সিলেটে আরকুম শাহ-র মাজারে যখন প্রথম যাই
উনিশ শ নিরানব্বুই সালে। তখনই প্রথম শুনি এই গান। মাজারে অতিথি এলে মাজারের শিল্পীরা
ঢোল করতাল বাজিয়ে নেচে নেচে গান করেন, ‘আমার আনন্দের আর সীমা নাই গো, প্রাণবন্ধু আসিল
ঘরে`। এই মুহূর্তে
বরাক কতটা আনন্দমুখর আমি জানি না। কারণ আমি বসে আছি চৌদ্দশ কিলোমিটার দূরে। মনে পড়ছে
শুধু সেই দিনগুলি কথা। বর্ধমানে পড়তাম। কলকাতা থেকে কামরূপ এক্সপ্রেস গুয়াহাটি স্টেশনে
পৌঁছলেই ছুটতাম জানতে রাতের ট্রেন পাবো কিনা। তখন ইন্টারনেটের যুগ নয়। অনওয়ার্ড রিজার্ভেশন
করার একটা নিয়ম ছিল, টেলিগ্রাম পাঠিয়ে পরের ট্রেনের বার্থ রিজার্ভ করা যেতো। আমরা নিষ্ঠার
সাথে প্রতিবারই সেটা করতাম। প্রতিবারই গুয়াহাটি স্টেশনে নেমে জানতাম সেই ট্রেলিগ্রাম
পৌঁছোয় নি। তখনই খোঁজ শুরু হত টিটি-র। কারণ কাউন্টার থেকে বার্থ বুক করার সময় ততক্ষনে
পেরিয়ে যেতো। সারা রাত্রি ও সারা দিনের ট্রেন সফরের ধকলকে অগ্রাহ্য করে টিটিকে খোঁজা।
‘দাদা, একটা বার্থ হলেও চলবে। আমরা ভাগাভাগি করে নেবো।` টিটি-র কোন্ উত্তরের অর্থ সবুজ সংকেত
আর কোন্টি নয়, আমরা ততদিনে জেনে গিয়েছি। যদিও মুখে সবসময়ই বলত, কোনো সিট নেই। এই ‘নেই` কথার কোনটা সত্যি সত্যি ‘নেই` আর কোনটা দর হাঁকানো, আমরা জানতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কত টাকাই বা পকেটে থাকত। ঝুলোঝুলি চালিয়ে যেতাম। ক্কচিৎ দুটো
বার্থ পেয়েছি আমি আর বিশ্বতোষদা। কখনো একই বার্থে দুজনে দুদিকে মাথা দিয়ে ওর মাথাকে
আমি বালিশ করে, আর আমার মাথাকে ও বালিশ করে পাহাড় লাইনে বাড়ি ফিরেছি, তার ইয়ত্তা নেই।
কখনো কপাল খারাপ হলে সারা রাত, দুটো সিটের নীচে মাটিতে খবরের কাগজ পেতে অথবা বাথরুমের
সামনের খোলা জায়গায় বসে রাত কাটিয়েছি।
তবু এই লাইন নিয়ে আমাদের অহংকারের শেষ ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখনই কেউ জিজ্ঞেস করত, বাড়ি কোথায়। আমি আর বিশ্বতোষদা শিলচর বলেই বলতাম,
চৌদ্দশ কিলোমিটার দূরে। সাঁইত্রিশটা টানেল পেরিয়ে যেতে হয়। ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত
বাড়ালেই পাহাড়ের ঘাস, গাছের ডাল ছোঁওয়া যায়। বন্ধুরা অবাক হয়ে যেতো। আমরাও অবাক হতাম
যখন প্রতি শনিবার অর্ঘ্য সেনের কাছে গান শিখতে কলকাতা আসতাম, তখন ইলেকট্রিক ট্রেনের
বিদ্যুৎ গতি দেখে। নিজেরা ফিসফিস করতাম, কবে আমাদের বরাকেও এমন ট্রেন চলবে। আমাদের
অনেক বন্ধু আশি নব্বুই কিলোমিটার দূর থেকে যাতায়াত করে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে
আসত।
কলকাতা থেকে একশ পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব ট্রেনে বর্ধমানে এসে অনুষ্ঠান করে আবার
রাতেই কলকাতায় ফিরে যেতেন সুচিত্রা মিত্র, অর্ঘ্য সেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ইন্দ্রানী
সেনরা। আমাদের কাছে তা ছিল অভাবনীয়। আমাদের শিলচর থেকে হাফলং যেতেই দিন কাবার। কপাল
খারাপ হলে রাতও মাটি। ধর্মনগর করিমগঞ্জও ছিল ট্রেনে দূর অস্ত্। আমার ছাত্রজীবন শুরু
হয়েছিল নিউ বঙ্গাগাঁও থেকে ব্রডগেজের ট্রেন ধরা দিয়ে। এমএসসি পড়া শেষ হতে হতেই ব্রডগেজ
চলে এল গুয়াহাটি অবধি। খুব তাড়াতাড়ি ব্রডগেজের লাইন চলে গেল লামডিং, এমনকী ডিব্রুগড়
অবধি। শিলচর অধরাই রয়ে গেলে। লামডিং গুয়াহাটি মিটারগেজ তুলে দেওয়ার পর আমাদের স্বপ্নের
কু ঝিকঝিক মিটারগেজ ক্রমেই হতশ্রী হতে থাকল। তবু সব মেনে নিয়েছিলাম আমরা, অচিরেই ব্রডগেজ
আসছে। ছ’জন প্রধানমন্ত্রী এলেন গেলেন, আমরা পড়ে রইলাম সেই অন্ধকারেই।
ভোট এলো ভোট গেলো।
লোকসভায় যিনিই ভোট চাইতে আসেন, তিনিই বলেন, আমাকে ভোট দিন। ব্রডগেজ এনে দেবো। বিধানসভায়
যিনি ভোট চান, তিনিও বলেন, আমাকে ভোট দিন, আমি এনে দেবো ব্রডগেজ। কখনো শুনি ট্রান্সপোর্ট
লবির চক্রান্ত। কখনো শুনি দিল্লি উদাসীন। কখনো শুনি দিসপুর কাঠি নাড়ছে। আশ্চর্য কথা।
যারা ভোট চাইতে আসতেন ব্রডগেজের নামে তাদের প্রত্যেকেরই টিঁকি বাঁধা ছিল দিল্লি কিংবা
দিসপুরে। এমন কী ট্রান্সপোর্ট লবির মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তাঁদের অনেকেই। অনেক নেতারই
বাস চলত নাইটসুপার ডেসুপার হয়ে। এখানে রঙের কোনো তারতম্য নেই। বরাকের মানুষ জানতেন
সবই। আমাদের বঞ্চনার অপমান ক্রমে অন্তর্মুখী হল।
বর্ণবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট একজন অন্ত্যজ
যেমন নিজের জন্মের প্রতি ধিক্কারে একান্তে বলে, ‘জন্ম নিয়েছি ধূলিতে/ দয়া করে দাও ভুলিতে/
নাই ধূলি মোর অন্তরে`। তেমনি দুর্ভাগা বরাকের আমরাও আমাদের সব দুর্গতির কথা বলতে গেলেই বলতাম,
আমাদের জন্মটাই অভিশপ্ত। আমরা কেঁদেছি কবিতায় গল্পে ছবিতে সিনেমায় ব্যর্থ শ্লোগানে।
আমাদের নিয়ে খেলেছে কেউ কেউ। আমরা বুঝেও বুঝি নি। যখন আমাদের ক্রোধ তীব্র হয়েছে। কেউ
কেউ ভয় পেয়েছেন, এই বুঝি সমস্ত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফেটে পড়বে প্রবল বিক্ষোভে। তখনই
গোপনে কেউ কেউ ছড়িয়ে দিয়েছেন বিষের হাওয়া। হিন্দু মুসলমান, গরু শুয়োরে মত্ত হয়ে ভুলে
গিয়েছি, আমাদের সব না-পাওয়াগুলোর কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই। এখন গোটা বরাক জুড়ে আনন্দের
হাওয়া বইছে। আমরা বাকি পৃথিবীর সাথে যুক্ত হচ্ছি। আমরা আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা
হয়ে থাকব না। জানি, এই মুহূর্তে এই দেশ ভাবছে এমন ট্রেনের কথা যা ছুটবে ঘন্টায় তিনশ
কিলোমিটার বেগে।
এখন স্মার্ট ট্রেন, স্মার্ট স্টেশন, স্মার্ট সিটির হাওয়া বইছে দেশজুড়ে।
এই হাওয়ায় যে ট্রেন আমাদের আসছে, তার গতি হবে কোথাও ঘন্টায় তিরিশ কিলোমিটার, কোথাও
পঞ্চাশ কিলোমিটার। গোটা যাত্রাপথে সর্বোচ্চ গতিতে যাবে বরাকের ভেতরে শুধু। ঘন্টায়
সত্তর কিলোমিটার। চারধারে আশঙ্কা। ক’দিন চলবে এই ট্রেন? বর্ষায় চালু থাকবে তো লাইন?
নাকি আবার সেই দিনের পর দিন লাইন বন্ধ। জরুরি সামগ্রীর আকাল। কালোবাজারী। তবু আমাদের
আজ আনন্দের সীমা নেই। জানি, উনবিংশ শতকে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছিল অনেক পশ্চাৎপদ,
যখন এখানকার পাহাড় জঙ্গল ছিল দুর্গম, তখন সাঁইত্রিশটি টানেল ও একটি দীর্ঘ রেলপথ গড়ে
উঠতে সময় লেগেছিল আট বছর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের চোখ ধাঁধানো এই সুসময়ে আমাদের
সুড়ঙ্গগুলি ও লাইনকে বড়ো করতে আর কিছুটা নতুন লাইন পাততে সময় রেগেছে দীর্ঘ উনিশ বছর।
তবু আমাদের খুশির সীমা নেই আজ! আবার ট্রেন ছুটবে গুয়াহাটি থেকে শিলচর। হোক না ন্যূনতম
চৌদ্দ ঘন্টার সফর। তবু হারেঙ্গাজাওয়ের সিঙারা। বদরপুরের পুরি তরকারি। মাহুরের প্যারা।
জাটিঙ্গার কমলা। সব ফিরে আসছে আমাদের কাছে। হাফলং এ টিলার ওপরের হোটেলের ডিম ভাত নিউ
হাফলঙে থাকবে কি? খুব বেশি চাওয়া নেই আমাদের। বুলেট ট্রেন চাই না। উলেকট্রিক ট্রেনের
দরকার নেই। একটু ভালোবেসে, আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক না ভেবে একটি নিরবচ্ছিন্ন
ট্রেন পরিষেবা হলেই হোলো। শিলচরে চাপবো নামবো কলকাতা বা চেন্নাই বা নতুন দিল্লিতে মোটামুটি
স্বাভাবিক সময়ে, তাতেই হবে। আমি জানি না, এই মুহূর্তে যারা কৃতিত্বের প্রতিযোগিতায়
মত্ত, তারা এই প্রতিশ্রুতিটুকু দিতে পারবেন কি না। মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি আগামী ভোটের
বড় বড় হোর্ডিং, দলের প্রতীক আলাদা হলেও কৃতিত্বের ব্রডগেজ ট্রেনের ছবি অভ্রান্তভাবেই
ঠাঁই পাবে সেখানে। এই প্রবল প্রতিযোগিতার মধ্যে প্রতিযোগীরা নিশ্চয়ই ভুলে যাবেন, কিন্তু
আমরা বরাকের মানুষরা যেন না ভুলি, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের নাম যদি ত্রিপুরা না হতো,
সেখানকার মানুষ যদি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হতেন, তবে উনিশ বছরেও এই লাইন
জুড়তো কিনা আমার সন্দেহ আছে।
এটুকুমাত্র রাজনৈতিক উচ্চারণের জন্যে ক্ষমা
চাইছি।