পরিণত বয়সেই তিনি চলে গিয়েছিলেন। এক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরই তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। তবু এখনও এতগুলি বছর যাওয়ার পরও তাঁকে ঘিরে শূন্যতা বোধের শেষ হয় না। বরং বেড়েই যায় হয়ত। এই শূন্যতার অনুভূতি শুধু তাঁর নিজের দলের ভেতরেই নয়। রাজনীতির সাথে আপাত সংস্রবহীন মানুষও কোনো সমস্যার কথা উঠলেই বলেন, জ্যোতি বসু থাকলে আজ এমনটা হত না। অর্থাৎ রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়েও আজ শূন্যতা অনুভূত হচ্ছে সমাজের নানা স্তরে। এটাই হয়ত রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসুকে তাঁর সমসাময়িক অন্য নেতাদের চেয়ে আলাদা মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। দলীয় রাজনীতির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তাঁর উপস্থিতি।
এখন
সবদিক দিয়েই একটা সংকটের সময়। শুধু যে জ্যোতি বসুর দল আজ পরাজিত ও দুর্বল হয়েছে
তাই নয়। যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে জ্যোতি বসুরা রাজনীতি করেছেন, সেই পরিমণ্ডলই
আজ নেই। আজ ওপর থেকে নীচ, কেন্দ্র থেকে রাজ্য, সবটাই ওলোট পালোট হয়ে গেছে। এই পাল্টে
যাওয়াটায় আমরা নিশ্চিতভাবেই বিস্মিত হব না, কারণ পৃথিবী তো নিয়ত পরিবর্তনশীল। আমাদের
বিস্ময় সভ্যতার ঐতিহাসিক পথ ধরে মানুষের সমাজ অগ্রগতির যে পথ ধরে হেঁটেছে একটা সময়ে,
সেটা আবার উল্টোমুখো যাত্রা শুরু করল না তো? তবে এটাও সত্য সভ্যতার অগ্রগতির পথটা কখনোই
একরৈখিক নয়, তা সততই দ্বন্দ্বমূলক। ফলে উত্থান পতন এগানো পেছোনো সব মিলিয়েই হয়ত
তার ঐতিহাসিক যাত্রা।
এই
সব কথা বলার পরও এটা অনস্বীকার্য যে এই মুহূর্তে এই রাজ্যে বামপন্থী আন্দোলন যে বিপর্যয়ের
মুখোমুখি হয়েছে তা অভূতপূর্বই। যদি বলা হয় যে এই বিপর্যয় মানে শুধু একটি নির্বাচনের
ফলাফলগত বিপর্যয় বা প্রত্যাশিত বিজয় অর্জিত না হওয়ার বিপর্যয়, তবে এক গভীর সঙ্কটকে
হয়ত অনেকটাই লঘু করে দেখা হবে। জ্যোতি বসুর জন্মদিন এলে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে,
নানা সময়ে তাঁর উচ্চারিত সতর্কবাণী বা সাধারণভাবে বলা নানা কথা থেকে আমরা কোথাও কোনো
দূরত্ব রচনা করেছিলাম? দূরত্ব রচনা যদি কোথাও হয়েও থাকে, তবে সেটাই কি আজকের এই অভূতপূর্ব
বিপর্যয়ের এক অন্যতম কারণ? নাকি, যে সময়, যে পরিমণ্ডলে জ্যোতি বসুরা রাজনীতি করে
গেছেন, তার থেকে আজকের সময় এতটাই পাল্টে গেছে, যে তাঁর পথে অবিচল থেকেও আমরা সম্ভাব্য
সঙ্কট থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারলাম না? হয়ত, দুটো কথাই সত্যি। তবে এটা সত্য, আজকের
সময়ের মত জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর আর কখনো, এতটা গভীরভাবে তাঁর শূন্যতা অনুভব করে নি
এ রাজ্যের রাজনীতি বা তাঁর নিজের দলের কর্মী সমর্থকরা। স্বজন বন্ধুদের আড্ডা থেকে খবরের
কাগজের নিবন্ধ, নানা আলোচনায় বারবার ফিরে আসছেন জ্যোতি বসু।
প্রকৃতপক্ষে
এই মাটির বাস্তবতায় বাম রাজনীতির প্রায়োগিক দিকটির বীজ রোপণ করে একে মহীরুহের চেহারায়
নিয়ে এসেছিলেন যে সমস্ত মহারথীরা, তাঁদের মধ্যে জ্যোতি বসু অগ্রণী। ব্যারিস্টারি পড়তে
বিলেত গিয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে দেশে ফিরে যখন তিনি সর্বক্ষণের রাজনীতিতে
ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন সমস্ত পথটাই ছিল অজানা। কমিউনিস্টদের সামনে তখন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই
ছিল না এমন পথে হাঁটার। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি এক প্রবল ঘূর্ণাবর্তের মধ্য দিয়ে
এগোচ্ছে। যে দেশগুলিকে আলোকবর্তিকা করে কমিউনিস্টরা নিজেদের নীতিমালা প্রণয়ণ করত,
সেই দেশের রাজনীতি থেকে সরাসরিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের জটিল রাজনীতিকে মুখোমুখি হওয়া
কোনো চটজলদি টোটকাও লভ্য ছিল না। ফলে পথ কেটে কেটে পথ তৈরি করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল
না জ্যোতি বসুদের সামনে। এভাবেই পরিষদীয় রাজনীতি থেকে রেল শ্রমিক আন্দোলন, সর্বত্র
অচেনাকে চিনে চিনে পথ তৈরি করেছেন জ্যোতি বসু। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, এই দীর্ঘ সময়পর্বে
কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নানা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সেই
সময়টিতে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর এক সর্বনাশা অতি বাম বিচ্যুতির কবলে পড়ে কমিউনিস্ট
পার্টি। পরাধীনতার শেষ লগ্নে সারা দেশে কংগ্রেস মুসলিম লীগের রাজনীতির এক বিকল্প ভাষ্য
নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে শ্রমিক কৃষকের শ্রেণিসংগ্রামকে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে
যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং তারই ফলে
রাজ্যে রাজ্যে যে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রভাবের বিস্তার ঘটে, তা পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের
অতিবাম লাইনের (যা রণদিভে লাইন নামে পরিচিত) ফলশ্রম্নতিতে সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়ে।
এই বিপর্যয়কে ব্যবহার করে ট্রেড ইউনিয়ন ক্ষেত্রে নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করে নেয় আইএনটিইউসির
মত শক্তি। বিভিন্ন জাতি উপজাতির রাজনৈতিক উন্মেষ ঘটেছিল যে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শ
পেয়ে, সেখানেও তৈরি হল শূন্যতা। ওই রকম একটি বিপর্যয় বা পরবর্তীতে অতিবাম বিচ্যুতি
থেকে নিষ্কৃতি পেতে গিয়ে অতি দক্ষিণপন্থার খপ্পরে পড়ে যাওয়া, নেহরু—ইন্দিরার লেজুড়বৃত্তির
লাইনের দিকে চলে যাওয়া, আবার চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান বলে হাজার হাজার
নিবেদিতপ্রাণ তরুণের অতিবাম রাজনীতির মোহে জীবন বিসর্জন দেওয়া, এমন সব বিপর্যয়ের
মধ্যেও হতাশাগ্রস্ত না হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে সুসংগঠিত করা, পরিষদীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য
শক্তিতে পরিণত করা, আদর্শগতভাবে একটি শক্তিশালী অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা, এসবই ছিল
জ্যোতি বসু ও তাঁর সহযোদ্ধাদের এক অভূতপূর্ব অবদান। ১৯৭৭ সালে যেদিন বামপন্থীরা রাজ্য
সরকার গঠন করলেন, সেদিনই তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে বামপন্থীদের বিকল্প রাজনীতির
