সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০০৯

অসম না আসাম ? : নামে কিবা আসে যায়?


একমাত্র গণশক্তি এবং আজকাল-ই এখনও আসামকে অসম নয়, আসাম-ই লিখছে। কলকাতার বাকি সমস্ত সংবাদপত্র, এমনকি লিটল ম্যাগাজিনও আজকাল আসাম লিখছে অসম হিসাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সারা ভারত জুড়েই তো চলছে নাম বদলের ব্যাপার। বোম্বে মুম্বই হল, মাদ্রাজ চেন্নাই হল, ক্যালকাটা হল কলকাতা, কিংবা হালে ব্যাঙ্গালোরও হয়েছে বেঙ্গালুরু, এই ধারাবাহিকতায় আসাম অসম হলে আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই। সকলেই ফিরে যাচ্ছে স্থানগুলির মূল নামে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিহ্ন মুছে ফেলার এই উদ্যোগ আর যাই হোক নিন্দনীয় নয়। সব পরিবর্তন সকলের মত মেনে নিলেও আসামের ক্ষেত্রেই গণশক্তি বা আজকাল পরিবর্তনটি করছে না কেন? এটা কি টেলিগ্রাফ কাগজের মত একগুঁয়ে মনোভাব? ইংরেজি বাংলা হিন্দি ওড়িয়া নির্বিশেষে সকলে কলকাতা লিখলেও তারা যেমন এখনও ক্যালকাটাই লিখে চলেছে কলকাতা না লিখে। বিষয়টি কি এমন? বলা বাহুল্য, এমনটা নয়। আজকাল-এর ক্ষেত্রেও বিষয়টি যেমন একগুঁয়ে মনোভাবের ব্যাপার হতে পারে না, গণশক্তির মত মতাদর্শগত চালিকাশক্তি দ্বারা নির্ধারিত সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে তো নয়ই। সেখানে নীতি ছাড়া, অভ্যেস বা একগুঁয়ে মনোভাব কোনও ভূমিকা নেয় না। ফলে বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
নানা ভাষা ও নানা জাতিগোষ্ঠীর বাসভূমি আসাম নিয়ে যত রাজ্যের যত বিভ্রান্তি। শুধু বাইরে নয়, বিভ্রান্তি আসাম রাজ্যের ভেতরেও। ছোট্ট একটা রাজ্যের মধ্যে এত ভাষা ও জাতিগত বৈচিত্র্য যে এখানকার এক অংশের মানুষ অন্য অংশের গত দু’শো বছরের ইতিহাস নিয়েও নানা বিভ্রান্তিতে ভোগেন। এখন বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে খোদ রাজ্যের নাম নিয়েও। সমস্যা, আসামকে বাংলা বা ইংরাজিতে কী বলা হবে? অসম, অহম না আসাম। ইংরাজিতে নতুন বানানে Assam এর বদলে কেউ লিখছেন Asom, আবার কেউ Axom। এমনিতে ভাবতে গেলে এ নিয়ে জটিলতার কোন অবকাশ নেই। ক্যালকাটা যদি কলকাতা হয় বা বোম্বে, মুম্বই - তবে আসাম অসম হতে আপত্তি কোথায়? আসামের ভাষা রাজনীতির গভীরে গিয়ে বিষয়টি না দেখলে এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বস্তুত, আজকাল কেউ জেনে বুঝে, কেউ বা অজ্ঞানতাবশত তড়িঘড়ি বাংলায় ‘অসম’ লিখতে শুরু করে দিয়েছেন। সমস্যা দু’টি। প্রথমত, সংবিধানগত ভাবে এখনও আসামের নাম আসাম-ই। মহীশূর বা মাদ্রাজের মত সংবিধান সংশোধন করে কর্ণাটক বা তামিলনাড়– হয় নি। রাজ্যের প্রধান শহর গৌহাটি সরকারিভাবেই এখন গুয়াহাটিতে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের নামের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। অন্যদিকে, অসমীয়াতে আসামকে অসম লেখা হলেও উচ্চারণে তা অহম, অসম নয়। বাংলায় অসমীয়া অনুসারী বানান লিখতে হলে অহম লেখা বাঞ্ছনীয়, অসম কখনোই নয়। বাংলায় ‘অসম’ যে ভাবে উচ্চারিত হয়, সে নামে কোনও রাজ্য ভূ-ভারতে নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, যখন গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত ইংরাজি সংবাদপত্র বা সরকারি কাগজপত্রে ‘আসাম’ শব্দ ব্যবহার এখনও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, এমন কি তরুণ গগৈ-র নেতৃত্বাধীন সরকার যারা মন্ত্রিসভার আচমকা এক সিদ্ধান্তে রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে সরকারিভাবে ‘অসম’ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আসামের জনসাধারণের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় পিছু হটে তারা এখনও সরকারিভাবে রাজ্যের নাম ‘আসাম’-ই বহাল রেখেছেন, তখন কলকাতার আনন্দবাজার তড়িঘড়ি ‘আসাম’ বিদায় দিয়ে ‘অসম’ লিখতে শুরু করল কেন? এ প্রশ্নেরও উত্তর সম্পৃত্ত হয়ে আছে আসামের ভাষা রাজনীতির গভীরে। তবে প্রথমে আসা যাক, রাজ্যের প্রাচীনতম নামের প্রশ্নে। কোনটি আদি নাম? আসাম না অসম? আসামের নামকরণ হয়েছে প্রকৃতপক্ষে শ্যাম জাতির অধ্যুষিত দেশ, আ-শ্যম থেকে। শ্যাম বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে আগত আহোম নামের মঙ্গোলীয় বংশদ্ভূত মানুষদের কথা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরাও আ-শ্যম থেকেই রাজ্যের নামকরণ করেছিল, আসাম। আ-শ্যম কথা থেকেই আসলে আহোম শব্দটি এসেছে। আহোম থেকেই এসেছে অহম। ‘অসম’ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ‘অহম’ নামের সংস্কৃতকরণের বা আর্যীকরণের ফল। এই সংস্কৃতকরণ বা আর্যীকরণের ব্যাপারটিও একটি বিচিত্র ব্যাপার। এই মুহূর্তে সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতের সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সব ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভারতীয়ত্ব বর্জন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী পথে হাঁটানোর চেষ্টা চলছে। এখন মনিপুরের জাতীয়তাবাদীরাও বৈষ্ণবীয় পরম্পরাকে ভারতীয় আগ্রাসনের পূর্বসূরী আখ্যা দিয়ে প্রাক-বৈষ্ণব ধর্মে ফিরে যাওয়ার উন্মাদনায় রাজ্যের নাম বদল করে ‘কাইলেংপাক’ করতে চান। সেই ধারাতেই নিজেদের পদবীর শেষে সিংহ ব্যবহার বাদ দিয়ে নামের শুরুতে গোত্র নাম ব্যবহার শুরু করার চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে ইদানিং। বাংলা লিপি ও বৈষ্ণব ইতিহাসের সমস্ত স্মারক মুছে দেওয়ার জন্য শতাব্দী প্রাচীন গ্রন্থাগারের কয়েক লক্ষ বইয়ের বহ্ন্যুৎসব হয়েছে। উনবিংশ শতকে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী। আসামের কথাই ধরা যাক। আজ যে আসামের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ কথায় কথায় ভারতীয়ত্ব বর্জনের কথা বলেন, সেই সংগঠন, সেই জাতীয়তাবাদীরা উনবিংশ শতকে অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষপর্বে নিজেদেরকে আর্য সভ্যতার উত্তরসূরী প্রমাণ করার জন্যে তৎপর ছিলেন। উত্তর ভারতীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করতে চেয়ে তাঁরা এমনও অভিমত সেদিন প্রকাশ করেছিলেন যে অসমীয়া ভাষায় আধুনিক সঙ্গীত বা সাহিত্য রচিত হতে পারে না। এই ভাষা কেবল লোকসঙ্গীত বা লোকসাহিত্যেরই পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে। আধুনিক অসমীয়া সঙ্গীতকে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সুর শুধু নয়, বাণীর জন্যেও আশ্রয় নিতে হবে বাংলা বা হিন্দি ভাষার কাছে। এই প্রবণতার বিরুদ্ধেই লড়াই করে পরবর্তীতে অসমীয়া আধুনিক সঙ্গীতের রূপকার, আসাম গণনাট্যের প্রথম সভাপতি জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়াল অসমীয়া লোক সুরের পরম্পরা ও অসমীয়া ভাষার বিচিত্র সৌন্দর্যকে নির্ভর করে তৈরি করেন অসমীয়া আধুনিক গানের প্রাথমিক ভিত্তি। আবার ফিরে আসি, রাজ্যের নামকরণের প্রশ্নে। অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষ পর্বে সংস্কৃতকরণের পর্যায়ে, আসামকে পাহাড় সমতলের সমন্বয়ে গড়া অ-সম মাটির দেশ থেকে রাজ্যের নাম হয়েছে ‘অসম’, এমনটাই বলার চেষ্টা হয়েছে। এই কথা বলে ‘অহম’ শব্দের বানান পাল্টে করা হয় ‘অসম’। যদিও উচ্চারণ একই থাকে। এই দাবি সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক। আসামে ব্যবহৃত কোন ভাষারই পূর্বরূপে সংস্কৃত-অনুরূপ এ ধরনের কোনও শব্দ নেই। সময়ের দীর্ঘ পরিবর্তনের পর আর্য সভ্যতার সাথে নিজেদের একাত্ম করে তোলার বিপরীত পথেই অবশ্য যাত্রা করছে অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বা সাংস্কৃতিক রাজনীতি। এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে, সাংস্কৃতিক-রাজনীতির ভিন্নতর কৌশল হিসাবে ‘অসম’ নাম নিয়ে চলছে কূট রাজনীতি। এক উগ্র জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রকল্প নির্মাণের অঙ্গ হিসাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে রাজ্যের নাম বিষয়ক রাজনীতির বিষয়টি। বাস্তবে আসাম রাজ্যটি বহুভাষিক বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাজ্য। প্রধান জনগোষ্ঠী অসমীয়া ভাষীরা মোট জনসংখ্যার মাত্র অর্ধেকের একটু বেশি। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আদম সুমারিতে বঙ্গভাষী মুসলিমদের রাজনৈতিক চাপ ও ভীতি প্রদর্শন করে অসমীয়াভাষী বলে ঘোষণা করতে বাধ্য করে। এর পর আবার ১৯৭১ সালের আদম সুমারিতে শাসকশ্রেণির পরিকল্পনায় ও আইএনটিউসি’র প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা শ্রমিকদেরদেখানো হয়েছে অসমীয়াভাষী হিসাবে। আসামে অসমীয়া জাতির জাতি গঠন প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক রাস্তা ছেড়ে ইতিহাসে বারবারই রাজনৈতিক কূট কৌশলের পথে হেঁটেছে। আসামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, যেমন কার্বি, লালুং, আহোম, মটক, কোচ, রাভা, এমন কি বড়োরাও, জাতি গঠন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ঐতিহাসিক পথ ধরে অসমীয়া জাতিসত্তার সাথে যখন সম্পৃত্ত হচ্ছিল, তখন বর্ণহিন্দু অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি উগ্র জাতীয়তাবাদের পথ ধরে আগ্রাসনের পথে হাঁটতে শুরু করে। যার ফলশ্র“তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী পরিচিতিকে সামনে রেখে এই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসে আসামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা জনগোষ্ঠীর মানুষও ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছিলেন অসমীয়া জাতিসত্তাতেই। উগ্রতার রাজনীতির উত্তরে এখন তারাও উগ্রতার পথ ধরেছেন। একই বিষয় বঙ্গভাষী মুসলিমদের ক্ষেত্রেও। রাজনৈতিক চক্রান্তে তারা ভাষিক পরিচয় হারালেও উগ্র জাতীয়তাবাদী অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি এঁদেরকে কখনো অসমীয়া মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করে নি। তাদের ন-অসমীয়া নাম দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে অসমীয়া জাতিসত্তার ভেতর আঙ্গিনার একটু বাইরে। তাদের অসমীয়া পরিচিতি ব্যবহার করা হয়েছে শুধু মাত্র আদম সুমারির প্রয়োজনে। এর ফলে, বাঙালি জাতিসত্তার বাইরে বেরিয়ে যাওয়া এবং অসমীয়া জাতিসত্তায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়া এই মাতৃভাষা-হারা জনগোষ্ঠীর জন্য একমাত্র পরিচিতি থেকে যায় তার ধর্মীয় পরিচয়। ফলেই ধর্মীয় পরিচিতিকে কেন্দ্র করেই এই মুহূর্তে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ চান। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে আসামের রাজনীতিতে এইউডিএফ নামে একটি ধর্মীয় পরিচিতি-কেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করার মধ্যে। এই দলের রাজনীতিতে মুসলিম ধর্মীয় গুরুরা প্রধান ভূমিকা পালন করলেও এর পতাকা তলে সামিল হয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বঙ্গভাষী মুসলিমদের এক বিরাট অংশ। কখনো বিদেশি, কখনো বহিরাগত, কখনো বাংলাদেশি নাম দিয়ে যাদের দশকের পর দশক ধরে নির্যাতিত করা হয়েছে, তারা এখন মুখর হয়েছেন। এই দলের সমর্থকরা কংগ্রেসের আদি ভোটার, এই দলের নেতারা কংগ্রেসেরই হয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দশকের দশক ধরে সংখ্যালঘু ভোট আদায় করেছেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বলতায় তারা পৃথকত্বের পথে হাঁটলেও এই প্রচেষ্টার গভীরে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের আর্তি লুকিয়ে আছে, তা বিস্মৃত হলে বোধহয় চলবে না। আসামের ভৌগোলিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও ভাষিক বহুত্ব একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা, যে বাস্তবতাকে অস্বীকার করাই স্বাধীনতা পরবর্তী আসামের শাসকশ্রেণির রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। উল্টোদিকে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বামপন্থীদের নেতৃত্বে এবং এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষা ও জনগোষ্ঠীর আন্দোলনগুলি এই বহুত্বকেই রাজনৈতিক ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এখান থেকেই ‘আসাম’, ‘অসম’-এর ব্যাপারটি বোঝা সহজ হবে। সঙ্ঘ পরিবার যেমন উগ্র হিন্দুত্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতবর্ষকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান এর ফর্মুলায় সাম্প্রদায়িক একীকরণের যোজনা নিয়েছে, তেমনি আসামেও উগ্র জাতীয়তাবাদীরা আসাম-অসম-অসমীয়া এর ফর্মুলায় ভাষিক আগ্রাসনের প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকে। কংগ্রেসের শরীর থেকে তথাকথিত সংখ্যালঘু তোষণের গন্ধ মুছে ফেলে উগ্র অসমীয়া সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের কৃপালাভের আশায় গত নির্বাচনের পর মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-র ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার উদ্যোগে রাজ্য মন্ত্রিসভা আসামের নাম সরকারিভাবে বদলে অসম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর পর অসমীয়া অনসমীয়া নির্বিশেষে সারা আসামে বিরাট বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাজ্যে একের পর এক বন্ধ্ পালিত হয়। বিদেশে বসবাসরত অসমীয়াভাষীদের সংগঠনগুলিও সরকারকে এই আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত থাকতে আবেদন জানায়। তারপরই পিছিয়ে আসে সরকার। আসামে সরকারিভাবে রাজ্যের নাম আসাম-ই রয়ে যায়। অসমীয়া ভাষায় আগের মতই রাজ্যকে লেখা হয়, অসম, উচ্চারণে যা অহম। এখন ফিরে আসা যাক, আনন্দবাজারের আসামকে অসম লেখার ইতিহাসে। এই ইতিহাসও কম চমকপ্রদ নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, গত শতকের আটের দশকে আসামের যে তথাকথিত বিদেশী বিতাড়ণ আন্দোলন সারা ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তার শুরুয়াৎ ছিল আনন্দবাজারের গণবহ্ন্যুৎসব দিয়ে। আটাত্তরের আসাম বিধানসভা নির্বাচনে প্রথমবার সিপিআই(এম) ১১ টি আসন সহ বামপন্থীরা সর্বমোট ২৫ টি আসন পেলে আনন্দবাজারের পাতায় বিশিষ্ট সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, আসামে সিপিএমের অগ্রগতি মানে বাঙালিদের আধিপত্য বিস্তার। এই লেখা প্রকাশিত হতেই আসাম জুড়ে তৈরি হল উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট উন্মাদনা, যার লক্ষ্য, একদিকে বঙ্গভাষীরা এবং অন্যেিদক তাদের দোসর ঠাউরে রাজনৈতিকভাবে অসমীয়াভাষী বামপন্থী কর্মীরা। অভূতপূর্ব হিংসাত্মক আক্রমণের জেরে প্রাণ হারালেন একদিকে শতাধিক অসমীয়াভাষী সিপিআই(এম) কর্মীরা, অন্যদিকে স্থানে স্থানে দেখা দিল বঙ্গভাষী মানুষের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ। আনন্দবাজার সহ সমস্ত বাংলা সংবাদপত্র এবং বাংলা চলচ্চিত্রের উপর ঘোষিত হল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। এক দশক ধরে এই অবস্থা চলার পর কুখ্যাত আসাম চুক্তির পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় এল আন্দোলনকারীদের তৈরি নতুন রাজনৈতিক দল অসম গণ পরিষদ বা অগপ। সেই গণউন্মাদনার নায়ক প্রফুল্ল মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এক মাস পরই এলেন ক’লকাতা সফরে। এসেই আশ্চর্য, এতদিন ধরে ঘোষিত ‘গণশত্র“’ আনন্দবাজার পত্রিকা দফতর পরিদর্শনে গেলেন। এই সফরের পর প্রায় রাতারাতি আনন্দবাজার তাদের সমস্ত প্রকাশনায় আসামকে ‘অসম’ লিখতে শুরু করল। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের স্বঘোষিত অভিভাবক যখন এমন পরিবর্তন করলেন, তখন পিছিয়ে থাকলেন না অন্যান্য সংবাদপত্র বা লিটল ম্যাগাজিনগুলোও। আসামের ভাষা-রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে অতটা সচেতনতা না থাকায় অনেকেই ভাবলেন আসামের নাম পরিবর্তনটি বোধহয় ঔপনিবেশিক চিহ্ন মোছারই প্রয়াস, যা চলছে সারা দেশ জুড়েই। ব্যতিক্রম, দৈনিক গণশক্তি এবং দৈনিক আজকাল। ভাষিক আগ্রাসনের এই প্রচেষ্টায় যোগ না দিয়ে বহুভাষিক বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত আসামের সরকারি নামেই এখনও স্থিত আছেন। এই অবস্থান আসামের বহুত্বের প্রতিরোধ ও উগ্র ভাষিক আগ্রাসনের মধ্যে চলা লড়াইয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিগত অবস্থান, যা গণতান্ত্রিক কন্ঠস্বরকে শক্তিশালী করছে। লড়াই চলছে। যদিও এর শেষ কোথায় এখনও জানা নেই।

৩টি মন্তব্য:

  1. ফলোয়ার গেজেট লাগাও ! আমার ব্লগো আইইয়া, ফলোয়ার বোতাম টিপো।

    উত্তরমুছুন
  2. লেখাটা ভালো । আমার ব্লগে অসমিয়া ভাষার X ধ্বনি নিয়ে রাজেন বরুয়ার লেখাটা পড়। লেখাটার শেষের দিকে এ নিয়ে একটা ভালো নোট আছে। তবে কি জানো আমি কিন্তু বাংলাতে 'অসম' লিখি। ইংরেজিতে Assam. বাংলাতে আসাম লিখলে কেঊ আজকাল তেড়ে যায় না। কিন্তু বাঙালিরা যখন 'আসামী' বলে তখন মনে হয় দে ধরে দুই থাপ্পড়। তবে 'বাঙালি' উচ্চারণে 'অহ'ম' টা আসে না এটা ঠিক। আর 'অসম' লিখলে ঠিক উচ্চারণতা ধরা হয় না এও ঠিক।

    উত্তরমুছুন
  3. আমার কিন্তু নামের ব্যাপারে একটু খুতখুতানি ভাব আছে মনে হয়। যার যা নাম সেটার সঠিক উচ্চারন হওয়া বিশেষ জরুরী। তবে না জেনে ভুল করে বলে ফেললে সে ভিন্ন কথা, যেমন আমরা বাংলাদেশিরা এত দিন আসাম বলেই জানতাম।
    দাদা, ফলোয়ার গেজেট লাগিয়ে দিন। সুশান্তর সাথে আমিও অনুরোধ জানালাম। আগামী ভ্রমনে যেন আপনার ফলোয়ার হতে পারি এই আশা জানিয়ে গেলাম।

    উত্তরমুছুন