিন্তু এ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ লেখালেখি হতে হতে প্রায় দু’টি দশক কেটে গেছে। তাও সেই অর্থে গবেষণাধর্মী পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনও হয় নি। প্রথম পর্বে যে সমস্ত লেখালেখি হয়েছে, তার বেশিরভাগটাই স্মৃতিকথা। এই স্মৃতিকথা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, এতে বিভিন্ন ব্যক্তির তরফে অতিকথন রয়েছে, কেউ বলেন এতে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। কেউ বলেন, এই স্মৃতিকথাগুলিতে অনেক সত্য অনুল্লেখিত রয়ে গেছে। পরবর্তীতে অবশ্য কিছু কিছু গবেষণাধর্মী লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন অনেকে। সম্প্রতি দুয়েকজন বিচ্ছিন্নভাবে বিধিসম্মত গবেষণাও করেছেন বা করছেন এই ঐতিহাসিক সংগ্রাম নিয়ে। কিন্তু এই সংগ্রামের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যের নিরিখে এই উদ্যোগগুলিকে খুবই প্রাথমিক স্তরের, যদিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মনে হবে।

যে সামান্য লেখালেখিকে নির্ভর করে বরাকের ভাষা সংগ্রাম নিয়ে চর্চা হয়, সেই লেখালেখিগুলিও ভীষণ রকমের আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণের দ্বারা আক্রান্ত। আসাম রাজ্যের রাজনীতি বা সামাজিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতার নিরিখে বরাকের ভাষা সংগ্রামের মূল্যায়ন করার কোনও উদ্যোগ এখনও পরিলক্ষিত হয় নি। এই কথাটি দু’দিক থেকেই সত্য। বরাক উপত্যকায় যেমন এই সংগ্রামের ইতিহাসকে রাজ্যগত দৃষ্টি থেকে পর্যালোচনা করা হয় নি, ঠিক তেমনি অবশিষ্ট আসামেও বুদ্ধিজীবী মহলে বা রাজনৈতিক স্তরে বরাকের ভাষা সংগ্রাম নিয়ে কোনও গভীর অনুসন্ধান করেন নি কেউ। অন্তত তেমন কোনও আলোচনা এখনও সাধারণ্যে প্রকাশিত হয় নি। অবশিষ্ট আসামের উদার মনোভাবাপন্ন ভিন্নভাষাগোষ্ঠীর বিদ্বৎসমাজের কাছে বরাকের ভাষা সংগ্রাম একটি পৃথকত্বমুখী রাজনৈতিক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের কাছে এটি একটি বাঙালি উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ। এই সমস্যা অবশ্য শুধু বরাকের ভাষা সংগ্রাম নিয়েই নয়। বরাক ও অবশিষ্ট আসামের মধ্যে অন্যান্য বিষয় নিয়েও তেমন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক সংলাপ আমরা খুব একটা দেখি নি। এক অলিখিত বিভাজন যেন কাজ করে মানসিকতার স্তরে। লেবাননের ক্ষেত্রে আমরা যেমন জেনেছি যে সেখানে সরকারি বৈধতা নিয়েই দেশের ভেতর খ্রিস্টান ও মুসলিমদের আলাদা অঞ্চল। দুই অঞ্চলের মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই কাঁটাতারও রয়েছে। বরাক ও বহির্বরাক নিয়ে সরকারিভাবে কোনো সীমান্ত বিভাজন না থাকলেও দু‘টি অঞ্চলেই মানসিকতার স্তরে এক জল বিভাজন রেখা রয়েছে। অথচ বহুভাষিক বহুসাংস্কৃতিক বহুজাতিক আসাম রাজ্যে এক মৈত্রী ও পারস্পরিক সহযোগিতার সমাজ গড়ে তুলতে এই রাজ্যের বহুমুখী বৈচিত্রের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক চর্চা অত্যন্ত জরুরি। বামপন্থী আন্দোলনের জন্যে বলা বাহুল্য, এই চর্চা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিভিন্ন অংশের শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক ঐক্য। সামাজিকস্তরে যে সংলাপ বিভিন্ন অংশের মধ্যে চলতে থাকলে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্যের পাশাপাশি সামাজিক মিলন ঘটে, সেই সংলাপের স্বার্থেই  বামপন্থীদের তরফে বরাকের ভাষা সংগ্রাম ও রাজ্যের বিভিন্ন অংশের নানা ভাষা জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের গভীর পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ ক্ষেত্রে এখনও কোনও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় নি কোত্থাও।

