গেট দিয়ে ঢুকে রুদ্র অবাক!
সবুজ আবির মেখে তুমুল আনন্দে নাচছে রাম বাহাদুর ও মহাদেব। সারা শহরজুড়ে সকাল থেকে পটকা
ফাটছে। ইলেকশনের রেজাল্ট যে খারাপ হবে, তা বোঝা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। তবে এভাবে
ধ্বস নামবে হয়ত বোঝা যায় নি। হাতের কালো ব্যাগটাকে শক্ত করে ধরে একটা অবিচল মুখচ্ছবি
যথাসম্ভব বজায় রেখে নিজের দফতরের দিকে ধীরে ধীরে চলে যায় রুদ্র। চলে যাওয়ার মুহূর্তে
হঠাৎই রামবাহাদুর দেখতে পায় রুদ্রকে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নেয় একটু, নাচে সামান্য
ভাঁটা পড়ে যেন। রাম বাহাদুরকে অপ্রস্তুত দেখে মুচকি হেসে রুদ্র অস্ফূট স্বরে বলে, ঠিক
আছে, ঠিক আছে! মুখে এমন কথা বললেও, তার বুকের ভেতরে তখন আছড়ে পড়েছে এক তীব্র সাইক্লোন।
যা দেখল চোখের সামনে তা অবিশ্বাস্য! রাম বাহাদুর আর মহাদেবও এভাবে নাচছে বিজয়ের আনন্দে!
অথচ গতকালই বিকেলে এই জায়গাতেই বকুল গাছের তলায় চা খেতে খেতে ওরা যে বলছিল সম্পূর্ণ
অন্য কথা। পরিবর্তন আসছে টের পাচ্ছিল রুদ্রও। তবে নেতারা নাকি টের পান নি। অন্তত আজ
সকাল থেকে টিভির পর্দায় ইলেকশনের ফল আসতে শুরু হতেই নেতারা বলছেন, এটা অপ্রত্যাশিত
ফলাফল। রুদ্র জানত এমনটা হতে যাচ্ছে, যদিও এমন বিপর্যয় ওরা কাছেও অপ্রত্যাশিতই। সবচেয়ে
অভাবনীয় আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখেই গেটের সেই দৃশ্য। গতকালই এই গেটের পাশে রুদ্র
যখন একা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল, তাঁকে দেখেই এগিয়ে এসে কথা বলেছিল রাম বাহাদুর আর মহাদেব।
রাম বাহাদুরের সাথে রুদ্রর পরিচয় দীর্ঘদিনের। সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, তখন রাম বাহাদুর
ছিল তাদের ছাত্রাবাসের নাইট গার্ড। তখনকার অল্পবয়েসী ছোকরা রামবাহাদুরের সাথে ছাত্রাবাসের
আবাসিক ছাত্রদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মত। একসাথে টেবিল টেনিস খেলা, টিভিতে বিশ্বকাপ
ফুটবল ক্রিকেটের টেলিকাস্ট দেখা, হোস্টেলের সরস্বতী পুজো ফাংশন- সবকিছু নিয়ে নিয়ে রাম বাহাদুরের উত্তেজনা ছিল আবাসিকদের
মতই। তাঁরাও তাকে বন্ধুই মনে করত। সেই হৃদ্যতার ধারাবাহিকতা রুদ্র এবং রাম বাহাদুরের
সম্পর্কে এখনও রয়েছে। রুদ্র এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক, রাম বাহাদুর তাঁদের প্রশাসনিক
কার্যালয়ের গেটের সিকিউরিটি গার্ড। তবে পেশাগত পরিচয়ের উচ্চ-নীচ কোনো ব্যাপারই নয় এই
সম্পর্কের ক্ষেত্রে। গতকাল বকুলতলার চায়ের গুমটিতে রাম বাহাদুর আর মহাদেব আসতেই রুদ্র
ওদের জন্যেও চা বলেছিল। চা খেতে খেতে এক মুখ উদ্বেগ নিয়ে রাম বাহাদুর জিজ্ঞেস করেছিল
রুদ্রকে, কী হবে দাদা কাল? সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা থেকেই রুদ্র অকপটে বলেছিল, আমার খুব
একটা ভালো ঠেকছে না। বামফ্রন্ট বোধহয় আর আসছে না। রুদ্রর মুখে এই কথা শুনে চোখ কপালে
তুলে রাম বাহাদুর আর মহাদেব বলেছিল, বল কি, দাদা? এমনটা হলে এই রাজ্যের সর্বনাশ হয়ে
যাবে যে! আবার সেই বাহাত্তর-সাতাত্তরের দিন ফিরে আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ে! ভাবতে পারছ কী
হবে তখন? রুদ্রর একবারও সন্দেহ করার কোনো কারণ হয় নি, ওরা কথাগুলি মন থেকে বলছে কী
না!
এই এরাই এখন, মাত্র বারো
চৌদ্দ ঘন্টার তফাতে রুদ্রর চোখের সামনে উদ্দাম নাচছে সবুজ আবির মেখে! এতটাই অচেনা ছিল
বুঝি এরা ওর কাছে! নাকি ওরাই ওকে মন খুলে প্রাণের কথা বলতে পারে নি! রাম বাহাদুর মহাদেবরা
কী ওকে তবে শুধু একটি রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবেই দেখেছে? এই যে একে অপরের সুখে দুঃখে সমব্যথী
হওয়া, খোঁজখবর নেওয়া, ব্যক্তিগত পারিবারিক নানা সুসংবাদ দুঃসংবাদ বিনিময় করা, দিনের
পর দিন, বছরের পর বছর ধরে, এগুলো কোথায় কোনো অতিরিক্ত সম্পর্ক নির্মান করে না? এত কথা
বলত রাম বাহাদুর! স্কুল কলেজের স্পোর্টসে তার মেয়েটার নানা পুরস্কার পাওয়া, শিক্ষকদের
পরামর্শ অনুযায়ী খেলায় দেবে না পড়াশুনো আরো করাবে, নাকি বিয়েই দিয়ে দেবে সৎপাত্র পেলে,
এ সম্পর্কিত এত এত কথা সকাল বিকেল! তবু শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা এতটাই উপরিতলে থেকে যায়
যে রাজনীতির কথা এলেই এক ছদ্মমুখ তুলে ধরতে হয় রাম বাহাদুর আর মহাদেবকে ওর সামনে? যাকে
এতদিন সে ভেবেছে এক গভীর আত্মীয়তা, তা আসলে বুঝি এক লুকোচুরি খেলা? নাকি রাম বাহাদুর
বা মহাদেব নয়, রুদ্ররই এমন কোনো মুখচ্ছবি আছে যা রাম বাহাদুর আর মহাদেবকে আত্মীয়তার
বৃত্তের বাইরে রেখে দিয়েছে। কাছে আসতে গিয়েও নানা দ্বিধা জন্মেছে তাদের মনে?
