ছুটন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া ধানখেত আর গাছেদের সারির মত
চলে যায় জীবন। একটা সময় ছিল, দূর অতীতের সেই সময়ে, বড় হওয়ার দিন আসতে চাইত না। কবে
গালে দাড়ি উঠবে, বাবা কাকাদের মত ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে জনসমাজে,
তার ছিল অন্তহীন অপেক্ষা। এখন জানুয়ারি এলেই ঝড়ের গতিতে চলে আসে ডিসেম্বর। পাগলা ঘোড়ার
মত দ্রুত দিগন্তের রেখার দিকে ছুটে যাচ্ছে আয়ুর অশ্ব।‘না আছে তার পায়ে রেকাব, না আছে
তার হাত লাগামে’। মশারির মত ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ অবধি টাঙানো রেডিওর
অ্যারিয়েল দিয়ে শুরু হয়েছিল যে শৈশব, সে আজ প্রৌঢ়ত্বে রেড-মি ফোর মোবাইলে ইউনিকোডে
টাইপ করে ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া ছড়ার পংক্তি খোঁজে। শৈশবে শিলং-এর নীচের বাড়িতে কদাচিৎ
বেজে উঠত উঁচু টুলের উপর রাখা কালো টেলিফোন। একবার বাজলে ঝনঝনিয়ে উঠত পাড়ার সবথেকে
নীচের বাড়ি থেকে সব থেকে ওপরের বাড়ির ঘরের কোণও। অনেক দূর থেকে শোনা যেতো টেলিফোনে
কথা বলা। ট্রাঙ্ক কল এলে বোঝা যেতো, কারণ তার আওয়াজ হতো একটানা। সাধারণ কলের মত থেমে
থেমে নয়। ট্রাঙ্ক কলের কথোপকথনও হত আরো উঁচু তারে বাঁধা, পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে
সম্ভবত যাকে বলে সোপ্রানো।
তখন শীতকাল মানেই ক্রিকেট আর কমলালেবু। এখনকার চল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে
এক শরীর ঘাম নিয়ে রঙীন পোশাক আর সাদা বলের বাণিজ্য নয়। সুরুচি, সংযম আর শিষ্টাচারের
অপর নাম ছিল ক্রিকেট। খেলোয়াড়দের ধবধবে সাদা পোশাকের মত অমলিন ছিল ক্রিকেট। ‘গুড মর্নিং,
দিস ইজ ডিকি রত্নাগর রিপোর্টিং ইউ ফ্রম দ্য ইডেন গার্ডেন ক্যালকাটা। বিউটিফুল সানি
উইন্টারি মর্নিং উইথ লাশ গ্রীন আউটফিল্ড, স্টেডিয়াম ফুল টু দ্য ক্যাপাসিটি, উই উইল
টেক ইউ থ্রু দ্য নেক্সট ফাইভ ডেইজ অব এক্সাইটিং এন্ড বেস্ট ক্রিকেট। উই এক্সপেক্ট ইট
টু বি প্লেড ইন দ্য ট্রুয়েস্ট স্পিরিট অব দ্য গেম।‘ আমাদের ইংরেজি বলার প্রথম পাঠ ডিকি
রত্নাগর, আনন্দ শীতলাবাদ, নরোত্তম পুরীর কাছে। তখনো আন্তর্জাতিক ফুটবলের সাথে আমাদের
পরিচয় খবরের কাগজের খেলার পাতাতেই, কিংবা ‘গড়ের মাঠ‘, ‘অলিম্পিক‘ বা ‘স্টেডিয়াম‘ পত্রিকার
মধ্য দিয়েই। খবরের কাগজের পাতার স্থির চিত্রের মধ্যেই আমরা খুঁজে পেতাম স্ট্যানলি ম্যাথিউজ,
পেলে, ইউসেবিও বা ববি চার্লটনের গতি, লেভ ইয়াসিন বা পিটার থঙ্গরাজের দুর্দান্ত ডাইভ।
ফুটবলের ধারাবিবরণী মানে অজয় বসু বা পুষ্পেন সরকার। হকি মানে যশদেব সিং। ক্রিকেট ইংরেজি,
হকি হিন্দী আর ফুটবল বাংলা। রেডিও ধারাবিবরণীর ভাষা মানচিত্রের বিভাজন ছিল এভাবেই।