বরাকের ভাষা সংগ্রাম যদিও ১৯৬০ সালের রাজ্যভাষা আইনের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছিল, তবু এর প্রেক্ষাপটটি যুক্ত হয়ে আছে এই অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে। আরো স্পষ্ট করে বললে, ইতিহাসের নানা পর্যায়ে এই অঞ্চলের ভূগোলের ভাঙা-গড়ার সাথে সম্পৃত্ত হয়ে আছে বরাকের ভাষা সংগ্রামের প্রশ্নটি। আবার, পণ্ডিতদের কাছে সমস্যাটা আসামের পরিচয় নিয়েও। আসাম কি বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি বহুভাষিক রাজ্য, নাকি আসাম মূলত একটি একভাষী রাজ্য? অসমীয়াভাষী ছাড়া অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ বা আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে বাঙালিরা কি এখানে নিতান্তই বহিরাগত এবং ফলে উটকো, নাকি শতাধিক বছর পাশাপাশি বাস করার ফলে এখানকার স্থানীয় মানুষদেরই একজন হয়ে গেছেন? আসামের ভাষা ও জাতি সমস্যা নিয়ে পণ্ডিত গবেষকরা এ পর্যন্ত যে প্রতিবেদনগুলি তৈরি করেছেন, তার বেশিরভাগই রাজ্যের মূল সমস্যার খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরেছে। আগেই বলেছি. বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রাম নিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার তাত্ত্বিকেরা প্রায় নীরব। দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী পণ্ডিতেরা বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনকে পৃথকত্ববাদী প্রবণতা হিসাবেই দেখেছেন। তাদের কাছে, একষট্টি, বাহাত্তর, ছিয়াশির ভাষা আন্দোলন আসামের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার প্রবণতার প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা, যারা সংকটের দিনে ভাষিক সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়ে নিগৃহীত হয়েছেন নানা সময়ে, তারাও বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রাম বা আসামের রাজনীতিতে এই সংগ্রামের তাৎপর্য তাৎপর্য সম্পর্কে খুব একটা অবহিত নন। বরাক উপত্যকায় সাধারণভাবে ভাষা সংগ্রামকে দেখা হয়ে থাকে শুধুমাত্র বাঙালিত্বের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে, এই আন্দোলন বঙ্গভাষী মানুষের প্রধান অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে গড়ে উঠলেও এর তাৎপর্য ছিল অনেক গভীর ও বিস্তৃত। শুধুমাত্র বাঙালিত্বের গণ্ডিতে একে  দেখলে ঐতিহাসিক ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে, বহুভাষিক আসামের স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্বটিই এখানে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। একদিকে আসামের শাসকশ্রেণি চেয়েছে রাজ্যের বহুভাষিক চরিত্রকে অস্বীকার করতে, আর অন্যদিকে বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীগুলির সংগ্রামগুলি মূলগতভাবে চেয়েছে আসামের বহুভাষিক, অসংখ্য ছোট বড় জাতিগোষ্ঠীগত পরিচয়কে (multilingual and multi-ethnic) প্রতিষ্ঠিত করতে। গত পঞ্চাশ বছরের আসামের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে এই কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বের আবর্তে। ১৯৬০ সালে সরকারি ভাষা আইনের মাধ্যমে আসামের সরকারি ভাষা হিসাবে যখন একমাত্র অসমীয়া ভাষাকেই চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা হচ্ছিল, তখন প্রতিবাদ ধ্বণিত হয়েছিল শুধু বাঙালি নয়, সমস্ত অনসমীয়া ভাষাগোষ্ঠীগুলির তরফ থেকে। এই প্রতিবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রে অবশ্যই ছিলেন বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষী সমাজ, তবে বিভাজন ছিল অসমীয়া ও অনসমীয়ার, শুধু বাঙালি অসমীয়ার নয়। ১৯ শে মে শিলচর রেল স্টেশনে গুলিতে এগারো জন বাঙালি যুবক যুবতী প্রাণ দিলে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শিলং শহরে হাজার হাজার খাসি সম্প্রদায়ের মানুষ মৌন মিছিলে শামিল হয়েছিলেন। এর আগে পরে বিভিন্ন অনসমীয়া গোষ্ঠীর মানুষ আসামের সরকারি ভাষা আইন সম্পর্কে রাজ্য সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলেও ঐতিহাসিক নানা কারণে এই আন্দোলন পরবর্তীতে বরাক উপত্যকার সংগ্রাম হিসাবেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকল। আসামের শাসক শ্রেণিও চেয়েছিল গোটা বিষয়টিকে অসমীয়া বাঙালি বা আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে অসমীয়া ও বরাক উপত্যকার বাঙালির বিরোধ হিসাবে উপস্থিত করে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে কিংবা অসমীয়া সমাজের গণতান্ত্রিক অংশকে এই সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে দিতে। অন্যদিকে দূরদর্শিতার অভাবে বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনও আসামের বহুত্বের সংগ্রাম না হয়ে বরাকের বাঙালির লড়াই হিসাবে প্রতিপন্ন হল।

বরাকের ভাষা সংগ্রামকে আরো গভীরভাবে বুঝতে হলে একটুখানি পেছনের দিকে তাকাতে হবে। উনবিংশ শতকে প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্রিটিশ শাসনাধীন আসামকে যুক্ত করা হয়েছিল বঙ্গদেশের সাথে। ১৮৩৪ সাল থেকে বাংলা ভাষাকে আসামে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করা হয়। সারা রাজ্য জুড়ে গড়ে উঠল অসংখ্য বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়। ঔপনিবেশিক প্রশাসনে করণিক ইত্যাদি  চাকরিতে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে ইংরাজি শিক্ষিত বাঙালিরা এসে হাজির হলেন আসামের নানাপ্রান্তে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সদ্যজাত অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনে। একদিকে সরকারি কাজ ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা, অন্যদিকে করণিকের চাকরিতে হাজার হাজার বঙ্গভাষী মানুষের নিয়োগ, তারা ভাবলেন এই বঙ্গীকরণের মধ্যদিয়ে হারিয়ে যাবে তাদের মাতৃভাষা অসমীয়া ও তাদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি। তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৮৭৪ সালে বাংলা ভাষা প্রত্যাহৃত হল। কিন্তু আতঙ্ক রয়েই গেল। নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি গ্রাস হয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই জন্ম নিল মধ্যবিত্ত সমাজে বাঙালি-বিদ্বেষ। 

পরবর্তীতে বাংলা থেকে আলাদা করে আসামকে পৃথক রাজ্য হিসাবে গঠন করা হলে আসামের রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করা জন্যে ব্রিটিশ প্রশাসন যে দু’টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাও রাজ্যে বাঙালি-বিদ্বেষের আবহে আরো নেতিবাচক ভূমিকা পাল করে। প্রথমত, রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে বঙ্গদেশের দু’টি রাজস্ব উদ্বৃত্ত অঞ্চল, সিলেট জেলা ও রংপুর জেলার গোয়ালপাড়া মহকুমাকে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, যেহেতু আসামের স্থানীয় মানুষ জলাজমিতে চাষ করতে জানতেন না, আর অন্যদিকে পূর্ব বাংলায় জমির ক্ষুধায় দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক সমাজ অস্থির হয়ে ছিল, তাই রাজ্যের খাদ্য উৎপাদনে নতুন জোয়ার আনার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন পূর্ব বাংলা থেকে ভূমিহীন কৃষকদের এনে বসতি দিল আসামে। আসামের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পালে নতুন বাতাস লাগার আশায় প্রথম অবস্থায় অসমীয়া মধ্যবিত্ত সমাজের পুরোধারা ব্রিটিশ প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানিয়েছিলেন। আসামের খাদ্য উৎপাদন বেড়ে গেল দ্রুত গতিতে। শূন্য থেকে শুরু করে ১৯১৯-২০ সালের মধ্যে আসামের ১,০৬,০০০ একর জমি পাটচাষের আওতায় চলে এল। কিন্তু এর অনুষঙ্গে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা ভূমিহীন কৃষকের জনসংখ্যাও বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে। ১৯০৪-১১ সময়সীমায় পূর্ববঙ্গীয় কৃষকের সংখ্যা ছিল ৫৪,০০০। ১৯২১-৩১ সময়সীমায় তা দাঁড়াল ৫,৭৫,০০০ এ। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার আনন্দ মুছে গেলে অসমীয়া মধ্যশ্রেণির মন থেকে। গ্রাস করল নিজদেশে পরবাসী হবার আতঙ্ক। প্রশাসনে বাঙালিদের আধিপত্য খর্ব করা, পূর্ববঙ্গ থেকে কৃষকদের জনস্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করার জোরালো দাবি উঠল। অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানা সংগঠন দাবি তুলল নানা ধরনের - সবগুলিরই সাধারণ উদ্দেশ্য বাঙালিদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে অসমীয়া ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা করা। ১৯২০ সালে চালু হল কুখ্যাত ‘লাইন প্রথা‘। আসামের মূলভূমিতে বহিরাগত বাঙালি কৃষকদের বাধ্য করা হল চর এলাকার বসতি স্থাপন করতে। চর এলাকার বাইরে তাদের বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ হল। যাদের হাড়ভাঙা শ্রমে আসামের বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে সোনার ফসল ফলল, তাদের ঠেলে দেওয়া হল নদীর চরে। নদীচরের ভাঙা-গড়ার মতই অনিশ্চিত হয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। পৃথিবীর ইতিহাসে বর্ণবিদ্বেষী শাসনে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্ল্যাক টাউনশিপের ঘেটো ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত আর কোথাও নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে আসামের পার্থক্য এটাই - দক্ষিণ আফ্রিকার ঘেটো আন্তর্জাতিক ভাবেই বর্ণবিদ্বেষ নামে নিন্দিত ও ঘৃণিত। আসামের লাইন প্রথাকে এখনও বহু প্রগতিশীলেরা অভিহিত করেন অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসাবে। আসামের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব অম্বিকাগিরি রায় চৌধুরীও ছিলেন এই কুখ্যাত লাইন প্রথার উগ্র সমর্থক। স্বাধীনতার সময় গণভোটের মধ্যদিয়ে আসামের রাজস্ব সমৃদ্ধ জেলা সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন অসমীয়া জাতীয়তাবাদী নেতারা। এই ঘটনায় তারা বিজয়ের অনুভূতি পেলেন।

১৯৪৭ এর স্বাধীনতা সারা দেশে সাধারণ মানুষের মনে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্তির স্বাদ এনে দিলেও আসামের অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে তা এনে দিয়েছিল বাড়তি আরেকটি মুক্তির স্বাদ। সেটা ছিল রাজ্যের রাজনীতিতে বঙ্গভাষীদের প্রভাব থেকে মুক্তির আনন্দ। পত্র পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধ, জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভাষণ, এমন কি আসাম বিধানসভায় রাজ্যপালের ভাষণ - সবকিছুতেই ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্তির পাশাপাশি বাঙালিদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দ।

১৯৪৭ এর ২০ জুলাই আসামের প্রধান সংবাদপত্র ‘দ্য আসাম ট্রিবিউন‘ লিখল -
“ চিরজাগ্রত থাকার মূল্যেই মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক এবং ভাষিক - সমস্ত বিচারে আসামের প্রত্যেক অনসমীয়া মানুষ বিদেশি। ...... ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ অধিগ্রহণের পর যারা ব্যবসায়িক বা অন্যকাজে আসামে এসেছে, তারা সকলেই বহিরাগত। এই বহিরাগতরা আগামী দিনের স্বাধীন আসামে কোনও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে এমন আশা করার কোনও কারণ নেই।“
প্রায় একই সময়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ এক জনসমাবেশে বলেন - নিঃসন্দেহে আসাম অসমীয়াভাষীদের রাজ্য। ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর আসাম বিধানসভার অধিবেশনে রাজ্যপাল স্যার আকবর হায়দরী বলেন-
“ আসামের স্থানীয় মানুষরাই এখন নিজেদের রাজ্যের প্রভু।.... এখন তারা অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসার সহ তাদের সতীর্থ ট্রাইবেল জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। বাঙালিরা চাইলেও এখন আর আসামের পাহাড় ও সমতলের মানুষের ওপর কিছু চাপাতে পারবে না, কারণ এখন তারা ক্ষমতাহীন। বাঙালিদের সম্পর্কে এমন ধারণার ভিত্তি যে ভয়, সেই ভয়ের এখন আর কোনও কারণ নেই। যতক্ষণ না এই বহিরাগতরা আমাদের প্রতি বশ্যতা প্রকাশ করছে ততক্ষণ এঁদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে, আমি আপনাদের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।“ বিরিঞ্চি কুমার বরুয়ার মত ব্যক্তিত্বও মত দিলেন, “আসামের সমস্ত অনসমীয়া মানুষকে বিদেশি বিবেচনা করা হোক। তাঁর মতে, নিজেদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে অনসমীয়ারা যদি একমাত্র অসমীয়া ভাষা, সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেন, তবেই তারা আসামে বসবাস করার অধিকার পেতে পারেন।“ এই তথাকথিত বিদেশিদের অসমীয়াকরণই হয়ে দাঁড়াল এর পরবর্তী দশকগুলির আসামের শাসকশ্রেণির সাংস্কৃতিক-রাজনীতির প্রধান নীতি। এর সূত্র ধরেই আসামের জনবিন্যাস নিজেদের স্বার্থে পরিবর্তিত করার জন্য আদম শুমারিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়ে দাঁড়াল আসামের শাসকশ্রেণির প্রধান রণকৌশল। আসামের জনসংখ্যার ভাষিক বিন্যাসে রাতারাতি ঘটে গেল প্রায় ‘অলৌকিক‘ পরিবর্তন। ‘অলৌকিক‘ শব্দটি ব্যবহৃত হল, কারণ সমাজ বিজ্ঞানীরা একে ‘ডেমোগ্রাফিক মিরাকল‘-ই বলেছেন। ১৯৩১ এর আদম শুমারিতে আসামে অসমীয়াভাষীর অনুপাত যেখানে ছিল ৩১.৪%, মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে ১৯৫১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল ৫৬.৭% এ। পূর্ববঙ্গাগত বাঙালি মুসলমান কৃষকরা যারা আসামকে শস্যশ্যামলা করেছে, তারা রাতারাতি নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা ত্যাগ করে নিজেদের অসমীয়াভাষী হিসাবে পরিচয় দিতে বাধ্য হল। বলা বাহুল্য, এটি কোনও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ঘটা সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের স্বাভাবিক দৃষ্টান্ত নয়। বিশুদ্ধ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাষা, সংস্কৃতির অধিকার হরণ করে নেওয়ার জঘন্যতম উদাহরণ। এই দরিদ্র বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যালঘুত্ব নিয়ে এমনভাবে ষড়যন্ত্র সাজানো হয়েছিল যে, তখন এর কাছে আত্মসমর্পন করা ছাড়া কোনও গত্যন্তর ছিল না। ভাষিক আগ্রাসনের এই অভূতপূর্ব নজিরকেই আসামের শাসকশ্রেণি অভিহিত করেছে ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়‘ হিসাবে। আসামবাসী অন্যান্য অনসমীয়া সমাজকেও তারা আহ্বান জানিয়েছে এই পথে হাঁটতে। আশ্চর্যের বিষয়, সারা পৃথিবীতে ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়‘ বললে দ্বিমুখী সাংস্কৃতিক প্রবাহ বোঝালেও আসামের শাসকশ্রেণির ক্ষেত্রে এই শব্দের অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকেই ব্যাখ্যা করা হয়ে আসছে ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়‘ হিসাবে। এখানে ‘সমন্বয়‘ একটি একমুখী আগ্রাসী প্রবাহ।

আমরা আলোচনা করছিলাম আসামের রাজনীতির প্রেক্ষিতে একটি বামপন্থী অবস্থান থেকে বরাকের ভাষা সংগ্রামের একটি বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের। এই কাজটি করতে যাওয়ার পথে আসামের সমাজ ও রাজনীতির কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার হয়ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর সময়ের নানা ঘটনাবলীর উগ্র জাতীয়তাবাদী নানা ভাষ্য আসামের রাজনীতির মূলস্রোতে এক ধরনের বৈধতা পেয়ে গেছে। এ নিয়ে এই রাজ্যেরই অন্য অংশের বা অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষের ভিন্ন ভাষ্য থাকতে পারে বা রয়েছে। কিন্তু রাজ্যের মুল স্রোতের¯ গণমাধ্যম বা সরকারি বেসরকারি পরিসরে সেগুলির জন্যে খুব একটা ঠাঁই নেই। স্বাধীনতার পর থেকেই আসামের রাজনীতি দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এক, অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতি অন্য ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসনের মুখে বিপন্ন, একে বাঁচাতে হবে। দুই, বিপুল সংখ্যায় বহিরাগত মানুষ এসে আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্য বদলে দিয়ে এই রাজ্যের নিরাপত্তা বিপন্ন করছে। এই ‘বহিরাগত‘ বলতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বোঝাতো পূর্ববঙ্গাগত বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের। পরে এই অর্থের আওতায় যুক্ত হল নেপালিরা। এখন ‘বহিরাগত‘ বলতে প্রধানত বোঝানো হয় পূর্ববঙ্গমূলের মুসলিমদের। আসামের মূল স্রোতে¯এই দু’টি অসত্য অভিমত প্রায় ধ্রুবসত্য হিসেবে গৃহীত হয়ে গেছে।

বাস্তব বিচারে দেখা যাবে, স্বাধীনতার পর আসামে যদি কোনো একটি ভাষা-সংস্কৃতিকে যদি চিহ্নিত করা যায়, যা স্পষ্টত ক্রমসমৃদ্ধ হয়েছে, তবে তা অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতি। অসমীয়া সাহিত্য সঙ্গীত নাটক চলচ্চিত্র সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে এই সময়পর্বে। অসমীয়া নৃত্য সঙ্গীতের সমৃদ্ধি এতটাই যে তা আসামের ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অন্য সঙ্গীত নৃত্যের সাথে নিজেকে সংলাপে রত করতে সমর্থ হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অসমীয়া ভাষা এতটাই সমৃদ্ধ হয়েছে যে সরকারি কাজকর্মে, নতুন পরিভাষা সৃজনে পূর্বাঞ্চলে আর কোনও ভাষা এতটা সাফল্যের মুখ দেখতে পেয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির এই সমৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় আসামের অন্যান্য ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কখনোই নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেন নি। গভীর অনুসন্ধানে দেখা যাবে, অসমীয়াভাষী মানুষের এই সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে আসামের অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ সক্রিয় সহযাত্রাই প্রদান করেছেন তাঁর অসমীয়া প্রতিবেশীকে। বরং এই সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের ফলে বিপন্নতার মুখে পড়েছে, আসামের অন্য ভাষা ও সংস্কৃতি। অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধির এই কাজকে আসামের শাসকশ্রেণি ও উগ্র জাতীয়তাবাদী বিদ্বৎসমাজ আসাম রাজ্যে অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির একাধিপত্য স্থাপনের সাথে একাকার করে দিয়েছেন। এই একাকার করার প্রক্রিয়াতেই তাঁরা অস্বীকার করতে চেয়েছেন অন্য ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতির অধিকারকে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত জনজাতিগোষ্ঠীগুলি অসমীয়া জাতিসত্তার মধ্যে নিজেদের বিকশিত করতে চেয়েছিল একটা সময়ে, তাঁরা এই আগ্রাসী সাংস্কৃতিক-রাজনীতির মুখে নিজেদের আত্মপরিচয়ের দাবি উত্থাপন করতে উদ্যত হলেন। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি প্রথম থেকেই মুখোমুখি হতে হয়েছে হিংসাত্মক আক্রমনেরও। অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির একাধিপত্য স্থাপন করার অভিপ্রায়ে আসামের বঙ্গভাষী জনপদগুলিকে অসমীয়াকরণের সরকারি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৫১ সালের আদম শুমারির যে সরকারি কর্মসূচির কথা আগেই বলা হয়েছে, সেই কর্মসূচির ফলাফলে ধুবড়ি- গোয়ালপাড়া অঞ্চলের ভাষিক পরিবর্তন ঘটে যায়। দুঃখের বিষয়, ভাষিক আগ্রাসনের এই সরকারি কূটকৌশলকে কোনও কোনও বামপন্থী লেখক একটি ইতিবাচক উদ্যোগ বলে উল্লেখ করেছেন সম্প্রতি কোন কোনও লেখায়। একটি কথা স্পষ্ট, যখন ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে দীর্ঘদিন বসবাস করার পর একটি ভাষাগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের ভাষিক পরিচয় বদলে যায়, সেটা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা নিয়ে আপত্তি তোলার অবকাশ থাকে না। মানব সভ্যতা বলা বাহুল্য এই পথেই এগোয়। কিন্তু যখন কোনও শাসকগোষ্ঠী সরকারি কর্মসূচি হিসেবে ছলে-বলে-কৌশলে একটি জনগোষ্ঠীকে তাঁর মাতৃভাষা ত্যাগ করতে বাধ্য করে, তা কখনোই ইতিহাসের বিচারে শুভ হতে পারে না।

১৯৫১ সালের আদম শুমারির সময়ে সংগঠিত যে অপকর্মটিকে এতকাল আসামে ‘সমন্বয়‘ বলে মহিমান্বিত করা হয়েছে, সেই অপচেষ্টার ভূতই এখনও আসামের রাজনীতিকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এই তথাকথিত ‘সমন্বয়‘-এর ভূত নানা ধরনের। সাম্প্রতিক সময়ে বড়োল্যাণ্ড অঞ্চলে যে হিংসাত্মক ঘটনাবলীর ঘটনা ঘটেছে, তাকে সংবাদ মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে বড়ো-মুসলিম সংঘাত হিসেবে। অর্থাৎ এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাষিক পরিচয়ের উল্লেখকে এড়িয়ে গিয়ে। এমন কি বামপন্থী দলের বিবৃতি বা দলিলেও বারবার উল্লেখ করা হয়েছে বড়ো-মুসলিম বিবাদ হিসেবে। কোথাও কোথাও তাঁদের উল্লেখ করা হয়েছে পূর্ববঙ্গমূলের মুসলিম হিসেবে। এই নিবন্ধেও সেভাবেই পরিচিত করা হয়েছে এই জনগোষ্ঠীর মানুষকে। তার মানে এটা স্পষ্ট যে গত ষাট বছরেও এই জনগোষ্ঠীর মানুষের ভাষিক পরিচয়ের ব্যাপারটি এখনও নিষ্পত্তির প্রতীক্ষায়, আদম শুমারি যাই বলুক না কেন। একদা যাঁদের উল্লেখ করা হয়েছিল ন-অসমীয়া বা নব-অসমীয়া বলে, কয়েক যুগ কেটে যাওয়ার পর এখনও তাঁরা ভিতর ঘরে স্থান পেলেন না। এখনও তাঁরা ন-অসমীয়া কিংবা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘বাংলাদেশী‘। বড়োল্যান্ড অঞ্চলের সাম্প্রতিক দাঙ্গার সময়ে টেলিভিশনের পর্দায় ঘরপোড়া সর্বস্ব হারানো তথাকথিত বাংলাদেশী মানুষের সাক্ষাৎকার আমরা শুনেছি। তাঁদের বলা ভাষা বাংলা ও অসমীয়ার মাঝামাঝি একটা রূপ নিয়েছে, তবু তাঁরা এখনও সাধারণ জনমানসে বাংলাদেশী। ভাষাসংস্কৃতি ত্যাগ করার পরও এ মাটি তাঁদের নিজের হল না। বামপন্থীরা কী ভাবে দেখবেন এই প্রশ্নটিকে? সম্ভবত কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই। সাম্প্রতিককালে শুনেছিলাম একটি ঘটনা। একটি বামপন্থী দলের রাজ্যস্তরের শিক্ষাক্লাসে একজন ‘পূর্ববঙ্গমূলের‘ মুসলিম রাজনৈতিক কর্মী তাঁর দলের রাজ্য নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কমরেড, আমাদের দল আমাদের কী মনে করে? অসমীয়া, না বাঙালি? আমরা বাড়িতে বাংলা বলি, সরকারিভাবে আমাদের পরিচয় অসমীয়া। আমরা কে?‘ শুনেছিলাম এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে সেই নেতাকে। কারণ সত্যিই এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট সর্ববাদীসম্মত অবস্থান নেই দলের। বিগত ষাট বছরে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বহু ভাষাগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মেরই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভাষিক পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে আছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি হিন্দু, নেপালি, মারওয়ারি, সাঁওতাল সহ নানা আদিবাসী ও আরো নানা ভাষা গোষ্ঠীর একটি অংশ। এই স্বাভাবিক ঘটনা রাজ্যে কোনও অশান্তি সৃষ্টি করে নি।

সরকারি উদ্যোগ বা স্বাভাবিক পরিবর্তন, এই দুয়ের একটিও অবিভক্ত কাছাড়ে সম্ভব ছিল না। ফলে রাজ্যভাষা আইনের মাধ্যমে কাছাড়ের ভাষিক পরিবর্তনের অপচেষ্টা হয় বিগত শতকের ছয়ের দশকের শুরুতে। এই ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই আজকের বরাক কিংবা তৎকালীন কাছাড়ে ভাষা সংগ্রাম গড়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নীতির প্রতিক্রিয়াতে একইভাবে বড়ো অঞ্চলে পিটিসিএ-র আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে আসামের নানা অঞ্চলে আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যে ভাবে সংগ্রামমুখর হয়েছে, তার মধ্যে উগ্রবাদী, অ-গণতান্ত্রিক ঝোঁক কখনো কখনো থাকলেও মূলগতভাবে যে প্রশ্নগুলিকে সামনে এনেছে, তার গণতান্ত্রিক সারবত্তা রয়েছে।

১৯৫১ সালের আদম শুমারির কথা আগে বলেছি। ১৯৭১ সালের আদম শুমারিতেও কতগুলো অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা শ্রমিকদের লেখানো হল অসমীয়ভাষী হিসেবে, আর বরাক উপত্যকার চা শ্রমিকদের বলা হল হিন্দিভাষী। বলা বাহুল্য, দু‘টোই চরমতম অসত্য। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা শ্রমিকদের সাথে অসমীয়া জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের কোনও পর্বেই কোনও আত্মীয়তা নেই। অন্যদিকে, বরাক উপত্যকায় চা শ্রমিকদের মধ্যে হিন্দিভাষীরা সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হচ্ছেন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান, ছোট নাগপুর অঞ্চল থেকে আসা মানুষ। বরাকের চা বাগান অঞ্চলে যে উপভাষাটি বহুল প্রচলিত, তাকে চা বাগানে বলা হয় ‘বর্ধমানী‘। এ থেকেই স্পষ্ট এরা কাঁরা। 

এমন আরো নানা প্রশ্ন রয়েছে আসামের ভাষা-সংস্কৃতি-জাতিগত সমস্যা নিয়ে। এই সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র শ্রমজীবী মানুষের রুটিরুজির লড়াইতে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে বামপন্থী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা যাবে না। আজকের পৃথিবীতে যে তিনটি ধরনের লড়াইকে বামপন্থীরা বিশ্বজুড়েই গুরুত্ব আরোপ করছেন এবং ভারতবর্ষেও শ্রেণিসংগ্রামের সাথে এই লড়াইকে যুক্ত করতে চাইছেন, তা হল নারী, আদিবাসী এবং সংস্কৃতির লড়াই। উত্তর পূর্বাঞ্চলে একমাত্র ত্রিপুরাতেই আদিবাসী মানুষের মধ্যে বামপন্থীরা শক্তিশালী। বামপন্থীরা প্রথম যুগ থেকেই আদিবাসী সমাজের ভাষা-সংস্কৃতির লড়াইকে গুরুত্ব দিয়ে সংগঠিত করেছেন। লক্ষ্যণীয়, ভারতবর্ষের অন্যান্য আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে মাওবাদীদের কর্মপরতা থাকলেও ত্রিপুরায় এরা অনুপস্থিত।

এবার ফিরে আসা যাক গোড়ার কথায়। ভাষা রাজনীতির এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনকে মূল্যায়ণ করা হবে কোন্ নিরিখে? বাংলাদেশে যে ভাবে ‘একুশের চেতনা‘ কথাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত, একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে বরাক উপত্যকায় ভাষা সংগ্রাম থেকে জন্ম নেওয়া চেতনাকে বলা হচ্ছে ‘উনিশের চেতনা‘। তবে ‘উনিশের চেতনা‘কে এখনও আসামের ভাষা রাজনীতির ইতিহাসের আলোয় সংজ্ঞায়িত করার কাজটি এখনও অপূর্ণ। দায়সারাভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শব্দটিই যে ভাষার রাজনীতির আবর্তে জর্জরিত আসামে ভাষিক ঐক্যের নতুন পথ দেখাতে পারে সে সম্পর্কে ভাবার সময় এসেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বহুভাষিক আসামে শাসক শ্রেণি ছলে বলে প্রচেষ্টা চালিয়েছে আসামকে একভাষী হিসেবে একীকরণ করার। এর উত্তরে ষাট, সত্তর বা আশির দশকের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের মূল অভিমুখই ছিল আসামের বহুভাষিক সত্তাকে তুলে ধরার। ফলেই ‘উনিশের চেতনা‘ প্রকৃতপক্ষে বহুত্বের চেতনাই। উনিশের চেতনা একটি বহুভাষিক সামাজিক পরিসরের শরিক সমস্ত ভাষাগোষ্ঠীর নিজের ভাষা চর্চার চেতনা।

১৯৬১ সালের ১৯ মে, ১৯৭২ সালের ১৬ আগস্ট, ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই, ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ সেই সংগ্রামের নানা রক্তাক্ত দিনের নাম। বহমান সেই ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস ১৯ মে। একুশ যদি ধর্মভিত্তিক জাতিতত্ত্বের প্রত্যাখান হয়, তবে উনিশ আসামের বহুভাষিক বহুসাংস্কৃতিক পরিসরে শাসকশ্রেণির উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাষানীতির বিরুদ্ধে বহুভাষিকতার নীতির, প্রত্যেকটি ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্য নাম।


বরাকের ভাষাসংগ্রাম সহ রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে বামপন্থী মহলে এখনও কোনও পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা হয়ে ওঠে নি। কোনও কোনও বামপন্থী দল কখনো রাজ্যের স্বার্থ রক্ষার নামে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। কোনও কোনও বামপন্থী দলের মূল্যায়নে আমরা দেখেছি, এক ধরনের সংখ্যালঘুবাদের ঝোঁক। তা ছাড়া, আসামের দু’টি প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক নানা প্রশ্ন নিয়ে দু’টি অংশের সমাজ-সংস্কৃতিকর্মীদের স্তরেও এখনও মতবিনিময়ের অভিপ্রায় নিয়ে কোনও আলোচনা চক্র বা সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণও হয় নি। দু’টি অঞ্চলের ইতিহাস সংস্কৃতি নিয়েও রয়েছে এক সীমাহীন পারস্পরিক অজ্ঞতা। ফলেই বিভ্রান্তি সৃষ্টির সব উপাদানই বিরাজমান।  ১৯৫১ সালের আদমশুমারিকে কেন্দ্র করে যে ভাষিক আগ্রাসনের ঘটনা ঘটে, সেই অধ্যায় নিয়েও দুঃখের বিষয় বরাক উপত্যকা এবং অবশিষ্ট আসামের বামপন্থী মহলে কোনও সর্বসম্মত দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠে নি। কোনও কোনও বামপন্থী লেখকের কলমেও অভিবাসী বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা হরণের সরকারি কর্মসূচিটিকে প্রশংসিত করার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে সম্প্রতি কালে। কেউ কেউ আসামের সমাজ ও রাজনীতিতে একটি বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাকে একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে চান।

বর্তমান নিবন্ধেও নানা অপূর্ণতা থাকতেই পারে। কিন্তু আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বরাকের ভাষা সংগ্রাম সহ আসামের ভাষা সংস্কৃতিগত সমস্যার নানা প্রশ্ন নিয়ে এক বামপন্থী পর্যালোচনার। একটি সর্ববাদী সম্মত বামপন্থী ভাষ্যই আগামী দিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারে। অন্যথায়, আমাদের সমস্ত অগ্রগতি থমকে যাবে বারবার ভাষাসংস্কৃতির নানা চোরাবালিতে।



৫টি মন্তব্য:

  1. অধ্যাপক নিশীথ রঞ্জন দাসের লেখা 'বরাক উপত্যকার রক্তস্নাত বহমান ভাষা আন্দোলনের এক সৈনিকের ডায়েরি' বামপন্থী পর্যালোচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। পড়ে দেখো।