দফতরে গিয়ে বসতেই নানা
দিক থেকে ফোন আসে। বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজনের সাবধান-বাণীর ফোন। ‘সাবধানে থেকো। কারো
সাথে তর্ক করতে যেয়ো না। মাথা ঠা-া রেখো’। ফোন আসে স্বমতের লোকেদেরও। ‘তোমাদের ওদিকে
কোনো গ-গোল আছে? এখানে তো নেতাদের বাড়ির সামনে দিয়ে মিছিল থেকে নানা খিস্তিখাস্তা দিচ্ছে।’
রুদ্রর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী অ্যাসিসটেন্ট কন্ট্রোলার দিবানাথ একটু পরেই আসে রুদ্রর
ঘরে। ‘এত বাড়াবাড়ি করেছিস না তোরা শেষ ক’টা বছর, এমনটা হওয়ারই ছিল। মুশকিল হচ্ছে, এখন
আমাদের মত সাধারণ সমর্থককেও সকাল থেকে রাজ্যের টিটকিরি শুনতে হচ্ছে।’ রুদ্র উত্তর দেয়
না। তবে মনে মনে সে জানে, দিবানাথের কথার বেশিরভাগটাই সত্য! দিবানাথ বলেই যায়, ‘আমাদের
পাড়ার দু’জন এলসিএম, একজন জোনাল সদস্য শুনলাম ইতিমধ্যেই শহর ছেড়ে পালিয়েছে। গতকাল অবধি
যে ছিল পাড়ার অলিখিত রাজা, আজ সেই ল্যাজ তুলে হাওয়া।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার
রুদ্র এই রাজ্যের ছেলে নয়, যদিও এখন পাকাপাকিভাবেই চলে এসেছে এখানে। ছাত্র জীবনে বাম
রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার অন্য রাজ্যেই যেখানে বামেদের প্রায় কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই রাজ্য-রাজনীতিতে।
কলেজ জীবনে সদ্য বাম আবহাওয়ায় প্রবেশ করা রুদ্রদের কাছে পশ্চিমবঙ্গ ছিল সোভিয়েত কিংবা
চীনের মতই স্বপ্নরাজ্য। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা দলীয় সাপ্তাহিকের নিবন্ধ আর খবর পড়ে তারা
বাম রাজনীতির উষ্ণতায় তপ্ত করত নিজেদের। তাদের শহরে যখন লাল ঝা-ার মিছিলে গুটি কয়েক
মানুষ হাঁটত, তখন প্রতিদিন কলকাতার খবরের কাগজের পাতায় দেখত ব্রিগেড জুড়ে জনজোয়ারের
ছবি। ভাবত কবে তাদের ছোট্ট শহর বর্ধমান হবে, কবে তাদের রাজ্য পশ্চিমবাংলা হবে। কিংবা
এ দেশ সোভিয়েত বা চীন হবে! এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে হিসেব করত সোভিয়েতের পার্টির প্রতিষ্ঠা
কবে আর বিপ্লব হল কতদিন পর। ভাবতো কিউবা চীন ভিয়েতনামের পার্টি প্রতিষ্ঠা আর বিপ্লবের
মধ্যে কত বছরের দূরত্ব। এক ধরনের ছেলেমানুষী ঐকিক নিয়মের অঙ্ক কষত মনে মনে। চীন রাশিয়ায়
যদি এত বছর পর বিপ্লব এসেছে তবে ভারতে তা কত বছর পর আসতে পারে! কলেজে পড়ার দিনগুলিতে
প্রেম আর বিপ্লব ছিল গায়ে মাখামাখি করে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার পংক্তি, তুমি আমার
মিছিলের সেই মুখ/ এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাকে খুঁজে/ বেলা গেল দেখি সে আগন্তুক/
ঘর আলো করে বসে আছে পিলসুজে- পংক্তিগুলি বুকের ভেতর রিনরিন করত সর্বক্ষণ। সবচেয়ে ভালো
লাগত ওই লাইন, দিগন্তে কারা আমাদের সারা পেয়ে/ সাতটি রঙের ঘোড়ায় চাপায় জিন/ তুমি আলো,
আমি আঁধারের আল বেয়ে/ আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন।
কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়তে রুদ্র এসেছিল পশ্চিমবঙ্গের লাল মাটি লাল হাওয়া আর লাল দুনিয়ায়। এই প্রথম অনেক
ছাত্র অনেক মানুষ অনেক বড়ো মিছিল অনেক বড়ো জনসভার শরিক হয়েছে সে। তার চেয়েও বড়ো কথা,
এই প্রথম নির্বাচনী বিজয়ের প্রত্যক্ষ অংশীদার সে। তাদের রাজ্যে নির্বাচনের আগে পথসভা
জনসভায় ভিড় করে মানুষ বক্তৃতা শোনে, কিন্তু ভোটে বামপন্থীদের বাক্স ফাঁকা। ভোটের আগে
গরিব পাড়া বস্তি ও গ্রামে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মানুষকে তারা নতুন কথা শোনাতো। প্রতিবার
ভাবত, এবার হয়ত মানুষগুলি একটু হলেও অন্যভাবে ভাববে। ভোটের দিন রুদ্রদের চোখের সামনে
সেই গরিবগুর্বো মানুষগুলো কেউ কংগ্রেসের রিক্সা চেপে কেউ বিজেপির অটো চড়ে দলে দলে
ভোট দিয়ে যেত। একজন দুজন কখনো ভোটকেন্দ্রের সামনে রুদ্রকে দেখে এগিয়ে এসে বলত, জানি
দাদা, আপনারা সৎ। আপনারা ভালো মানুষ। কিন্তু আপনারা যে জিততে পারেন না! কী হবে আপনাদের
ভোট দিয়ে। ওদের ভোট দিলে আর কিছু না হোক ভোটের দিন কিছু টাকা হাতে তো পাওয়া যায়! এমন
কথার সামনে অসহায় মনে হত রুদ্রর নিজেদেরকে। সত্যি, ওরা জিততে পারে না। টাকার শক্তির
কাছে, পেশির শক্তির কাছে, জনবলের কাছে ওরা বারবার হেরে যায়। আবার কী আশ্চর্য, বন্যা
হলে দাঙ্গা হলে এই মানুষগুলি নিজেরাই রুদ্রদের ডেকে নিয়ে যেত ওদের পাড়ায়। বলত, আপনাদের
ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, দাদা। আপনারা একটু পাশে দাঁড়ান আমাদের। এতদিনে সব
ব্যাটাদের চিনে নিয়েছি। পরের বার আর ভুল নয়, আমরা সবাই আপনাদেরকেই ভোট দেবো। রুদ্রদের
বুক ভরে উঠত এসব কথা শুনে। আবার দ্বিগুন উদ্যমে লেগে যেত রাজনীতির কাজে। একবার হঠাৎ
আসা ঝড় তুফানে ওদের শহরের গরিব বস্তির প্রচুর ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। মন্ত্রী
নেতা সকলের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল গরিব পাড়ায়। সরকারি ত্রাণ পুনর্বাসনে যা হয়, একজন
গরিব রিক্সাওয়ালার পুরো ঘরে ভেঙে গেলেও সরকারি ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় নাম উঠল না। কিছুদিন
শাসকদলের ছোট নেতা মেজো নেতার পেছনে ঘুরে ঘুরে যখন কিছু হল না, তখন এক সকালে সেই রিক্সাওয়ালা
হাজির হয় রুদ্রর বাড়িতে। প্রথমেই কেঁদে কেটে বলে, ওই কংগ্রেসীরা সব চোর বদমায়েশ। বলে
পাঁচ হাজার টাকা আদায় করে দিলে আমাদের কত দিবি আগে বল্? বাবু, আপনারা ছাড়া গরিবের কে
আছে বলুন। আপনি যে করেই হোক আমার একটা ব্যবস্থা করুন। রুদ্র তখন তাদের পার্টির নেতাদের
ধরে মাসের পর মাস ওই রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে সরকারি দপ্তরের এই টেবিল ওই টেবিল ঘুরে পুরো
পাঁচ হাজার টাকা আদায় করিয়ে দিয়েছিল। এই সময়ে প্রতিদিন লোকটিকে চা খাওয়ানো, রিক্সাভাড়া
দেওয়া, এসবও করতে হয়েছে রুদ্রকে। রিক্সাওয়ালাটিও বলত, বাবু, সংগঠন গড়ুন। আপনাদের সংগঠন
বড়ো দুর্বল। শেষমেশ অনেক লড়াইয়ের পর যেদিন লোকটি হাতে টাকা পেল তখন রুদ্র এই জয়কে উদযাপন
করতে বলল, চল শেষবার এই অফিসের ক্যান্টিনে চা খেয়ে নিই। সেই চায়ের আসরে লোকটি বিনা
প্রসঙ্গেই হঠাৎ বলে বসে, বাবু, একটা কথা বলি। তারপর খানিক চুপ করে থেকে অস্ফূট স্বরে
বলল, আপনাদের পার্টির এখানে যা অবস্থা, আপনারা কখনো জিততে পারবেন বলে মনে হয় না। আমি
বলছি কি, এসব করে কি আর দিন যাবে বাবু? একটা চাকরি বাকরি দেখুন। আর না হলে পশ্চিমবঙ্গ
বা ত্রিপুরায় চলে যান, ওখানে আপনাদের পার্টির দাম আছে। এখানে নেই। এক গরিব মেহনতির
মুখে অমন নির্জলা সুবিধাবাদের কথা শুনে প্রথমে একটু বিষণœই হয়ে পড়েছিল রুদ্র। হঠাৎই মনে পড়ল, প্রতি ইলেকশনে
হেরে পার্টি অফিসে ফিরে এসে তারা একে অপরকে বলত, উই ক্যান লুজ সাম ব্যাটল এ- এভরি ব্যাটল
বাট দ্য লাস্ট। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রেখে সদ্য ক্ষতিপূরণের টাকা
হাতে পাওয়া রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে রুদ্র বলল, তুমি নিশ্চয়ই এর পরের ইলেকশনেও হয়
বিজেপি বা কংগ্রেসকে ভোট দেবে। তবু বলছি, এ সমস্ত কিছুর পরও যদি কোনো বিপদে পড়ে তুমি
আমার বাড়ি আস, আমি বা আমাদের পার্টি তোমার হয়ে কিন্তু একইভাবেই লড়ব। তুমি জেনো, তোমার
এমন হাজারটি কথাও আমাকে বিন্দুমাত্র হতাশ করতে পারবে না। তুমি ভাবছ, তুমি জিতে গেলে।
হ্যাঁ, হয়ত তুমি জিতলেই, আর আমি হারলাম। কিন্তু আমরা হারিনি। আমি-ই আসলে তোমাকে বোঝাতে
পারি নি যে রাজনীতিটা আসলে খেলা নয়, মানুষের বাঁচা মরার সংগ্রাম। তুমি ভাবছ, রাজনীতি
একটা ফুটবল খেলা। কে কাকে কখন গোল দেবে তার প্রতিযোগিতা। একদিন তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে
প্রকৃত সত্য। তুমি না বুঝলেও তোমার ছেলে হয়ত বুঝবে, তোমার কোনো আত্মীয় বা বন্ধু বুঝবে।
আমি বোঝাতে না পারলেও হয়ত আমারই কোনো না কোনো কমরেড একদিন তোমাকে বোঝাতে সফল হবে।
দিবানাথ বেরিয়ে যাওয়ার
পর একা ঘরে পুরোনো কথাগুলি ভাবছিল রুদ্র। হঠাৎই জানালার বাইরে থেকে একসাথে অসংখ্য বাজি
পটকার আওয়াজ ও অনেক কন্ঠের শ্লোগান শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এখনও অ-বাম সংগঠনের
সদস্য খুবই কম। ওদের মিছিলে তিরিশ চল্লিশ জনের বেশি হাঁটে না। এই ভোটের আগেও বামেদের
ডাকা মিছিলে কম করেও প্রায় দুশো কর্মচারি হেঁটেছে। অবাকই হল রুদ্র, এতগুলি গলার আওয়াজ
ওদের মিছিল থেকে তো আসার কথা নয়! হয়ত রাম বাহাদুর মহাদেবের মত অনেকেই আজ যোগ দিয়েছে
এই মিছিলে। গতকাল অবধি ওরা হয়ত নিতান্ত অনিচ্ছায়ই ছিল বামেদের মিছিলের অংশ। নাকি উল্টোটা,
নতুন শাসক, নতুন ভয়, সে জন্যেই নতুন মিছিলে হাঁটা! আজ শুক্রবার। কাল পরশু বিশ্ববিদ্যালয়
ছুটি। দু’দিনের ছুটির পর এই উচ্ছ্বাস এই উন্মাদনায় হয়ত একটু ভাঁটা পড়বে। কিংবা কে জানে,
হয়ত বাড়বেও। অনেক মানুষ হয়ত মুক্তির আনন্দে কিংবা নতুন কোনো ভয়ে রাজনৈতিক ঠাঁই-বদল
করবে। অনেককে নতুন চেহারায় দেখা যাবে। হয়ত চেনাও যাবে অনেককে।
শুক্রবার। বুকের ভেতরটা
ধ্বক করে ওঠে রুদ্রর। অনেক দূর থেকে অনেকগুলো শুক্রবার ভিড় করে আসে মনে। উনিশ উননব্বই-নব্বই-একানব্বইয়ের
শুক্রবারগুলি ছিল বুকে কাঁপন ধরানো। শুক্রবার এলেই রাত সাড়ে ন’টায় দূরদর্শনের পর্দায়
ভেসে উঠত কাঁচা পাকা দাড়িতে বুদ্ধিদীপ্ত প্রণয় রায়ের মুখ। অনুষ্ঠানের নাম ছিল দ্য ওয়ার্ল্ড
দিস উইক। এ দেশের দর্শকের জন্যে সেটাই তখন বিদেশের জানালা। বরফ ঢাকা পূর্ব ইউরোপের
দেশগুলির রাজপথে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ নামছে রাস্তায়। আওয়াজ তুলছে কমিউনিস্ট শাসনের
অবসানের দাবিতে। এসব ছবি ছিল সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অংশ। প্রথম প্রথম রুদ্ররা এই সমস্ত
কিছুকে পশ্চিমী দুনিয়ার অন্তর্ঘাত ভাবত। ছাত্র রাজনীতির করার সময়েরই তারা পড়েছে কীভাবে
হাঙ্গেরিতে কিংবা চেকোশ্লোভাকিয়ায় পশ্চিমী দেশগুলি চক্রান্ত করেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে
ভেঙে দিতে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে দিনের পর দিন প্রচার করে এবং কমিউনিস্ট পার্টির
কঠোর পদক্ষেপে কীভাবে ব্যর্থ করা সম্ভব হয়েছিল সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্ত তা ওরা পড়েছে নানা পুস্তিকায় এবং পার্টি মুখপত্রে।
ছিয়াশি সাতাশি সালে যখন প্রথম পোল্যান্ডে বন্দর শ্রমিকরা ধর্মঘট করল, তখনই রুদ্রদের
মনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। পরে জেনেছে, পোল্যান্ডে মোট জমির ষাট ভাগ ছিল চার্চের করায়ত্তে।
ফলেই পোলিশ সমাজে ধর্মের প্রভাব তখনো প্রবল। সংশোধনবাদী বিচ্যুতিই ওই দেশকে এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির
মুখে ফেলেছে, এমনটাই ছিল তাদের মূল্যায়ন। হঠাৎই মনে পড়ল, সে সময় দূরদর্শনে গভীর রাতে
নানা বিদেশি ছবি দেখানো হত। ‘কোয়াক’ নামে একটি পোলিশ ছবি দেখেছিল রুদ্র। এক অজ পাড়া
গাঁয়ে এক রোগীর জরুরি ব্রেন অপারেশন করতে হবে। সেখানে কোনও উন্নত হাসপাতাল নেই। নেই
কোনো অপারেশনের ছুরি কাঁচি। এক সার্জেন হাতের কাছে যা পেয়েছেন তাকে সম্বল করে রুদ্ধশ্বাস
এক অপারেশনের পর রোগীকে বাঁচিয়ে দেন। সংজ্ঞাহীন রোগীর যখন জ্ঞান ফেরে তখন সেই সার্জনের
মধ্যে সে দেখতে পায় যীশুখ্রিস্টকে। যীশুই সার্জনের রূপে আবির্ভূত হয়ে ওকে বাঁচালেন,
শেষ ছিল এমনটাই। একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের এমন ছবি দেখে অবাক হয়ে যায় রুদ্র। ও বোঝে,
স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত পার্টির বিংশ কংগ্রেসে ক্রুশ্চভের নেতৃত্বে যে বিচ্যুতির
পথ নেওয়া হয়েছিল তার রাস্তা ধরেই পূর্ব ইউরোপের নানা দেশে এমনসব সাংস্কৃতিক অবক্ষয়।
তবু শুক্রবার রাত এলেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠত। কোন্ দেশের কোন্ অশুভ সংবাদ বয়ে আনবে
দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক এবং প্রণয় রায়! টেলিভিশনের সাপ্তাহিক ওই অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে যাবার
জো ছিল না। খবরের কাগজের শিরোনামেও সমাজতান্ত্রিক দেশের বিদ্রোহ বিক্ষোভের খবর। প্রতি
শুক্রবার ওই অনুষ্ঠান দেখার পর পার্টি অফিসে, চায়ের দোকানের ঠেকে তখন অন্তহীন আলোচনা,
প্রশ্নের পর প্রশ্ন নিজেদের ভেতরপ্রদেশ জুড়ে। যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যেতো বুকের ভেতর
যখন পর্দায় দেখত ভেঙে পড়ছে লেনিনের মূর্তি দেশের পর দেশে। হাতে ক্রশ নিয়ে সমাজতান্ত্রিক
দেশের শ্রমজীবী জনতা প্রবল ঘৃণায় পা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে কাস্তে হাতুড়ি আঁকা রক্ত পতাকা।
ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসমসাহসী সৈনিক রুমানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান চেসেস্কু জনতার
প্রবল বিদ্রোহে পালিয়ে যাচ্ছিলেন হেলিকপ্টার চড়ে সস্ত্রীক। পরে নিজেরই এককালের অনুগত
সৈনিকদের হাতে তার ধরে পড়ে যাওয়া। ভাবলে এখনও বিভীষিকা হয়। ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে ছিঁচকে
চোরের মত ঘাড় ধরে বের করে আনা হচ্ছে চেসেস্কু ও তাঁর স্ত্রীকে। সামরিক আদালতে তাঁর
চটজলদি বিচার, মৃত্যুদ- দান, বিচারকদের বিরুদ্ধে চেসেস্কুর হুঙ্কার, পেছনে দড়ি বেঁধে
যখন তাঁদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন তাঁর স্ত্রীর আর্তনাদ। সবশেষে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে
তাঁদের হত্যা। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা একদা রাষ্ট্রনায়কের মৃতদেহ। এসব ছবি দেখেছে রুদ্র
দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ।
সব ভিড় করে আসে রুদ্রর
মনে আজ এত বছর পর আবার! সেদিনও ওই দেশগুলিতে জয়ের আনন্দে বিজয় উৎসবে মেতেছিল সাধারণ
মানুষ। সারা পৃথিবী জুড়েই এরপর কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে তর্কবিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। দুভাগ
হয়েছে পার্টি। একদল দলিল থেকে মার্ক্সবাদকে বিসর্জন দিয়েছে। অন্য দল মনে করেছে বিপর্যয়
যা হয়েছে তা মার্ক্সবাদের নয়, বরং এই ঘটনা মার্ক্সবাদ থেকে বিচ্যুতির ফলাফল। রুদ্রদের
দলে সে ধরনের কোনও বিভ্রান্তি আসে নি। বরং এই বিপর্যয় নিয়ে তাদের দলের মূল্যায়নের সাথে
একমত হয়েছে পৃথিবীর বেশিরভাগ কমিউনিস্ট পার্টি, এতে হাজারো হতাশার মধ্যে রুদ্রর বুকে
ভরসা জন্মেছিল। বিটি রণদিভে এক নিবন্ধে দেখিয়েছিলেন, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বিকাশের
দুর্বলতা কীভাবে জনগণকে পার্টি থেকে, পার্টির সাধারণ সদস্যদের নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন
করেছে। সোভিয়েতের এই বিচ্যুতি থেকে পৃথিবীর সব কমিউনিস্টদেরই শিক্ষা নিতে হবে। কোনো
অবস্থাতেই মানুষের থেকে মুখ ফেরালে হবে না। বক্তৃতায় নিবন্ধে এমন কথাগুলি রুদ্রর মনে
প্রত্যয় জাগাতো। তবে রুদ্রদের সঙ্গে ছাত্র-রাজনীতি করা অরুণাংশু লেনিন মূর্তির ভেঙে
পড়া দেখে বিমর্ষ হয়ে পার্টির সদস্যপদ ছেড়ে দেয়। এমন ঘটনা তখন পৃথিবীর নানা দেশেই ঘটেছে।
অনেক দেশে কমিউনিস্ট পার্টির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও সমানভাবে ভাগ করা হয়েছে। ফেসবুকে
রুদ্র পড়েছে বাংলাদেশের একটি তরুণের কথা। যখন ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তরের
মধ্যে দেওয়াল তুলে দিয়ে সম্পত্তির বিভাজন হল দু’টি দলে, তখন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাউহাউ
করে কেঁদেছিল সেই তরুণ। সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকে মুক্ত এক সমাজের স্বপ্ন যাঁরা
দেখেছিল তাঁদেরকে এই রূপে মেনে নিতে পারে নি সেই তরুণ। রুদ্রর মনে পড়ে মৃণাল সেনের
‘মহাপৃথিবী’ ছবিতে দেখেছিল যেদিন বার্লিন ওয়াল ভেঙে পড়ে সেদিনই মহানগরী কলকাতায় আত্মহত্যা
করেন পুলিসের গুলিতে নিহত সত্তরের এক নকশাল যুবকের মা। হয়ত যে স্বপ্নের ভরসায় পুলিসের
গুলিতে নিজের ছেলের হত্যার ঘটনাকেও মেনে নিয়েছিলেন তিনি, বার্লিন ওয়াল ভেঙে পড়ার সাথে
ধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর ভরসার স্বপ্নও।
এই মুহূর্তে যে উল্লাসে
মেতে উঠেছে এই রাজ্যের গরিব মানুষদের এক বড়ো অংশ সেটা কী আটের দশকের পূর্ব ইউরোপের
ঘটনারই পুনরাবৃত্তি? হয়ত তাই, হয়ত নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনে সরকার বদল তো একটি
স্বাভাবিক ঘটনা, তার সাথে কমিউনিস্ট দেশগুলির ভেঙে পড়ার সাদৃশ্য কোথায়? কেরলে তো প্রতি
পাঁচ বছরেই সরকার বদলায়। একবার পরাজিত হলে তো বামেরা সেখানে হারিয়ে যায় না। এটাই বরং
অস্বাভাবিক যে পশ্চিমবাংলায় চৌত্রিশ বছর ধরে তারা একটানা ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এটাও
তো আবার সত্যি যে সাধারণ মানুষের একটা বড়ো অংশ তাদেরকে দু হাজার সাত সাল থেকেই ধীরে
ধীরে বর্জন করেছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক সত্য, রুদ্রর দল মানুষের এই সরে যাওয়াকে ঘূণাক্ষরেও
বুঝতে পারে নি। আটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে রুদ্র ফিরে গিয়েছিল নিজের
রাজ্যে। তারপর জীবনের নানা মোড় ঘুরে আবার সে এখানে যখন ফিরেছে তখন নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর
নিয়ে রাজ্যের রাজনীতি সরগরম। অফিস ফেরৎ রুদ্র একদিন পথে দেখেছিল তাদের দলের একটি মিছিল,
সিঙ্গুরে শিল্পের সমর্থনে। সেই মিছিলে এমন অনেক চেহারার লোক ছিল, ছাত্রজীবনে যাদেরকে
কখনো বামপন্থীদের মিছিলে দেখবে রুদ্র কল্পনাও করেনি। দু’একজন ঘনিষ্ঠ নেতাকে সে বলেও
ছিল। তাদের উত্তর অবশ্য তাকে খুব একটা খুশি করতে পারে নি। কেউ যুক্তি দিয়েছেন, সরকার
চালাতে গেলে নানা ধরনের সমঝোতা করতেই হয়। সব সমঝোতা ক্ষতিকর নয়। কেউ বলেছে, দেখতে হবে,
নিয়ন্ত্রণ কার হাতে। এই সমস্ত লোকগুলি তো মিয়ার পার্টিসিপেন্ট, এরা তো আর কন্ট্রোল
করছে না! রুদ্রর কাছে যুক্তিটা খুব গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। ভালো লাগে নি, সমস্ত মানুষকে
তার রাজনৈতিক আনুগত্য দিয়ে বিচার করার সংস্কৃতি! পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির কথা মনে পড়েছিল
রুদ্রর সেদিনই যেদিন একটা পার্টি চিঠিতে সে পড়েছিল, ‘একটা সময়ে সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধ
রাজনৈতিক পক্ষের ছত্রছায়া থেকে সরিয়ে আনতে আমাদের অনেকে সমাজ বিরোধীদের সাথে সম্পৃক্ততা
বাড়িয়েছিলেন। কয়েক বছর যাওয়ার পর দেখা গেল, সেই সমাজ বিরোধীরা বিভিন্ন স্থানে নানা
স্তরের নেতৃত্বে জায়গা করে নিয়েছে। এখন এদের আঘাত করতে গেলে সংগঠনের শরীরে ঘা পড়ে যায়।
ফলে অনেক সময়ই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা মুলতুবিই থেকে যায়।’ রুদ্র আরো লক্ষ্য
করেছে, এক শ্রেণির লোক সবসময় ঘুরঘুর করছে কিছু নেতাদের চারপাশে, যারা সংগঠনের কোনও
স্তরেই নেই, অথচ গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত ব্যাপারেই তারা নাক গলায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত
করে। এরা এলসিএম নয়, জেডসিএম নয়, ডিসিএম নয়, কোনও কিছুই নয়। সবাই ওদের চেনে ‘আমাদের
লোক’ নামে।
টেলিফোন ঝনঝনিয়ে ওঠে। সম্বিৎ
ফেরে রুদ্রর।
‘খবর পেয়েছ রুদ্রদা? গণনাট্যের
শিবু বউকে ক্যামোথেরাপি করিয়ে বাড়ি ফিরছিল। রিক্সা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে প্রবল মারধোর
করেছে। মাথা ফেটেছে, সারা শরীর রক্তে ভেসে গেছে। ওর বউ হাতে পায়ে ধরেছিল এই অবস্থাতেই
ওদের। কেউ কথা শোনেনি’।
রুদ্রর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। নাটক করা বামপন্থী
ছেলে যে ক্ষমতার রাজনীতির ধারে কাছেও ছিল না। ছিল শুধু সাধারণ কর্মী, তাকেও এভাবে আক্রমণ!
‘শিবুকে মারল কেন? ও তো
কারো কোনো ক্ষতি করে নি কখনো? সে জাস্ট একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী’
‘আরেকটা কথা শুনলে অজ্ঞান
হয়ে যাবে। এই মারে নেতৃত্ব দিয়েছে কে জানো? অংশু! যে কিনা গত সপ্তাহেও তোমাদের নেতাদের
হয়ে একে ওকে মারধোর করে বেরিয়েছে।’
‘বলিস কি? অংশু! ও তো অফিসের
কম্পিউটার থেকে সকলের ট্রেনের টিকিট করে দেওয়া, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রাতবিরেতে অধ্যাপক
আধিকারিক নেতা কর্মীদের এটা ওটা ফরমাইশ খাটা সবেতেই থাকে।’
‘আর মারামারির কথা বললে
না? যাকে তাকে যখন তখন মারধোর করে যে বেড়াতো সেটাও বল। ও তো নিজের স্বার্থে মারামারি
করে তারপর তাতে রাজনীতির রং লাগিয়ে দিত। তোমাদের নেতারাও তাই বিশ্বাস করতেন। কেষ্টর
মত একজন নিষ্ঠাবান পার্টি সমর্থককে ট্র্যানস্ফার করে দেওয়া হল শুধু অংশুর কথা শুনে।’
‘হারাটা বোধহয় খুব প্রয়োজন
ছিল, ভজন। খুবই প্রয়োজন ছিল। না হলে এদের চিনতাম কী করে! জিতলে এরাই হয়ত লিডার হয়ে
বড়ো বড়ো বক্তৃতা দিত।’
‘প্রয়োজন তো ছিল নিশ্চয়ই।
তবে অনেক মূল্য দিতে হবে। হয়ত পার্টিটা বাঁচবে। হয়ত তুমি খুন হয়ে যাবে বা আমি খুন হব
বা আমরা দুজনেই খুন হব, পার্টিটা বেঁচে যাবে।’
সত্যি কথাই বলেছে ভজন!
একটা অগ্নিশুদ্ধি বোধহয় চাইছে এই সময়! কারা ক্ষমতার রাজনীতির মোহে ভিড় জমিয়েছিল তাদের
পাশে, আর কারা গভীর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে দলের সাথে যুক্ত হয়েছে- এদের একটু আলাদা করে চিনতেই হবে। দুর্দিন না এলে
এই বিভাজন কী করে হবে? রুদ্রর মনে পড়ে, কথায় কথায় এক শ্রেণির লোকেরা নেতৃত্বের দোহাই
দিতেন। এই ‘নেতৃত্ব’ কথাটারও এক অদ্ভুত রূপান্তর ঘটেছিল শেষ কয়েকটা বছরে। কুড়ি বছর
পর এ রাজ্যে ফিরে রুদ্র লক্ষ্য করেছে, সমষ্টিবাচক অর্থের শব্দ ‘নেতৃত্ব’ কথাটি অবলীলায়
ব্যক্তি নেতাকে বোঝাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন, ‘এখন বক্তব্য রাখবেন এলাকার পাির্ট
নেতৃত্ব কমরেড অমুক’। রুদ্র কয়েকবার তার বন্ধুস্থানীয়দের বলেছে সে কথা। বলেছে, কোনও
স্তরের পার্টিনেতাদের সমষ্টিকে বোঝাতেই ব্যবহার করা উচিত ‘নেতৃত্ব’ কথাটি। কোনও বিষয়ে
কোনও একজন নেতার মতামত মানে পার্টির মতামত নয় বা নেতৃত্বের মতামতও নয়। কথাটা ভাবতেই
আবার মনে পড়ে পূর্ব ইউরোপের কথা। রুদ্রদের দলের দলিলে বলা হয়েছে, পূর্ব ইউরোপে জনসাধারণের
চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল পার্টি, পার্টির সাধারণ সভ্যদের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল পার্টির কেন্দ্রীয়
কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল পলিটবুরো। সবশেষে পলিটবুরোর সমষ্টিগত
নেতৃত্বের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিজে। রণদিভে একটি নিবন্ধে
লিখেছেন, এ ধরণের একটি সামাজিক পরিস্থিতিতে ব্যক্তি-মানুষ সমষ্টির সামনে নিজেকে অসহায়
মনে করত। রুদ্র ভাবে যে কোনও নেতাকে কথায় কথায় ‘নেতৃত্ব’ বলে সম্বোধন করার মধ্যে কী
এমনই এক বিচ্যুতির পূর্বাভাস নিহিত রয়েছে? হয়ত রয়েছে। সে জন্যেই কি বেশ কিছু বছর ধরে
শুদ্ধিকরণের কথা বলেছে তারা। ভেতর থেকে এ ধরনের বর্জ্য পদার্থদের নিকেশ করতে হবে। বিভিন্ন
দলিলে বলা হয়েছে, সংগঠনে ও সরকারে মানুষের কন্ঠস্বরকে আরো বেশি করে শ্রুত করে তুলতে
হবে। মনে হয় না, খুব একটা কিছু হয়েছে বলে। ২০০৯ সালে যখন লোকসভা ভোটে প্রথম বিপর্যয়
এল, তখনও চায়ের দোকানের ঠেকে বন্ধুরা তর্কের ঝড় তুলেছিল। সবাই বলছিল, বেনোজল না বের
করলে সর্বনাশ। মজার কথা বলেছিল শঙ্কু।
‘মধ্যরাতে কখনো কখনো চোর
চোর বলে চীৎকার শুনেছিস? চীৎকার শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে চোরকে তাড়া করেছিস পাড়ার লোকের
সাথে?’
রুদ্র বলে, ‘অনেকবার!’
‘কখনো দেখেছিস চোরকে ধরা
পড়েছে?’
‘না।’
‘না। চোরকে কখনোই ধরা যায়
না, কারণ যারা ছোটে তারা কেউ চোরকে দেখেনি। একজনের চীৎকার শুনে আরেকজন চীৎকার করে।
এভাবে সবাই চীৎকার দেয় আর ছোটে। তুইও জানতেই পারিস না তোর পাশে যে ‘চোর চোর’ ‘ধর ধর‘
বলে চেঁচিয়ে ছুটছে, সেই আসলে চোর। নিজেকে বাঁচাতে সেও সবার সাথে চোর চোর বলে চীৎকার
করছে।’
‘তাতে কী হল?’
‘আমাদের এই শুদ্ধিকরণও
এমন, বেনোজল সংক্রান্ত আলোচনাগুলোও এমনই ব্যাপার। প্রত্যেকেই বলে বেনোজল তাড়াতে হবে।
যে বেনোজল সেও বলে। পার্টির নাম ভাঙিয়ে যারা প্রমোটারি করে বেড়িয়েছে, যে সমস্ত হোলটাইমাররা
হাতে এন-সিরিজের মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সবাই বলে বেনোজল তাড়াতে হবে। ফলেই বেনোজল
যেখানে থাকার সেখানেই থেকে যায়!’
বিষণ্ন হাসি ফুটে ওঠে রুদ্রর
মুখে। সেদিন শঙ্কুর কথা শুনে তার খারাপই লেগেছিল। এ রকম অতিসরলীকরণ সে মেনে নিতে পারে
নি।
আবার ফোন বাজে। দিবানাথ।
‘তুই এখনও আছিস্? বাড়ি
চলে যা।’
‘কেন?’
‘ওরা সেকশনে সেকশনে ঘুরে
সকলকে সবুজ আবির মাখাচ্ছে।’
‘তাতে কী হয়েছে। ওদের জয়
হয়েছে, সেলিব্রেট তো করবেই। আমরা কী জিতলে লাল আবির মাখাতাম না?’
‘তোর কাছে এলে কী করবি?’
‘জোর করে মাখাতে গেলে প্রতিবাদ
করব।’
‘এ সব ঝামেলা করার কী দরকার।
চলে যা না। কখন কী হয় বুঝিস না?’
‘না আমি যাবো না।’
কথা শেষ হতে না হতেই একদল
সবুজ আবির মাখা সমর্থক নিয়ে ঘরে ঢোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ইউনিয়নের নেতা সরোজ।
‘স্যার, আজ আমাদের আনন্দের
দিন। সবাইকে সবুজ আবির মাখাতে বেরিয়েছি। আপনাকে একটু দেবো, অনুমতি দেবেন?’
অবাকই হয় রুদ্র! চারধারে
এত অশান্তি, হঠাৎ এদের এত সৌজন্য কেন? কারণ যাইহোক, সৌজন্যের উত্তর তো অসৌজন্য দিয়ে
হয় না।
‘দেখুন আপনারা আনন্দ ভাগ
করতে চাইছেন আমার সাথে, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আপনারা আমার পক্ষপাত তো জানেনই। আমি
কিন্তু এরপরই সবুজ আবির মুছে ফেলব। আপনারা মাখাবেন আমি কিছু মনে করব না। আবার আমি মুছে
ফেলব, আপনাদেরকেও সেটা মেনে নিতে হবে।’
‘ঠিক আছে, স্যার। এই স্যারকে
বেশি দিস না।’
কপালে ও গালে সবুজ আবির
মাখিয়ে দেওয়া শেষ হতেই রুদ্র পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে শুরু করে দেয়। সরোজ বলে,
‘স্যার, রুমালটা দিন। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’ সবুজ আবির মাখিয়ে আবার তারাই নিজের
হাতে মুছে দিয়ে যায়।
রুদ্র একা বসে ভাবে, চারধারে
অসৌজন্য এবং অসহিষ্ণুতার মধ্যে, একটুখানি সৌজন্য ও সহিষ্ণুতায় কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত!
আবার ফোন বেজে ওঠে। ভজন।
‘ওরা এসেছিল সবুজ আবির
মাখাতে?’
‘হ্যাঁ’
‘মাখলে?’
‘আমি বললাম, তোমরা তোমাদের
আনন্দ আমার সাথে ভাগ করতে চাও। কর। কিন্তু আমি নিজে কিন্তু মুছে ফেলব। ওরা মাখিয়ে দেওয়ার
পর নিজেরাই মুছে দিয়ে গেল।’
‘ওদের হাতে সবুজ আবির মাখতে
পারলে তুমি? ওই হাতে কত কমরেড খুন হয়েছে জানো? ওই হাত শিবুকে অসুস্থ বউয়ের সামনে মেরে
রক্তাক্ত করেছে। আর তুমি ওদের হাতেই আবির মাখলে?’
‘তোদের সেকশনে যায় নি?’
‘ওরা আসছে দেখেই আমি টয়লেটে
চলে গিয়েছি। আমার পক্ষে ওদের সাথে ভদ্রতা করা অসম্ভব। মাথা খারাপ হয়েছে? আমি সবুজ আবির
মাখব?’
‘টয়লেটে চলে যাওয়াটা কী
প্রত্যাখান করা হল? ওটা তো পালিয়ে যাওয়া। আমি মনে করি, হয় প্রত্যাখান করব নয় ওদের দিতে
দেব। পালিয়ে যাবো কেন?’
‘এই পরিস্থিতিতে প্রত্যাখান
করে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ আছে? কিছু হলে কেউ এগিয়ে আসবে আজ আর?’
‘তবু এটা তো কোনও নৈতিক
অবস্থান হল না।’
‘তোমারটা কোথাকার নৈতিক
অবস্থান। তুমি তো শিবুকে যারা মেরেছে তাদের সাথে কম্প্রোমাইজ করে নিলে।’
‘তুই তো পালিয়ে গেলি। এটা
কি নীতিগত অবস্থান?’
‘ও সব জানি না। আমার মনে
হয় এটা তুমি ঠিক কর নি, রুদ্রদা।’
ফোন রেখে দিয়ে রুদ্র সংশয়েই
পড়ে যায়। কাজটা ঠিক হল কি? ভজন বলছে, এটা কম্প্রোমাইজ। সত্যিই? যতটা সৌজন্যের সাথেই
অনুরোধ করুক না কেন সরোজরা, ওই আবির প্রত্যাখান করাই উচিত ছিল রুদ্রর, তাই কি? প্রত্যাখান
করলে, সরোজরা আর কতক্ষণ সৌজন্যে আটকে থাকত বলা মুশকিল। এরপরই হয়ত শিবুর অবস্থা হত তারও।
শিবুর মত রক্তাক্ত হতে চায় নি বলেই কি আবির নিয়েছে ওদের হাতে রুদ্র? তবে তো ভজন আর
রুদ্রর অবস্থানে কোনও তফাৎ নেই। ভজন পালিয়ে গেছে আর সে ওদের অনুরোধ মান্য করেছে। না,
রুদ্র ভয় পায় নি। সে শুধু সৌজন্যের উত্তরে সৌজন্য দেখিয়েছে। আগেকার নির্বাচনের পর যখন
রুদ্রদের দলের কর্মীরা সকলকে লাল আবির পরাতো তখন উল্টোদিকের সকলের কাছে কী এই সৌজন্যই
প্রত্যাশা করে নি তারা? কিন্তু রক্তাক্ত শিবু যদি জানতে পারে, তার উপর আক্রমনকারীদের
দেওয়া আবির রুদ্র বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করেছে, সে কি ভাববে? ভাববে, রুদ্র ভয় পেয়ে সৌজন্যের
মুখোসে আত্মসমর্পন করেছে। কিন্তু রুদ্র কী ভাবছে নিজের সম্পর্কে! সে কি পরিবর্তিত রাজনৈতিক
পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার মানসিকতা থেকে এমনটা করল? নাকি, অন্য কিছু। রুদ্রর এই মনোভাব
তো নতুন নয়। যখন চতুর্দিকে তাদের রমরমা, তখনও সে প্রতাপের প্রদর্শন পছন্দ করত না। কখনো
চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তৃণমূল ইউনিয়নের নেতার সাথে খোশগল্প করলে পরে নানা টিটকিরি শুনতে
হয়েছে। কেউ বলেছে, এখন থেকে লাইন করছ? কেউ বলেছে, অত গণতান্ত্রিক হওয়ার কী আছে! সকলকেই
রুদ্র বলত, সংগ্রামকে আমি ঝগড়া মনে করি না। বিরোধীকে শত্রু মনে করি না। আমি বিরোধী
মতের পরাজয় চাই নিশ্চয়ই, কিন্তু বিরোধীর মৃত্যু চাই না! বলত, বিরোধীকে গণতন্ত্র না
দিতে পারলে স্বমতের লোককেও পরিসর দিতে পারব না। এটা তার বিশ্বাস, স্থির প্রত্যয়, তবু..।
তবু, আজকের নির্বাচনী ওলোট পালোট এবং চতুর্দিকে আক্রমনের সময়ে, বিশেষ করে ঘনিষ্ঠবৃত্তের
একজন শিবুকে এমন নৃশংসভাবে মারধোর করার পর ওদের হাতে আবির গ্রহণ করাটা ঠিক হল কী না
বুঝে উঠতে পারে না রুদ্র। ভজনের ফোন ওকে এক সংশয়ের সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে। কোথায় পার
সে এই মুহূর্তে জানে না।
আপোষ- লড়াই-বিচ্যুতি-নীতিনিষ্ঠা-পতন-অভ্যুদয়! এক গভীর আবর্তে তলিয়ে যেতে থাকে রুদ্র। ঢেউয়ে ঢেউয়ে উথাল পাথাল ভাবনাতরঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশ্চিমবঙ্গ, রাশিয়া চীন থেকে কিউবা ভিয়েতনাম, একাকার হয়ে যায়! পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া অতীত। ভিয়েতনাম, চীন, কিউবা দাঁড়িয়ে আছে এখনো। কেরল নেই, পশ্চিমবঙ্গ চলে গেল। ত্রিপুরা এখনো রয়েছে। কোথায় ভুল, কোন পথেই বা উত্তরণ! প্রশ্নের পর প্রশ্ন মনে উদয় হয়, মিলিয়ে যায়। অনেক অনেক লড়াই সামনে। অনেক দেখা শোনা জানা বাকি। অনেক অনেক পথ হাঁটতে হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সব যাত্রার শুরু ঘরের ভেতর থেকে, নিজের মনের অন্দর থেকে। প্রথমে এটা বুঝে নেওয়া জরুরি, আজ একটু আগে সে যা করেছে, সেটা ভুল না শুদ্ধ! সেটা আপোষ বা সৌজন্য! সব অন্ধকার, সব কুয়াশা কাটবে। হয়ত কাটবে। হয়ত নয়, নিশ্চয়ই কাটবে! কিন্তু আগে নিজের ভেতরে আলো ফেলতে হবে। এটাই এই মুহূর্তে জরুরি কাজ!