হারিয়ে গেছে ওই দিনগুলি। হারিয়ে গেছে শর্ট ওয়েভে বিদেশের মাটিতে হওয়া ক্রিকেট ম্যাচের
ধারা বিবরণীর আওয়াজের হ্রাসবৃদ্ধি। মোক্ষম মুহূর্তে হঠাৎ রেডিওর আওয়াজ যেত মিইয়ে। তখন
সকলের কান এগিয়ে গেছে রেডিওর দিকে। গায়ে গায়ে থাকা অন্য রেডিও স্টেশনের সিগন্যাল এসে
অস্পষ্ট করে দিচ্ছে কাঙ্খিত কন্ঠস্বর। কী হল? ভালো, না মন্দ? ঠাওর করা যাচ্ছে না। হয়ত
কেউ রেডিও থেকে কান সরিয়ে এনে উচ্ছসিত আনন্দে বললেন ‘চার!‘, পর মুহূর্তেই আরেকজন ব্যাজার
মুখ করে বললেন, ‘না, না আউট‘। মুহূর্তে বিষাদ নেমে এলো।
মনে পড়ে, লর্ডসে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের প্যাভিলিয়নমুখী লম্বা মিছিল। একটু
পরেই ইনিংস বিয়াল্লিশে গুঁড়িয়ে যাবে। ক্রিস ওল্ড আর ম্যাথিউ আর্নল্ড যেন মৃত্যুদূত।
জেঠু বলল, ‘চলো, ঠাকুর ঘরে যাই‘। ঠাকুর ঘরে আমি আর জেঠু ষাষ্টাঙ্গে মাটিতে। পেছনে রেডিও
থেকে ভেসে আসছে মৃত্যুবিবরণী। একনাথ সোলকারের অপরাজিত ষোলো যেন গারফিল্ড সোবার্সের
তিনশো পঁয়ষট্টি। বোকার মতো ক্যাচ তুলে অনুশোচনায় মাথার ঝাঁকুনিতে যেভাবে মাথার টুপি
বেলের ওপর পড়তেই খসে পড়েছিল ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের রাজা ও টেস্ট ম্যাচের ভিখিরি অশোক
মানকড়ের উইকেট ও ক্রিকেটজীবন, সেভাবেই চলে গেলে আমাদের সোনাঝরা দিনও।
যা হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত আর। কিন্তু স্বপ্নে যে দেখা দেয় সেই
দিনগুলি। ঘুমের মধ্যে ডুকরে কেঁদে খুঁজে বেড়াই আমার সবচাওয়ার সবপাওয়ার জেঠুকে। হঠাৎ
দেখি শিলং এর ওয়ার্ড লেক আর গভর্নর হাউসের মাঝের এঁকে বেঁকে যাওয়া রাস্তা দিয়ে লুঙ্গির
মত ধুতি পরা, ধূসর রঙের দিদির বুনে দেওয়া পুলোওভার গায়ে হেঁটে আসছে জেঠু। হাতে উইলসের
তামাক আর সাদা পাতা দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করা ‘মিক্সচার‘ এর সিগারেট। আমি ‘জেঠু‘ বলে
ছুটে যেতেই ঘুম ভেঙে যায়। দেখি পাশে স্ত্রী আর পুত্র শুয়ে আছে, শুয়ে আছে একটা অন্য
জীবন। এ যেন অন্য একটা পৃথিবী। চারপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর মধ্যে জেঠুকে আর খুঁজি
পাই না। বাবা মা জেঠাইমা বড়দা মেজদারা বলত, জেঠু সংসারী নয়। সর্বক্ষণ ‘ঠাকুর ঠাকুর‘,
আর শীতকাল এলে ‘ক্রিকেট ক্রিকেট‘ করে। জেঠুর ‘ঠাকুর ঠাকুর‘ও এখন কারো মধ্যে দেখি না।
জেঠুর ‘ঠাকুর ঠাকুর‘ মানে প্রতি সন্ধ্যায় কারো না কারো মুখোমুখি বসে গান শোনা। গান
শুনতে শুনতে চোখ বুঁজে ধ্যাণস্থ হওয়া আর নিঃশব্দে কেঁদে যাওয়া। দু চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরে
যায় জল। আজন্ম দেখেছি, ফলে অবাক হই নি। পাশের ঘরের নতুন ভাড়াটের বাচ্চা অবাক হয়ে মা’কে