ধারার কথা শুনিয়েছিলেন। রাইটার্সের বারান্দা থেকে তিনি বলেছিলেন, বামপন্থী সরকার রাইটার্স
থেকে পরিচালিত হবে না। হবে রাজ্যের মাঠ ময়দান থেকে। বলতে দ্বিধা নেই, চৌত্রিশ বছরের
বামপন্থীদের শাসনের যা কিছু সাফল্য, তাই এসেছে এই নীতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে। যখনই কোনো
ভুল হয়েছে বা ভ্রান্তি হয়েছে, তা হয়েছে কোনো না কোনো ভাবে এই নীতি থেকে বিচ্যুতি
থেকেই। আজ সারা পৃথিবীতেই বামপন্থীরা এক নতুন বামপন্থার কথা বলছেন, যেখানে ক্ষমতার
উৎস রাষ্ট্রশক্তির অভ্যন্তরে নয়, জনসাধারণের সম্মিলিত শক্তির আধার থেকেই আসবে। লাতিন
আমেরিকায় নানা সঙ্কটের মধ্যেও যে নতুন বামপন্থার পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, কিংবা যে
বামপন্থার অনুসরণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের
ডগায় বসে ছোট্ট রাষ্ট্র কিউবা সমাজতন্ত্রের পথে অবিচল থাকেত সমর্থ হয়েছে, তা এই বিকল্প
বামপন্থাই। অপারেশন বর্গা থেকে পঞ্চায়েতি রাজ, বক্রেশ্বর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন থেকে
সাক্ষরতা আন্দোলনে এক নতুন ধরনের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিকল্প বামপন্থার চর্চাই হয়েছে
জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবাংলায়। আজ তৃণমূল রাজত্বে এই গণউদ্যোগকে তুচ্ছ করে
আমলানির্ভর পুলিশনির্ভর লুম্পেনশক্তি কেন্দ্রিক সরকার পরিচালনার রাজনীতিরই আমদানী হয়েছে
পশ্চিমবঙ্গে।
সোভিয়েতের ভাঙন উত্তর নয়া উদারনীতির পৃথিবীতে
বামপন্থীদের চলার পথ আরো কঠিন হয়ে যায়। ওই সময়ে প্রথাগত বামপন্থার বাইরে গিয়ে নতুন
পথ খুঁজতে হয়েছে বামপন্থীদের সর্বত্র। আমাদের দেশে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই নতুন
পথ অণে¦ষণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জ্যোতি বসুই। তবে একটি বিষয়ে সবসময়েই
সচেতন ছিলেন। যে কোনো নতুন নীতিই হোক, তাকে জনসাধারণের সম্মতির কষ্টিপাথরে যাচাই করে
নিতে হবে। সে জন্যে বারবার বলতেন জনসাধারণের কাছে যাওয়ার কথা। এই যাওয়ার পথটি কেমন
হবে তা হয়ত সেভাবে চর্চিত হয় নি। কিন্তু জনসাধারণের কাছে যাওয়া ছাড়া যে কোনো বিকল্প
নেই সে কথা বারংবার বলেছেন জ্যোতি বসু। আজকের অন্ধকার সময়ে জ্যোতি বসুর এই কথাটিই
আমাদের পথ দেখাতে পারে। আরেকটি বিষয়ও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জ্যোতি বসু সারাজীবনের
রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে যে সম্মান অর্জন করেছেন, তা তাঁর দলের মর্যাদাকেও ছাড়িয়ে
গেছে নানা সময়েই। তবু ব্যক্তি জ্যোতি বসু পার্টির সাংগঠনকি সিদ্ধান্তের প্রতি ছিলেন
অনুগত। হাজারো মতপার্থক্য সত্ত্বেও ছিলেন পার্টির সিদ্ধান্তের অধীন। কখনোই পার্টির
সম্মিলিত সত্তার চেয়ে নিজেকে বড়ো করতে চান নি। পার্টির যে সিদ্ধান্তকে তাঁর মনে হয়েছিল
ঐতিহাসিক ভুল, তাঁকে তিনি পালন করেছেন ঐকান্তিক নিষ্ঠায়।
জ্যোতি বসুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সামগ্রিকতাই আমাদের
আজকের অন্ধকারে নতুন পথ খুঁজতে অনুপ্রাণিত করবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন