শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫

যিনি স্পর্ধা শিখিয়েছেন!

তিনি আমাদের রাজনীতির শিক্ষক, একথা বললে তাঁর সম্মান বাড়ে না। বাড়ে আমাদেরই। কারণ তাঁর মত একজন নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী সৎ রাজনৈতিক নেতাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েও আমরা উচ্চতায় তাঁর ধারে কাছেও আসতে পারলাম না। আজ দুপুর সাড়ে বারোটায় দেশহিতৈষীর সন্দীপ দে প্রথম ফোন করে দিলেন দুঃসংবাদটি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে ছুটলাম। তাড়াতাড়ি কলকাতা পৌঁছতে হবে। সারা রাস্তা জুড়ে গত ৩৬ বছরের আমার রাজনীতির জীবনের নানা সময়ের ঘটনাগুলি ছবির মত ছুটে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। বারবারই মনে মনে বলছি, তিনি আমার শিক্ষক। তারপর বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠছে। এই কথা বললে নূরুলদার তো সম্মান বাড়বে না। কারণ তাঁর জীবন থেকে কিছুই নিতে পারলাম না আমার জীবনে। তাঁকে শিক্ষক বলার কতটাই বা যোগ্যতা রয়েছে আমার!


১৯৭৯ সাল। সারা আসামে বিদেশি বিতাড়ণ আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমার দিদি ও মাসতুতো দাদা তখন গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এবং সেখানে সক্রিয়ভাবে এসএফআই করে। দাদা দিদিদের অনুপ্রেরণায় এসএফআই-এর সদস্য হয়ে গেলাম। তারপর থেকেই নাজিরপট্টির দোতলায় যাতায়াত শুরু হল। ১৯৭৯ সালের পুজোর ছুটির দিনে গোপেনদা কাঠের আলমারি থেকে বের করে আমার হাতে তুলে দিলেন পার্টি কর্মসূচি। তার কিছুদিন আগেই ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের সালকিয়াতে পার্টির প্লেনামে ঠিক হয়, পার্টিতে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্রার্থী সদস্যপদ ও পূর্ণ সদস্যপদের আগে প্রাথমিক একটি স্তরকে অন্তর্ভুক্ত করার। তখনই পার্টি বা গণসংগঠনের সক্রিয় কর্মীদের প্রথমে এ,জি (তখন বলা হত অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ, এখন বলা হয় অক্সিলিয়ারি গ্রুপ)-এ অন্তর্ভুক্ত করে কর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদানের একটি স্তর অতিক্রম করে প্রার্থী সদস্যপদ প্রদান করা। এর আগে এ,জি ব্যাপারটা যেমন ছিল না, ঠিক তেমনি পার্টিতে সদস্যপদ পাওয়াটাও অত্যন্ত কঠোর ছিল। সালকিয়াতে তা খানিকটা লঘু করা হয় সঙ্গে একটি বাড়তি স্তরকে যোগ করে। ১৯৭৯ সালের পুজোর পরপরই শিলচরের প্রথম পার্টি এ,জিতে আমি এবং আরো কয়েকজন ছাত্রকর্মী অন্তর্ভুক্ত হলাম। তখন শিলচরের পার্টি লোকাল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন নূরুলদা। আমাদের নিয়ে বসতেন নূরুলদাই। নূরুলদা আমার পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন এর আগেই। আমার মেসো এবং কাকা ছিল তাঁর যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বন্ধু।


কলেজে তখন আমার সহপাঠি, বন্ধু দেবাশিসের নেতৃত্বে ডিএসও এবং বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য ও পার্বতী পালের নেতৃত্বে আরওয়াইএসএল নামের নকশালপন্থী ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মকাণ্ড ছিল। মিঠুদা (পার্থপ্রতিম মৈত্র), তীর্থঙ্কর দা (চন্দ) এবং এখন এই শহরের বিশিষ্ট চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট অরিন্দম ভট্টাচার্যরা সকলেই আরওয়াইএসএল করত। লুকুদার চায়ের দোকানে প্রতিদিন চলত দেবাশিস ও বিশ্বনাথদার তাত্ত্বিক তর্ক। তিন দুনিয়ার তত্ত্ব, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ একদিকে এবং অন্য দিকে ভারতের একমাত্র সাম্যবাদী দল, শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার তর্ক। আমি এসএফআই-এ যোগ দিতেই এর সাথে যুক্ত হল ভারতে সামন্ততন্ত্র রয়েছে কিনা, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব না সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব- বিষয়ক তর্ক। রাজনীতিতে আমি নতুন, দেবাশিস পুরোনো। ফলে দেবাশিস প্রতিদিন এক একটি কথা বলে আমাকে ঘায়েল করত, আর আমি উত্তর খুঁজতে পার্টি অফিসে গিয়ে নূরুলদাকে প্রশ্ন করতাম। নূরুলদা একটা একটা করে বিষয়গুলি বুঝিয়ে দিতেন। পরে এ,জি সভার আগে বলতেন, তোর প্রশ্নগুলো লিখে আনিস। আমি আগে থেকে প্রশ্নমালা তৈরি করে তাঁর হাতে তুলে দিতাম। নূরুলদা ধৈর্যের সাথে সেগুলো পড়ে উত্তর দিতেন। কখনো বলতেন কোনও একটি বই পড়ে নিতে সঙ্গে। তখন দেশহিতৈষী পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে পার্থ ঘোষের ‘সমাজতন্ত্র কী কেন কোন পথেশিরোনামে একটি ধারাবাহিক প্রকাশিত হত। আমার রাজনীতির হাতেখড়িতে এই ধারাবাহিকের অবদানও অপরিসীম। চীনে তখন বিরাট অদলবদল চলছে। সেই নিয়ে পিপলস ডেমোক্রেসিতে প্রকাশিত বাসবপুন্নাইয়ার নানা নিবন্ধের অনুবাদ প্রকাশিত হত দেশহিতৈষীতে। সেগুলোও প্রতি সপ্তাহে গোগ্রাসে গিলতাম। আমাদের এ,জি সভা বা পার্টি ক্লাসে নূরুলদা সেই প্রবন্ধগুলির প্রসঙ্গও আনতেন। নূরুলদাকে আমরা ভয় পেতাম ঠিকই, কিন্তু সে সময় থেকেই তার সাথে অবলীলায় তর্কে মেতে উঠতে পারতাম। এই সম্পর্ক তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হওয়ার পরও অব্যাহত থেকেছে। পশ্চিমবঙ্গের কমরেডদের জন্যে এই ব্যাপারটা প্রায় অকল্পনীয়। এখানে জোনাল সম্পাদক ঘরে ঢুকলেই সাধারণ পার্টি সদস্যদের গল্পগাছা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের শিলচরে পার্টির অভ্যন্তরের পরিবেশটা অনেকটাই ব্যতিক্রমী ছিল। এক বছর পর যখন আমি পার্টির প্রার্থী সভ্যপদ পাই তখন আমার বয়স আঠারো পূর্ণ হতে কয়েকমাস বাকি। নূরুলদার মুখস্থ ছিল আমার জন্মের সন তারিখ। ফর্ম ফিলাপ করার সময় তিনি হেসে বললেন, তোর তো এখনও আঠারোই হয় নি রে। এখনও তিন মাস বাকি। আমার ফর্মে ছিল তাঁরই স্বাক্ষর।


এখন নূরুলদা নেই। এসব ভাবতে ভাবতে অজানা গর্বে বুক ভরে ওঠে, আর চোখের কোণে আচমকাই নেমে আসে অশ্রুবিন্দু। নিজের প্রতি ধিক্কারই হয়! আমার রাজনীতির জীবনে আলো ফেলে গেছেন গোপেনদার মত আন্দামানে দ্বীপান্তরিত বিপ্লবী, দিগেন দাশগুপ্তের মত বিপ্লববাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সুরমা উপত্যকার প্রথম কমিউনিস্টদের একজন, অচিন্ত্যদার মত ক্ষুরধার মেধার জননেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। কাছে পেয়েছি চানবাবু সিংহ, মনীষ ভট্টাচার্য, রুক্মিণী আচার্যের মত কৃষক নেতা, তেভাগার বীর সেনানী ভগীরথ সিংহ, সোনামনি সিংহ, কাশীরাম মুড়া, মজহর আলি, তৈয়ব আলিকে। কৃষক সভার সভাসমিতিতে ‘চাষী দে তোর লাল সেলামখালি গলায় গাইতেন উধারবন্দের নগরের কৃষক নেতা উপাসক নুনিয়া। তাঁর গাওয়া শুনেই শিখেছি এই গান। ‘মোদের চলার পথে পথে রক্তনিশান ওড়েকে উপ্সাদা গাইতেন ‘মোদের চলার পথে পথে লাল ঝাণ্ডা ওড়ে। আমার ভারি ভালো লাগত সেটি। আমিও এভাবেই গাই এখনও গানটা। কষ্ট হয়, যখন আবিষ্কার করি ওই রক্তপতাকার ওই বীর সেনানী আলোকিত ব্যক্তিদের আলোর এক ফোঁটাও জীবনে ধারণ করতে পারলাম না। যে পতাকা তারা বইবার জন্যে দিয়েছিলেন সেই পতাকা বইবার শক্তি বরাক উপত্যকায় আমি বা আমরা সকলেই ক্রমেই হারিয়েছি।


অনেক কথা ভিড় করে আসছে মনে। নূরুলদা কখনো কোত্থাও এক মিনিট দেরিতে যেতেন না। কেউ কোনো সভাসমিতিতে দেরিতে এলে প্রচণ্ড রাগ করতেন। এই কিছুদিন আগে অবধি হেঁটে চলাফেরা করতেই ভালোবাসতেন। তাঁর একটি হিসেব ছিল। সাড়ে তিন থেকে চার কিলোমিটারের দূরত্ব তিনি কখনোই রিক্সায় যেতেন না। এভাবেই ঝালুপাড়ার বাড়ি থেকে নাজিরপট্টির পার্টি অফিসে তিনি হেঁটে আসতেন প্রতিদিন। শিলচরের পুরোনো লোকেদের এই ছবিটি নিশ্চয়ই গাঁথা রয়েছে-  রাত্রি আটটা বা সাড়ে আটটার নাজিরপট্টির পথ দিয়ে প্রেমতলা উল্লাসকর সরণি হয়ে ঝালুপাড়ার দিকে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন নূরুলদা ও ছবিদি। একমাত্র ইম্ফলে পার্টির কাজে গেলেই নূরুলদা প্লেনে যেতেন। গুয়াহাটি যেতেন রাজ্য সরকারি পরিবহনের তখনকার হতশ্রী বাসেই। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় যেতেন স্লিপার ক্লাসের ট্রেনে। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে প্রতি মাসে অন্তত দুবার তাঁকে যেতে হত গুয়াহাটিতে। কোনো কোনো মাসে আরো বেশি বার। সোনাপুর লাইড্রিমবাইয়ের ভাঙাচোরা রাস্তায় গ্রীষ্ম বর্ষা শীতে সবসময়ই তিনি যেতেন ওই বাসেই। ওই পথের ওই কষ্টের বাসযাত্রা করে শিলচরে বাড়ি ফিরেই ¯স্নান সেরে হয়ত বেরিয়ে পড়লেন লাইন বাসে চড়ে সোনাই বা ভাগাবাজার বা হাইলাকান্দিতে। ক্লান্তিহীন ছিলেন নূরুলদা। কেন্দ্রীয় কমিটির বড়ো দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে পার্টি পত্রিকার অনাদায়ী টাকা বাড়ি বাড়ি ঘরে সংগ্রহ করার কাজও করতেন। তখন নূরুলদাকে দেখলেই আমরা ভয় পেতাম তখন। কারণ দেখা হলেই, এই ব্যস্ততার মধ্যে ডায়েরির ভেতর থেকে বার করবেন তালিকা, কার এলাকায় গণশক্তি, দেশহিতৈষী বা পিপলস ডেমোক্রেসির কত টাকা অনাদায়ী পড়ে আছে। দিল্লি গুয়াহাটি ইম্ফল সোনাই ধলাই করার মধ্যেই নানা লোকের বাড়িতে বা অফিসে ঢুকে সংগ্রহ করে আনতেন অনাদায়ী টাকা। পরে দেখা হলে বলতেন, তোরা তিন মাস ধরে টাকাটা আনতে পারলি না। আমি তো যেতেই দিয়ে দিল।


তখন আমি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ছুটিতে বাড়ি এসেছি। ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি সভা হবে শিলচরে। নূরুলদা আমাকে বললেন, ডায়েরিতে তারিখটা লিখে নাও। সেদিন থাকতে হবে, কয়েকটা গান করতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। উনি বারবার বললেন, ভুলে যাবি না কিন্তু। আমি বললাম, ভুলব কেন। পরের দিন নূরুলদা চলে গেলেন গুয়াহাটিতে, তারপর কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় দিল্লিতে। 

এই সময়ের মধ্যে একদিন করিমগঞ্জ থেকে তখনকার জেলা সম্পাদক শ্রীনিবাসদা চিঠি লিখে বলল, ওই দিনেই দুল্লভছড়াতে যুব ফেডারেশনের কমরেডরা একটি গানের অনুষ্ঠান করতে চায় আমাকে নিয়ে। টিকিট দিয়ে অনুষ্ঠান করে ওরা অর্থ সংগ্রহ করবে সংগঠনের জন্যে। আমি যেন অবশ্যই যাই। আমি তো জলে পড়লাম। নূরুলদা পইপই করে বলে গেছেন যেন ওই সভাটা মিস না করি। দুলালদাকে বললাম। ও বলল, সভার আগে দুটো গান গাওয়ার চেয়ে এই অনুষ্ঠানটা বেশি জরুরি। শ্রীনিবাস চিঠি লিখেছে। তুমি চলে যাও। আমি নূরুলদাকে বলে দেবো। উনি জানলে বিষয়টা বুঝবেন। আমি চলে গেলাম। এদিকে সভার দিন সকালবেলা নূরুলদা ফিরেছেন। সভায় এসেই নূরুলদা জিজ্ঞেস করলেন, শুভ কই। কে একজন বলল, ও তো দুল্লভছড়াতে ফাংশনে গেছে। শুনেই নূরুলদা অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। ‘আমি এতদিন আগে ওকে নোট করিয়ে রাখলাম, আর ও চলে গেলে।ততক্ষণে দুলালদা এসে দেখে নূরুলদা অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন। ওনার রুদ্রমূর্তি দেখে দুলালদা ভয়ে কিছুই বলল না। ভাবল, পরে রাগ নেমে গেলে বুঝিয়ে বলবে। তারপরের দিন পার্টি জেলা কমিটির সভা শহীদ ভবনে। সেদিনই বিকেলে আমি ফিরব। পার্টি অফিসে গিয়েছি সবার সাথে দেখা করতে। নূরুলদা আমাকে দেখেই মিটিং কিছুক্ষনের জন্যে স্থগিত রেখে বেরিয়ে এলেন। সপ্তমে গলা চড়িয়ে বললেন, তুমি আমার কথা রাখো নি। তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তোমাকে আমি ¯স্নেহ করি। তোমার কাকা মেসো আমার বন্ধু। তোমার সিক্সটি-টু তে জন্ম। তুমি আমার বিশ্বাসভঙ্গ করলে। আমি তো হতবাক। এত রেগে গেছেন নূরুলদা। ঝড়ের বেগে কথাগুলি বলে আবার সভায় চলে গেলেন। সামনে বসেছিলেন ছবিদি। আমাকে নূরুলদার গালি দেওয়া শুনে বেরিয়ে এসেছিলেন গোপেনদা। নূরুলদা বেরিয়ে যেতে ফিক করে হেসে বললেন, মোগলাই খেপছে রে। কিতা করছস। যা বর্ধমান যা। মাতিস না। আবার খেপবো। তখন আমার মাথা গরম হয়ে গেল। দুলালদার ওপর সব রাগ ঝেড়ে দিয়ে আমি ছবিদি ও গোপেনদার কাছে নালিশ করতে শুরু করলাম। ছবিদি আমার প্রতি খুব সহানুভূতিশীল হয়ে পড়লেন। সত্যি, ও শুভর কথাটা একবার শুনলও না। না শুনেই গালি দিয়ে গেল। গোপেনদা হেসেই যাচ্ছেন। তখন দুলালদা বেরিয়ে এল, বলল, সরি সরি। আসলে নূরুলদা ওই সভার আগের দুটো গানকে যে এতটা গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছিলেন বুঝতে পারি নি। আমি ভযে কিছু বলতে পারি নি। পরে ওনাকে বলে দেবো।


আমি ফিরে গেলাম বর্ধমানে। ভুলেও গেলাম, কারণ ওনার কাছে বকুনি খাওয়াটা কোনো ব্যাপারই ছিল না আমাদের জন্যে। মাস দুয়েক পর দেখি নূরুলদার একটি পোস্টকার্ড এসেছে আমার হোস্টেলের ঠিকানায়। লিখলেন, ¯স্নেহের শুভ, কলকাতায় আসছি অমুক তারিখে। যোধপুর পার্কে থাকবো। একবার পারলে দেখা কোরো। আমার মাথা থেকে ততদিনে নূরুলদার বকুনির ব্যাপারটা চলে গেছে। আমি নির্দিষ্ট দিনে এলাম কলকাতায়। নূরুলদা অনেক গল্পগুজব করলেন। বর্ধমানের খোঁজ নিলেন। পার্টির কথা জিজ্ঞেস করলেন। অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর বেরিয়ে এলাম বাড়ি যাবো বলে। লিফটের সামনে এসে হঠাৎ বললেন, তুই রাগ করিস নি তো তোকে বকে ছিলাম বলে। এই দুলাল টুলাল এত দায়িত্বহীন, আমাকে বলবে তো তুই পার্টিরই প্রোগ্রামে দুল্লভছড়া গিয়েছিস। বলে, ভয়ে বলি নি। ভয় পাওয়ার কী আছে, আমি মারব নাকি! আমি বললাম, না, না। আমি কিছু মনে করি নি।



বর্ধমান থেকে ফিরে এলাম শিলচরে। কলেজে পড়ানোর কাজের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পার্টি রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হলাম। এই সময় থেকে নূরুলদা সর্বভারতীয় পার্টি সংগঠনে আরো বেশি বেশি জড়িয়ে পড়লেন। গুয়াহাটিতে বেশি সময় দেন। মাঝে মাঝেই যান ইম্ফলে। কিন্তু বরাক উপত্যকায় নানা কারণে পার্টির সংগঠন ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। এদিকে বরাকের নির্বাচনী রাজনীতি আরো বেশি বেশি করে ধর্ম-জাতপাতের নিগড়ে বাঁধা পড়ে যেতে থাকে। আদর্শবাদের বিদায় নিয়ে তার জায়গা নেয় অর্থশক্তির প্রাধান্য এবং পারিতোষিক বিতরণের মাধ্যমে নির্বাচনী সমর্থন আদায়ের রাজনীতি। নির্বাচনের পর নির্বাচনে নূরুলদা এবং তাঁর আদর্শবাদ পরাস্ত হতে থাকল। ভোটের অঙ্কে শক্তি ক্ষীণ হতে থাকল পার্টির। যে নূরুলদা কখনো নিজের মনিপুরিত্ব বা মুসলমান পরিচয়কে রাজনীতিতে টেনে আনেন নি, তাঁর সাধনভূমি বরাক এই জাতপাত-ধর্ম বিবেচনার রাজনীতির ক্ষেত্র হয়ে গেল। যিনি নিজেকে মার্কসবাদের আদর্শে নিবেদিত শ্রমিক কৃষকের মুক্তির স্বপ্নে দায়বদ্ধ এক রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তুলে ধরেছেন, তাঁর কোনো স্থান বরাকের নির্বাচনী রাজনীতিতে রইল না। মাত্র চৌদ্দ মাসের লোকসভার কর্মকালে তিনি লোকসভাকে সাধারণ মানুষের দাবি দাওয়া নিয়ে মুখর রেখেছেন। একবার মাত্র বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে বিধানসভাকে সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া আদায়ের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেছেন কুশলতার সঙ্গে। এসব বরাকের নির্বাচনী রাজনীতিতে গুরুত্বহীন হয়ে গেল। 

আজ কজন জানে জরুরি অবস্থার সময় সারা দেশের সিপিআই (এম)-এর সাংসদদের মধ্যে মিসা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল মাত্র দুজনকে। একজন প্রবাদপ্রতিম জ্যোতির্ময় বসুকে। দ্বিতীয়জন ছিলেন মাত্র চৌদ্দ মাস লোকসভায় কাজ করতে পারা তরুণ সদস্য নূরুল হুদা। চৌদ্দ মাসেই লোকসভায় নূরুল হুদা নিজের কন্ঠস্বরকে এতটাই বলিষ্ঠতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন জরুরি অবস্থার সময় এই দুজন সদস্য যেন সভায় না আসতে পারে। নূরুলদা বরাকের রাজনীতিতে গুরুত্ব হারাতে শুরু করলেন কারণ তিনি দুর্গাপুজা বা ঈদে চাঁদা দেন না, দেবার সামর্থ্যও নেই। কথায় কথায় পকেট থেকে লাখ টাকা বের করে চাঁদা দেন না। যেখানে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে, একবার মৌলানার দরবারে গিয়ে কুর্নিশ জানানো বা গুরুদেবের জন্মতিথির প্রভাতী বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় অংশ নিতে হবে। এটাই এখন এখানকার রাজনীতির রেওয়াজ। উচ্চশিক্ষিত, হেলায় উচ্চপদের চাকরি ত্যাগ করে আসা, কাঁধে ঝোলা, কপর্দকহীন নিবেদিত প্রাণ, ত্যাগী রাজনীতিক নূরুল হুদার স্থান এমন একটি পরিসরে হবেই বা কেন। নূরুল হুদার মত মানুষকে বরাক শুধু প্রত্যাখান করে নি, ভোটে হারানোর জন্যে তাঁর মত মানুষের নামে সীমাহীন কুৎসা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলমান গ্রামে গিয়ে বলা হয়েছে নূরুল হুদার হিন্দু স্ত্রী বাড়িতে মূর্তি পূজা করেন। হিন্দু পাড়ায় দেওয়ালে লেখা হয়েছে, পাকিস্তান থাকিয়া খাইলাম খেদা/কই আছলায় বা নূরুল হুদা। এরা জানেই না, দেশভাগ-উত্তর কলকাতার যাদবপুরের উদ্বাস্তু কলোনীতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতেন নূরুলদা উদ্বাস্তুদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন সংগঠিত করার জন্যে।


রবীন্দ্রনাথের ‘গানভঙ্গ কবিতায় পড়েছিলাম নবীন যুবা গায়ক কাশীনাথের অসাঙ্গীতিক গলার আস্ফালনের দেখনদারিতে চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রবীণ সঙ্গীতসাধক বরজলালের গান। সভার মানুষ সঙ্গীতের সেই রসগ্রাহিতায় না মজে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কাশীনাথের দেখনদারির গলাবাজিতে। সভা শেষে ধীর পদক্ষেপে বরজলাল বেরিয়ে যাচ্ছে নির্জন পথ ধরে একাকী বাড়ির পথে। এখানে তাঁর সাধনার কোনো মূল্য নেই।
যদিও সাংগঠনিক দায়িত্ব নিয়ে নূরুলদা সর্বভারতীয় কৃষক সভার কাজে দিল্লিতে চলে যান, তবুও বরাকের নির্বাচনী রাজনীতি থেকে তাঁকে প্রত্যাখান, তাঁর মত মেধাবী নিবেদিত প্রাণ সৎ ও সংগ্রামী নেতার নেতার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে বরাকের সাধারণ মানুষের অপারগতা দেখে নূরুলদাকে আমার কেমন যেন ‘গানভঙ্গ কবিতার বরজলালের মতই মনে হয়। সাধারণ মানুষের জন্যে জীবনকে সঁপে দেওয়ার মধ্যেও যে আভিজাত্য থাকে, নূরুলদা ছিলেন তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নূরুলদা যখন দিল্লিতে ছিলেন, তখন ভিপি হাউসে তাঁর বাড়িতে সন্ধ্যে বেলা গেলে দেখা যেতো তিনি আর শ্রমিক নেতা মহম্মদ আমিন পাশাপাশি বসে টিভি দেখছেন। আর তাঁদের মধ্য দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে একটি বাচ্চা মেয়ে। নূরুলদা ও ছবিদি বাচ্চাটিকে গুড়িয়া বলে ডাকতেন। নূরুলদা ও ছবিদির ভীষণ আদরের ছিল গুড়িয়া। নূরুলদা কখনো খাইয়ে দিতেন, কোলে নিয়ে গল্পগুজব করতেন। নূরুলদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাচ্চাটির পরিচয়। বললেন, ওর বাবা সত্যেন্দ্র সিং পাশের ঘরে থাকে। বিজেপি-র নেতা। পরের বার গিয়ে দেখলাম গুড়িয়া ছবিদির সাথে শুয়ে আছে। ছবিদি বললেন, ওরা এখন গাজিয়াবাদে চলে গেছে। আমাদের কাছে সারাদিন থাকবে বলে আজ ওকে আনিয়েছি। আজ নূরুলদা মারা যাওয়ার পর ছবিদির সাথে দেখা করতে যোধপুর পার্কের তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখি, দেওয়ালে গুড়িয়ার ছবি টাঙানো। ছবি দিকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আমাদের সাথে দেখা করতে এই মাসের ৩০ তারিখ গুড়িয়াকে নিয়ে ওর বাবা আর মার কলকাতায় আসার কথা ছিল। আসা হল না। অসুস্থতার খবর পেয়ে সত্যেন্দ্র সিং গতকাল এসেছে কলকাতায়। কাঁদতে কাঁদতে ছবি দি বললেন, সব রাজনীতি দিয়ে বিচার হয় না শুভ। নীচে নেমে এসে দেখলাম, অচিন্ত্যদার ছেলে অরিন্দমের সাথে গাড়ি থেকে নামছে কৃষক সভার তরুণ নেতা বিজু কৃষ্ণাণ এবং বিজেপি নেতা সত্যেন্দ্র সিং। পিস হাভেনে নূরুলদার মরদেহকে রেখে ফিরে এসেছেন তাঁরা। মনে পড়ে গেল, তাঁর নিজের শহরেই উনআশি সালে তারাপুরে হেঁটে যাওয়ার সময় এক প্রাক্তন ফুটবল খেলোয়াড় তাঁর পেছনে পেছনে কুৎসিৎ ভাষায় গালিগালাজ করে অনুসরণ করে গিয়েছিল।

 আজ এসব কিছুর বাইরে চলে গেলেন নূরুলদা। সেই ফুটবলারও আগেই গত হয়েছে। আজ তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আরো দরিদ্র হলাম। আমাদের রাজনীতি আরো শ্রীহীন হলাম। জানি না এই সত্য কোনোদিন আমরা বুঝবো কিনা।

৩টি মন্তব্য:

  1. আমার ও সশ্রদ্ধ প্রণাম। এমন সব মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারাটাই জীবনের পরম পাওয়া। তুই ও ধন্য ।

    উত্তরমুছুন
  2. আমার ও সশ্রদ্ধ প্রণাম। এমন সব মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারাটাই জীবনের পরম পাওয়া। তুই ও ধন্য ।

    উত্তরমুছুন
  3. খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। এমন বিপ্লবীরা ছিলো বলে আজ আমরা স্বপ্ন দেখতে পারছি

    উত্তরমুছুন