জিজ্ঞেস করেছিল, ‘দাদু, কাঁদছে কেন?‘। তার মা’র কাছে উত্তর ছিল না। আজও আমাদের কাছে
নেই। কী সেই বিপন্ন বিস্ময় যা জেঠুর অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করত! বড়ো হয়ে জেনেছি
মারিফত পন্থায় গানই হচ্ছে এবাদত, পরমের সাথে সেতু। প্রতিদিনের একক গায়ক ও একক শ্রোতার
গানের এবাদত মাঝে মাঝে সম্প্রসারিত হত বাড়ির কীর্তনের আসরে। সেখানে বাজারের আলুওয়ালা
গণেশ গাইতেন ‘তোমার বদল দিয়া যাও বাঁশি ও প্রাণনাথ‘, বাড়িতে যিনি রক্ত পরীক্ষার রক্ত
সংগ্রহ করতে আসতেন অন্য সময় তিনি সেই আসরে গাইতেন ‘শিবের বুকে দাঁড়িয়ে কেন বল মা শ্যামা
শিবানী গো‘। আমাদের বাড়িতে যিনি রান্নার কাজ করতেন তিনি গাইতেন ‘পিঞ্জিরার পাখির মত
উইড়া গিয়া দেখি কোথায় গো আমার কালো পাখি‘। বাবা গাইত ‘আজি বিজন ঘরে‘। দিদিরা গাইত,
মা গাইত। জেঠু কেঁদে যেত। কেঁদেই যেত। ‘আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে/ সেদিন যে রাগিনী
গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে/ আজি পূবের হাওয়ায় হাওয়ায়, হায় হায় হায় রে কাঁপন
ভেসে চলে।‘
এক একর জমির শিলং কেঞ্চেস ট্রেসের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম আমরা একটা সময়ে।
ওই বাড়িতে ফলের বাগান ছিল, সব্জির বাগান ছিল, ফুলের বাগান ছিল, গাড়ি বারান্দা ছিল।
আর ছিল তিরতিরি করে বয়ে যাওয়া একটা পাহাড়ি ছড়া। রাত্তিরে বিছানায় শুতে গেলে লেপের তলা
থেকে শুনতে পেতাম পাইন গাছের পাতার সাথে বাতাসের কানাকানি। সেই সাঁইসাঁই শব্দে ঘুমিয়ে
পড়তাম মায়ের কোমড়ে হাত জড়িয়ে, বুকে মুখ গুঁজে। ভোরে আমাদের ঘরের নীচে কাঠের প্ল্যাঙ্কিং
এর তলার মুরগীর ঘর থেকে কোঁকর কোঁ শব্দে ঘুম ভাঙত। ছড়া পেরিয়ে লাবান পাহাড়ের ‘হাতি
পাথর‘ এর ওপর দিয়ে কমলা গাছের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো পড়ত আমাদের পূবের বারান্দায়। সেখানে
কাঞ্চার তৈরি চা পাউঁরুটি টোস্ট খেতে খেতে তাকিয়ে থাকতাম পাহাড়ের দিকে। রাতে যদিও কোনোদিনই
তাকাতাম না ওদিকে। কারণ অন্ধকার নামলেই মনে পড়ত ওই অন্ধকার পাহাড়ে গাছের ডালে গলায়
দড়ি দিয়ে মারা গেছে ত্রিপুরা পণ্ডিতের ছেলে। এ নিয়ে বাড়িতে আসা অতিথিদের সাথে মায়েরা
অনেক দিন গল্প করেছে। কেন মরল? এই প্রশ্ন এলেই চোখ দিয়ে আমাদের দেখিয়ে আলোচনা নেমে
আসতো খাদে, একটা পর্যায়ে ফিসফিসানিতে। প্রবল আগ্রহে কান পেতে এর মধ্যেই ঠিক শুনে নিতাম
একটি মেয়ের নাম।
আমাদের বাড়ির প্লাম গাছের ইংরেজি ওয়াইয়ের মত একটি ডাল কেটে ফুটবলের ব্লাডারের
রাবার দিয়ে একটি অসাধারণ গুলতি বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের কাঞ্চা। গাছের ডাল আর ব্লাডারের
রাবারের নমনীয়তা গুলতিকে দিয়েছিল একটা অভূতপূর্বে দূরত্বে নিশানা করার ক্ষমতা। পুটিংয়ের