    উত্তরমুছুন
  2. এই নিবন্ধে যে অবস্থান নেওয়া হয়েছে তা সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক কর্মসূচীর অঙ্গ, একে বামপন্থী মূল্যায়ন বলে গণতন্ত্রের পরিধিকে এবং বামপন্থার অন্তর্বস্তুকে খাটো করার কোন মানে হয় না। বরঞ্চ গণতন্ত্রের সর্তেই আরও র‍্যাডিক্যাল অবস্থান নেওয়া যায় - গণতন্ত্রের আরও সম্প্রসারণকেই কি লেখক সংখ্যালঘুবাদ হিসেবে অভিহিত করেছেন? লেখকের অবস্থান স্পষ্ট ও সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য, যদিও বেশ কিছু বক্তব্য অতিকথনের ও গণতন্ত্রহীনতার দোষে দুষ্ট। কিন্তু সুপ্ত পার্টিজান দৃষ্টিভঙ্গী ভাষার অধিকারের প্রশ্নে গণতান্ত্রিক তাত্বিকীকরণ করা থেকে লেখককে বিরত রেখেছে। কোন একটা জনসমষ্ঠির (সংখ্যায় ছোট না বড় তা গুরুত্বপূর্ণ নয়) ভাষিক পরিচিতি কী হবে তা কীভাবে নির্ধারিত হবে? ইতিহাস, ভাষাতত্ব, নৃতত্বের বিশেষজ্ঞদের কূটতর্কের মধ্য দিয়ে, না এই জনসমষ্ঠি বর্তমানে কী ভাষায় কথা বলে বা এই জনসমষ্ঠি নিজেদের কী পরিচয় দিতে চায় তা দিয়ে (যা অবশ্যই যাচাই করতে হবে এক ভয়মুক্ত পরিস্থিতিতে এবং এটা করা খুব কঠিন কাজও নয়)? প্রথম প্রক্রিয়া দিয়ে নির্ধারণ করলে বিতর্কের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারটুকুও শিকেয় তুলে রাখতে হয় এবং নিজের ভাগ্য নিজে নির্ধারণ করার অধিকারকে অস্বীকার করে গণতন্ত্রকে পদদলিত করা হয়। দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় যে ভাষা যে স্তরে আছে সেখান থেকেই উচ্চতর অধিকার আদায়ের কাজ শুরু করতে হয় এবং সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সর্বনিম্ন স্তরে মুখের ভাষাকেই মান্যতা দিয়ে লেখ্য ভাষা তৈরির কাজে সচেষ্ট হতে হয় যাতে শিক্ষার প্রসার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এই গণতান্ত্রিক অবস্থান থেকে বিচার করলে ভাষিক পরিচিতি নির্ধারণ করা খুব জটিল কাজ নয়। অনেকে হয়ত বলবেন তাতে অনৈক্য বাড়বে - আমার মতে অনৈক্য তো বাস্তবে রয়েছে, একাজটি করলে ঐক্যের ও জাতিগঠনের ভিত তৈরি হবে। অথচ লেখক বামপন্থা ও গণতন্ত্রকে দুঃখজনকভাবে পদদলিত করেন, যখন তিনি বরাকের চা-শ্রমিকের মুখের ভাষাকে উপভাষা হিসেবে উল্লেখ করেন। তাহলে এই ভাষাটি কার উপ এবং লেখক কী করে এব্যাপারে সিদ্ধান্তটি নিচ্ছেন, এভাবে ঝুলি থেকে উগ্রজাতিয়তাবাদী বেড়ালের মুখ বেড় করে দিচ্ছেন না তো? লেখক লিখেছেন বামপন্থীরা ভারতবর্ষেও শ্রেণিসংগ্রামের সাথে যে লড়াইকে যুক্ত করতে চাইছেন, তা হল নারী, আদিবাসী এবং সংস্কৃতির লড়াই। লেখকের একথার অর্থ নিশ্চিতভাবে এভাবে করা যায় যে শ্রেণিসংগ্রামের পাশাপাশি এগুলি নিয়েও আন্দোলন করতে হবে। অর্থটা যদি তাই হয় তাহলে তো মার্কসবাদকে অস্বীকার করে বামপন্থার মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করা হয়ে যায়। লেখক যেভাবে নারী, আদিবাসী ও সংস্কৃতির লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন - সে সবকিছুই গণতন্ত্রের ও শ্রেণিসংগ্রামের অন্তর্বস্তু, তবে খিলঞ্জিয়ার মত আদিবাসী শব্দ নিয়ে আমার আপত্তি আছে কারণ এতে বাকীদের সময়ের মাপকাঠিতে অ-আদি করে দেওয়ার প্রবণতা আছে, বরঞ্চ জনজাতি - দলিত ইত্যাদি শব্দ, যা বঞ্চনা ও উৎপাদন সম্পর্কের মাপকাঠিতে সামাজিক বর্গকে চিহ্নিত করে, তা বেশি গ্রহণযোগ্য। আজকের নয়া-বামপন্থায় যা সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় তা হলো গণতন্ত্রের প্রশ্ন, কারণ গণতন্ত্র ছাড়া বামপন্থী হওয়া যায় না, অথচ পরিতাপের বিষয় এই যে বামপন্থীরা ইতিহাসের যে কোন জটিল মুহূর্তে গণতন্ত্রকে বিভিন্ন অছিলায় পদদলিত করেছেন।
    শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে বামপন্থীদের এক অতিমানবের মর্যাদা প্রদানের ব্যর্থ প্রচেষ্টা বামপন্থার প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে। এই ঐতিহ্য থেকেই ত্রিপুরার মত এক মডেলহীন মডেলকে বামপন্থার শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে উর্দ্ধে তুলে ধরার প্রবণতা ভাবের ঘরে চুরি এবং এই প্রয়াসে সাময়িক হাততালি জুটলেও তা বামপন্থাকে হাস্যাস্পদ করে তুলে।

    উত্তরমুছুন
  3. স্বাভিমান এনজিও'র নামে প্রকাশিত উপরোক্ত মন্তব্যটি করেছেন অরূপ বৈশ্য।

    উত্তরমুছুন
  4. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন