মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪

কালবেলা

গেট দিয়ে ঢুকে রুদ্র অবাক! সবুজ আবির মেখে তুমুল আনন্দে নাচছে রাম বাহাদুর ও মহাদেব। সারা শহরজুড়ে সকাল থেকে পটকা ফাটছে। ইলেকশনের রেজাল্ট যে খারাপ হবে, তা বোঝা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। তবে এভাবে ধ্বস নামবে হয়ত বোঝা যায় নি। হাতের কালো ব্যাগটাকে শক্ত করে ধরে একটা অবিচল মুখচ্ছবি যথাসম্ভব বজায় রেখে নিজের দফতরের দিকে ধীরে ধীরে চলে যায় রুদ্র। চলে যাওয়ার মুহূর্তে হঠাৎই রামবাহাদুর দেখতে পায় রুদ্রকে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নেয় একটু, নাচে সামান্য ভাঁটা পড়ে যেন। রাম বাহাদুরকে অপ্রস্তুত দেখে মুচকি হেসে রুদ্র অস্ফূট স্বরে বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে! মুখে এমন কথা বললেও, তার বুকের ভেতরে তখন আছড়ে পড়েছে এক তীব্র সাইক্লোন। যা দেখল চোখের সামনে তা অবিশ্বাস্য! রাম বাহাদুর আর মহাদেবও এভাবে নাচছে বিজয়ের আনন্দে! অথচ গতকালই বিকেলে এই জায়গাতেই বকুল গাছের তলায় চা খেতে খেতে ওরা যে বলছিল সম্পূর্ণ অন্য কথা। পরিবর্তন আসছে টের পাচ্ছিল রুদ্রও। তবে নেতারা নাকি টের পান নি। অন্তত আজ সকাল থেকে টিভির পর্দায় ইলেকশনের ফল আসতে শুরু হতেই নেতারা বলছেন, এটা অপ্রত্যাশিত ফলাফল। রুদ্র জানত এমনটা হতে যাচ্ছে, যদিও এমন বিপর্যয় ওরা কাছেও অপ্রত্যাশিতই। সবচেয়ে অভাবনীয় আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখেই গেটের সেই দৃশ্য। গতকালই এই গেটের পাশে রুদ্র যখন একা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল, তাঁকে দেখেই এগিয়ে এসে কথা বলেছিল রাম বাহাদুর আর মহাদেব। রাম বাহাদুরের সাথে রুদ্রর পরিচয় দীর্ঘদিনের। সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, তখন রাম বাহাদুর ছিল তাদের ছাত্রাবাসের নাইট গার্ড। তখনকার অল্পবয়েসী ছোকরা রামবাহাদুরের সাথে ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্রদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মত। একসাথে টেবিল টেনিস খেলা, টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল ক্রিকেটের টেলিকাস্ট দেখা, হোস্টেলের সরস্বতী পুজো ফাংশন- সবকিছু নিয়ে নিয়ে রাম বাহাদুরের উত্তেজনা ছিল আবাসিকদের মতই। তাঁরাও তাকে বন্ধুই মনে করত। সেই হৃদ্যতার ধারাবাহিকতা রুদ্র এবং রাম বাহাদুরের সম্পর্কে এখনও রয়েছে। রুদ্র এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক, রাম বাহাদুর তাঁদের প্রশাসনিক কার্যালয়ের গেটের সিকিউরিটি গার্ড। তবে পেশাগত পরিচয়ের উচ্চ-নীচ কোনো ব্যাপারই নয় এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে। গতকাল বকুলতলার চায়ের গুমটিতে রাম বাহাদুর আর মহাদেব আসতেই রুদ্র ওদের জন্যেও চা বলেছিল। চা খেতে খেতে এক মুখ উদ্বেগ নিয়ে রাম বাহাদুর জিজ্ঞেস করেছিল রুদ্রকে, কী হবে দাদা কাল? সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা থেকেই রুদ্র অকপটে বলেছিল, আমার খুব একটা ভালো ঠেকছে না। বামফ্রন্ট বোধহয় আর আসছে না। রুদ্রর মুখে এই কথা শুনে চোখ কপালে তুলে রাম বাহাদুর আর মহাদেব বলেছিল, বল কি, দাদা? এমনটা হলে এই রাজ্যের সর্বনাশ হয়ে যাবে যে! আবার সেই বাহাত্তর-সাতাত্তরের দিন ফিরে আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ে! ভাবতে পারছ কী হবে তখন? রুদ্রর একবারও সন্দেহ করার কোনো কারণ হয় নি, ওরা কথাগুলি মন থেকে বলছে কী না! 

এই এরাই এখন, মাত্র বারো চৌদ্দ ঘন্টার তফাতে রুদ্রর চোখের সামনে উদ্দাম নাচছে সবুজ আবির মেখে! এতটাই অচেনা ছিল বুঝি এরা ওর কাছে! নাকি ওরাই ওকে মন খুলে প্রাণের কথা বলতে পারে নি! রাম বাহাদুর মহাদেবরা কী ওকে তবে শুধু একটি রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবেই দেখেছে? এই যে একে অপরের সুখে দুঃখে সমব্যথী হওয়া, খোঁজখবর নেওয়া, ব্যক্তিগত পারিবারিক নানা সুসংবাদ দুঃসংবাদ বিনিময় করা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে, এগুলো কোথায় কোনো অতিরিক্ত সম্পর্ক নির্মান করে না? এত কথা বলত রাম বাহাদুর! স্কুল কলেজের স্পোর্টসে তার মেয়েটার নানা পুরস্কার পাওয়া, শিক্ষকদের পরামর্শ অনুযায়ী খেলায় দেবে না পড়াশুনো আরো করাবে, নাকি বিয়েই দিয়ে দেবে সৎপাত্র পেলে, এ সম্পর্কিত এত এত কথা সকাল বিকেল! তবু শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা এতটাই উপরিতলে থেকে যায় যে রাজনীতির কথা এলেই এক ছদ্মমুখ তুলে ধরতে হয় রাম বাহাদুর আর মহাদেবকে ওর সামনে? যাকে এতদিন সে ভেবেছে এক গভীর আত্মীয়তা, তা আসলে বুঝি এক লুকোচুরি খেলা? নাকি রাম বাহাদুর বা মহাদেব নয়, রুদ্ররই এমন কোনো মুখচ্ছবি আছে যা রাম বাহাদুর আর মহাদেবকে আত্মীয়তার বৃত্তের বাইরে রেখে দিয়েছে। কাছে আসতে গিয়েও নানা দ্বিধা জন্মেছে তাদের মনে? 

দফতরে গিয়ে বসতেই নানা দিক থেকে ফোন আসে। বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজনের সাবধান-বাণীর ফোন। ‘সাবধানে থেকো। কারো সাথে তর্ক করতে যেয়ো না। মাথা ঠা-া রেখো’। ফোন আসে স্বমতের লোকেদেরও। ‘তোমাদের ওদিকে কোনো গ-গোল আছে? এখানে তো নেতাদের বাড়ির সামনে দিয়ে মিছিল থেকে নানা খিস্তিখাস্তা দিচ্ছে।’ রুদ্রর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী অ্যাসিসটেন্ট কন্ট্রোলার দিবানাথ একটু পরেই আসে রুদ্রর ঘরে। ‘এত বাড়াবাড়ি করেছিস না তোরা শেষ ক’টা বছর, এমনটা হওয়ারই ছিল। মুশকিল হচ্ছে, এখন আমাদের মত সাধারণ সমর্থককেও সকাল থেকে রাজ্যের টিটকিরি শুনতে হচ্ছে।’ রুদ্র উত্তর দেয় না। তবে মনে মনে সে জানে, দিবানাথের কথার বেশিরভাগটাই সত্য! দিবানাথ বলেই যায়, ‘আমাদের পাড়ার দু’জন এলসিএম, একজন জোনাল সদস্য শুনলাম ইতিমধ্যেই শহর ছেড়ে পালিয়েছে। গতকাল অবধি যে ছিল পাড়ার অলিখিত রাজা, আজ সেই ল্যাজ তুলে হাওয়া।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার রুদ্র এই রাজ্যের ছেলে নয়, যদিও এখন পাকাপাকিভাবেই চলে এসেছে এখানে। ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার অন্য রাজ্যেই যেখানে বামেদের প্রায় কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই রাজ্য-রাজনীতিতে। কলেজ জীবনে সদ্য বাম আবহাওয়ায় প্রবেশ করা রুদ্রদের কাছে পশ্চিমবঙ্গ ছিল সোভিয়েত কিংবা চীনের মতই স্বপ্নরাজ্য। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা দলীয় সাপ্তাহিকের নিবন্ধ আর খবর পড়ে তারা বাম রাজনীতির উষ্ণতায় তপ্ত করত নিজেদের। তাদের শহরে যখন লাল ঝা-ার মিছিলে গুটি কয়েক মানুষ হাঁটত, তখন প্রতিদিন কলকাতার খবরের কাগজের পাতায় দেখত ব্রিগেড জুড়ে জনজোয়ারের ছবি। ভাবত কবে তাদের ছোট্ট শহর বর্ধমান হবে, কবে তাদের রাজ্য পশ্চিমবাংলা হবে। কিংবা এ দেশ সোভিয়েত বা চীন হবে! এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে হিসেব করত সোভিয়েতের পার্টির প্রতিষ্ঠা কবে আর বিপ্লব হল কতদিন পর। ভাবতো কিউবা চীন ভিয়েতনামের পার্টি প্রতিষ্ঠা আর বিপ্লবের মধ্যে কত বছরের দূরত্ব। এক ধরনের ছেলেমানুষী ঐকিক নিয়মের অঙ্ক কষত মনে মনে। চীন রাশিয়ায় যদি এত বছর পর বিপ্লব এসেছে তবে ভারতে তা কত বছর পর আসতে পারে! কলেজে পড়ার দিনগুলিতে প্রেম আর বিপ্লব ছিল গায়ে মাখামাখি করে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার পংক্তি, তুমি আমার মিছিলের সেই মুখ/ এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাকে খুঁজে/ বেলা গেল দেখি সে আগন্তুক/ ঘর আলো করে বসে আছে পিলসুজে- পংক্তিগুলি বুকের ভেতর রিনরিন করত সর্বক্ষণ। সবচেয়ে ভালো লাগত ওই লাইন, দিগন্তে কারা আমাদের সারা পেয়ে/ সাতটি রঙের ঘোড়ায় চাপায় জিন/ তুমি আলো, আমি আঁধারের আল বেয়ে/ আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন।

কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে রুদ্র এসেছিল পশ্চিমবঙ্গের লাল মাটি লাল হাওয়া আর লাল দুনিয়ায়। এই প্রথম অনেক ছাত্র অনেক মানুষ অনেক বড়ো মিছিল অনেক বড়ো জনসভার শরিক হয়েছে সে। তার চেয়েও বড়ো কথা, এই প্রথম নির্বাচনী বিজয়ের প্রত্যক্ষ অংশীদার সে। তাদের রাজ্যে নির্বাচনের আগে পথসভা জনসভায় ভিড় করে মানুষ বক্তৃতা শোনে, কিন্তু ভোটে বামপন্থীদের বাক্স ফাঁকা। ভোটের আগে গরিব পাড়া বস্তি ও গ্রামে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মানুষকে তারা নতুন কথা শোনাতো। প্রতিবার ভাবত, এবার হয়ত মানুষগুলি একটু হলেও অন্যভাবে ভাববে। ভোটের দিন রুদ্রদের চোখের সামনে সেই গরিবগুর্বো মানুষগুলো কেউ কংগ্রেসের রিক্সা চেপে কেউ বিজেপির অটো চড়ে দলে দলে ভোট দিয়ে যেত। একজন দুজন কখনো ভোটকেন্দ্রের সামনে রুদ্রকে দেখে এগিয়ে এসে বলত, জানি দাদা, আপনারা সৎ। আপনারা ভালো মানুষ। কিন্তু আপনারা যে জিততে পারেন না! কী হবে আপনাদের ভোট দিয়ে। ওদের ভোট দিলে আর কিছু না হোক ভোটের দিন কিছু টাকা হাতে তো পাওয়া যায়! এমন কথার সামনে অসহায় মনে হত রুদ্রর নিজেদেরকে। সত্যি, ওরা জিততে পারে না। টাকার শক্তির কাছে, পেশির শক্তির কাছে, জনবলের কাছে ওরা বারবার হেরে যায়। আবার কী আশ্চর্য, বন্যা হলে দাঙ্গা হলে এই মানুষগুলি নিজেরাই রুদ্রদের ডেকে নিয়ে যেত ওদের পাড়ায়। বলত, আপনাদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, দাদা। আপনারা একটু পাশে দাঁড়ান আমাদের। এতদিনে সব ব্যাটাদের চিনে নিয়েছি। পরের বার আর ভুল নয়, আমরা সবাই আপনাদেরকেই ভোট দেবো। রুদ্রদের বুক ভরে উঠত এসব কথা শুনে। আবার দ্বিগুন উদ্যমে লেগে যেত রাজনীতির কাজে। একবার হঠাৎ আসা ঝড় তুফানে ওদের শহরের গরিব বস্তির প্রচুর ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। মন্ত্রী নেতা সকলের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল গরিব পাড়ায়। সরকারি ত্রাণ পুনর্বাসনে যা হয়, একজন গরিব রিক্সাওয়ালার পুরো ঘরে ভেঙে গেলেও সরকারি ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় নাম উঠল না। কিছুদিন শাসকদলের ছোট নেতা মেজো নেতার পেছনে ঘুরে ঘুরে যখন কিছু হল না, তখন এক সকালে সেই রিক্সাওয়ালা হাজির হয় রুদ্রর বাড়িতে। প্রথমেই কেঁদে কেটে বলে, ওই কংগ্রেসীরা সব চোর বদমায়েশ। বলে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করে দিলে আমাদের কত দিবি আগে বল্? বাবু, আপনারা ছাড়া গরিবের কে আছে বলুন। আপনি যে করেই হোক আমার একটা ব্যবস্থা করুন। রুদ্র তখন তাদের পার্টির নেতাদের ধরে মাসের পর মাস ওই রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে সরকারি দপ্তরের এই টেবিল ওই টেবিল ঘুরে পুরো পাঁচ হাজার টাকা আদায় করিয়ে দিয়েছিল। এই সময়ে প্রতিদিন লোকটিকে চা খাওয়ানো, রিক্সাভাড়া দেওয়া, এসবও করতে হয়েছে রুদ্রকে। রিক্সাওয়ালাটিও বলত, বাবু, সংগঠন গড়ুন। আপনাদের সংগঠন বড়ো দুর্বল। শেষমেশ অনেক লড়াইয়ের পর যেদিন লোকটি হাতে টাকা পেল তখন রুদ্র এই জয়কে উদযাপন করতে বলল, চল শেষবার এই অফিসের ক্যান্টিনে চা খেয়ে নিই। সেই চায়ের আসরে লোকটি বিনা প্রসঙ্গেই হঠাৎ বলে বসে, বাবু, একটা কথা বলি। তারপর খানিক চুপ করে থেকে অস্ফূট স্বরে বলল, আপনাদের পার্টির এখানে যা অবস্থা, আপনারা কখনো জিততে পারবেন বলে মনে হয় না। আমি বলছি কি, এসব করে কি আর দিন যাবে বাবু? একটা চাকরি বাকরি দেখুন। আর না হলে পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরায় চলে যান, ওখানে আপনাদের পার্টির দাম আছে। এখানে নেই। এক গরিব মেহনতির মুখে অমন নির্জলা সুবিধাবাদের কথা শুনে প্রথমে একটু বিষণœই হয়ে পড়েছিল রুদ্র। হঠাৎই মনে পড়ল, প্রতি ইলেকশনে হেরে পার্টি অফিসে ফিরে এসে তারা একে অপরকে বলত, উই ক্যান লুজ সাম ব্যাটল এ- এভরি ব্যাটল বাট দ্য লাস্ট। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রেখে সদ্য ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে পাওয়া রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে রুদ্র বলল, তুমি নিশ্চয়ই এর পরের ইলেকশনেও হয় বিজেপি বা কংগ্রেসকে ভোট দেবে। তবু বলছি, এ সমস্ত কিছুর পরও যদি কোনো বিপদে পড়ে তুমি আমার বাড়ি আস, আমি বা আমাদের পার্টি তোমার হয়ে কিন্তু একইভাবেই লড়ব। তুমি জেনো, তোমার এমন হাজারটি কথাও আমাকে বিন্দুমাত্র হতাশ করতে পারবে না। তুমি ভাবছ, তুমি জিতে গেলে। হ্যাঁ, হয়ত তুমি জিতলেই, আর আমি হারলাম। কিন্তু আমরা হারিনি। আমি-ই আসলে তোমাকে বোঝাতে পারি নি যে রাজনীতিটা আসলে খেলা নয়, মানুষের বাঁচা মরার সংগ্রাম। তুমি ভাবছ, রাজনীতি একটা ফুটবল খেলা। কে কাকে কখন গোল দেবে তার প্রতিযোগিতা। একদিন তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে প্রকৃত সত্য। তুমি না বুঝলেও তোমার ছেলে হয়ত বুঝবে, তোমার কোনো আত্মীয় বা বন্ধু বুঝবে। আমি বোঝাতে না পারলেও হয়ত আমারই কোনো না কোনো কমরেড একদিন তোমাকে বোঝাতে সফল হবে।

দিবানাথ বেরিয়ে যাওয়ার পর একা ঘরে পুরোনো কথাগুলি ভাবছিল রুদ্র। হঠাৎই জানালার বাইরে থেকে একসাথে অসংখ্য বাজি পটকার আওয়াজ ও অনেক কন্ঠের শ্লোগান শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এখনও অ-বাম সংগঠনের সদস্য খুবই কম। ওদের মিছিলে তিরিশ চল্লিশ জনের বেশি হাঁটে না। এই ভোটের আগেও বামেদের ডাকা মিছিলে কম করেও প্রায় দুশো কর্মচারি হেঁটেছে। অবাকই হল রুদ্র, এতগুলি গলার আওয়াজ ওদের মিছিল থেকে তো আসার কথা নয়! হয়ত রাম বাহাদুর মহাদেবের মত অনেকেই আজ যোগ দিয়েছে এই মিছিলে। গতকাল অবধি ওরা হয়ত নিতান্ত অনিচ্ছায়ই ছিল বামেদের মিছিলের অংশ। নাকি উল্টোটা, নতুন শাসক, নতুন ভয়, সে জন্যেই নতুন মিছিলে হাঁটা! আজ শুক্রবার। কাল পরশু বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি। দু’দিনের ছুটির পর এই উচ্ছ্বাস এই উন্মাদনায় হয়ত একটু ভাঁটা পড়বে। কিংবা কে জানে, হয়ত বাড়বেও। অনেক মানুষ হয়ত মুক্তির আনন্দে কিংবা নতুন কোনো ভয়ে রাজনৈতিক ঠাঁই-বদল করবে। অনেককে নতুন চেহারায় দেখা যাবে। হয়ত চেনাও যাবে অনেককে।

শুক্রবার। বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে রুদ্রর। অনেক দূর থেকে অনেকগুলো শুক্রবার ভিড় করে আসে মনে। উনিশ উননব্বই-নব্বই-একানব্বইয়ের শুক্রবারগুলি ছিল বুকে কাঁপন ধরানো। শুক্রবার এলেই রাত সাড়ে ন’টায় দূরদর্শনের পর্দায় ভেসে উঠত কাঁচা পাকা দাড়িতে বুদ্ধিদীপ্ত প্রণয় রায়ের মুখ। অনুষ্ঠানের নাম ছিল দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক। এ দেশের দর্শকের জন্যে সেটাই তখন বিদেশের জানালা। বরফ ঢাকা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির রাজপথে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ নামছে রাস্তায়। আওয়াজ তুলছে কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের দাবিতে। এসব ছবি ছিল সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অংশ। প্রথম প্রথম রুদ্ররা এই সমস্ত কিছুকে পশ্চিমী দুনিয়ার অন্তর্ঘাত ভাবত। ছাত্র রাজনীতির করার সময়েরই তারা পড়েছে কীভাবে হাঙ্গেরিতে কিংবা চেকোশ্লোভাকিয়ায় পশ্চিমী দেশগুলি চক্রান্ত করেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে দিনের পর দিন প্রচার করে এবং কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর পদক্ষেপে কীভাবে ব্যর্থ করা সম্ভব হয়েছিল সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্ত তা ওরা পড়েছে নানা পুস্তিকায় এবং পার্টি মুখপত্রে। ছিয়াশি সাতাশি সালে যখন প্রথম পোল্যান্ডে বন্দর শ্রমিকরা ধর্মঘট করল, তখনই রুদ্রদের মনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। পরে জেনেছে, পোল্যান্ডে মোট জমির ষাট ভাগ ছিল চার্চের করায়ত্তে। ফলেই পোলিশ সমাজে ধর্মের প্রভাব তখনো প্রবল। সংশোধনবাদী  বিচ্যুতিই ওই দেশকে এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে, এমনটাই ছিল তাদের মূল্যায়ন। হঠাৎই মনে পড়ল, সে সময় দূরদর্শনে গভীর রাতে নানা বিদেশি ছবি দেখানো হত। ‘কোয়াক’ নামে একটি পোলিশ ছবি দেখেছিল রুদ্র। এক অজ পাড়া গাঁয়ে এক রোগীর জরুরি ব্রেন অপারেশন করতে হবে। সেখানে কোনও উন্নত হাসপাতাল নেই। নেই কোনো অপারেশনের ছুরি কাঁচি। এক সার্জেন হাতের কাছে যা পেয়েছেন তাকে সম্বল করে রুদ্ধশ্বাস এক অপারেশনের পর রোগীকে বাঁচিয়ে দেন। সংজ্ঞাহীন রোগীর যখন জ্ঞান ফেরে তখন সেই সার্জনের মধ্যে সে দেখতে পায় যীশুখ্রিস্টকে। যীশুই সার্জনের রূপে আবির্ভূত হয়ে ওকে বাঁচালেন, শেষ ছিল এমনটাই। একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের এমন ছবি দেখে অবাক হয়ে যায় রুদ্র। ও বোঝে, স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত পার্টির বিংশ কংগ্রেসে ক্রুশ্চভের নেতৃত্বে যে বিচ্যুতির পথ নেওয়া হয়েছিল তার রাস্তা ধরেই পূর্ব ইউরোপের নানা দেশে এমনসব সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। তবু শুক্রবার রাত এলেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠত। কোন্ দেশের কোন্ অশুভ সংবাদ বয়ে আনবে দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক এবং প্রণয় রায়! টেলিভিশনের সাপ্তাহিক ওই অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে যাবার জো ছিল না। খবরের কাগজের শিরোনামেও সমাজতান্ত্রিক দেশের বিদ্রোহ বিক্ষোভের খবর। প্রতি শুক্রবার ওই অনুষ্ঠান দেখার পর পার্টি অফিসে, চায়ের দোকানের ঠেকে তখন অন্তহীন আলোচনা, প্রশ্নের পর প্রশ্ন নিজেদের ভেতরপ্রদেশ জুড়ে। যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যেতো বুকের ভেতর যখন পর্দায় দেখত ভেঙে পড়ছে লেনিনের মূর্তি দেশের পর দেশে। হাতে ক্রশ নিয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশের শ্রমজীবী জনতা প্রবল ঘৃণায় পা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে কাস্তে হাতুড়ি আঁকা রক্ত পতাকা। ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসমসাহসী সৈনিক রুমানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান চেসেস্কু জনতার প্রবল বিদ্রোহে পালিয়ে যাচ্ছিলেন হেলিকপ্টার চড়ে সস্ত্রীক। পরে নিজেরই এককালের অনুগত সৈনিকদের হাতে তার ধরে পড়ে যাওয়া। ভাবলে এখনও বিভীষিকা হয়। ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে ছিঁচকে চোরের মত ঘাড় ধরে বের করে আনা হচ্ছে চেসেস্কু ও তাঁর স্ত্রীকে। সামরিক আদালতে তাঁর চটজলদি বিচার, মৃত্যুদ- দান, বিচারকদের বিরুদ্ধে চেসেস্কুর হুঙ্কার, পেছনে দড়ি বেঁধে যখন তাঁদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন তাঁর স্ত্রীর আর্তনাদ। সবশেষে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে তাঁদের হত্যা। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা একদা রাষ্ট্রনায়কের মৃতদেহ। এসব ছবি দেখেছে রুদ্র দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ।

সব ভিড় করে আসে রুদ্রর মনে আজ এত বছর পর আবার! সেদিনও ওই দেশগুলিতে জয়ের আনন্দে বিজয় উৎসবে মেতেছিল সাধারণ মানুষ। সারা পৃথিবী জুড়েই এরপর কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে তর্কবিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। দুভাগ হয়েছে পার্টি। একদল দলিল থেকে মার্ক্সবাদকে বিসর্জন দিয়েছে। অন্য দল মনে করেছে বিপর্যয় যা হয়েছে তা মার্ক্সবাদের নয়, বরং এই ঘটনা মার্ক্সবাদ থেকে বিচ্যুতির ফলাফল। রুদ্রদের দলে সে ধরনের কোনও বিভ্রান্তি আসে নি। বরং এই বিপর্যয় নিয়ে তাদের দলের মূল্যায়নের সাথে একমত হয়েছে পৃথিবীর বেশিরভাগ কমিউনিস্ট পার্টি, এতে হাজারো হতাশার মধ্যে রুদ্রর বুকে ভরসা জন্মেছিল। বিটি রণদিভে এক নিবন্ধে দেখিয়েছিলেন, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বিকাশের দুর্বলতা কীভাবে জনগণকে পার্টি থেকে, পার্টির সাধারণ সদস্যদের নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। সোভিয়েতের এই বিচ্যুতি থেকে পৃথিবীর সব কমিউনিস্টদেরই শিক্ষা নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মানুষের থেকে মুখ ফেরালে হবে না। বক্তৃতায় নিবন্ধে এমন কথাগুলি রুদ্রর মনে প্রত্যয় জাগাতো। তবে রুদ্রদের সঙ্গে ছাত্র-রাজনীতি করা অরুণাংশু লেনিন মূর্তির ভেঙে পড়া দেখে বিমর্ষ হয়ে পার্টির সদস্যপদ ছেড়ে দেয়। এমন ঘটনা তখন পৃথিবীর নানা দেশেই ঘটেছে। অনেক দেশে কমিউনিস্ট পার্টির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও সমানভাবে ভাগ করা হয়েছে। ফেসবুকে রুদ্র পড়েছে বাংলাদেশের একটি তরুণের কথা। যখন ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তরের মধ্যে দেওয়াল তুলে দিয়ে সম্পত্তির বিভাজন হল দু’টি দলে, তখন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছিল সেই তরুণ। সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকে মুক্ত এক সমাজের স্বপ্ন যাঁরা দেখেছিল তাঁদেরকে এই রূপে মেনে নিতে পারে নি সেই তরুণ। রুদ্রর মনে পড়ে মৃণাল সেনের ‘মহাপৃথিবী’ ছবিতে দেখেছিল যেদিন বার্লিন ওয়াল ভেঙে পড়ে সেদিনই মহানগরী কলকাতায় আত্মহত্যা করেন পুলিসের গুলিতে নিহত সত্তরের এক নকশাল যুবকের মা। হয়ত যে স্বপ্নের ভরসায় পুলিসের গুলিতে নিজের ছেলের হত্যার ঘটনাকেও মেনে নিয়েছিলেন তিনি, বার্লিন ওয়াল ভেঙে পড়ার সাথে ধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর ভরসার স্বপ্নও।

এই মুহূর্তে যে উল্লাসে মেতে উঠেছে এই রাজ্যের গরিব মানুষদের এক বড়ো অংশ সেটা কী আটের দশকের পূর্ব ইউরোপের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি? হয়ত তাই, হয়ত নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনে সরকার বদল তো একটি স্বাভাবিক ঘটনা, তার সাথে কমিউনিস্ট দেশগুলির ভেঙে পড়ার সাদৃশ্য কোথায়? কেরলে তো প্রতি পাঁচ বছরেই সরকার বদলায়। একবার পরাজিত হলে তো বামেরা সেখানে হারিয়ে যায় না। এটাই বরং অস্বাভাবিক যে পশ্চিমবাংলায় চৌত্রিশ বছর ধরে তারা একটানা ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এটাও তো আবার সত্যি যে সাধারণ মানুষের একটা বড়ো অংশ তাদেরকে দু হাজার সাত সাল থেকেই ধীরে ধীরে বর্জন করেছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক সত্য, রুদ্রর দল মানুষের এই সরে যাওয়াকে ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি। আটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে রুদ্র ফিরে গিয়েছিল নিজের রাজ্যে। তারপর জীবনের নানা মোড় ঘুরে আবার সে এখানে যখন ফিরেছে তখন নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর নিয়ে রাজ্যের রাজনীতি সরগরম। অফিস ফেরৎ রুদ্র একদিন পথে দেখেছিল তাদের দলের একটি মিছিল, সিঙ্গুরে শিল্পের সমর্থনে। সেই মিছিলে এমন অনেক চেহারার লোক ছিল, ছাত্রজীবনে যাদেরকে কখনো বামপন্থীদের মিছিলে দেখবে রুদ্র কল্পনাও করেনি। দু’একজন ঘনিষ্ঠ নেতাকে সে বলেও ছিল। তাদের উত্তর অবশ্য তাকে খুব একটা খুশি করতে পারে নি। কেউ যুক্তি দিয়েছেন, সরকার চালাতে গেলে নানা ধরনের সমঝোতা করতেই হয়। সব সমঝোতা ক্ষতিকর নয়। কেউ বলেছে, দেখতে হবে, নিয়ন্ত্রণ কার হাতে। এই সমস্ত লোকগুলি তো মিয়ার পার্টিসিপেন্ট, এরা তো আর কন্ট্রোল করছে না! রুদ্রর কাছে যুক্তিটা খুব গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। ভালো লাগে নি, সমস্ত মানুষকে তার রাজনৈতিক আনুগত্য দিয়ে বিচার করার সংস্কৃতি! পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির কথা মনে পড়েছিল রুদ্রর সেদিনই যেদিন একটা পার্টি চিঠিতে সে পড়েছিল, ‘একটা সময়ে সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধ রাজনৈতিক পক্ষের ছত্রছায়া থেকে সরিয়ে আনতে আমাদের অনেকে সমাজ বিরোধীদের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছিলেন। কয়েক বছর যাওয়ার পর দেখা গেল, সেই সমাজ বিরোধীরা বিভিন্ন স্থানে নানা স্তরের নেতৃত্বে জায়গা করে নিয়েছে। এখন এদের আঘাত করতে গেলে সংগঠনের শরীরে ঘা পড়ে যায়। ফলে অনেক সময়ই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা মুলতুবিই থেকে যায়।’ রুদ্র আরো লক্ষ্য করেছে, এক শ্রেণির লোক সবসময় ঘুরঘুর করছে কিছু নেতাদের চারপাশে, যারা সংগঠনের কোনও স্তরেই নেই, অথচ গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত ব্যাপারেই তারা নাক গলায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করে। এরা এলসিএম নয়, জেডসিএম নয়, ডিসিএম নয়, কোনও কিছুই নয়। সবাই ওদের চেনে ‘আমাদের লোক’ নামে।

টেলিফোন ঝনঝনিয়ে ওঠে। সম্বিৎ ফেরে রুদ্রর।

‘খবর পেয়েছ রুদ্রদা? গণনাট্যের শিবু বউকে ক্যামোথেরাপি করিয়ে বাড়ি ফিরছিল। রিক্সা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে প্রবল মারধোর করেছে। মাথা ফেটেছে, সারা শরীর রক্তে ভেসে গেছে। ওর বউ হাতে পায়ে ধরেছিল এই অবস্থাতেই ওদের। কেউ কথা শোনেনি’।

 রুদ্রর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। নাটক করা বামপন্থী ছেলে যে ক্ষমতার রাজনীতির ধারে কাছেও ছিল না। ছিল শুধু সাধারণ কর্মী, তাকেও এভাবে আক্রমণ!

‘শিবুকে মারল কেন? ও তো কারো কোনো ক্ষতি করে নি কখনো? সে জাস্ট একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী’

‘আরেকটা কথা শুনলে অজ্ঞান হয়ে যাবে। এই মারে নেতৃত্ব দিয়েছে কে জানো? অংশু! যে কিনা গত সপ্তাহেও তোমাদের নেতাদের হয়ে একে ওকে মারধোর করে বেরিয়েছে।’

‘বলিস কি? অংশু! ও তো অফিসের কম্পিউটার থেকে সকলের ট্রেনের টিকিট করে দেওয়া, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রাতবিরেতে অধ্যাপক আধিকারিক নেতা কর্মীদের এটা ওটা ফরমাইশ খাটা সবেতেই থাকে।’

‘আর মারামারির কথা বললে না? যাকে তাকে যখন তখন মারধোর করে যে বেড়াতো সেটাও বল। ও তো নিজের স্বার্থে মারামারি করে তারপর তাতে রাজনীতির রং লাগিয়ে দিত। তোমাদের নেতারাও তাই বিশ্বাস করতেন। কেষ্টর মত একজন নিষ্ঠাবান পার্টি সমর্থককে ট্র্যানস্ফার করে দেওয়া হল শুধু অংশুর কথা শুনে।’

‘হারাটা বোধহয় খুব প্রয়োজন ছিল, ভজন। খুবই প্রয়োজন ছিল। না হলে এদের চিনতাম কী করে! জিতলে এরাই হয়ত লিডার হয়ে বড়ো বড়ো বক্তৃতা দিত।’

‘প্রয়োজন তো ছিল নিশ্চয়ই। তবে অনেক মূল্য দিতে হবে। হয়ত পার্টিটা বাঁচবে। হয়ত তুমি খুন হয়ে যাবে বা আমি খুন হব বা আমরা দুজনেই খুন হব, পার্টিটা বেঁচে যাবে।’

সত্যি কথাই বলেছে ভজন! একটা অগ্নিশুদ্ধি বোধহয় চাইছে এই সময়! কারা ক্ষমতার রাজনীতির মোহে ভিড় জমিয়েছিল তাদের পাশে, আর কারা গভীর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে দলের সাথে যুক্ত হয়েছে- এদের একটু আলাদা করে চিনতেই হবে। দুর্দিন না এলে এই বিভাজন কী করে হবে? রুদ্রর মনে পড়ে, কথায় কথায় এক শ্রেণির লোকেরা নেতৃত্বের দোহাই দিতেন। এই ‘নেতৃত্ব’ কথাটারও এক অদ্ভুত রূপান্তর ঘটেছিল শেষ কয়েকটা বছরে। কুড়ি বছর পর এ রাজ্যে ফিরে রুদ্র লক্ষ্য করেছে, সমষ্টিবাচক অর্থের শব্দ ‘নেতৃত্ব’ কথাটি অবলীলায় ব্যক্তি নেতাকে বোঝাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন, ‘এখন বক্তব্য রাখবেন এলাকার পাির্ট নেতৃত্ব কমরেড অমুক’। রুদ্র কয়েকবার তার বন্ধুস্থানীয়দের বলেছে সে কথা। বলেছে, কোনও স্তরের পার্টিনেতাদের সমষ্টিকে বোঝাতেই ব্যবহার করা উচিত ‘নেতৃত্ব’ কথাটি। কোনও বিষয়ে কোনও একজন নেতার মতামত মানে পার্টির মতামত নয় বা নেতৃত্বের মতামতও নয়। কথাটা ভাবতেই আবার মনে পড়ে পূর্ব ইউরোপের কথা। রুদ্রদের দলের দলিলে বলা হয়েছে, পূর্ব ইউরোপে জনসাধারণের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল পার্টি, পার্টির সাধারণ সভ্যদের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল পলিটবুরো। সবশেষে পলিটবুরোর সমষ্টিগত নেতৃত্বের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিজে। রণদিভে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, এ ধরণের একটি সামাজিক পরিস্থিতিতে ব্যক্তি-মানুষ সমষ্টির সামনে নিজেকে অসহায় মনে করত। রুদ্র ভাবে যে কোনও নেতাকে কথায় কথায় ‘নেতৃত্ব’ বলে সম্বোধন করার মধ্যে কী এমনই এক বিচ্যুতির পূর্বাভাস নিহিত রয়েছে? হয়ত রয়েছে। সে জন্যেই কি বেশ কিছু বছর ধরে শুদ্ধিকরণের কথা বলেছে তারা। ভেতর থেকে এ ধরনের বর্জ্য পদার্থদের নিকেশ করতে হবে। বিভিন্ন দলিলে বলা হয়েছে, সংগঠনে ও সরকারে মানুষের কন্ঠস্বরকে আরো বেশি করে শ্রুত করে তুলতে হবে। মনে হয় না, খুব একটা কিছু হয়েছে বলে। ২০০৯ সালে যখন লোকসভা ভোটে প্রথম বিপর্যয় এল, তখনও চায়ের দোকানের ঠেকে বন্ধুরা তর্কের ঝড় তুলেছিল। সবাই বলছিল, বেনোজল না বের করলে সর্বনাশ। মজার কথা বলেছিল শঙ্কু।

‘মধ্যরাতে কখনো কখনো চোর চোর বলে চীৎকার শুনেছিস? চীৎকার শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে চোরকে তাড়া করেছিস পাড়ার লোকের সাথে?’

রুদ্র বলে, ‘অনেকবার!’

‘কখনো দেখেছিস চোরকে ধরা পড়েছে?’

‘না।’

‘না। চোরকে কখনোই ধরা যায় না, কারণ যারা ছোটে তারা কেউ চোরকে দেখেনি। একজনের চীৎকার শুনে আরেকজন চীৎকার করে। এভাবে সবাই চীৎকার দেয় আর ছোটে। তুইও জানতেই পারিস না তোর পাশে যে ‘চোর চোর’ ‘ধর ধর‘ বলে চেঁচিয়ে ছুটছে, সেই আসলে চোর। নিজেকে বাঁচাতে সেও সবার সাথে চোর চোর বলে চীৎকার করছে।’

‘তাতে কী হল?’

‘আমাদের এই শুদ্ধিকরণও এমন, বেনোজল সংক্রান্ত আলোচনাগুলোও এমনই ব্যাপার। প্রত্যেকেই বলে বেনোজল তাড়াতে হবে। যে বেনোজল সেও বলে। পার্টির নাম ভাঙিয়ে যারা প্রমোটারি করে বেড়িয়েছে, যে সমস্ত হোলটাইমাররা হাতে এন-সিরিজের মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সবাই বলে বেনোজল তাড়াতে হবে। ফলেই বেনোজল যেখানে থাকার সেখানেই থেকে যায়!’

বিষণ্ন হাসি ফুটে ওঠে রুদ্রর মুখে। সেদিন শঙ্কুর কথা শুনে তার খারাপই লেগেছিল। এ রকম অতিসরলীকরণ সে মেনে নিতে পারে নি।

আবার ফোন বাজে। দিবানাথ।

‘তুই এখনও আছিস্? বাড়ি চলে যা।’

‘কেন?’

‘ওরা সেকশনে সেকশনে ঘুরে সকলকে সবুজ আবির মাখাচ্ছে।’

‘তাতে কী হয়েছে। ওদের জয় হয়েছে, সেলিব্রেট তো করবেই। আমরা কী জিতলে লাল আবির মাখাতাম না?’

‘তোর কাছে এলে কী করবি?’

‘জোর করে মাখাতে গেলে প্রতিবাদ করব।’

‘এ সব ঝামেলা করার কী দরকার। চলে যা না। কখন কী হয় বুঝিস না?’

‘না আমি যাবো না।’

কথা শেষ হতে না হতেই একদল সবুজ আবির মাখা সমর্থক নিয়ে ঘরে ঢোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ইউনিয়নের নেতা সরোজ।

‘স্যার, আজ আমাদের আনন্দের দিন। সবাইকে সবুজ আবির মাখাতে বেরিয়েছি। আপনাকে একটু দেবো, অনুমতি দেবেন?’

অবাকই হয় রুদ্র! চারধারে এত অশান্তি, হঠাৎ এদের এত সৌজন্য কেন? কারণ যাইহোক, সৌজন্যের উত্তর তো অসৌজন্য দিয়ে হয় না।

‘দেখুন আপনারা আনন্দ ভাগ করতে চাইছেন আমার সাথে, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আপনারা আমার পক্ষপাত তো জানেনই। আমি কিন্তু এরপরই সবুজ আবির মুছে ফেলব। আপনারা মাখাবেন আমি কিছু মনে করব না। আবার আমি মুছে ফেলব, আপনাদেরকেও সেটা মেনে নিতে হবে।’

‘ঠিক আছে, স্যার। এই স্যারকে বেশি দিস না।’

কপালে ও গালে সবুজ আবির মাখিয়ে দেওয়া শেষ হতেই রুদ্র পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে শুরু করে দেয়। সরোজ বলে, ‘স্যার, রুমালটা দিন। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’ সবুজ আবির মাখিয়ে আবার তারাই নিজের হাতে মুছে দিয়ে যায়।

রুদ্র একা বসে ভাবে, চারধারে অসৌজন্য এবং অসহিষ্ণুতার মধ্যে, একটুখানি সৌজন্য ও সহিষ্ণুতায় কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত!

আবার ফোন বেজে ওঠে। ভজন।

‘ওরা এসেছিল সবুজ আবির মাখাতে?’

‘হ্যাঁ’

‘মাখলে?’

‘আমি বললাম, তোমরা তোমাদের আনন্দ আমার সাথে ভাগ করতে চাও। কর। কিন্তু আমি নিজে কিন্তু মুছে ফেলব। ওরা মাখিয়ে দেওয়ার পর নিজেরাই মুছে দিয়ে গেল।’

‘ওদের হাতে সবুজ আবির মাখতে পারলে তুমি? ওই হাতে কত কমরেড খুন হয়েছে জানো? ওই হাত শিবুকে অসুস্থ বউয়ের সামনে মেরে রক্তাক্ত করেছে। আর তুমি ওদের হাতেই আবির মাখলে?’

‘তোদের সেকশনে যায় নি?’

‘ওরা আসছে দেখেই আমি টয়লেটে চলে গিয়েছি। আমার পক্ষে ওদের সাথে ভদ্রতা করা অসম্ভব। মাথা খারাপ হয়েছে? আমি সবুজ আবির মাখব?’

‘টয়লেটে চলে যাওয়াটা কী প্রত্যাখান করা হল? ওটা তো পালিয়ে যাওয়া। আমি মনে করি, হয় প্রত্যাখান করব নয় ওদের দিতে দেব। পালিয়ে যাবো কেন?’

‘এই পরিস্থিতিতে প্রত্যাখান করে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ আছে? কিছু হলে কেউ এগিয়ে আসবে আজ আর?’

‘তবু এটা তো কোনও নৈতিক অবস্থান হল না।’

‘তোমারটা কোথাকার নৈতিক অবস্থান। তুমি তো শিবুকে যারা মেরেছে তাদের সাথে কম্প্রোমাইজ করে নিলে।’

‘তুই তো পালিয়ে গেলি। এটা কি নীতিগত অবস্থান?’

‘ও সব জানি না। আমার মনে হয় এটা তুমি ঠিক কর নি, রুদ্রদা।’

ফোন রেখে দিয়ে রুদ্র সংশয়েই পড়ে যায়। কাজটা ঠিক হল কি? ভজন বলছে, এটা কম্প্রোমাইজ। সত্যিই? যতটা সৌজন্যের সাথেই অনুরোধ করুক না কেন সরোজরা, ওই আবির প্রত্যাখান করাই উচিত ছিল রুদ্রর, তাই কি? প্রত্যাখান করলে, সরোজরা আর কতক্ষণ সৌজন্যে আটকে থাকত বলা মুশকিল। এরপরই হয়ত শিবুর অবস্থা হত তারও। শিবুর মত রক্তাক্ত হতে চায় নি বলেই কি আবির নিয়েছে ওদের হাতে রুদ্র? তবে তো ভজন আর রুদ্রর অবস্থানে কোনও তফাৎ নেই। ভজন পালিয়ে গেছে আর সে ওদের অনুরোধ মান্য করেছে। না, রুদ্র ভয় পায় নি। সে শুধু সৌজন্যের উত্তরে সৌজন্য দেখিয়েছে। আগেকার নির্বাচনের পর যখন রুদ্রদের দলের কর্মীরা সকলকে লাল আবির পরাতো তখন উল্টোদিকের সকলের কাছে কী এই সৌজন্যই প্রত্যাশা করে নি তারা? কিন্তু রক্তাক্ত শিবু যদি জানতে পারে, তার উপর আক্রমনকারীদের দেওয়া আবির রুদ্র বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করেছে, সে কি ভাববে? ভাববে, রুদ্র ভয় পেয়ে সৌজন্যের মুখোসে আত্মসমর্পন করেছে। কিন্তু রুদ্র কী ভাবছে নিজের সম্পর্কে! সে কি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার মানসিকতা থেকে এমনটা করল? নাকি, অন্য কিছু। রুদ্রর এই মনোভাব তো নতুন নয়। যখন চতুর্দিকে তাদের রমরমা, তখনও সে প্রতাপের প্রদর্শন পছন্দ করত না। কখনো চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তৃণমূল ইউনিয়নের নেতার সাথে খোশগল্প করলে পরে নানা টিটকিরি শুনতে হয়েছে। কেউ বলেছে, এখন থেকে লাইন করছ? কেউ বলেছে, অত গণতান্ত্রিক হওয়ার কী আছে! সকলকেই রুদ্র বলত, সংগ্রামকে আমি ঝগড়া মনে করি না। বিরোধীকে শত্রু মনে করি না। আমি বিরোধী মতের পরাজয় চাই নিশ্চয়ই, কিন্তু বিরোধীর মৃত্যু চাই না! বলত, বিরোধীকে গণতন্ত্র না দিতে পারলে স্বমতের লোককেও পরিসর দিতে পারব না। এটা তার বিশ্বাস, স্থির প্রত্যয়, তবু..। তবু, আজকের নির্বাচনী ওলোট পালোট এবং চতুর্দিকে আক্রমনের সময়ে, বিশেষ করে ঘনিষ্ঠবৃত্তের একজন শিবুকে এমন নৃশংসভাবে মারধোর করার পর ওদের হাতে আবির গ্রহণ করাটা ঠিক হল কী না বুঝে উঠতে পারে না রুদ্র। ভজনের ফোন ওকে এক সংশয়ের সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে। কোথায় পার সে এই মুহূর্তে জানে না।

আপোষ- লড়াই-বিচ্যুতি-নীতিনিষ্ঠা-পতন-অভ্যুদয়! এক গভীর আবর্তে তলিয়ে যেতে থাকে রুদ্র। ঢেউয়ে ঢেউয়ে উথাল পাথাল ভাবনাতরঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশ্চিমবঙ্গ, রাশিয়া চীন থেকে কিউবা ভিয়েতনাম, একাকার হয়ে যায়! পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া অতীত। ভিয়েতনাম, চীন, কিউবা দাঁড়িয়ে আছে এখনো। কেরল নেই, পশ্চিমবঙ্গ চলে গেল। ত্রিপুরা এখনো রয়েছে। কোথায় ভুল, কোন পথেই বা উত্তরণ! প্রশ্নের পর প্রশ্ন মনে উদয় হয়, মিলিয়ে যায়। অনেক অনেক লড়াই সামনে। অনেক দেখা শোনা জানা বাকি। অনেক অনেক পথ হাঁটতে হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সব যাত্রার শুরু ঘরের ভেতর থেকে, নিজের মনের অন্দর থেকে। প্রথমে এটা বুঝে নেওয়া জরুরি, আজ একটু আগে সে যা করেছে, সেটা ভুল না শুদ্ধ! সেটা আপোষ বা সৌজন্য! সব অন্ধকার, সব কুয়াশা কাটবে। হয়ত কাটবে। হয়ত নয়, নিশ্চয়ই কাটবে! কিন্তু আগে নিজের ভেতরে আলো ফেলতে হবে। এটাই এই মুহূর্তে জরুরি কাজ! 

বৃহস্পতিবার, ৮ জুলাই, ২০২১

গভীর অন্ধকারে তোমাকে চাই

 


পরিণত বয়সেই তিনি চলে গিয়েছিলেন। এক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরই তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। তবু এখনও এতগুলি বছর যাওয়ার পরও তাঁকে ঘিরে শূন্যতা বোধের শেষ হয় না। বরং বেড়েই যায় হয়ত। এই শূন্যতার অনুভূতি শুধু তাঁর নিজের দলের ভেতরেই নয়। রাজনীতির সাথে আপাত সংস্রবহীন মানুষও কোনো সমস্যার কথা উঠলেই বলেন, জ্যোতি বসু থাকলে আজ এমনটা হত না। অর্থাৎ রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়েও আজ শূন্যতা অনুভূত হচ্ছে সমাজের নানা স্তরে। এটাই হয়ত রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসুকে তাঁর সমসাময়িক অন্য নেতাদের চেয়ে আলাদা মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। দলীয় রাজনীতির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তাঁর উপস্থিতি।

            এখন সবদিক দিয়েই একটা সংকটের সময়। শুধু যে জ্যোতি বসুর দল আজ পরাজিত ও দুর্বল হয়েছে তাই নয়। যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে জ্যোতি বসুরা রাজনীতি করেছেন, সেই পরিমণ্ডলই আজ নেই। আজ ওপর থেকে নীচ, কেন্দ্র থেকে রাজ্য, সবটাই ওলোট পালোট হয়ে গেছে। এই পাল্টে যাওয়াটায় আমরা নিশ্চিতভাবেই বিস্মিত হব না, কারণ পৃথিবী তো নিয়ত পরিবর্তনশীল। আমাদের বিস্ময় সভ্যতার ঐতিহাসিক পথ ধরে মানুষের সমাজ অগ্রগতির যে পথ ধরে হেঁটেছে একটা সময়ে, সেটা আবার উল্টোমুখো যাত্রা শুরু করল না তো? তবে এটাও সত্য সভ্যতার অগ্রগতির পথটা কখনোই একরৈখিক নয়, তা সততই দ্বন্দ্বমূলক। ফলে উত্থান পতন এগানো পেছোনো সব মিলিয়েই হয়ত তার ঐতিহাসিক যাত্রা।

            এই সব কথা বলার পরও এটা অনস্বীকার্য যে এই মুহূর্তে এই রাজ্যে বামপন্থী আন্দোলন যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে তা অভূতপূর্বই। যদি বলা হয় যে এই বিপর্যয় মানে শুধু একটি নির্বাচনের ফলাফলগত বিপর্যয় বা প্রত্যাশিত বিজয় অর্জিত না হওয়ার বিপর্যয়, তবে এক গভীর সঙ্কটকে হয়ত অনেকটাই লঘু করে দেখা হবে। জ্যোতি বসুর জন্মদিন এলে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে, নানা সময়ে তাঁর উচ্চারিত সতর্কবাণী বা সাধারণভাবে বলা নানা কথা থেকে আমরা কোথাও কোনো দূরত্ব রচনা করেছিলাম? দূরত্ব রচনা যদি কোথাও হয়েও থাকে, তবে সেটাই কি আজকের এই অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের এক অন্যতম কারণ? নাকি, যে সময়, যে পরিমণ্ডলে জ্যোতি বসুরা রাজনীতি করে গেছেন, তার থেকে আজকের সময় এতটাই পাল্টে গেছে, যে তাঁর পথে অবিচল থেকেও আমরা সম্ভাব্য সঙ্কট থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারলাম না? হয়ত, দুটো কথাই সত্যি। তবে এটা সত্য, আজকের সময়ের মত জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর আর কখনো, এতটা গভীরভাবে তাঁর শূন্যতা অনুভব করে নি এ রাজ্যের রাজনীতি বা তাঁর নিজের দলের কর্মী সমর্থকরা। স্বজন বন্ধুদের আড্ডা থেকে খবরের কাগজের নিবন্ধ, নানা আলোচনায় বারবার ফিরে আসছেন জ্যোতি বসু।

            প্রকৃতপক্ষে এই মাটির বাস্তবতায় বাম রাজনীতির প্রায়োগিক দিকটির বীজ রোপণ করে একে মহীরুহের চেহারায় নিয়ে এসেছিলেন যে সমস্ত মহারথীরা, তাঁদের মধ্যে জ্যোতি বসু অগ্রণী। ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গিয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে দেশে ফিরে যখন তিনি সর্বক্ষণের রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন সমস্ত পথটাই ছিল অজানা। কমিউনিস্টদের সামনে তখন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিল না এমন পথে হাঁটার। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি এক প্রবল ঘূর্ণাবর্তের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। যে দেশগুলিকে আলোকবর্তিকা করে কমিউনিস্টরা নিজেদের নীতিমালা প্রণয়ণ করত, সেই দেশের রাজনীতি থেকে সরাসরিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের জটিল রাজনীতিকে মুখোমুখি হওয়া কোনো চটজলদি টোটকাও লভ্য ছিল না। ফলে পথ কেটে কেটে পথ তৈরি করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না জ্যোতি বসুদের সামনে। এভাবেই পরিষদীয় রাজনীতি থেকে রেল শ্রমিক আন্দোলন, সর্বত্র অচেনাকে চিনে চিনে পথ তৈরি করেছেন জ্যোতি বসু। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, এই দীর্ঘ সময়পর্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নানা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সেই সময়টিতে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর এক সর্বনাশা অতি বাম বিচ্যুতির কবলে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টি। পরাধীনতার শেষ লগ্নে সারা দেশে কংগ্রেস মুসলিম লীগের রাজনীতির এক বিকল্প ভাষ্য নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে শ্রমিক কৃষকের শ্রেণিসংগ্রামকে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং তারই ফলে রাজ্যে রাজ্যে যে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রভাবের বিস্তার ঘটে, তা পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের অতিবাম লাইনের (যা রণদিভে লাইন নামে পরিচিত) ফলশ্রম্নতিতে সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়ে। এই বিপর্যয়কে ব্যবহার করে ট্রেড ইউনিয়ন ক্ষেত্রে নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করে নেয় আইএনটিইউসির মত শক্তি। বিভিন্ন জাতি উপজাতির রাজনৈতিক উন্মেষ ঘটেছিল যে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শ পেয়ে, সেখানেও তৈরি হল শূন্যতা। ওই রকম একটি বিপর্যয় বা পরবর্তীতে অতিবাম বিচ্যুতি থেকে নিষ্কৃতি পেতে গিয়ে অতি দক্ষিণপন্থার খপ্পরে পড়ে যাওয়া, নেহরুইন্দিরার লেজুড়বৃত্তির লাইনের দিকে চলে যাওয়া, আবার চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান বলে হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ তরুণের অতিবাম রাজনীতির মোহে জীবন বিসর্জন দেওয়া, এমন সব বিপর্যয়ের মধ্যেও হতাশাগ্রস্ত না হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে সুসংগঠিত করা, পরিষদীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত করা, আদর্শগতভাবে একটি শক্তিশালী অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা, এসবই ছিল জ্যোতি বসু ও তাঁর সহযোদ্ধাদের এক অভূতপূর্ব অবদান। ১৯৭৭ সালে যেদিন বামপন্থীরা রাজ্য সরকার গঠন করলেন, সেদিনই তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে বামপন্থীদের বিকল্প রাজনীতির ধারার কথা শুনিয়েছিলেন। রাইটার্সের বারান্দা থেকে তিনি বলেছিলেন, বামপন্থী সরকার রাইটার্স থেকে পরিচালিত হবে না। হবে রাজ্যের মাঠ ময়দান থেকে। বলতে দ্বিধা নেই, চৌত্রিশ বছরের বামপন্থীদের শাসনের যা কিছু সাফল্য, তাই এসেছে এই নীতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে। যখনই কোনো ভুল হয়েছে বা ভ্রান্তি হয়েছে, তা হয়েছে কোনো না কোনো ভাবে এই নীতি থেকে বিচ্যুতি থেকেই। আজ সারা পৃথিবীতেই বামপন্থীরা এক নতুন বামপন্থার কথা বলছেন, যেখানে ক্ষমতার উৎস রাষ্ট্রশক্তির অভ্যন্তরে নয়, জনসাধারণের সম্মিলিত শক্তির আধার থেকেই আসবে। লাতিন আমেরিকায় নানা সঙ্কটের মধ্যেও যে নতুন বামপন্থার পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, কিংবা যে বামপন্থার অনুসরণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে ছোট্ট রাষ্ট্র কিউবা সমাজতন্ত্রের পথে অবিচল থাকেত সমর্থ হয়েছে, তা এই বিকল্প বামপন্থাই। অপারেশন বর্গা থেকে পঞ্চায়েতি রাজ, বক্রেশ্বর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন থেকে সাক্ষরতা আন্দোলনে এক নতুন ধরনের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিকল্প বামপন্থার চর্চাই হয়েছে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবাংলায়। আজ তৃণমূল রাজত্বে এই গণউদ্যোগকে তুচ্ছ করে আমলানির্ভর পুলিশনির্ভর লুম্পেনশক্তি কেন্দ্রিক সরকার পরিচালনার রাজনীতিরই আমদানী হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।

            সোভিয়েতের ভাঙন উত্তর নয়া উদারনীতির পৃথিবীতে বামপন্থীদের চলার পথ আরো কঠিন হয়ে যায়। ওই সময়ে প্রথাগত বামপন্থার বাইরে গিয়ে নতুন পথ খুঁজতে হয়েছে বামপন্থীদের সর্বত্র। আমাদের দেশে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই নতুন পথ অণে¦ষণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জ্যোতি বসুই। তবে একটি বিষয়ে সবসময়েই সচেতন ছিলেন। যে কোনো নতুন নীতিই হোক, তাকে জনসাধারণের সম্মতির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হবে। সে জন্যে বারবার বলতেন জনসাধারণের কাছে যাওয়ার কথা। এই যাওয়ার পথটি কেমন হবে তা হয়ত সেভাবে চর্চিত হয় নি। কিন্তু জনসাধারণের কাছে যাওয়া ছাড়া যে কোনো বিকল্প নেই সে কথা বারংবার বলেছেন জ্যোতি বসু। আজকের অন্ধকার সময়ে জ্যোতি বসুর এই কথাটিই আমাদের পথ দেখাতে পারে। আরেকটি বিষয়ও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জ্যোতি বসু সারাজীবনের রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে যে সম্মান অর্জন করেছেন, তা তাঁর দলের মর্যাদাকেও ছাড়িয়ে গেছে নানা সময়েই। তবু ব্যক্তি জ্যোতি বসু পার্টির সাংগঠনকি সিদ্ধান্তের প্রতি ছিলেন অনুগত। হাজারো মতপার্থক্য সত্ত্বেও ছিলেন পার্টির সিদ্ধান্তের অধীন। কখনোই পার্টির সম্মিলিত সত্তার চেয়ে নিজেকে বড়ো করতে চান নি। পার্টির যে সিদ্ধান্তকে তাঁর মনে হয়েছিল ঐতিহাসিক ভুল, তাঁকে তিনি পালন করেছেন ঐকান্তিক নিষ্ঠায়।

             জ্যোতি বসুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সামগ্রিকতাই আমাদের আজকের অন্ধকারে নতুন পথ খুঁজতে অনুপ্রাণিত করবে।

বুধবার, ৯ মে, ২০১৮

কিছু তার বুঝি না বা!

বিকেলের পড়ন্ত রোদে একা হেঁটে পেরোই বীরহাটার সেতু। শীত চলে গেছে। গ্রীষ্ম আসি আসি করছে। ক’দিন ধরে মাঝেমাঝেই সন্ধ্যায় উঠছে মাতাল ঝড়, নামছে অঝোর বৃষ্টি। গতকাল সন্ধ্যার প্রবল বর্ষণের স্মৃতি যেন এখনও লেগে আছে আজকের মৃদুমন্দ হাওয়ায়। মন্দগতি বাঁকা নদীর জল তার স্বভাব আলস্য ছেড়ে ইদানীং একটু হলেও প্রাণ পেয়েছে। দিনের কাজের শেষের এই অলস হাঁটায় মনটা কেমন ‘গান-গান‘ করে।

এ কী?? এ গান কেন বাজছে ভেতরে??? ‘যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম ভুলিয়ে দিল তারে/ আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে‘! অন্ধকার কোথায়, চারধার তো আদুরে আলোয় ভরা। আমার গায়ে ঢলে পড়ছে যে সুবাতাস সে গাইছে, ‘জীবনলতা অবনতা তব চরণে/ হরষগীত উচ্ছসিত কিরণমগন গগনে‘। নেচে উঠছে ছন্দে ছন্দে মনিপুরি নাচের বোলে ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ প্রাণেশ হে আনন্দবসন্তসমাগমে‘। তবে ওই গান কেন জাগে এই অসময়ে ভেতরে? বাইরের এই আনন্দবসন্তের বুকের গভীরে এ কোন্ রিক্ত হেমন্তের শূন্যতা? হঠাৎই কাঁচাপাকা দাড়িভরা মুখ, কাঁচাপাকা চুল, মাথায় বেতের টুপি ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়ের মুখটি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। স্বভাবদার্শনিক একদা আগুনখেকো নকশাল, অপ্রতিদ্বন্দ্বী মেধার ক্ষিতীশবাবু আমার গণিত বিভাগের শিক্ষক।

ক্যালেন্ডারের পাতা পেছনে চলে যায় চৌত্রিশ বছর আগেকার এক বসন্তে, গোলাপবাগে। বিভাগের প্রবীণ বিদায় অনুষ্ঠানে বসন্তকে সঙ্গী করেই গেয়েছিলাম ‘যদি তারে নাই চিনি গো, সে কি আমায় নেবে চিনে এই নবফাল্গুনের দিনে!‘ অগ্রজদের চলে যাওয়াকে গানে ভাষা দিতে এর পরেই গেয়েছি, ‘কেন আমায় পাগল করে যাস, ওরে চলে যাওয়ার দল‘। হারমোনিয়াম বন্ধ করে ফিরে যাচ্ছি, এমন সময় পাশে সার দিয়ে রাখা চেয়ারে বসা শিক্ষকদের মধ্য থেকে ক্ষিতীশবাবু ডাকলেন, ‘যেতে যেতে একলা পথে‘ জানো? ওটা গাও।’ ফিরে এসে আবার হারমোনিয়ামে আঙুল বোলাই। বাইরে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পুকুরের পাশের রাস্তার ধার বরাবর প্রাচীন গাছের সারিতে কচি সবুজের উজ্জ্বল উপস্থিতি। ওপারে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের গায়ে লাল ফুলে ছেয়ে থাকা বীথি থেকে পুকুর পেরিয়ে ভেসে আসে আনন্দবাতাস। গোটা গোলাপবাগে তখন ‘কোন রঙের মাতন উঠল দুলে ফুলে ফুলে‘। যে গান গাইতে এসে এবার দাঁড়িয়েছি সে গান কোনো আত্মীয়তা পায় না আলো-হাওয়া-রৌদ্রে। খানিক বিস্ময় ও কিছুটা অনিচ্ছাতেই স্যারের অনুরোধের গান গাই।

কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় জিমন্যাসিয়াম হলে আন্তঃ বিভাগীয় নাটক প্রতিযোগিতার ফল প্রকাশের আগে বন্ধুদের অনুরোধে গাইতে উঠেছি। অপ্রস্তুত মঞ্চে উঠে কী গাইব ভেবে হারমোনিয়াম আঙুল বোলাতে ওই সন্ধ্যাই উঠে এল আমার বয়ানে। ‘আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা, অন্ধকারের ললাটমাঝে পরানু রাজটীকা‘। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুরা বারবার শুনতে চাইত ‘আমার নাইবা হল পারে যাওয়া‘। দর্শকাসন থেকে সোচ্চার অনুরোধ ভেসে এলো। গাইলাম। তারপর উইংসে একটি জুনিয়ার ছেলে ফিসফিস করে প্রায় বলে, ‘একজন স্যার ‘যেতে যেতে একলা পথে‘ শুনতে চাইছেন‘। এই উৎসবমুখর প্রাঙ্গনে এমন গান! আমি অবাক চোখে অন্ধকারে বসে থাকা দর্শকদের দিকে চোখ ফেলি। দেখি, অদূরে একটি কোণে একটি স্টিলের চেয়ারে বসে আছেন ক্ষিতীশবাবু। তারপরও বিভাগের নবীনবরণে, আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো অনুষ্ঠানে দর্শকাসনে ক্ষিতীশবাবু থাকলেই বলবেন, ‘শুভ, ওই গানটি গাও‘।

তখন এটাই শুধু ভাবতাম, স্যারের প্রিয় গান। খ্যাপা মানুষ, তাই প্রিয় গান সবসময় শুনতে চান। আমাদেরও তখন আগুনরাঙা যৌবন। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশে উড়ছে সমাজতন্ত্রের পতাকা। সোভিয়েত চীন পূর্ব ইউরোপ ভিয়েতনাম কিউবা আফগানিস্তান পেরিয়ে বিপ্লবের বিজয়শকট ভারতে ঢুকল বলে। তিনটি রাজ্যে উড়ছে রক্তনিশান। বাকি রাজ্যে হতে আর কতক্ষণ। ক্ষিতীশবাবু সুপণ্ডিত সেজন্যে, আবার একদা-নকশাল সেজন্যেও কিছুটা দূরে থাকতাম। আমাদের চোখে ‘বাম হঠকারী‘। ভাবতাম উনিও হয়ত ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী‘ ভাবেন আমাকে। ফলে শ্রদ্ধা ছিল, দূরত্বও ছিল। আমাদের হৈ হৈ অনুষ্ঠানের মঞ্চে তখন ‘যেতে যেতে একলা পথে‘ চলত না। মন চাইত না। বন্ধুরাও চাইত না। তখন সময় ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো‘র। কিন্তু আশ্চর্য! বিদ্যুৎহীন অঝোর বৃষ্টির সন্ধ্যায় হোস্টেলের ঘরে হারমোনিয়াম নিয়ে হয়ত বসেছি। গাইছি ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’ বা ‘ওই যে মেঘের কোলে‘ বা ‘আমি তখন ছিলেন মগন গহন ঘুমের ঘোরে‘, তখন হঠাৎই কোনো টগবগে বামপন্থী বন্ধু গান থেমে গেলে অস্ফুটে বলত, ‘যেতে যেতে একলা পথে‘ গানটা কর্। ভাবতাম বাইরের প্রাকৃতিক অন্ধকার এ গান এনে দিয়েছে তাকে।

তারপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হল। পোল্যান্ডে বন্দর শ্রমিকরা ধর্মঘট করল সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে। শুক্রবার রাতের ওয়ার্ল্ড দিস ইউকের প্রণয় রায় আর ভেঙে পড়া লেনিনমূর্তি একাকার হয়ে গেল। শুক্রবার রাত এলেই বুকের ভেতর ছমছম করে, বুকের ভেতর কে যেন গায় ‘যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম ভুলিয়ে দিল তারে‘। ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে অপরাধীর মত টেনে হিঁচড়ে বার করা হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফ্যাসীবিরোধী যুদ্ধের নায়ক চেচেস্কু আর তাঁর স্ত্রীকে। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে উদ্যত বন্দুকের সারির দিকে তাকিয়েও তিনি অকুতোভয়। বাবরি মসজিদ ভাঙার রাত। শিলচরের শুনশান রাস্তার অন্ধকারে আমি আর প্রসাদ। আমাদের সজল চোখ। অন্ধকারে ঠোঁটের জ্বলন্ত আগুন- আমাদের শপথের, নাকি স্বপ্নের চিতার? অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রাতের তারা খুঁজি। একটু আলো, একটু আলো চাই। ‘বুঝিবা ওই বজ্ররবে নূতন পথের বার্তা কবে‘!!!

রাশিয়া চীন পেরিয়ে এখন অন্ধকার ঘনিয়েছে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম থেকে কামদুনি পার্ক স্ট্রিট হয়ে নীল-সাদা রক্তগঙ্গা আর গৈরিক রামনবমীতে। এখনও বুকের কাছে বীণ বেজে উঠলেই অনিবার্যভাবে ‘যেতে যেতে একলা পথে’। বিপ্লবী ফকির রায়ের আত্মকথা প্রকাশের অনুষ্ঠানে ৩০ বছর পর দেখা ক্ষিতীশবাবুর সাথে। হারমোনিয়াম ধরতেই ‘শুভ, যেতে যেত একলা পথে‘। বললাম, ‘স্যার, ছাত্রজীবনেও এই গান আপনি অনুরোধ করতেন সব অনুষ্ঠানে‘। স্যার মৃদু, নাকি বিষণ্ন, হাসলেন। বললাম, বাংলাদেশের বাম সংস্কৃতি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন ছিলেন একজন কৃষক নেতাও। সভা সমাবেশে তিনি কৃষকদের উদ্দীপিত করতে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের নানা অন্য গান। কিন্তু একান্ত ঘরোয়া আসরে তাঁকে গাইতে বললেই অবধারিতভাবেই গাইতেন যেতে যেতে একলা পথে। জানি না এটা কী সংযোগ। ক্ষিতীশবাবুও এই গানের অনুরোধ করেন। আমিও এই গানই গেয়ে উঠি আজকাল থেকে থেকে।’

সম্প্রতি হয়ে গেল গণিত বিভাগের পুনর্মিলন। আনন্দ উচ্ছাসে ভরে আছে চারদিক। গাইতে উঠে ক্ষিতীশবাবুকে দেখে বললাম, ‘স্যার, সারাজীবন একটি গানই অনুরোধ করে গেছেন। আজ অন্য গান গাই?‘ স্যার অনুমতি দিতে গিয়েও একটু থমকে গেলেন, তারপর করুণ আর্তি, ‘ওটাই গাও। যেতে যেতে একলা পথে‘। গান শেষ করে বসি স্যারের পাশে। বললাম, ‘স্যার, এই গান আপনি সবসময় অনুরোধ করেন। আগে বুঝতাম না। এখন বুঝি। আমারও ভেতর জুড়ে এই গান এখন সবসময়। ঘুমে জাগরণে।‘

স্যার বললেন, ‘জানো তো আমি খুব সক্রিয়ভাবে নকশাল আন্দোলনে ছিলাম? বহুবার মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে বেঁচে ফিরে এসেছি। একবার ওই ঝড়ো সত্তরেই একটি গোপন আস্তানায় একটি ঝড়ো সভার মধ্যেই প্রবল ঝড় উঠল। সভা শেষ। ঝড়ও থেমে গেছে। সভায় ছিলেন চারুবাবু, সরোজ দত্ত, আমি এবং একজন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মী। চারুবাবু বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মীকে বললেন, গান গাও ‘যেতে যেতে একলা পথে‘। সেই স্মৃতি আমার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে। গান বললেই আমার কাছে ‘যেতে যেতে একলা পথে‘। অনেক ভাঙন হয়েছে। অনেক বিভ্রান্তি। অনেক প্রশ্ন। অনেক সংশয়। তবু ‘ঝড় উঠেছে ওরে ওরে, ঝড় উঠেছে ওরে এবার, ঝড়কে পেলেম সাথী’ ভাবলেই রক্তের ভেতর এক অদ্ভুত প্রবাহ বয়ে যায়।‘
আজীবন ঝড়ই সাথী।

গানটি কি বুঝেছি? নাকি বুঝি নি? নাকি শুধু আভা? নাকি শুধু অনুমান? নাকি কিছুই বুঝি নি।

বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৭

অনেকদিনের আমার যে গান

ছুটন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া ধানখেত আর গাছেদের সারির মত চলে যায় জীবন। একটা সময় ছিল, দূর অতীতের সেই সময়ে, বড় হওয়ার দিন আসতে চাইত না। কবে গালে দাড়ি উঠবে, বাবা কাকাদের মত ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে জনসমাজে, তার ছিল অন্তহীন অপেক্ষা। এখন জানুয়ারি এলেই ঝড়ের গতিতে চলে আসে ডিসেম্বর। পাগলা ঘোড়ার মত দ্রুত দিগন্তের রেখার দিকে ছুটে যাচ্ছে আয়ুর অশ্ব।‘না আছে তার পায়ে রেকাব, না আছে তার হাত লাগামে। মশারির মত ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ অবধি টাঙানো রেডিওর অ্যারিয়েল দিয়ে শুরু হয়েছিল যে শৈশব, সে আজ প্রৌঢ়ত্বে রেড-মি ফোর মোবাইলে ইউনিকোডে টাইপ করে ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া ছড়ার পংক্তি খোঁজে। শৈশবে শিলং-এর নীচের বাড়িতে কদাচিৎ বেজে উঠত উঁচু টুলের উপর রাখা কালো টেলিফোন। একবার বাজলে ঝনঝনিয়ে উঠত পাড়ার সবথেকে নীচের বাড়ি থেকে সব থেকে ওপরের বাড়ির ঘরের কোণও। অনেক দূর থেকে শোনা যেতো টেলিফোনে কথা বলা। ট্রাঙ্ক কল এলে বোঝা যেতো, কারণ তার আওয়াজ হতো একটানা। সাধারণ কলের মত থেমে থেমে নয়। ট্রাঙ্ক কলের কথোপকথনও হত আরো উঁচু তারে বাঁধা, পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সম্ভবত যাকে বলে সোপ্রানো।


তখন শীতকাল মানেই ক্রিকেট আর কমলালেবু। এখনকার চল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে এক শরীর ঘাম নিয়ে রঙীন পোশাক আর সাদা বলের বাণিজ্য নয়। সুরুচি, সংযম আর শিষ্টাচারের অপর নাম ছিল ক্রিকেট। খেলোয়াড়দের ধবধবে সাদা পোশাকের মত অমলিন ছিল ক্রিকেট। ‘গুড মর্নিং, দিস ইজ ডিকি রত্নাগর রিপোর্টিং ইউ ফ্রম দ্য ইডেন গার্ডেন ক্যালকাটা। বিউটিফুল সানি উইন্টারি মর্নিং উইথ লাশ গ্রীন আউটফিল্ড, স্টেডিয়াম ফুল টু দ্য ক্যাপাসিটি, উই উইল টেক ইউ থ্রু দ্য নেক্সট ফাইভ ডেইজ অব এক্সাইটিং এন্ড বেস্ট ক্রিকেট। উই এক্সপেক্ট ইট টু বি প্লেড ইন দ্য ট্রুয়েস্ট স্পিরিট অব দ্য গেম।‘ আমাদের ইংরেজি বলার প্রথম পাঠ ডিকি রত্নাগর, আনন্দ শীতলাবাদ, নরোত্তম পুরীর কাছে। তখনো আন্তর্জাতিক ফুটবলের সাথে আমাদের পরিচয় খবরের কাগজের খেলার পাতাতেই, কিংবা ‘গড়ের মাঠ‘, ‘অলিম্পিক‘ বা ‘স্টেডিয়াম‘ পত্রিকার মধ্য দিয়েই। খবরের কাগজের পাতার স্থির চিত্রের মধ্যেই আমরা খুঁজে পেতাম স্ট্যানলি ম্যাথিউজ, পেলে, ইউসেবিও বা ববি চার্লটনের গতি, লেভ ইয়াসিন বা পিটার থঙ্গরাজের দুর্দান্ত ডাইভ। ফুটবলের ধারাবিবরণী মানে অজয় বসু বা পুষ্পেন সরকার। হকি মানে যশদেব সিং। ক্রিকেট ইংরেজি, হকি হিন্দী আর ফুটবল বাংলা। রেডিও ধারাবিবরণীর ভাষা মানচিত্রের বিভাজন ছিল এভাবেই। হারিয়ে গেছে ওই দিনগুলি। হারিয়ে গেছে শর্ট ওয়েভে বিদেশের মাটিতে হওয়া ক্রিকেট ম্যাচের ধারা বিবরণীর আওয়াজের হ্রাসবৃদ্ধি। মোক্ষম মুহূর্তে হঠাৎ রেডিওর আওয়াজ যেত মিইয়ে। তখন সকলের কান এগিয়ে গেছে রেডিওর দিকে। গায়ে গায়ে থাকা অন্য রেডিও স্টেশনের সিগন্যাল এসে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে কাঙ্খিত কন্ঠস্বর। কী হল? ভালো, না মন্দ? ঠাওর করা যাচ্ছে না। হয়ত কেউ রেডিও থেকে কান সরিয়ে এনে উচ্ছসিত আনন্দে বললেন ‘চার!‘, পর মুহূর্তেই আরেকজন ব্যাজার মুখ করে বললেন, ‘না, না আউট‘। মুহূর্তে বিষাদ নেমে এলো।


মনে পড়ে, লর্ডসে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের প্যাভিলিয়নমুখী লম্বা মিছিল। একটু পরেই ইনিংস বিয়াল্লিশে গুঁড়িয়ে যাবে। ক্রিস ওল্ড আর ম্যাথিউ আর্নল্ড যেন মৃত্যুদূত। জেঠু বলল, ‘চলো, ঠাকুর ঘরে যাই‘। ঠাকুর ঘরে আমি আর জেঠু ষাষ্টাঙ্গে মাটিতে। পেছনে রেডিও থেকে ভেসে আসছে মৃত্যুবিবরণী। একনাথ সোলকারের অপরাজিত ষোলো যেন গারফিল্ড সোবার্সের তিনশো পঁয়ষট্টি। বোকার মতো ক্যাচ তুলে অনুশোচনায় মাথার ঝাঁকুনিতে যেভাবে মাথার টুপি বেলের ওপর পড়তেই খসে পড়েছিল ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের রাজা ও টেস্ট ম্যাচের ভিখিরি অশোক মানকড়ের উইকেট ও ক্রিকেটজীবন, সেভাবেই চলে গেলে আমাদের সোনাঝরা দিনও।


যা হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত আর। কিন্তু স্বপ্নে যে দেখা দেয় সেই দিনগুলি। ঘুমের মধ্যে ডুকরে কেঁদে খুঁজে বেড়াই আমার সবচাওয়ার সবপাওয়ার জেঠুকে। হঠাৎ দেখি শিলং এর ওয়ার্ড লেক আর গভর্নর হাউসের মাঝের এঁকে বেঁকে যাওয়া রাস্তা দিয়ে লুঙ্গির মত ধুতি পরা, ধূসর রঙের দিদির বুনে দেওয়া পুলোওভার গায়ে হেঁটে আসছে জেঠু। হাতে উইলসের তামাক আর সাদা পাতা দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করা ‘মিক্সচার‘ এর সিগারেট। আমি ‘জেঠু‘ বলে ছুটে যেতেই ঘুম ভেঙে যায়। দেখি পাশে স্ত্রী আর পুত্র শুয়ে আছে, শুয়ে আছে একটা অন্য জীবন। এ যেন অন্য একটা পৃথিবী। চারপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর মধ্যে জেঠুকে আর খুঁজি পাই না। বাবা মা জেঠাইমা বড়দা মেজদারা বলত, জেঠু সংসারী নয়। সর্বক্ষণ ‘ঠাকুর ঠাকুর‘, আর শীতকাল এলে ‘ক্রিকেট ক্রিকেট‘ করে। জেঠুর ‘ঠাকুর ঠাকুর‘ও এখন কারো মধ্যে দেখি না। জেঠুর ‘ঠাকুর ঠাকুর‘ মানে প্রতি সন্ধ্যায় কারো না কারো মুখোমুখি বসে গান শোনা। গান শুনতে শুনতে চোখ বুঁজে ধ্যাণস্থ হওয়া আর নিঃশব্দে কেঁদে যাওয়া। দু চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরে যায় জল। আজন্ম দেখেছি, ফলে অবাক হই নি। পাশের ঘরের নতুন ভাড়াটের বাচ্চা অবাক হয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘দাদু, কাঁদছে কেন?‘। তার মা’র কাছে উত্তর ছিল না। আজও আমাদের কাছে নেই। কী সেই বিপন্ন বিস্ময় যা জেঠুর অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করত! বড়ো হয়ে জেনেছি মারিফত পন্থায় গানই হচ্ছে এবাদত, পরমের সাথে সেতু। প্রতিদিনের একক গায়ক ও একক শ্রোতার গানের এবাদত মাঝে মাঝে সম্প্রসারিত হত বাড়ির কীর্তনের আসরে। সেখানে বাজারের আলুওয়ালা গণেশ গাইতেন ‘তোমার বদল দিয়া যাও বাঁশি ও প্রাণনাথ‘, বাড়িতে যিনি রক্ত পরীক্ষার রক্ত সংগ্রহ করতে আসতেন অন্য সময় তিনি সেই আসরে গাইতেন ‘শিবের বুকে দাঁড়িয়ে কেন বল মা শ্যামা শিবানী গো‘। আমাদের বাড়িতে যিনি রান্নার কাজ করতেন তিনি গাইতেন ‘পিঞ্জিরার পাখির মত উইড়া গিয়া দেখি কোথায় গো আমার কালো পাখি‘। বাবা গাইত ‘আজি বিজন ঘরে‘। দিদিরা গাইত, মা গাইত। জেঠু কেঁদে যেত। কেঁদেই যেত। ‘আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে/ সেদিন যে রাগিনী গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে/ আজি পূবের হাওয়ায় হাওয়ায়, হায় হায় হায় রে কাঁপন ভেসে চলে।‘


এক একর জমির শিলং কেঞ্চেস ট্রেসের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম আমরা একটা সময়ে। ওই বাড়িতে ফলের বাগান ছিল, সব্জির বাগান ছিল, ফুলের বাগান ছিল, গাড়ি বারান্দা ছিল। আর ছিল তিরতিরি করে বয়ে যাওয়া একটা পাহাড়ি ছড়া। রাত্তিরে বিছানায় শুতে গেলে লেপের তলা থেকে শুনতে পেতাম পাইন গাছের পাতার সাথে বাতাসের কানাকানি। সেই সাঁইসাঁই শব্দে ঘুমিয়ে পড়তাম মায়ের কোমড়ে হাত জড়িয়ে, বুকে মুখ গুঁজে। ভোরে আমাদের ঘরের নীচে কাঠের প্ল্যাঙ্কিং এর তলার মুরগীর ঘর থেকে কোঁকর কোঁ শব্দে ঘুম ভাঙত। ছড়া পেরিয়ে লাবান পাহাড়ের ‘হাতি পাথর‘ এর ওপর দিয়ে কমলা গাছের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো পড়ত আমাদের পূবের বারান্দায়। সেখানে কাঞ্চার তৈরি চা পাউঁরুটি টোস্ট খেতে খেতে তাকিয়ে থাকতাম পাহাড়ের দিকে। রাতে যদিও কোনোদিনই তাকাতাম না ওদিকে। কারণ অন্ধকার নামলেই মনে পড়ত ওই অন্ধকার পাহাড়ে গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে ত্রিপুরা পণ্ডিতের ছেলে। এ নিয়ে বাড়িতে আসা অতিথিদের সাথে মায়েরা অনেক দিন গল্প করেছে। কেন মরল? এই প্রশ্ন এলেই চোখ দিয়ে আমাদের দেখিয়ে আলোচনা নেমে আসতো খাদে, একটা পর্যায়ে ফিসফিসানিতে। প্রবল আগ্রহে কান পেতে এর মধ্যেই ঠিক শুনে নিতাম একটি মেয়ের নাম।


আমাদের বাড়ির প্লাম গাছের ইংরেজি ওয়াইয়ের মত একটি ডাল কেটে ফুটবলের ব্লাডারের রাবার দিয়ে একটি অসাধারণ গুলতি বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের কাঞ্চা। গাছের ডাল আর ব্লাডারের রাবারের নমনীয়তা গুলতিকে দিয়েছিল একটা অভূতপূর্বে দূরত্বে নিশানা করার ক্ষমতা। পুটিংয়ের গোলায় একবারই নিক্ষেপ করেছিলাম আমার গুলতি। বাড়ির মালিকের বড় ছেলে সিম ‘দেখি দেখি‘ বলে আমার হাত থেকে নিয়ে একবার ক্ষমতা পরখ করেই পায়ের হিলের এক ঘায়ে ভেঙে দিয়েছিল আমার সাধের গুলতি। এতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ কেউ হয়, বিশেষ করে আমার সেই বয়সের হিরো বাড়ির মালিকের বড় ছেলে সিম এমনটা হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনে এর চেয়ে বড় প্রতারিত হওয়ার আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রতিবাদ করতে পারি নি, কাঁদতে পারি নি। বড়দের কাছে নালিশ করেছি। ‘কী আছে, আরেকটা তৈরি করে দেবে কাঞ্চা‘ বলে সকলে এড়িয়ে গেছে। জীবনে আর কোনো গুলতি এত নিখুঁত হয় নি। কেঁদেছি স্বপ্নে বহুদিন, বহু বহু দিন। আবার কখনো দেখেছি চালের ড্রামের ভেতর হঠাৎ খুঁজে পেয়েছি সেই স্বপ্নের গুলতি। কখনো বাড়ির ছড়ার পারে পড়ে থাকা গুলতিটা দেখেছি কেমন জোড়া লেগে গেছে নিজে নিজেই। আনন্দে নেচে উঠবো। ঘুম ভেঙে গেছে। আমার চারপাশে গভীর রাতের অন্ধকার ছাড়া আর কিছু সত্য ছিল না তখন। ওই গুলতির জন্যে এখনও আমার দীর্ঘশ্বাসের শেষ নেই। এমনকি এই বড়ো অবেলায় ল্যাপটপে টাইপ করতে করতেও বুকের ভেতর কে যেন কেঁদেই চলেছে। আমি এখনও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি সিমের সেই ক্রুর হাসির দিকে।


আমার জন্ম শিলং এর গণেশ দাস চিলড্রেন হসপিটেলে। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। ন বছর বয়স অবধি শিলংয়েই ছিলাম। তারপরও বেড়াতে, গান গাইতে গিয়েছি অসংখ্যবার। জন্মের পর হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার পর আর কখনো ওই হাসপাতালে যাই নি। গণেশদাস হাসপাতাল আমি দেখতেও চাই না। ছোটবেলা থেকে কল্পনায় সেই হাসপাতালের একটা অবয়ব রয়েছে আমার কাছে। এটা আমি হারাতে চাই না। দেখিনি বলেই হারাইও নি। তবে সেই হাসপাতাল থেকে যে আমাকে কোলে করে বাড়িতে এনেছিল তার নাম রাম, তাকে হারিয়েছি। পুরো নাম ছিল নিমারাম উপাধ্যায়। আমাদের বাড়ির নেপালি গৃহকর্মী। সকাল সন্ধ্যে আমাদের রান্নাঘরে কাজ করত, দিনের বেলায় বাবাদের অফিসের পিওন। মা’র কাছে শুনেছি, আমি প্রথমে ‘মা‘ ডাকি নি, রামকে ‘আম‘ বলে ডাকার মধ্য দিয়েই আমার কথা ফোটা। রামের কোলের ওম আমি আজো ভুলি না। প্রতি বছর রাম ছুটি নিয়ে একমাসের জন্যে নেপালের বিরাট নগরে ছেলে বউয়ের কাছে যেতো। যাওয়ার আগে আমাকে শার্ট প্যান্ট জুতো মোজা কিনে দিয়ে যেতো। রামের বিছানায় একটা তেল চিটচিটে বোঁটকা গন্ধ ছিল। মানে ওই গন্ধ যে বোঁটকা সেটা বড়দের কথায় শুনেছি। ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই সেই বোঁটকা গন্ধওয়ালা বিছানায় চলে যেতাম। রামের পাশে শুয়ে থাকতে ভীষণ ভালো লাগত। ন বছর বয়স অবধি আমার সেটা প্রায় নিত্যকর্ম ছিল। রামের বিছানার গন্ধ আমি এখনও নাকে টের পাই। ওই গন্ধ এখনও আমাকে ডাকে। ছোটবেলায় আমাকে দেখাশোনা করত যে খাসি রমণী সে আমাকে তার পিঠে চাদর দিয়ে বেঁধে ঘরের কাজ করত, রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যেতো। তাঁকে আমি ডাকাতম ‘কং‘। কং মানে খাসি ভাষায় দিদি। খাসি রমণীকে এই সম্বোধনই করা হয় ওখানে। কং-এর পিঠে চেপে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ আমি ট্রেন প্লেন জাহাজ চড়েও পাই নি। ওটাই আমার জীবনের সেরা যান। ঘুরতে ঘুরতে কখনো পেছন থেকে কংকে জড়িয়ে ধরে আদর করতাম, কখনো রেগে গেলে মারতাম, চুল টানতাম। কং চা খেতে খেতে ওর মুখের এঁটো কাপ থেকেই আমাকে চা খেতে দিত। দাঁত দিয়ে অর্ধেক বিস্কুট ভেঙে বাকিটা পেছনে হাত বাড়িয়ে আমাকে দিত। শিলং এর কাঁচা সুপুরি ও খাসি পানপাতার ভীষণ কড়া ‘কোয়াই পান‘ খেতো কং। অর্ধেক মুখে দিয়ে বাকিটা আমাকে দিত। তিন চার বছরের আমিও কং এর মত তর্জনীর মাথা থেকে জিভে চূণ ঠেকাতাম। ঠোঁট লাল হয়ে যেতো। বাবার বন্ধুরা বাড়িতে এসে বলতেন, আপনার শ্রীমানকে দেখলাম কংএর পিঠে খাসি বাচ্চার মত ঠোঁট লাল করে চলেছে। বাবারা কংকে কিছু বলত না। কং বাজারে সব্জির দোকানও দিত। আমাকেও সেখানে নিয়ে যেতো। কংয়ের হাতের নাগালের বাইরে থেকে ফুলকপি, সিম, টমেটো আমি এনে পাল্লায় তুলে দিতাম। পরেও কিশোর বয়সে যখন আর কং আমাদের বাড়ি কাজ করত না তখনও বাজারে গেলে আমি কংএর পাশে বসে থাকতাম। বাবা বাজার শেষ করে আমাকে নিয়ে যেতো। আমি ততক্ষণ কংয়ের সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। আসার সময় কং আমাকে একটা ফুলকপি বা বাঁধাকপি কিছু একটা দিয়ে দিত।


ন বছর বয়সে যখন শিলং ছেড়ে চলে আসি শিলচরে তখন আমাদের বাড়িতে পোষা একটা কুকুর ছিল, নাম জাম্বো। এর আগে একটা সাদা ককাস স্প্যানিয়েল ছিল। সাদা ছিল বলে নাম দেওয়া হয়েছিল গোরা। আমরা বলতাম গোরার ভালো নাম গৌরাঙ্গ প্রসাদ নন্দী মজুমদার। জেঠু একটু রাগ করেছিল বটে। কিন্তু গোরা মাছ মাংস খেত না, জেঠুর কীর্তনের আসরে বাইরে ঠায় বসে থাকত বলে জেঠুর ওর প্রতি একটু দুর্বলতা ছিল। আমরা যখন চলে আসি, আমরা জানতাম জাম্বোও আমাদের সাথে আসবে। জিনিষপত্র গোছানোর সঙ্গে সঙ্গে জাম্বোর জিনিষপত্রও গোছানো হচ্ছিল। তখন আসাম স্টেট ট্রান্সপোর্টের কালো অ্যাম্বেসেডার ভাড়া পাওয়া যেতো। গায়ে গণ্ডারের অ্যাম্বব্লেম। ওটাকে বলা হত ফার্স্ট ক্লাস। বাবা শিলচর যাওয়ার জন্যে ফার্স্ট ক্লাস ভাড়া করেছিল। সকালবেলা সব জিনিষ যখন উঠছে তখন ফার্স্ট ক্লাসের ড্রাইভার বলল, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া কুকুর নিয়ে যাওয়া যাবে না। সেই শুনে আমাদের ভাইবোনেদের কী কান্না। আমরা গাড়িতে উঠে চলে এলাম। দূরে জাম্বো আমার পিসতুতো দাদা সেজদার হাতে চেনে বাঁধা আমাদের গাড়ির দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। গাড়িটা দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল। সেই কান্না আমাদের আজো গেল না। সেজদা তখন ব্যাচেলার ছিল। বাড়ি ফেরার কোনো ঠিক ছিল না। সেজন্যে জাম্বোকে ছেড়ে রাখত। জাম্বো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো অনাথের মত। কেউ খেতে দিত, কেউ মেরে তাড়াতো। এক বন্ধু পরে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, তোদের জাম্বো পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। লোকে মারে। শুকিয়ে গেছে। গায়ে রাস্তার কুকুরের মত ঘা হয়ে গেছে। আমি চিঠি পড়ে কেঁদে ভাসিয়েছি। কবে জাম্বো মারা গেছে সেই খবরও পাই নি। এখন বড়ো হয়ে আমার মনে হয়, সেদিন ড্রাইভারের সেই কথাটা নিশ্চয়ই আমার অভিভাবকদের শিখিয়ে দেওয়া কথা ছিল। একটা কুকুরের জন্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ব্যাপারটা নিশ্চয়ই একটু বাড়াবাড়িই।


ছোটবেলা থেকে দেখতাম বাড়িতে কেউ এলে মা-বাবারা অবধারিতভাবে জিজ্ঞেস করত, বাড়ি কোথায় ছিল? উত্তরে হয়ত বললেন সিলেটের অমুক গ্রামে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা মা কোনো একটা যোগাযোগের প্রসঙ্গ তুলে একটা আত্মীয়তার বাঁধনে বাঁধতে চাইতেন। হয়ত বললেন সিলেট শহরে বাড়ি ছিল। বাবা জিজ্ঞেস করল, কোন্ পাড়া। ওরা বললেন। তারপর প্রশ্ন, কোন্ বাড়িটা? তারপর সেটাও বললেন। বাবা এরপর বলল হয়ত একটা দোকান ছিল যে মিষ্টির, তার কোন দিকে? তিনি হয়ত বললেন, তার উল্টো দিকেই। এবারে বিজয়ীর হাসি দুজনেরই মুখে, চিহ্নিত করা গেছে বা চেনানো গেছে। তারপরের মুহূর্তেই দীর্ঘশ্বাস। ‘আর কী হবে! সব গেল! কী ছিল আমাদের জীবন, আর এখন কী হল!‘ মুহূর্তে ভারি হয়ে যেতো পরিবেশ। কথা বলতে বলতে হয়ত কেউ চোখ মুছতেন, কেউ ঘনঘন মাথা নাড়তেন। এই ঘর হারানোর হাহাকার আমার শৈশব। এই চোখের জলেই আমার ‘স্বদেশ‘এর সাথে পরিচয়। এই ধরনের অসংখ্য কথোপকথন শুনতে শুনতে আমাদের বড় হওয়া। অসংখ্য গ্রামের নাম, রেল স্টেশনের নাম, দোকানের নাম, পাড়ার নাম, স্কুলের নাম, কলেজের নাম, বিশিষ্ট মানুষের নাম, বংশের নাম- এভাবে আমাদের মুখস্থ হয়ে যেতো। কল্পনায় আমরা আমাদের পিতৃপ্রজন্মের ভিটে বাড়ি সব দেখতে পেতাম।


১৯৯৯ সালে প্রথম ওপারে গেলাম বড়ো হয়ে। করিমগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ওপারে জকিগঞ্জই বাংলাদেশ। নদীটা আন্তর্জাতিক সীমানা। নদীর এপার থেকে ওপার দেখা যায়। মানুষের চলাফেরা দেখা যায়, বাড়ি দেখা যায়, গাড়ি দেখা যায়, গাছপালা দেখা যায়। করিমগঞ্জে এলেই সাধারণত আমরা একবার কালীবাড়ির ঘাটে এসে ওপারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে মনে গাইতাম ‘আমার নাইবা হল পারে যাওয়া/.... নেই যদি বা জমল পাড়ি ঘাট আছে তো বসতে পারি/ আমার সারাদিনের এই কি রে কাজ ওপার পানে কেঁদে চাওয়া?‘ সেদিন নৌকোয় চেপে বসেছি। একটু একটু করে দূরে যাচ্ছে ‘দেশ‘, একটু একটু করে আসছে আমার মায়ের দীর্ঘশ্বাস, বাবার চোখের অশ্রুবিন্দু ‘বিদেশ‘। নৌকো এসে ভিড়ল ঘাটে। লাফ দিয়ে নামলাম মাটিতে। বুকের ভেতর কে যেন বলল, ‘তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা‘। না, এটা তো আমার দেশ নয়। পাসপোর্ট ভিসা লাঞ্ছিত বিদেশ। ওপার? ওপারও তো আমার ঘর নয়। জন্মস্থান শিলং-এ আমি অবাঞ্ছিত ‘ড-খার‘ মানে বহিরাগত, আসামে বিদেশি, বাংলাদেশী।


গাড়ি এগিয়ে চলে হুহু করে সিলেটের দিকে। পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত একটির পর একটি গ্রাম, বাজার। কালীগঞ্জ, চারখাই, গোলাপগঞ্জ, বাঁ দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে রাস্তা শ্রীচৈতন্যের ঢাকাদক্ষিণের দিকে। সিলেটে ঢুকতেই শেখঘাট, চৌহাট্টা, মিরাবাজার, বন্দর বাজার, শিবগঞ্জ। সব চেনা। একটা নামও অশ্রুতপূর্ব নয়। দেখছি, পড়ছি আর ভেসে উঠছে শৈশবের স্মৃতি। এই নামগুলি শোনার শৈশব। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। ভীষণ চেনা একটা বিদেশ। যার সব জানি সব শুনেছি অথচ একটা বিদেশ। একে কোন সুরে বাঁধিব? মঞ্চে উঠতেই ভেতর থেকে কে যেন গেয়ে উঠল ‘রক্তে রেখে গেছে ভাষা/ স্বপ্নে ছিল যাওয়া আসা/ কোন যুগে কোন হাওয়ার পথে কোন বনে কোন সিন্ধুতীরে/ মন যে বলে চিনি চিনি/ যে গন্ধ বয় এই সমীরে কে ওরে কয় বিদেশিনী‘! অনুষ্ঠানের শেষে এসে গাইতে থাকি, ‘আমার শান্তির গৃহ সুখের স্বপন রে, ও দরদী কে দিল ভাঙিয়া/ মন কান্দে পদ্মার চরে লাইগ্যা‘। এই প্রথম গাইতে গাইতে চোখের জলে ভেসে যাই। গলা জড়িয়ে যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় আড়াইশো ‘বিদেশি‘ শ্রোতা চোখের জলে ভেসে যেতে থাকে।


অনুষ্ঠান শেষ। রেস্টুরেন্টের অন্ধকার উঠোনে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে অপরিচিত ‘বিদেশি‘ যুবক, অশ্রু ছলোছলো চোখে বলল, ‘দাদা, তুমি আমাদের কখনো পর ভেবো না। সিলেটকে বিদেশ ভেবো না। সাতচল্লিশে রাজনীতির খেলায় কী হয়েছে সে আমি জানি না। তখন তুমিও ছিলে না, আমিও ছিলাম না। এখন যখন পেয়েছি তখন আর দূরে ঠেলো না। এরপর থেকে যখন আসবে, ভেবো দেশে ফিরছি। সারা বছরের কর্মক্লান্তি থেকে বিরতি নিতে দেশবাড়িতে এসেছি‘!



আমার হারানোপ্রাপ্তির খাতাটা এমনই। চোখের জল, দীর্ঘশ্বাস আর বোকার মত আবেগের। এতে কোনো কা-জ্ঞান নেই!

সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬

আছে তাঁবু অন্তরে বাহিরে

এই দিনটা এলে কী করব ভেবে পাই না। আনন্দ? নাকি বিষাদ? জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই ধন্দেই চলেছে জীবন! এই দিনে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর রক্তদানের মধ্য দিয়ে লালকেল্লা থেকে ইউনিয়ন জ্যাক নেমে তেরঙ্গা উঠেছিল, এটা তো কম আনন্দের নয়। সেই তেরঙ্গা আজকের কলঙ্কিত তেরঙ্গা নয়।কিন্তু আমি তো শুধু ভারতীয় নই, আমি বাঙালিও। আসামের তৎকালীন রাজধানী শিলং শহরে জন্মানো বাঙালি, যার মা বাবা সাতচল্লিশের এই দিনে নিজের ভিটেমাটি হারিয়েছে। মা বাবার প্রজন্মের ভিটেমাটি হারানোর যন্ত্রণা তো আমাকেও ছুঁয়ে আছে আজন্ম। তবে এই দিনটিকে কী করে আনন্দের দিন বলি!

মনে আছে প্রতি বছর এই দিনটা এলে বাবা একটি গল্প বলত। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। বাবা তখন আসামের জোরহাট শহরে। বাবা আর বাবার প্রাণের বন্ধু বীরেন সন্ধেবেলা পায়চারি করছিলেন জোরহাট শহরের রাস্তায়। বীরেনকাকাও ছিলেন সিলেটের লোক। একটু বড়ো হয়ে জেনেছি বীরেনকাকা আমার নিজের কাকা নন এবং তিনি বাঙালিও নন। মনিপুরি। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি। তবে সিলেটেরই। বাবা আর বীরেনকাকা যখন সন্ধেবেলা পায়চারি করছে জোরহাট শহরের রাস্তায়, তখন চারধারে বাজি পুড়ছে, আলোর রোশনাই। দেশ স্বাধীন হয়েছে। মানুষ সেই স্বপ্নের স্বাধীনতা অর্জন উদযাপন করছে মহানন্দে।বাবা বীরেনকাকাকে বলল, ভাবতে পারিস বীরেন, দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো! ব্রিটিশ সত্যি সত্যি এ দেশ ছেড়ে চলে গেল! এখন আমরা স্বাধীন! আমরা কি কখনো ভেবেছিলাম, ব্রিটিশ সত্যি সত্যি এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে? এই কথার উত্তরে বীরেনকাকা বলেছিল, দেশ স্বাধীন হল ঠিকই, কিন্তু আমাদের সিলেটটা বিদেশ হয়ে গেল! একথা শোনার পর বাবাও স্তব্ধ হয়ে যায়। দুজনে নীরবে আরো কিছুক্ষণ পাশাপাশি অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে থাকে। একটা লাইটপোস্টের কাছাকাছি আসতেই আবিষ্কার করে, দুজনেরই চোখ দিয়ে অঝোরে নেমে আসছে অশ্রু। প্রতি বছর পনেরো আগস্ট এলে আমার বাবা এই গল্পটা দিনের কোনো না কোনো সময় একবার অন্তত বলে উঠতোই। বাবার এই ঘোরলাগা স্মৃতিকাতরতা আমাকে ছুঁয়ে আছে আজও। ‘আমার মন কান্দেরে পদ্মার চরের লাইগ্যা‘ গানটা গাইতে গেলেই বাবার ওই গল্প মনে পড়ে। প্রিলিউডের মত প্রতিটি আসরে ওই গানটি গাইতে গেলে আমি অবধারিতভাবেই বাবার গল্পটি বলি। আমার বাবাদের প্রজন্মের অনেকেরই ধারণা ছিল দেশভাগের ঘটনাটি একটি ক্ষণস্থায়ী ভ্রান্তিমাত্র। একটা অতিক্রান্তিকালীন পর্বে এক ধরনের বিকৃত উন্মাদনার শিকার হয়েছে মানুষ। এ কখনো স্থায়ী হতে পারে না। কিছুদিন পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে দেশ আবার এক হয়ে যাবে। আমার মণিকাকাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা সাতচল্লিশে আসার সময় বাড়িটা বিক্রি না করে ওই হরিবাবুর জিম্মায় রেখে চলে এলে কেন? মণিকাকা বলল, আমরা ভেবেছিলাম দেশভাগটা একটা সাময়িক গণ্ডগোল। কিছুদিন গেলে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। দেশটাও আবার এক হয়ে যাবে, আমরাও ফিরে যাবো সিলেটে। বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল মণিকাকা। নেতাজী থাকলে দেশটা ভাগ হত না।  আমি এটাও লক্ষ্য করেছি, আমাদের এপারের ভিটেহারা মানুষের একটা বড়ো অংশ সারাজীবন বিশ্বাস করেছেন, নেতাজী থাকলে দেশটা ভাগ হত না। অনেকেই প্রতীক্ষায় থাকতেন, নেতাজী আত্মপ্রকাশ করবেন। একবার নেতাজী আত্মপ্রকাশ করলেই ভারত-পাকিস্তান এক হয়ে যাবে। 

আমি যখন বড়ো হয়ে ভোটাধিকার পাবার বয়সে পৌঁছে গিয়েছি, তখনও আমার ভোটাধিকার প্রাপ্তি হয় নি। কারণ আসামে তখন নতুন ভোটার তালিকা তৈরি বন্ধ। দেশভাগের বলি হয়ে ওপার থেকে এপারে মানুষ এসে নাকি আমাদের রাজ্যের অস্তিত্ত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। সেজন্যেই এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু হল আমাদের রাজ্যে। ‘দেশ থেকে বিদেশীদের বিতাড়ণ করতে হবে। ভোটার তালিকায় লক্ষ লক্ষ বিদেশীদের নাম। এগুলো বাদ না দেওয়া অবধি নতুন ভোটার তালিকা তৈরি বন্ধ রাখতে হবে।‘ বছরের পর বছর চলল অবরোধ, বন্ধ্, স্কুল কলেজ বন্ধ। আমাদের পরীক্ষা শিকেয় উঠলো। দিকে দিকে বাঙালিদের হত্যা হচ্ছে। আমার দাদার বন্ধু, আমাদের নিজের দাদারই সমতুল ডাক্তার অঞ্জন চক্রবর্তী গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে খুন হয়ে গেল। কী আশ্চর্য, আমার দাদা যখন এই খবরটি আমাকে দেয় তখন আমি আমাদের সংগঠন ‘দিশারী‘র মহড়ায় অসমীয়া গানই গাইছিলাম। জ্যোতিপ্রসাদের গান। দাদা ডাকল, তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। অঞ্জনকে গুয়াহাটিতে খুন করেছে। মনে একবারও দ্বিধা এল না, যে আন্দোলনকারী ঘাতকদের হাতে অঞ্জনদা খুন হল ওরা অসমীয়াই। ওরা জ্যোতিপ্রসাদের গান গেয়েই মিছিল করে। তাঁর গানের পংক্তি দিয়ে দেওয়াল লেখে। এটা একটা অদ্ভুত পরিহাসই।

যখন আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা গান নিষেধ, প্রকাশ্যে বাংলায় কথা বললে হেনস্থা হওয়ার সম্ভাবনা, যখন আনন্দবাজার পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে গোটা উপত্যকায়, যখন খুন হয়ে গেলেন অঞ্জন চক্রবর্তী, রবি মিত্ররা, তখন আমরা শিলচরে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে শুরুতে গাইতাম জ্যোতিপ্রসাদের ‘মোরে ভারতরে মোরে সপোনরে চিরসুন্দর সংস্কৃতি‘। আরও কত কত গান। প্রকৃতপক্ষে ওই সময়পর্বেই সবচেয়ে বেশি অসমীয়া গান গেয়েছি। একবারও মনে হয় নি কেন গাইব এই গান। আমাদের অনুষ্ঠানগুলিতে ভরা অডিটোরিয়ামে কোনো কোণ থেকে একজন মানুষও কখনো আপত্তিকর মন্তব্য করে নি একটিও। আসামের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী সমাজচিন্তক সুজিৎ চৌধুরী বলেছিলেন, উত্তর পূর্ব  ভারতে যারা ১৫ আগস্ট বা ২৬ জানুয়ারি এলে কালো পতাকা তোলে, যারা নিজেদের ভারতীয় বলতে অস্বীকার করে, যারা ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় হাতে, রাষ্ট্রের চোখে তাঁদের ভারতীয়ত্ব প্রশ্নাতীত। আর, আমরা যারা ১৫ আগস্ট নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়েছি। যারা এপারে এসেও প্রতি পদে পদে সয়ে চলেছি বৈষম্য, অপমান এবং তারপরও ১৫ আগস্ট ২৬ জানুয়ারি এলে যারা নিষ্ঠাভরে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে ‘বল বল সবে শতবীণাবেণুরবে‘ ‘জনগণমনঅধিনায়ক‘ গাই, তাদের নাগরিকত্ব প্রতি মুহূর্তে প্রশ্নের মুখে। তাঁদের তাড়ানোর জন্যেই বারবার দাঙ্গা হয়। কখনো বঙ্গাল খেদা নাম নিয়ে, কখনো বিদেশী বিতাড়ণ নাম নিয়ে, আবার কখনো বাংলাদেশী বিতাড়ণ নাম নিয়ে। তাদের তাড়াতেই সারাদেশে একমাত্র আসামে চলছে নাগরিকপঞ্জীর নবায়ন। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ নাগরিকত্ব হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে।

যে দেশ ছিল পূর্বপুরুষের তা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে বিদেশি হয়েছে। যে রাজ্যে জন্মেছি সেখানে আমার কোনো অধিকার নেই। যে রাজ্যে বড়ো হয়েছি সেখানে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে গিয়েও পদে পদে বাধা। আমি তখন রাজনৈতিক কর্মী। ভোটে প্রচার করি, বুথে এজেন্ট থাকি, কিন্তু আমার ভোটাধিকার নেই। তখন ভোটাধিকারের বয়স ছিল ২১। আমার বয়স যখন ২৮, তখনই সুযোগ এলো ভোটার তালিকায় নাম তোলার। কারণ এর আগে সমস্ত নির্বাচন হয়েছে ১৯৭৯ সালে তালিকা অনুযায়ী।  যেহেতু আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন বিদেশী বিতাড়ণ না করে নতুন তালিকা তৈরি হবে না। শুধু আমার জন্মের সনদ দিয়েই আমার নাগরিকত্ব চূড়ান্ত হবে না। হাতের কাছে প্রমাণ রাখতে হবে ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় আমার পিতামাতার অন্তর্ভুক্তির। আমার বাবার ১৯৬২ সালের ভারতীয় পাসপোর্টও তখন প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হল না। নাছোড়বান্তা নির্বাচনী আধিকারিক বললেন, আমার কাছে নির্দেশ ৬৬ সালের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকার প্রমাণ ছাড়া নাম তালিকাভুক্ত করা যাবে না। ৬৬ সালে আমরা থাকতাম আসামের পশ্চিমপ্রান্তের শহর ধুবড়ীতে। তার মানে আমাকে ধুবড়ীতে গিয়ে দিনের পর দিন নির্বাচনী দপ্তরে ঘুরে ভোটার তালিকার প্রত্যায়িত প্রতিলিপি সংগ্রহ করতে হবে। নচেৎ ভোটার তালিকায় নাম উঠবে না। আসামে ভোটার তালিকায় নাম না থাকা মানে বিদেশী ঘোষিত হওয়ারই নামান্তর। ভাগ্যিস, ঘরে খুঁজে পেয়েছিলাম ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে বাবার সরকারি দায়িত্বের একটি নথি। সেটা দিয়েই পার পেলাম। প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না আধিকারিক। আমি যখন তাঁকে বললাম, কোনো বিদেশী নাগরিক ১৯৬৭ সালের ভোটে জোনাল অফিসারের দায়িত্বে থাকা সম্ভব কি না, তখনই রাজি হলেন।

১৯৭২ সালে আমরা সপরিবারে একবেলার জন্যে সিলেট গিয়েছিলাম। বাবার ছিল সরকারি কাজ। আমরা তাঁর সঙ্গ নিয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে সেদিনই বাংলাদেশে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দুপুরবেলা আমরা যখন সিলেট শহরের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন রেডিওতে ভেসে আসছিল ঢাকার রমনা ময়দানের ইন্দিরা গান্ধীর জনসভার ধারাবিবরণী। মা আর বাবার সাথে সারাদিন তাঁদের বাড়ি, স্কুল, কলেজ, এক কথায় তাঁদের অতীতে ভ্রমণ সেরে রাতে যখন আমরা সীমান্ত অতিক্রম করছি, তখন দাদা বলল, আমরা বিদেশ থেকে এখন স্বদেশে ঢুকছি। মা অস্ফুট স্বরে বলল, স্বদেশ বিদেশ আমার গুলিয়ে গেছে। কোথায় গিয়েছিলাম, আর কোথায় ফিরলাম, আমি জানি না। মা‘র অস্ফুটস্বরে বলা সেই কথাটা সেই কিশোরবেলা থেকে এখনও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।

পরে ১৯৯৯ সালে আবার সিলেট গেলাম। বলা যায়, ১৯৯৯ সাল থেকে সিলেট যাচ্ছি। এর আগে ভারত সরকারের একটি বিশেষ নিয়মের জন্যে সিলেট বা বাংলাদেশের মানুষ এখানে আসতে পারতেন না সহজে। ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে কোনো বিদেশি নাগরিককে আসতে হলে ভিসা ছাড়াও রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া পারমিট নিতে হত দিল্লি থেকে। সে এক বিষম হ্যাঁপা। ফলে যোগাযোগ না থাকায় আমরাও তাঁদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পাই নি। এখানে ইন্দ্রকুমার গুজরাল ও ওপারে শেখ হাসিনার সরকার আসার পর আমাদের দুপারে যাতায়াত সহজ হল।১৯৯৯ সালে সিলেটে গিয়ে প্রথম দিন মদনমোহন কলেজে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে পরিচয় হল সেখানকার গণশিল্পী ভবতোষ চৌধুরীর সাথে। পরিচয়পর্ব শেষ হতেই বললেন, এসেছেন পূর্ব পুরুষের ভিটে দেখতে? পুকুরটা একই রয়েছে কি না? নারকেল গাছটা যেমন ছিল তেমন রয়েছে কি না, তাই দেখতে তো? না, এদেশে আপনাদের কোনো অধিকার নেই। ল্যাজ তুলে আপনাদের বাপ ঠাকুরদারা পালালেন। আমরা এদেশে থেকে যাওয়া হিন্দুরা এদেশের মুসলিম ভাইদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একুশের লড়াই লড়েছি, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে লড়েছি, স্বাধিকারের সংগ্রাম করেছি, মুক্তিযুদ্ধ লড়েছি, বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর একসাথে দুর্দিনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, এরশাদ বিরোধী লড়াই লড়েছি, পাকিস্তানের চিহ্ন মুছে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনেছি। এখন আপনি এসেছেন নারকেল গাছ আর পুকুর দেখতে। না, আপনার আবেগ আমাকে ছোঁয় না। প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। কোনো কথাই মুখ দিয়ে বেরোল না। পরে চিন্তা করে দেখলাম, এটাও তো একটা দৃষ্টিকোণ যার সাথে আমাদের কোনো পরিচয়ই নেই। ভবতোষদা যা বললেন, এটাও একটা সত্য যা আমি কখনো ভাবি নি।

মনে পড়ল, শিলচরে একবার আমাদের সংস্থায় অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন বাংলাদেশের শিল্পী সাদী মহম্মদ ও শম্পা রেজা। ওরা যেদিন ফিরে যাবেন সেদিনই সকালেই জানলাম শম্পা আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিলেটের যুগভেরী পত্রিকার সম্পাদক আমিনুর রশিদ চৌধুরীর পুত্রবধু। বাবার কাছে আমিনুর রশিদ সাহেবের অনেক গল্প শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলচর এসে তিনি বাবার সাথে দেখাও করেছিলেন। তারপর থেকে অনেক বছর অবধি ডাকে আমাদের বাড়িতে যুগভেরী পত্রিকা আসত। কথা সূত্রেই জানলাম শম্পার বাবারা ছিলেন মুর্শিদাবাদের লোক। কলকাতায় পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ওদের একটা বাড়ি ছিল। দেশভাগের সময় সেই বাড়ি ঢাকার কোনও এক হিন্দু পরিবারের সাথে বিনিময় করেছেন তাঁরা। শম্পার ও দেশভাগ নিয়ে আমার মতই আবেগ। বললেন, শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় কলকাতায় এলেই পার্ক সার্কাসের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেন। কল্পনা করতেন, বারান্দা দিয়ে তাঁর দাদী হেঁটে যাচ্ছেন। সাদীদের পরিবার পূর্ববঙ্গীয় মূলের। ফলে দেশভাগের ফলে তাঁদের কোনো স্থানান্তর হয় নি। আমার আর শম্পার কথা শুনে সাদী বললেন, ১৯৪৭ সালে শম্পার আব্বারা যদি পার্ক সার্কাস ছেড়ে ঢাকা না আসতেন, কিংবা আপনার বাবা মায়েরা যদি সিলেট ছেড়ে ভারতে চলে না যেতেন, তবে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হওয়ার জন্যে আমাদেরকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি অপেক্ষা করতে হত না। আরো আগেই আমরা দ্বিজাতি তত্ত্বের অন্ধগলি থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দিতে পারতাম। সিলেটে ভবতোষদার ষ্পষ্ট কথাটি সরাসরি শুনে আমার আবার সাদীভাইয়ের মুখে শোনা কথাই মনে পড়ল। এই সত্যটি আমাদের এপার থেকে কখনোই অনুভব করা যায় না। ফলেই এই কথাগুলি আমরা কখনো ভাবি নি। মায়ের মুখেই শুনেছিলাম। সিলেটে মায়ের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন হোসনে আরা বেগম। গণভোটের সময় দুজনের একটু খানি দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তাঁদের দুজনের মধ্যে। কারণ মায়েরা ছিল সিলেটের ভারতভুক্তির পক্ষে প্রচারে। হোসনে আরা বেগমেরা ছিলেন পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে। পরে সিলেট যখন সত্যি সত্যি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হল এবং আমার মায়েদের এপারে চলে আসতে হল, তখন আসার সময় মা‘কে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন হোসনে আরা। মা বলত, হোসনে আরা কেঁদে বলল, আমরা ভেবেছিলাম পাকিস্তান মানে বাড়তি কতগুলি সুযোগ সুবিধা, কতগুলি না পাওয়া অধিকার। পাকিস্তান মানে দুই বন্ধুর জন্যে দুটি দেশ, এটা যদি বুঝতাম তবে বোধহয় পাকিস্তান চাইতামই না। তবু পাকিস্তান হল। আমার মায়েরা এদিকে চলে এল। ওপারে চলে গেলেন শম্পার বাবা মায়ের মত কলিম শরাফী হাসান আজিজুল হকেরা। তবে ওরা ভিটে হারালেও ওপারে পেয়েছেন অকুন্ঠ সম্মান। উত্তর পূর্ব ভারতের বাঙালির মত জীবন অভিশপ্ত হয়ে ওঠে নি। ভিটের বদলে পেয়েছেন একটি দেশ।

আমার কী কোথাও আদৌ দেশ আছে। শিলং-এ আমরা ডখার, বহিরাগত। আসামে বাংলাদেশী। কলকাতায় বাঙালি, ভারতীয়, তবে বাঙাল। এমএসসি ক্লাসে বর্ধমানে আমার পাশে বসা আমার সহপাঠী ববি যে কথাটা বলেছিল সেটাও কোনো দিন কি ভুলতে পারি। ববি বলেছিল ভালোবেসেই। কিন্তু সে ভালোবাসাটা তীরের মত বিঁধে আছে সেই থেকে। বলেছিল, শুভ, তুই বাঙাল হলেও বাঙালদের মত নোস। তুই খুব ভালো, অন্যরকম। ববিকে বিষয়টা বোঝাতে আমি বললাম, তার মানে আমার বাবা মা কাকা কাকী আমার পরিজন স্বজন সক্কলেই খারাপ, শুধু আমি ভালো? এই প্রশংসাটা কী করে নিই বল্? অবিচলিত ববি বলল, তুই সেন্টিমেন্টাল হোস না। বাঙালরা সত্যি তোর মত না। কী চেঁচিয়ে কথা বলে। সর্বক্ষণ ঝগড়া করে। পাড়ায় একটা বাঙাল যদি ভাড়া আসে, দশ বছর পর দেখবি গোটা পাড়াটা বাঙাল হয়ে গেছে।

১৫ আগস্ট এলে এসব কথা ঘুরে ফিরে মনে পড়ে। এমনিতেও দেশপ্রেম কথাটায় আমার খুব অস্বস্তি হয়। বাংলাদেশ এবং আমাদের দেশে বিষয়টা ঠিক উল্টো। বাংলাদেশে দেশপ্রেম বিষয়টা একটা ইতিবাচক অবস্থান। কারণ সেখানে মৌলবাদী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা একটি ধর্মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের কথা বলে দেশপ্রেমের প্রতিকল্পে।সেই অবস্থান থেকেই তারা প্রত্যাখান করে একুশ, একাত্তরকে। আমাদের দেশে উল্টো। এখানে ধর্মকে জাতির সাথে একাকার করে এক বিকৃত জাতীয়বাদ ও জঙ্গী দেশপ্রেম হাজির করা হয় আন্তর্জাতিকতাকে প্রত্যাখান করতে। যদিও বিশ্বায়নে এই গৈরিক জাতীয়তাবাদের আপত্তি নেই। আপত্তি সাধারণ মানুষের আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্যে।আমার কাছে দেশ মানে সেই মাটি যেখানে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা থাকে। বিদেশ-বিদ্বেষের মুখরিত দেশপ্রেমে আমার কোনো আস্থা নেই।

আজ যখন নরেন্দ্র মোদীকে দেখি লালকেল্লা থেকে ভাষণ দিতে তখন মনে পড়ে ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরালের ভাষণ। গুজরালই ভিটেহারা জনগোষ্ঠী থেকে আসা এদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। গুজরালের সেদিনের বক্তৃতায় ১৯৪৭ সালের আমার বাবা এবং বীরেনকাকাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। গুজরাল বলেছিলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে যখন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, সেদিন আমাদের এক চোখে ছিল আনন্দের উচ্ছাস। আর অন্য চোখে ছিল বিষাদের অশ্রুজল।

এক চোখে আনন্দ আর অন্য চোখে বিষাদ নিয়ে ফিরে ফিরেই আসে ১৫ আগস্ট। বুকের ভেতর একটা অন্তর্লীন আশঙ্কা নিয়েই আমাদের বাঁচা।আবার কোনো রাজনীতির ঘুঁটি চালাচালিতে আমরা ভিটেহারা হব না তো? যে মাটিকে নিজের ভেবে নিয়েছি, কোনো এক র‌্যাডক্লিফ এসে পেনসিলে টানে সে মাটিকে বিদেশ বলে ঘোষণা করবে না তো? এজন্যেই কি প্যালেস্তাইনের নাটক দেখে আমার চোখে নেমে আসে আমার বাবা মায়ের প্রজন্মের অশ্রু?


আমাদের ঘর নেই। আছে তাঁবু অন্তরে বাহিরে।

রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

কথার কথা

আগুণঝরা দিনের শেষে দগ্ধ-আমি বাড়ি ফিরি। একটু শীতল হাওয়ার জন্যে ভেতর ও বাহির অস্থির হয়ে ওঠে। ঘরে ঢুকে ফ্যানের সুইচ অন করতেও সেই গরম হাওয়ারই ঝাপট লাগে সারা অঙ্গে। না হাওয়ায় কোনো শুশ্রুষা নেই। অগত্যা মন ঘোরাতে টিভির নব ঘোরাই।যদি একটি গানের কলি বা নিদেন পক্ষে একটি সুর কিংবা কিছু ভালো লাগায় ভাসিয়ে দেওয়া দু’চারটি কথা শুনি। আলো গিয়ে পড়ে সরাসরি এক সংবাদ ও ভাষ্যের চ্যানেলে। সেখানে তখন ভেসে ভেসে উঠছে একটি ব্রেকিং নিউজের চাঞ্চল্যকর উপস্থাপনা। পেছনে মানানসই আবহসঙ্গীত। একটি শিশুর শরীরে ভেসে ওঠা আঘাতের চিহ্নের ছবি ভেসে ভেসে ওঠে পর্দায়। বড়দের রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কোপ থেকে বাঁচে নি এই শিশুটিও। একটু পরেই শুরু হয় আলোচনার প্রহর। আলোচনা বা বিতর্কের কি কোনো সুযোগ আছে এখানে? এমন একটি জঘন্য পাশবিকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে সবাই! 

হঠাৎই যেন অনুভব করি দুপুরের খররোদের দহন। আমার শ্রবণজুড়ে ঝাপটাতে থাকে তপ্তহাওয়ার ঝড়। এই পাশবিকতারও তবে রঙ আছে? এই হিংস্রতারও তবে একটি এ-পক্ষ ওপক্ষ রয়েছে? তার মানে আমাদের সমস্ত কথাই কি পূর্ব নির্ধারিত। শুধু মাত্র উপলক্ষ্য বদলে বদলে যায়! বিশ্বব্রহ্মা- এদিক ওদিক হলেও এই সান্ধ্য আলোচনায় কোলাহলটিই শুধু একমাত্র সত্য? কার কন্ঠস্বর কীভাবে চাপা দেওয়া যাবে তারই বুঝি শিল্পিত উপস্থাপনা পর্দা জুড়ে? এই চীৎকৃত উল্লাস ও ক্রোধ- এর বাইরে বুঝি এই পৃথিবীতে কোনো কান্না নেই, মৃদু হাসি নেই, ¯িস্নগ্ধতায় ¯স্নাত করে দেওয়ার মত সুবাতাস নেই। এই দানবীয় হুঙ্কার থেকে রেহাই পেতে হঠাৎ আঙুলের চাপ পড়ে মিউট বোতামে। শব্দহীন দৃশ্যপট যেন আরো বীভৎস করে দেয় সবকিছুকে। না, সব বন্ধই করে দিতে হবে! 

বারান্দায় এসে দাঁড়াই। দূরে আকাশে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে একটি দু’টি তারা। বুকের ভেতর থেকে হঠাৎই জেগে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। কে যেন গেয়ে ওঠে, ‘যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে/ তারা কথার বেড়া গাঁথে/ কেবল দলের পরে দলে‘। তার মানে সেই কবেই বুঝি ‘কথা দিয়ে‘ কথা বলায় বিতৃষ্ণ হয়েছিলেন কবিগুরু! শব্দহীন টিভির পর্দাটা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, আর গান জেগে ওঠে, ‘একের কথা আরে/ বুঝতে নাহি পারে/ বোঝায় যত কথার বোঝা তত বেড়েই চলে‘। এ যেন এ রাজ্যেরই ধারাবিবরণী! রাজ্য কেন, এই সমসময়ের পৃথিবী নয় কি? যেখানে সর্বক্ষণ চলে শুধু কথার চাতুরি কিংবা চীৎকৃত উল্লাস! কিন্তু কথারও একটা সাহিত্য রয়েছে, কথা ছাড়া কবিতারই বা জন্ম হবে কী করে! কথাকে বর্জন করতে বলছেন কবিগুরু? তবে মুক্তি কোথায়? গানের সঞ্চারী যেন উত্তর নিয়ে বসেই ছিল।

‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর/ তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর‘! সুরে? সঙ্গীতে? গীতে? তবে যে প-িতেরা বলেন কবিতার সমাজে গীতি কবিতারা তুলনায় তরলতর সৃষ্টি। উচ্চ সাহিত্যের পদবাচ্য নয় তারা। সত্যিই কি তাই? রবীন্দ্রনাথ বলছেন একটি প্রসঙ্গে, সাহিত্যে সঙ্গীতের প্রয়োজন কতটা? তাঁর মতে যে সাহিত্যে সঙ্গীত নেই তা সাহিত্যই নয়। সাহিত্যে সঙ্গীত থাকা বাঞ্ছনীয়। সঙ্গীতই সাহিত্যকে সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। তার মানে যে কথায় সুর নেই তা কথাই নয়? ওই যে উচ্চকিত কথার ¯্রােত চার পাশকে তপ্ত করে, দগ্ধ করে, তাতে আর যাই থাক সুর নেই। বুকের ভেতর বেজে যায়, ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর/ তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর/ বোঝে কি নাই বোঝে থাকে না তার খোঁজে/ বেদন তাদের মেলে গিয়ে তোমার চরণতলে‘। বারবার বেজেই যায়, ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর...‘।

চেন্নাইয়ের হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে মা। দূর থেকে দেখি তামিল আয়া মেয়েটি মায়ের সাথে হাত নেড়ে কথা বলে চলেছে। কখনো হেসে, কখনো একটু গম্ভীর, কখনো করুণ চোখে। মা-ও উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করছে। কখনো দুজনের হাসি মিলছে কথোপকথনে, কখনো দুজনের করুণ আঁখিতে জেগে উঠছে একই অশ্রুবিন্দু। দূর থেকে দেখি, শুনি না কিছুই। বিস্ময় জাগে, এখানে আয়ারাও ভালো হিন্দি বা ইংরেজি বলে তবে। সে জন্যেই মা পেয়ে গেছে ভিজিটিং আওয়ার পেরিয়ে যাওয়ার পরও কথার সাথি। সামনে এসে ঘোর ভাঙে। মেয়েটি কথা বলে চলে বিশুদ্ধ তামিলে। মা নিজের বহুভাষিকতার সর্বস্ব দিয়ে কখনো বাংলা কখনো মায়ের পরীক্ষা পাশ করা অথচ দুর্বল কথ্যের হিন্দি, কখনো ইংরেজিতে। আমি অবাক, মা পরিচয় করিয়ে দিল, আমার ছেলে। উত্তরে এক গাল হেসে কুশল জিজ্ঞেস করল মাতৃভাষাতেই সেই আয়া। মা’কে বললাম, এভাবেই বুঝি তোমাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে? কেউ কারো কোনো কথা না বুঝে? মা বলে, অত বোঝার কী আছে? খুব ভালো মেয়েটি। বুঝি, ওর স্বাভাবিক ভালোত্বটাই হচ্ছে মায়ের সাথে তার সংযোগ ভাষা। এটাই কি কথার গভীরে থাকা সুর যা সর্বত্রগামী। এটাকেই কি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সাহিত্যের সার্থকতার জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় সঙ্গীত?

তোমার চরণতলে! যারা বিশ্বাসী তাদের জন্যে তোমার মানে তো ঈশ্বরই। যে নিরীশ্বর, আমার মতো? এই তুমি হচ্ছে জীবন, আবহমান জীবন, আমার ঘিরে থাকা বিশ্ব, তার প্রাণ, যার সুরে সুর মেলাতে আমার বেলা যায় সাঁঝ বেলাতে। কাছের সুরের একতারার একটি তারের ধ্বনিতে সেই বেজে ওঠে না। বিশ্বসঙ্গীতের ‘সহস্র দোতারা’ বেজে ওই সঙ্গীতে যেখানে দূর হয় নিকট, নিকট হয় চিরকালের। ‘যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর..‘। না, এটা সুরকে ধরতে চেয়ে কথাকে বর্জন করার কথা নয়। আমরা নিশ্চয়ই চাই না, কথা আর সুর চিরবিরহে থেকে যাক সমান্তরালে। চাই এমন কথা যা বেজে ওঠে সুরে, চাই এমন সুর যে এক গভীর গভীরতর কথা বহন করে।
পাশের বাড়ির টিভি থেকে অন্ধকার বারান্দায় ভেসে আসে হট্টগোল, সিরিয়ালের। হয়ত সংবাদ কিংবা ভাষ্যের অনুষ্ঠানেরই। একই রকম শোনায় যে দুটো, ধন্দ লেগে যায়!
‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে হলাহল
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল‘।