গোলায় একবারই নিক্ষেপ করেছিলাম আমার গুলতি। বাড়ির মালিকের বড় ছেলে সিম ‘দেখি দেখি‘
বলে আমার হাত থেকে নিয়ে একবার ক্ষমতা পরখ করেই পায়ের হিলের এক ঘায়ে ভেঙে দিয়েছিল আমার
সাধের গুলতি। এতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ কেউ হয়, বিশেষ করে আমার সেই বয়সের হিরো বাড়ির মালিকের
বড় ছেলে সিম এমনটা হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনে এর চেয়ে
বড় প্রতারিত হওয়ার আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রতিবাদ করতে পারি নি,
কাঁদতে পারি নি। বড়দের কাছে নালিশ করেছি। ‘কী আছে, আরেকটা তৈরি করে দেবে কাঞ্চা‘ বলে
সকলে এড়িয়ে গেছে। জীবনে আর কোনো গুলতি এত নিখুঁত হয় নি। কেঁদেছি স্বপ্নে বহুদিন, বহু
বহু দিন। আবার কখনো দেখেছি চালের ড্রামের ভেতর হঠাৎ খুঁজে পেয়েছি সেই স্বপ্নের গুলতি।
কখনো বাড়ির ছড়ার পারে পড়ে থাকা গুলতিটা দেখেছি কেমন জোড়া লেগে গেছে নিজে নিজেই। আনন্দে
নেচে উঠবো। ঘুম ভেঙে গেছে। আমার চারপাশে গভীর রাতের অন্ধকার ছাড়া আর কিছু সত্য ছিল
না তখন। ওই গুলতির জন্যে এখনও আমার দীর্ঘশ্বাসের শেষ নেই। এমনকি এই বড়ো অবেলায় ল্যাপটপে
টাইপ করতে করতেও বুকের ভেতর কে যেন কেঁদেই চলেছে। আমি এখনও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি
সিমের সেই ক্রুর হাসির দিকে।
আমার জন্ম শিলং এর গণেশ দাস চিলড্রেন হসপিটেলে। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি।
ন বছর বয়স অবধি শিলংয়েই ছিলাম। তারপরও বেড়াতে, গান গাইতে গিয়েছি অসংখ্যবার। জন্মের
পর হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার পর আর কখনো ওই হাসপাতালে যাই নি। গণেশদাস হাসপাতাল আমি
দেখতেও চাই না। ছোটবেলা থেকে কল্পনায় সেই হাসপাতালের একটা অবয়ব রয়েছে আমার কাছে। এটা
আমি হারাতে চাই না। দেখিনি বলেই হারাইও নি। তবে সেই হাসপাতাল থেকে যে আমাকে কোলে করে
বাড়িতে এনেছিল তার নাম রাম, তাকে হারিয়েছি। পুরো নাম ছিল নিমারাম উপাধ্যায়। আমাদের
বাড়ির নেপালি গৃহকর্মী। সকাল সন্ধ্যে আমাদের রান্নাঘরে কাজ করত, দিনের বেলায় বাবাদের
অফিসের পিওন। মা’র কাছে শুনেছি, আমি প্রথমে ‘মা‘ ডাকি নি, রামকে ‘আম‘ বলে ডাকার মধ্য
দিয়েই আমার কথা ফোটা। রামের কোলের ওম আমি আজো ভুলি না। প্রতি বছর রাম ছুটি নিয়ে একমাসের
জন্যে নেপালের বিরাট নগরে ছেলে বউয়ের কাছে যেতো। যাওয়ার আগে আমাকে শার্ট প্যান্ট জুতো
মোজা কিনে দিয়ে যেতো। রামের বিছানায় একটা তেল চিটচিটে বোঁটকা গন্ধ ছিল। মানে ওই গন্ধ
যে বোঁটকা সেটা বড়দের কথায় শুনেছি। ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই সেই বোঁটকা গন্ধওয়ালা বিছানায়
চলে যেতাম। রামের পাশে শুয়ে থাকতে ভীষণ ভালো লাগত। ন বছর বয়স অবধি আমার সেটা প্রায়
নিত্যকর্ম ছিল। রামের বিছানার গন্ধ আমি এখনও নাকে টের পাই। ওই গন্ধ এখনও আমাকে ডাকে।
ছোটবেলায় আমাকে দেখাশোনা করত যে খাসি রমণী সে আমাকে তার পিঠে চাদর দিয়ে বেঁধে ঘরের
কাজ করত, রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যেতো। তাঁকে আমি ডাকাতম ‘কং‘। কং মানে খাসি ভাষায় দিদি।
খাসি রমণীকে এই সম্বোধনই করা হয় ওখানে। কং-এর পিঠে চেপে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ আমি ট্রেন
প্লেন জাহাজ চড়েও পাই নি। ওটাই আমার জীবনের সেরা যান। ঘুরতে ঘুরতে কখনো পেছন থেকে কংকে
জড়িয়ে ধরে আদর করতাম, কখনো রেগে গেলে মারতাম, চুল টানতাম। কং চা খেতে খেতে ওর মুখের
এঁটো কাপ থেকেই আমাকে চা খেতে দিত। দাঁত দিয়ে অর্ধেক বিস্কুট ভেঙে বাকিটা পেছনে হাত
বাড়িয়ে আমাকে দিত। শিলং এর কাঁচা সুপুরি ও খাসি পানপাতার ভীষণ কড়া ‘কোয়াই পান‘ খেতো
কং। অর্ধেক মুখে দিয়ে বাকিটা আমাকে দিত। তিন চার বছরের আমিও কং এর মত তর্জনীর মাথা
থেকে জিভে চূণ ঠেকাতাম। ঠোঁট লাল হয়ে যেতো। বাবার বন্ধুরা বাড়িতে এসে বলতেন, আপনার
শ্রীমানকে দেখলাম কংএর পিঠে খাসি বাচ্চার মত ঠোঁট লাল করে চলেছে। বাবারা কংকে কিছু
বলত না। কং বাজারে সব্জির দোকানও দিত। আমাকেও সেখানে নিয়ে যেতো। কংয়ের হাতের নাগালের
বাইরে থেকে ফুলকপি, সিম, টমেটো আমি এনে পাল্লায় তুলে দিতাম। পরেও কিশোর বয়সে যখন আর
কং আমাদের বাড়ি কাজ করত না তখনও বাজারে গেলে আমি কংএর পাশে বসে থাকতাম। বাবা বাজার
শেষ করে আমাকে নিয়ে যেতো। আমি ততক্ষণ কংয়ের সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। আসার সময় কং আমাকে
একটা ফুলকপি বা বাঁধাকপি কিছু একটা দিয়ে দিত।
ন বছর বয়সে যখন শিলং ছেড়ে চলে আসি শিলচরে তখন আমাদের বাড়িতে পোষা একটা
কুকুর ছিল, নাম জাম্বো। এর আগে একটা সাদা ককাস স্প্যানিয়েল ছিল। সাদা ছিল বলে নাম দেওয়া
হয়েছিল গোরা। আমরা বলতাম গোরার ভালো নাম গৌরাঙ্গ প্রসাদ নন্দী মজুমদার। জেঠু একটু রাগ
করেছিল বটে। কিন্তু গোরা মাছ মাংস খেত না, জেঠুর কীর্তনের আসরে বাইরে ঠায় বসে থাকত
বলে জেঠুর ওর প্রতি একটু দুর্বলতা ছিল। আমরা যখন চলে আসি, আমরা জানতাম জাম্বোও আমাদের
সাথে আসবে। জিনিষপত্র গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে জাম্বোর জিনিষপত্রও গোছানো হচ্ছিল। তখন আসাম
স্টেট ট্রান্সপোর্টের কালো অ্যাম্বেসেডার ভাড়া পাওয়া যেতো। গায়ে গণ্ডারের অ্যাম্বব্লেম।
ওটাকে বলা হত ফার্স্ট ক্লাস। বাবা শিলচর যাওয়ার জন্যে ফার্স্ট ক্লাস ভাড়া করেছিল। সকালবেলা
সব জিনিষ যখন উঠছে তখন ফার্স্ট ক্লাসের ড্রাইভার বলল, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি
ছাড়া কুকুর নিয়ে যাওয়া যাবে না। সেই শুনে আমাদের ভাইবোনেদের কী কান্না। আমরা গাড়িতে
উঠে চলে এলাম। দূরে জাম্বো আমার পিসতুতো দাদা সেজদার হাতে চেনে বাঁধা আমাদের গাড়ির
দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। গাড়িটা দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল। সেই কান্না আমাদের আজো গেল
না। সেজদা তখন ব্যাচেলার ছিল। বাড়ি ফেরার কোনো ঠিক ছিল না। সেজন্যে জাম্বোকে ছেড়ে রাখত।
জাম্বো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো অনাথের মত। কেউ খেতে দিত, কেউ মেরে তাড়াতো। এক বন্ধু
পরে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, তোদের জাম্বো পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। লোকে মারে। শুকিয়ে গেছে।
গায়ে রাস্তার কুকুরের মত ঘা হয়ে গেছে। আমি চিঠি পড়ে কেঁদে ভাসিয়েছি। কবে জাম্বো মারা
গেছে সেই খবরও পাই নি। এখন বড়ো হয়ে আমার মনে হয়, সেদিন ড্রাইভারের সেই কথাটা নিশ্চয়ই
আমার অভিভাবকদের শিখিয়ে দেওয়া কথা ছিল। একটা কুকুরের জন্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি
ব্যাপারটা নিশ্চয়ই একটু বাড়াবাড়িই।
ছোটবেলা থেকে দেখতাম বাড়িতে কেউ এলে মা-বাবারা অবধারিতভাবে জিজ্ঞেস করত,
বাড়ি কোথায় ছিল? উত্তরে হয়ত বললেন সিলেটের অমুক গ্রামে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা মা কোনো একটা
যোগাযোগের প্রসঙ্গ তুলে একটা আত্মীয়তার বাঁধনে বাঁধতে চাইতেন। হয়ত বললেন সিলেট শহরে
বাড়ি ছিল। বাবা জিজ্ঞেস করল, কোন্ পাড়া। ওরা বললেন। তারপর প্রশ্ন, কোন্ বাড়িটা? তারপর
সেটাও বললেন। বাবা এরপর বলল হয়ত একটা দোকান ছিল যে মিষ্টির, তার কোন দিকে? তিনি হয়ত
বললেন, তার উল্টো দিকেই। এবারে বিজয়ীর হাসি দুজনেরই মুখে, চিহ্নিত করা গেছে বা চেনানো
গেছে। তারপরের মুহূর্তেই দীর্ঘশ্বাস। ‘আর কী হবে! সব গেল! কী ছিল আমাদের জীবন, আর এখন
কী হল!‘ মুহূর্তে ভারি হয়ে যেতো পরিবেশ। কথা বলতে বলতে হয়ত কেউ চোখ মুছতেন, কেউ ঘনঘন
মাথা নাড়তেন। এই ঘর হারানোর হাহাকার আমার শৈশব। এই চোখের জলেই আমার ‘স্বদেশ‘এর সাথে
পরিচয়। এই ধরনের অসংখ্য কথোপকথন শুনতে শুনতে আমাদের বড় হওয়া। অসংখ্য গ্রামের নাম, রেল
স্টেশনের নাম, দোকানের নাম, পাড়ার নাম, স্কুলের নাম, কলেজের নাম, বিশিষ্ট মানুষের নাম,
বংশের নাম- এভাবে আমাদের মুখস্থ হয়ে যেতো। কল্পনায় আমরা আমাদের পিতৃপ্রজন্মের ভিটে
বাড়ি সব দেখতে পেতাম।
১৯৯৯ সালে প্রথম ওপারে গেলাম বড়ো হয়ে। করিমগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ওপারে জকিগঞ্জই
বাংলাদেশ। নদীটা আন্তর্জাতিক সীমানা। নদীর এপার থেকে ওপার দেখা যায়। মানুষের চলাফেরা
দেখা যায়, বাড়ি দেখা যায়, গাড়ি দেখা যায়, গাছপালা দেখা যায়। করিমগঞ্জে এলেই সাধারণত
আমরা একবার কালীবাড়ির ঘাটে এসে ওপারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে মনে গাইতাম ‘আমার নাইবা
হল পারে যাওয়া/.... নেই যদি বা জমল পাড়ি ঘাট আছে তো বসতে পারি/ আমার সারাদিনের এই কি
রে কাজ ওপার পানে কেঁদে চাওয়া?‘ সেদিন নৌকোয় চেপে বসেছি। একটু একটু করে দূরে যাচ্ছে
‘দেশ‘, একটু একটু করে আসছে আমার মায়ের দীর্ঘশ্বাস, বাবার চোখের অশ্রুবিন্দু ‘বিদেশ‘।
নৌকো এসে ভিড়ল ঘাটে। লাফ দিয়ে নামলাম মাটিতে। বুকের ভেতর কে যেন বলল, ‘তোমার পায়ে ঠেকাই
মাথা‘। না, এটা তো আমার দেশ নয়। পাসপোর্ট ভিসা লাঞ্ছিত বিদেশ। ওপার? ওপারও তো আমার
ঘর নয়। জন্মস্থান শিলং-এ আমি অবাঞ্ছিত ‘ড-খার‘ মানে বহিরাগত, আসামে বিদেশি, বাংলাদেশী।
গাড়ি এগিয়ে চলে হুহু করে সিলেটের দিকে। পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত একটির
পর একটি গ্রাম, বাজার। কালীগঞ্জ, চারখাই, গোলাপগঞ্জ, বাঁ দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে রাস্তা
শ্রীচৈতন্যের ঢাকাদক্ষিণের দিকে। সিলেটে ঢুকতেই শেখঘাট, চৌহাট্টা, মিরাবাজার, বন্দর
বাজার, শিবগঞ্জ। সব চেনা। একটা নামও অশ্রুতপূর্ব নয়। দেখছি, পড়ছি আর ভেসে উঠছে শৈশবের
স্মৃতি। এই নামগুলি শোনার শৈশব। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। ভীষণ চেনা একটা বিদেশ। যার সব জানি
সব শুনেছি অথচ একটা বিদেশ। একে কোন সুরে বাঁধিব? মঞ্চে উঠতেই ভেতর থেকে কে যেন গেয়ে
উঠল ‘রক্তে রেখে গেছে ভাষা/ স্বপ্নে ছিল যাওয়া আসা/ কোন যুগে কোন হাওয়ার পথে কোন বনে
কোন সিন্ধুতীরে/ মন যে বলে চিনি চিনি/ যে গন্ধ বয় এই সমীরে কে ওরে কয় বিদেশিনী‘! অনুষ্ঠানের
শেষে এসে গাইতে থাকি, ‘আমার শান্তির গৃহ সুখের স্বপন রে, ও দরদী কে দিল ভাঙিয়া/ মন
কান্দে পদ্মার চরে লাইগ্যা‘। এই প্রথম গাইতে গাইতে চোখের জলে ভেসে যাই। গলা জড়িয়ে যায়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় আড়াইশো ‘বিদেশি‘ শ্রোতা চোখের জলে ভেসে যেতে থাকে।
অনুষ্ঠান শেষ। রেস্টুরেন্টের অন্ধকার উঠোনে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে অপরিচিত ‘বিদেশি‘
যুবক, অশ্রু ছলোছলো চোখে বলল, ‘দাদা, তুমি আমাদের কখনো পর ভেবো না। সিলেটকে বিদেশ ভেবো
না। সাতচল্লিশে রাজনীতির খেলায় কী হয়েছে সে আমি জানি না। তখন তুমিও ছিলে না, আমিও ছিলাম
না। এখন যখন পেয়েছি তখন আর দূরে ঠেলো না। এরপর থেকে যখন আসবে, ভেবো দেশে ফিরছি। সারা
বছরের কর্মক্লান্তি থেকে বিরতি নিতে দেশবাড়িতে এসেছি‘!
আমার হারানোপ্রাপ্তির খাতাটা এমনই। চোখের জল, দীর্ঘশ্বাস আর বোকার মত আবেগের।
এতে কোনো কা-জ্ঞান নেই!